দর্পণ ডেস্ক
একটি পূর্ণাঙ্গ ম্যাগাজিন। শিক্ষা, সাহিত্য ও গবেষণামূলক ম্যাগাজিন দর্পণ। ২০১৯ সালে ব্যতিক্রমধর্মী ম্যাগাজিন দর্পণ তার যাত্রা শুরু করে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে দর্পণ "গল্পবাজ" ম্যাগাজিন আত্তীকরণ করে।
দর্পণ ডেস্ক

ঘুমন্ত পুরী

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার


ক দেশের এক রাজপুত্র। রাজপুত্রের রূপে রাজপুরী আলোকিত। রাজপুত্রের গুণের কথা লোকের মুখে ধরে না।

একদিন রাজপুত্রের মনে হল, দেশভ্রমণে যাবেন। রাজ্যের লোকের মুখ ভার হল, রাণী আহার-নিদ্রা ছাড়লেন, কেবল রাজা বললেন,“আচ্ছা, যাক।”

তখন দেশের লোক দলে-দলে সাজলো,
রাজা চর-অনুচর দিলেন,
রাণী মণি-মাণিক্যের ডালা নিয়ে আসলেন।

রাজপুত্র লোকজন, মণি-মাণিক্য, চর-অনুচর কিছুই সঙ্গে নিলেন না। নতুন পোশাক পরে, নতুন তলোয়ার ঝুলিয়ে রাজপুত্র দেশভ্রমণে বের হলেন।

২.

যেতে যেতে যেতে, কত দেশ, কত পর্বত, কত নদী, কত রাজার রাজ্য ছাড়িয়ে, রাজপুত্র এক বনের মধ্যে দিয়ে যেতে গিয়ে অবাক হলেন। বনে পাখ-পাখালির শব্দ নেই, বাঘ-ভালুকের সাড়া নেই! রাজপুত্র চলতে থাকলেন।

চলতে চলতে, অনেক দূর গিয়ে রাজপুত্র দেখলেন, বনের মধ্যে এক রাজপুরী। এমন রাজপুরী রাজপুত্র আর কখনও দেখেননি। দেখে রাজপুত্র অবাক হয়ে গেলেন।

রাজপুরীর ফটকের চূড়া আকাশে ঠেকেছে। ফটকের দুয়ার বন জুড়ে আছে। কিন্তু ফটকের চূড়ায় বাদ্য বাজে না, ফটকের দুয়ারে দুয়ারী নেই।

রাজপুত্র আস্তে আস্তে রাজপুরীর মধ্যে গেলেন।

রাজপুরীর মধ্যে গিয়ে দেখলেন, রাজপুরী একদম পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। যেন দুই বার ধোয়া। সাদা ধব ধব করছে সবকিছু। কিন্তু এমন পুরীর মধ্যে জন-মানুষ কেউ নেই। কোন সাড়া-শব্দ নেই।

রাজপুত্র আশ্চর্য হলেন।

রাজপুত্র এদিক তাকালেন, ওদিক তাকালেন। পুরীর চারিদিকে দেখতে লাগলেন। এক জায়গায় গিয়ে রাজপুত্র থেমে গেলেন। দেখলেন, মস্ত আঙ্গিনা। আঙ্গিনা জুড়ে হাতী, ঘোড়া, সেপাই, লস্কর, দুয়ারী, পাহারা, সৈন্য-সামন্ত সব সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে।

রাজপুত্র হাঁক দিলেন।

কেউ কথা বলল না,
কেউ তাঁর দিকে ফিরে তাকালো না।

অবাক হয়ে রাজপুত্র কাছে গিয়ে দেখলেন, কাতারে কাতারে সেপাই, লস্কর, কাতারে কাতারে হাতী-ঘোড়া সব পাথরের মূর্তি হয়ে রয়েছে। কারো চোখে পলক পড়ে না, কারো গায়ের লোম নড়ে না। রাজপুত্র আশ্চর্য হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন।

তারপর রাজপুত্র রাজপ্রাসাদের মধ্যে গেলেন।

রাজপ্রাসাদের এক ঘরে গিয়ে দেখলেন, ঘরের মধ্যে অনেক রকমের ঢাল তলোয়ার, তীর, ধনুক সব হাজারে হাজারে টাঙানো রয়েছে। পাহারাদারেরা পাথরের মূর্তি, সেপাইরা পাথরের মূর্তি। রাজপুত্র নিজের তলোয়ার খুলে আস্তে আস্তে চলতে লাগলেন।

