চারপাশের এত পরিবর্তন খালেক মিয়াকে একদম চুপ করিয়ে দিয়েছে। সময়ের সাথে সাথে কথাবার্তাও কমে এসেছে বয়েসের বিপরীতে। ভাটার মতো এক এক করে পাঁজরের হাড়গুলোও চামড়া ওপর দৃশ্যমান হচ্ছে দিন দিন। আধাপাকা দাড়িচুলে ইদানীং নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাই না খালেক মিয়া।
আগের মতো এখনো ছনের বেড়ার ফাঁক দিয়ে শীত আসে, বর্ষার পানিতে বেড়াতে পচন ধরে, কালবৈশাখী ঝড়ে ঘুনে খাওয়া বাঁশের খুঁটির ওপর চালের মৃদু কান্নার শব্দ ঘুমাতে দেয় না খালেক মিয়াকে। মাঝেমধ্যে চৌকির পায়া মাঝরাতে ভেঙ্গে পড়ে। ভেজা পাতার ধুঁয়ার সাথে ভোরে আছমার অভাবী সংসারের দুঃখ চারপাশের ছড়িয়ে পড়ে। দাশবাবু আগের মতো গালাগাল করে , সময়ে অসময়ে ডাকে, গাছের ডাল ছাঁটায় , বৃষ্টিতে ভেঙ্গে যাওয়া খালের পার বাঁধানো, বাগানের টুকটাক কাজের জন্য।
এই আধুনিক যুগে মেশিনের কল্যাণে কাজের ধরণ পরিবর্তন হওয়ায় খালেক মিয়ার নিজেকে এখন দাশবাবু লাগে। অন্তত মেশিনগুলো তার কথা শোনে, তার আদেশে কাজ করে যেমন দাশবাবুর আদেশে খালেক মিয়া বছরের পর বছর করে আসছে। দাশবাবুর মতো প্রভাব প্রতিপত্তি না থাকলেও একসময়কার দাশবাবুর কাজকর্মের ধরণের বিচারে খালেক মিয়া এখন পয়ত্রিশ বছর বয়েসের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন দাশবাবু। অপার স্বাধীনতার সহায়সম্বলহীন দাশবাবু, না না খালেক বাবু!
পূর্বসূত্রে পাওয়া সম্পদের পাহাড়, গোয়ালভর্তি পনের বিশটা গাই গরু, বিশাল ফলের বাগানের মালিক এই ছোটখাটো, বিদঘুটে চেহারার দাশবাবু। বছরচুক্তিতে খালেক কাজ করত তখন, এখনো করে কিন্তু আজকের পর আর করবে না। আছমার কথা মনে পড়তেই চারপাশটা ছোট হয়ে আসতে থাকে। বুকে হিমালয় কুচকাওয়াজ করতে থাকে প্রশিক্ষণরত সৈনিকের মতো। মগজ আরও ধূসর হয়ে ওঠে। রাস্তার ধারের বৈদ্যুতিক তারগুলো শরীরে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে তার শরীরে। শিরা উপশিরায় হিমালয়ের শীতল পানি এসে রক্ত জমিয়ে দেয়। চারপাশটা ছোট হতে হতে একটা সময়হীন, সংজ্ঞাহীন বৃত্ত তৈরি করতে থাকে। যাকে শিক্ষানবিশ আর্টিস্ট সমস্ত রাগ নিয়ে ক্যানভাস থেকে মুছে ফেলে।
বিশ বছরের তাগড়া যুবক খালেক। বাগানের ফল বিক্রি, ঝড়-বৃষ্টিতে ভেঙে যাওয়া গাছের পরিচর্যা, গরুর গোয়াল পরিষ্কার, দুধ বিক্রি, তাদের খাবার-দাবার এসবের মানে এককথায় গেরস্থ সবকাজ সে-ই করত। সারাক্ষণ দাশবাবু তার পাশে থেকে কাজের তদারকি করতেন। সারাদিন বাপ-দাদার জমিদারীত্বের গল্প করে নিজের সাথে সন্তানদের তুলনা করে সারাক্ষণ হা-হুতাশ করতেন। খালেক মিয়া কোনো ভুল করলে রেগে গিয়ে অনেক সময় মা-বাপ তুলে গালি দিত।
ডান পা হঠাৎ কিসের সাথে যেন ধাক্কা লাগে। পায়ের দিকে তাকাতে লক্ষ করলো গোড়ালির দিকে বালি লেগে আছে। মাথা নত অবস্থায় পিছনে তাকিয়ে খালেক মিয়া দেখে শফিকের ছোট ছেলেটা গালাগাল করছে। বেলচাটা খালেকের পায়ে লেগে ছেলেটার সব খেলনা এলোমেলো হয়ে গেছে। চাপা স্বভাবকে টেনে এনে কিছু না বলে খালেক মিয়া বিকারহীনভাবে আবার হাঁটা শুরু করল।
খালেক মিয়ার শিবপূজার কথা মনে পড়ে। দাশবাবু শিব পূজার জন্য তাকে বেলগাছের কচি পাতা আনতে বলেছিল। বেলপাতা নাকি শিবের ত্রিশূলের মতো পবিত্র। বয়েসের তুলনায় বেলগাছটা অনেক বড়। তাই পাতার জন্য তাকে গাছে ওঠতে হবে, তাছাড়া কয়েকটা পাকা বেলও দেখা যাচ্ছে পুবদিকটায়।
বেল পেড়ে নামার সময় শফিকদের সদ্য বানানো বিল্ডিংয়ের বাথরুমের আধখোলা ভেন্টিলেটরে খালেক মিয়ার চোখ পড়ে, নাগ-নাগনীর রতিক্রিয়ার পরম শীৎকার ভেসে আসে তার কানে। গর্ভকালীন উদরে নাক ডুবিয়ে কামার্ত হাত আকঁড়ে ধরে আছে গর্ভধারিণীর সচেতন বুক। এই হাত শফিকের বিশ্বস্ত ছোটভাই রফিকের হাত। গর্ভে শফিকের বড় ছেলে৷ দুঃখের সূর্যকে পেরিয়ে খালেক মিয়া যাকে একটু হাসি দিয়ে সান্ত্বনা দিতে পারেনি।
পিছন ফিরে সে ছেলেটাকে আবার দেখে। খেলনাগুলো গুছাচ্ছে। বাবাদের পরিচিত মুখে কামনার অন্ত্যোষ্টক্রিয়া বয়েস মানে না। মানে না দূরত্ব। মানে না ধর্ম। জানে বাঁচতে হবে চাহিদার যোগান মিটিয়ে। বাস্তবতা, হোক কঠিন বাস্তবতা।
এই বাস্তবতা বা কঠিন বাস্তবতায় খালেক মিয়া ছোট ছেলেটিকে তার বাবার নামে ডেকে সান্ত্বনার হাত মাথায় বুলাতে পারে না। হয়তো এজন্যই অথবা চাপা স্বভাবের জন্য যা নিগৃহীত হতে হতে বয়েসের সাথে লেপ্টে আছে। খালেক মিয়ার মাথায় নৈতিকতা, সামাজিকতা, বোধ সবকিছু থেকে ভিন্ন ভিন্ন উত্তর ক্রমে আসতে থাকে।
খালেকের ছোট ছেলে বাছিরের প্রতি তার খুব রাগ ওঠতে থাকে। প্রচন্ড রাগ। ঐদিন মানে মাস ছয়েক আগে রাগের মাথায় গলা টিপে ধরার সময়টা যদি একটু বেশী হতো, আছমা আর মেয়ে শারমিন যদি না টেনে ধরত তাহলে ছেলের লাশের জন্য হলেও দাশবাবু বিশ্বাস করতেন। এতদিনের বিশ্বাস, সুসম্পর্ক ভাঙ্গত না। অস্তিত্বের, প্রিয়মুখগুলোর ভাতের চিন্তা আজ আর করতে হতো না।
খালেক মিয়ার ঘরের ওপর দিয়ে মানিকদের আমগাছের একটা ডাল খালেক জামালদের বাড়ি পর্যন্ত গিয়েছে। আম পড়ে খড়ের চাল নষ্ট হয় তাছাড়া উঠানে রোদ আসে না এসব অভিযোগ খালেক তাদের জানালে এবার আম খেয়ে কেটে দিবে বলে তারা জানায়। আম পাঁকলে ডালটা কাইট্যা অর্ধেক আম আমগোরে দিয়া তরা বাকিগুলা রাইখ্যা দিছ মানিকের মা আড়াল থেকে খালেক মিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে। ডালটাও রেখে দিস, তর বউয়ের আর লাকড়ির জন্য কষ্ট করতে হবে না, মাসখানেক শান্তিতে থাকবে বেচারি।
দুপুরে গোসল করতে যাওয়ার সময় খালেক মিয়া উঠানে একটা আধাপাকা আম পেয়ে দরজায় বসে আয়েশ করে খেতে লাগল। অন্যপাশটা ছিলানোর সময় খালেক মিয়া লক্ষ করে একটা বিশ্রী কালো পোকা মাথা বের করার চেষ্টা করছে । এমন সময় হাতে দুইটা চকবার আইসক্রিম আর গলায় ঝুলানো তিনটা চিপস নিয়ে বাছির ঘরে ঢুকে। খালেক অনেকটা বিরক্তি আর কৌতূহলের সুরে বাছিরকে ডাক দেয়, এত টাকা কোথায় পেল তা জানার জন্য। আছমারও তাকে দেওয়ার কথা না। নিশ্চয় কেউ কিনে দিয়েছে। আজকাল গ্রামের সব কুরবানির মাংসের ভাগ তার ঘরে আসে। কারণ গ্রামে আর কোনো গরীব নাই। এজন্য তাদের প্রতি সবাই সহানুভূতিশীল আচরণ করে। এসব আচরণ খালেক মিয়ার সবসময় ভালো লাগে না, অসহায় লাগে ৷ মুখে একরাশ মৃদু হাসি নিয়ে, চোখ বড় বড় করে বাছির উত্তর দেয়, ‘কও।’
‘টেহা কই পাইছস?’ বাছির চুপ। রাজ্যের খুশি নিয়ে কী একটা বলতে গিয়েও সে চেপে গেল।
খালেক কী করবে বুঝতে পারছে না। বান্ডিলে সবগুলো পাঁচশো টাকার নোট। বাছিরের কান্নার আওয়াজে তার আরও মেজাজ খারাপ হতে লাগল। মারবেই না কেন?
সামান্য একটা ঘুড়ির জন্য এতো টাকা! টাকাই বা নিবে কেন। যার কারণে তিনবেলা খাইতে পারে, তার কাছে তো বিনিময় খাটে না। আদান-প্রদানে সম্পর্ক ঈশ্বর পছন্দ করে না। দেওয়ার সম্পর্ক বাড়িয়ে যাও, সন্তুষ্টির দৃষ্টি একদিন ঘর আলোকিত করবে এটাই ইহ ও পরকালের রীতি।
আছমাকে ডেকে না পেয়ে খালেক মিয়া দিশেহারা হয়ে টাকাগুলোকে নিয়ে দাশবাবুর বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করে। দাশবাবু আজ শহরে যাবে দলিলের কাজে কথাটা মনে পড়তেই লুঙ্গিতে গোঁজানো বান্ডেল চেপে ধরে খালেক মিয়া দাঁড়িয়ে পড়লো। ঐ বাড়ির কাউকে আর বিশ্বাস করে না খালেক মিয়া। সম্পত্তির ভাগ নিয়ে ভাইদের মারামারি, বউদের কানাকানি, কথার মারপ্যাচ, এসবের মধ্যে বাছিরের এই ঘটনা তারা বিশ্বাস করতে চাইবে? ফল বিক্রির সামান্য কটা টাকা নিয়ে কাটারী হাতে এক ভাই আরেক ভাইকে যদি মারতে যেতে পারে তাদের কাছে এই ব্যাপারটা তো হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। হাতের চাঁদই, কারণ খালেক মিয়াকে কে তাড়ানোর জন্য এটা সবচেয়ে বড় সুযোগ। খালেক মিয়ার বিশ্বাস দাশবাবু তাকে বিশ্বাস করবেন। এতবছর খালেক মিয়া বিশ্বাসের সাথে কাজ করে গিয়েছে। কিন্তু ইদানীং দাশবাবু সন্তানদের এসব কর্মকান্ড দেখে কাউকে বিশ্বাস করতে চাই না। সবকিছুই তার কাছে ষড়যন্ত্র মনে হয়। সম্পত্তির লোভে ছেলেগুলোর এ অবস্থা তিনি কোনোভাবে মেনে নিতে পারছেন না। দুদিন পর পর বাড়িতে ঝগড়াঝাটি, মানসম্মানের দিকে চেয়ে এবার তিনি সম্পত্তি ভাগাভাগি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। খালেক মিয়ার মনে আরেকটা ভয়– যদি বড় বাবুর ভয়ে নগেন অস্বীকার করে! তখন চুরির দায় পড়বে বাছিরের ওপর। কারণ বড়বাবুর উঁচা গলার সামনে খালেক মিয়া কিছু বলতে পারবে না। বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না।
কিন্তু এত টাকা কোথায় রাখবে। ঘরে রাখার মতো তেমন কিছু নেই। ট্রাংকে রাখা যাবে না, কারণ ট্রাংকের তলায় বয়েসী ঝংকার পড়ে ভেঙে গিয়েছে। দুঃখ আর অভাব রাখতে রাখতে এই ছনের ঘরে আর কোনো লুকানোর জায়গা নেই। টাকার বান্ডিলটাকে একটা পলিথিন দিয়ে পেচিয়ে দক্ষিণ দিকের নতুন খুটি ঘেঁষে মাটি খুঁড়ে টাকাগুলো লুকিয়ে রাখলো। দুদিন আগে খুটি লাগানোতে নতুন খুঁড়াখুঁড়ির ব্যাপারটা বুঝা যাচ্ছে না।
নগেন আর বাছির সমবয়সী। কাকেই বা দোষ দিবে। বাছির ঘুড়ি দিতে চাচ্ছিলো না তাই নগেন টাকা দেওয়ার কথা বললে বাছির তখন দিতে রাজি হয়। এতটুকু বাচ্চাও বংশের প্রভাবিত উজ্জ্বল প্রদীপ। টাকার নিচে সব চাপা দিতে চাই। “রক্তে আছে” কথাটার উপযুক্ত প্রমাণ। কিন্তু বাছির! সে তো আমার মতো না। টাকার লোভ কী আমার এতোই! খালেক ভাবতে থাকে অভাব-অনটনে নিত্য টানাপোড়ন তাদের লেগেই থাকে, কিন্তু হিংসা, লোভ তার কোনোদিন ছিল না। পরক্ষণেই কিসব উল্টাপাল্টা চিন্তা করছে ভেবে নিজেকে তার গালি দিতে ইচ্ছা করে। আট নয় বছরের দুইটা ছেলের ব্যাপারে এসব ভেবে খালেক মনে মনে ভীষণ লজ্জিত হলো।
দাশবাবুর বাড়ি থেকে টাকা চুরির খরব আসলো, না না চুরিই, ‘হারিয়ে গেছে’ এটা আমাদের সমাজের ভাষা না, চিত্র না। ছেলে-মেয়েরা যার যার সম্পত্তি পেয়ে শান্তি ফিরিয়ে আনার যে মিথ্যা আবীরে সবাই মেতে ছিল তা একদম নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নগেনের বড়দা মানে বড়বাবুর বড় ছেলে বাসায় আসলে। বড়দার ল্যাপটপ কেনার জন্য তার মা বড় বাবুর আড়ালে পনেরো হাজার টাকা লুকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু টাকাটা তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। বিশাল বাড়ির বড়বাবুর স্ত্রীর কর্তৃত্বের সবটুকু জায়গা আতশকাঁচে সূক্ষ্ণভাবে খুঁজেছেন। মেকি কান্নাকাটি চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়িটাকে অশান্তির আখড়া করে তুলে বড়বাবুর স্ত্রী। সন্দেহের তীর আছমার ছোটবোনের মেয়ের দিকে, কারণ আছমায় তাকে বড়বাবু বাসায় কাজের জন্য নিয়ে এসেছিল। মেয়েটা ভয়ে সকাল থেকে কান্নাকাটি করছে। গতরাতে বড়বাবুর স্ত্রী তাকে অনেক মারধর করেছে। সকালে আছমা জেনে তাকে রান্নাঘরে এনে একরকম জেরা-ই করে। কিন্তু সে শুধু কেঁদেই যাচ্ছে আর বলছে, ‘খালা আমি মাইঝে মাইঝে পইড়া থাকা টেহা দিয়া আইসকিম খাই।’
‘সত্তি কইরা ক, পরে কইলাম পুলিশে ধরব, তারা কিন্তু পুলিশরে খবর দিছে।’
‘আল্লার কসম খালাম্মা আমি টেহা চুরি করি নাই, তাইনে শোয়ার ঘরে আমারে পতম দিন অই যায়তে না করছুইন, এরলাইগা আমি যায় না।’ সে আরও জোরে কান্না করতে করতে বলে, ‘রাইতে আমার টাংকে খুচ্ছে, কাপড়টাপড় সব ফালায় দিছে আমি নতুন কাপড়টা তুলতে গেছি পরে টাংক তুইলা পিডে ভারি মারছে।’
খালেক মিয়া দাশবাবুর বাড়ির অবস্থা দেখে এক্কেবারে বিস্মিত হয়ে যায়। একেকজনের দোষারোপ, এই নিয়ে বাকবিতণ্ডা, অশ্লীলতা দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন দাশবাবুকে গিয়ে সব খুলে বলবেন। এতবছরের কাজকামে এতটুকু বিশ্বাস তো উনি করতে পারেন। বান্ডেলটা তুলতে গিয়ে খালেক মিয়া দেখে টাকা লুকানোর জায়গাটাতে একটা আম গাছের ছোট চারা দুপাশে দুইটা পাতা ফেলে অনড় দাঁড়িয়ে আছে। গাঢ় কালচে লালের মাঝে শৈল মাছের গায়ের ছোপ ছোপ দাগের মতো অসংখ্য দাগ পাতা দুটোর গায়ে৷ হিমশীতল নক্ষত্র ছড়ানো ছিটানো দুইটা ভিন্ন আকাশ, ভিন্ন মতাদর্শ, একই সময়ের বিস্তর তফাতের দুইদিকে মুখ করা দুইটা সমাজ। বেঁচে থাকার তাগিদে তারা ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছে। খালেক মিয়া চারাটা উপড়ে ফেললেন। পাঁকা বেলের ঘ্রাণ খালেক মিয়ার নাকে আসতে লাগল। খুঁন্তিটা রেখে ঘ্রাণের উৎস খুঁজতে গিয়ে লক্ষ করেন আমের ছোটচারাটা থেকে আসছে। খালেক একটু ভড়কে গেলেন।
বাড়ির কাছাকাছি আসতেই বড় মেয়ে শারমিন আর বাছিরকে ঝগড়া করতে দেখে মেজাজ আরও বিগড়ে গেল খালেকের। জিগার গাছের একটা ছোট ডাল নিয়ে খালেক মিয়া এগোতে থাকে। হাত দুটো কেমন অসাড় হয়ে আসছে। ডালটা এত ভারী লাগছিল যেন হাতটা ছিঁড়ে পড়ে যাবে। ডানপায়ের ব্যাথাটা মনে হয় সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। ডালটা ফেলে কলপাড়ে বসতে গিয়ে সে আধমরা ঝংকার খাওয়া টিনের ওপর পড়ে যায়। শারমিন এতক্ষণ ভয়ে ঘরে লুকিয়ে ছিল। ধাক্কার আওয়াজ শুনে সে দ্বিগুণ ভয় নিয়ে এসে দেখে খালেক মিয়া মাটিতে আধশোয়া অবস্থা পড়ে আছে। এই অবস্থা দেখে শারমিন ভয়ে শরীরের সব শক্তি দিয়ে চিৎকার করে কান্না করতে লাগল।
খালেক মিয়া তাকে অস্পষ্ট থমক দিয়ে থামিয়ে বিড়বিড় করে বলে, ‘তর আম্মারে আর ফুলিরে পুলিশে লইয়া গ্যাছে।’
হাজার হাজার প্রশ্নকে মাটিচাপা দিয়ে শারমিন আগের চেয়ে আরো জোরে হাউমাউ করে কান্না করতে লাগল। ‘বাছির কই রে তুই, এহানে আ, মারমু না তরে, তর মারে পুলিশ নিয়া গ্যাছে গা রে।’ খালেক মিয়া এগুলো খুব নরম গলায় বলতে লাগল। যেন পৃথিবীতে তার কান্না করতে, আবেগের বহিঃপ্রকাশ করতে মানা। আবার ডাকতে লাগল। শারমিন কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘হে মনে হয় ডরে মসজিদের হেনে গ্যাছে।’
খালেক মিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে শারমিনকে বলে, ‘তুই একটা ব্যাগ লইয়া চুকির নিচে থিকা ইন্দুরে খাওয়া টেকা গুলা নিয়া আ, মাস্টারের বাড়ি যাইতে হইব।’