আর এক ঘরে গিয়ে দেখলেন, মস্ত বড় রাজদরবার। রাজদরবারে সোনার প্রদীপে ঘিয়ের বাতি জ্বল্ জ্বল্ করছে। চারিদিকে মণি-মাণিক্য ঝক্ঝক্ করছে। কিন্তু রাজসিংহাসনে রাজা পাথরের মূর্তি। মন্ত্রীর আসনে মন্ত্রী পাথরের মূর্তি। পাত্র-মিত্র, ভাট বন্দী, সেপাই লস্কর যে যেখানে, সে সেখানে পাথরের মূর্তি। কারো চোখে পলক নেই, কারো মুখে কথা নেই।

রাজপুত্র দেখলেন, রাজার মাথায় মুকুট হেলে আছে। দাসির হাতের পাখা ঢুলে আছে। সাড়া নেই, শব্দ নেই, সব ঘুমে নিঝুম। রাজপুত্র মাথা নিচু করে চলে আসলেন।

আর এক ঘরে গিয়ে দেখলেন, শত প্রদীপ একসঙ্গে জ্বলছে। কত রকমের ধন-রত্ন, কত হীরা, কত মাণিক, কত মোতি- ঘরেতে যেন আর ধরে না। রাজপুত্র কিছু ছুঁলেন না; দেখে আরেক ঘরে চলে গেলেন।

সে ঘরে যেতে না যেতেই হাজার হাজার ফুলের গন্ধে রাজপুত্র মাতোয়ারা হয়ে উঠলেন। কোথা থেকে এমন ফুলের গন্ধ আসে? রাজপুত্র ঘরের মধ্যে গিয়ে দেখলেন, জল নেই টল নেই, ঘরের মাঝখানে লাখে লাখে পদ্মফুল ফুটে রয়েছে! পদ্মফুলের গন্ধে ঘর ম’-ম’ করছে। রাজপুত্র ধীরে ধীরে ফুলবনের কাছে গেলেন।

ফুলবনের কাছে গিয়ে রাজপুত্র দেখলেন, ফুলের বনে সোনার খাঁট। সোনার খাটে হীরার ডাঁটনা। হীরার ডাঁটে ফুলের মালা দোলানো রয়েছে। সেই মালার নিচে, হীরার নালে সোনার পদ্ম। সেই সোনার পদ্মে এক পরমা সুন্দরী রাজকন্যা বিভোরে ঘুমাচ্ছেন। ঘুমন্ত রাজকন্যার হাত দেখা যায় না। পা দেখা যায় না। কেবল চাঁদের আলোর মতো মুখখানি সোনার পদ্মের সোনার পাপড়ির মধ্যে টুল্-টুল্ করছে। রাজপুত্র হীরার ডাঁটে ভর দিয়ে অবাক হয়ে দেখতে লাগলেন।

৩.

দেখতে দেখতে, দেখতে, দেখতে, কত বছর চলে গেল। রাজকন্যার আর ঘুম ভাঙ্গে না। রাজপুত্রের চোখেও আর পলক পড়ে না। রাজকন্যা অঘোরে ঘুমাচ্ছেন আর রাজপুত্র বিভোর হয়ে দেখছেন।

হঠাৎ একদিন রাজপুত্র দেখলেন, রাজকন্যার শিয়রে এক সোনার কাঠি। রাজপুত্র আস্তে আস্তে সোনার কাঠিটি তুলে নিলেন।

সোনার কাঠি তুলে নিতেই দেখলেন, আর এক দিকে এক রূপার কাঠি। রাজপুত্র আশ্চর্য হয়ে রূপার কাঠিও তুলে নিলেন। দুই কাঠি হাতে নিয়ে রাজপুত্র নাড়াচাড়া করে দেখতে লাগলেন।

দেখতে দেখতে, সোনার কাঠিটি একসময় টুক করে ঘুমন্ত রাজকন্যার মাথায় ছুঁয়ে গেল! অমনি পদ্মের বন শিউরে উঠলো। সোনার খাট নড়ে উঠলো। সোনার পাঁপড়ি ঝরে পড়লো। রাজকন্যার হাত হল, পা হল। গায়ের অলসতা ভেঙে, চোখের পাতা কচলিয়ে ঘুমন্ত রাজকন্যা চমকে উঠে বসলেন।

আর অমনি রাজপুরীর চারিদিকে পাখি ডেকে উঠলো। দুয়ারে দুয়ারী এসে হাঁক ছাড়ল। হাতী ঘোড়া ডাক ছাড়ল। সেপাইয়ের তলোয়ার ঝন ঝন করে উঠলো। রাজদরবারে রাজা জাগলেন। মন্ত্রী জাগলেন। পাত্র জাগলেন। হাজার বচ্ছরের ঘুম হতে তারা জেগে উঠলেন। যে যেখানে ছিলেন, জেগে উঠলেন। লোক লস্কর, সেপাই, পাহারাদার, সৈন্য-সামন্ত তীর-তলোয়ার নিয়ে খাড়া হল। সকলে অবাক হয়ে গেলেন। রাজপুরীতে কে আসলো!

রাজপুত্র অবাক হয়ে গেলেন,
রাজকন্যা অবাক হয়ে চেয়ে থাকলেন।

রাজা, মন্ত্রী জন-পরিজন সকলে রাজপুত্রের কাছে আসলেন। রাজপুত্র-রাজকন্যা মাথা নুইয়ে থাকলেন। রাজপুরীর চারদিকে ঢাক-ঢোলের বাদ্য, শানাইয়ের বাদ্য বেজে উঠলো!

রাজা বললেন,-“তুমি কোন দেশের ভাগ্যবান রাজার রাজপুত্র! তুমি আমাদের মরণ-ঘুমের হাত হতে রক্ষা করলে!”

লোকজন বলল,“আহা। আপনি কোন দেবতা? কোন রাজার দেব রাজপুত্র? এক দৈত্য রূপার কাঠি ছুঁইয়ে আমাদের রাজ্য সোনার রাজ্য বানিয়ে সবাইকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল। আপনি এসে আমাদের জাগিয়ে রক্ষা করলেন।”

রাজপুত্র মাথা নুইয়ে চুপ করে থাকলেন।

রাজা বললেন,“আমার কি আছে, কি দিব তোমাকে? এই রাজকন্যা তোমার হাতে দিলাম। এই রাজত্ব তোমাকে দিলাম।”

চারিদিকে ফুল-বৃষ্টি। চারিদিকে চন্দন-বৃষ্টি। ফুল ফোটে, খৈ ছোটে। রাজপুরীর হাজার ঢালে ‘ডুম-ডুম’ আওয়াজ শুরু হলো।

তখন, শতে শতে বাঁদী দাসি বাট্না বাটে, হাজারে হাজের দাই দাসী কুট্না কোটে।

দুয়ারে দুয়ারে মঙ্গল ঘড়া
পাঁচ পল্লব ফুলের তোড়া;
আল্পনা বিলিপনা, এয়োর ঝাঁক,
পাঠ-পিঁড়ি আসন ঘিরে’, বেজে ওঠে শাঁখ।

সে কি শোভা! রাজপুরীর চার-চত্বর ঝলমল। আঙ্গিনায় আঙ্গিনায় হুলুধ্বনি, রাজভান্ডারে ছড়াছড়ি; জনজনতার হুড়াহুড়ি। এতদিনের ঘুমন্ত রাজপুরী আনন্দে তোলপাড়।

তারপর, ফুটফুটে চাঁদের আলোয় পুরোহিতের সামনে রাজা পঞ্চরত্ন রাজমুকুট পরিয়ে রাজপুত্রের সঙ্গে রাজকন্যার বিয়ে দিলেন। চারিদিকে জয়ধ্বনি উঠলো।

৪.

এক বছর, দুবছর, বছরের পর বছর, অনেক বছর হলো রাজপুত্র দেশভ্রমণে গেছেন। রাজপুত্র আজও ফেরেননি। কেঁদে কেঁদে মাথা খুঁড়ে রাণী বিছানা নিয়েছেন। ভেবে ভেবে চোখের জল ফেলতে ফেলতে রাজা অন্ধ হয়েছেন। রাজ্য অন্ধকার, রাজ্যে হাহাকার।

একদিন ভোর হতে না হতেই রাজদুয়ারে ঢাক-ঢোল বেজে উঠলো, হাতী ঘোড়া সেপাই সান্ত্রীর হাঁকে দুয়ার কেঁপে উঠলো।

রাণী বললেন,“কি, কি?”

রাজা বললেন,“কে, কে?”

রাজ্যের প্রজারা ছুটে আসলো। রাজপুত্র রাজকন্যাকে বিয়ে করে ফিরে এসেছেন!

কাঁপতে কাঁপতে রাজা এসে রাজপুত্রকে বুকে নিলেন। পা পিছলে পড়তে পড়তে রাণী এসে রাজকন্যাকে বরণ করে নিলেন।

প্রজারা আনন্দধ্বনি করে উঠলো।

রাজপুত্র রাজার চোখে সেই সোনার কাঠি ছোঁয়ালেন, রাজার চোখ ভালো হয়ে গেল। ছেলেকে পেয়ে, ছেলের বউ দেখে রাণীর অসুখ সেরে গেল।

তারপর রাজপুত্র নিয়ে, ঘুমন্ত পুরীর রাজকন্যা নিয়ে রাজা-রাণী সুখে-শান্তিতে রাজত্ব করতে লাগলেন।

(চলিতকরণ: দর্পণ)


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu