সাঈদ আজাদ

ঘড়ি

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

   ক.

দুপুর বেলা।

নিউমার্কেটের গেটে আফজাল সাহেব লাল মারুতি থেকে নামতেই একঝলক ঠান্ডা বাতাস তাঁর গা ছুঁয়ে গেল। এতক্ষণ গাড়ির ভেতর এসির মধ্যে ছিলেন। বাইরে ছিল ঝাঁ ঝাঁ রোদ। ভেবেছিলেন, গাড়ি থেকে বের হলে গরম বাতাস গায়ে ধাক্কা দিবে। তার বদলে ঠান্ডা বাতাস! বেশ ভাল লাগল ঠান্ডা বাতাসের ছোঁয়ায়।

এখন মাথার উপর শেষ এপ্রিলের কাঠফাটা রোদ। এই সময় ঢাকা শহরে লু হাওয়া বওয়ার কথা। শীতল বাতাস না। কী জানি ঝড় টড় আসবে বোধহয়। সে কারণেই বাতাসটা শীতল। তা সময়টা যখন তখন ঝড় আসারই।

আফজাল সাহেব যে কিছু কিনতে নিউমার্কেট এসেছেন তা না। কোনো প্রয়োজন ছাড়াই মাঝে মাঝে তিনি এই মার্কেটে সেই মার্কেটে ঘোরাঘুরি করেন। শুধু মার্কেট কেন, বাজারে ঘোরেন। সারা দুপুর মাঠে বা পার্কেও বসে থাকেন। অকারণেই। সেই সময় ব্যবসা নিয়ে মাথা ঘামাতে ইচ্ছে করে না তাঁর। মনে হয়, অনেকতো হল ব্যবসা কাজকর্ম। আর কত! চারজনের জন্য মেলাই টাকা হয়েছে। ব্যবসা নিজে থেকেই আরো বড় হবে, আরো বাড়বে টাকা। শূন্য থেকে কত কিছুইতো হল। যখন অভাব ছিল তখনও দিন গেছে, এখন অঢেল টাকা এখনও দিন যায়। কোন দিনগুলো ভাল কে জানে! মাথায় যখন এমন বাই চাপে তখন আফজাল সাহেব গাড়ি থেকে হঠাৎ এখানে সেখানে নেমে পড়েন। কোনদিন পার্কেই বসে থাকেন সারাদিন। মানুষজন দেখেন। কোনদিন কোনো মার্কেটে চলে যান। দরকার নেই তবু এটা সেটা কেনেন। সবকিছু যে বাসায় নিয়ে যান তাও না। আর বাসায় নিলে কেইবা ব্যবহার করবে সেসব জিনিস। স্ত্রী ছেলে মেয়ে নিজেদের কেনাকাটা নিজেরাই করে। তাদেরও গাড়ি আছে আলাদা আলাদা। যখন যেখানে ইচ্ছা যায়। কেনা জিনিসের বেশিরভাগই ড্রাইভার মতি নেয়। বাকি সব গাড়ির পেছনে অনাদরেই পড়ে থাকে কিছু দিন। তারপর হয়তো রাস্তায় দেওয়ার মতো কাউকে পেলে দিয়ে দেন। তাঁর এসব ব্যাপার পরিবারের কেউ জানে না।  জানে শুধু ড্রাইভার মতি।

তা ড্রাইভার মতি মিয়া তার স্যারের এই অভ্যাসের কথা কাউকে বলেনি। স্যারের আরও অনেক অদ্ভুত অভ্যাসের সাথেই সে পরিচিত। তার কোনটার কথাই মতি মিয়া কাউকে বলেনি। এমনকি ম্যাডামকেও না। অবশ্য সে সবের কোনটাই খারাপ বা কু অভ্যাস না। যেমন – মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যালের সময় যে সব বাচ্চারা ফুল বিক্রি করে স্যার তাদের সবার সব ফুল কিনে নেন বেশি বেশি টাকা দিয়ে। বা কোনো বুড়ো রিকশাওয়ালা দুপুরবেলা রিকশায় আধশোয়া হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে, স্যার তার সাথে গিয়ে গল্প জুড়ে দেন। আসার সময় রিকশাওয়ালাকে একটা রিকশা কেনার টাকা দিয়ে আসেন। পেছনে হতভম্ব রিকশাওয়ালার দিকে ফিরেও তাকান না। আবার কখনো সারা দুপুর বসে থাকেন পার্কে। ভাসমান যে সব বাচ্চারা পার্কে ঘোরাঘুরি করে তাদেরকে টাকা দেন। দু‘টাকা পাঁচ টাকা না। পাঁচশ কী হাজার টাকার নিচে কাউকেই দেন না স্যার। আর বলেন, টাকাটা তোমার নিজের জন্যই খরচ করবে। মন যা চায় কিনবে। গাড়িতে স্যার সব সময় লাখ দু‘য়েক টাকা রাখেন। মতি মিয়া জানে, এখন তার স্যার সারাটা দুপুর নিউমার্কেট ঘুরবেন। কত কিছু কিনবেন! প্রয়োজন নেই, তবু কেনেন। স্যার বাড়ি ফিরে যাবেন বিকেলের দিকে।

আফজাল সাহেব নিউমার্কেটের ভেতরে ঢুকে ইতস্তত ঘুরতে লাগলেন। কত কিছু বিক্রি হচ্ছে! দোকানের  বাইরেই কত পণ্য। বাচ্চাদের সাইকেল, খেলনা, সুন্দর সুন্দর শোপিস, টাওয়েল, কাপড়, ব্যাগ, হাড়ি-পাতিল, ঝালমুড়ি, আচার, ফল। এক জায়গায় অদ্ভুত জিনিস বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাথে বসে একলোক মার্বেলের চেয়ে ছোট ছোট রাবারের বল বিক্রি করছে। বিক্রেতা তাকে দেখে বলল, নিয়া যান স্যার। ছোট ছোট পোলাপানরা খু্ব পছন্দ করব। এইগুলা হইল ম্যাজিক বল।

লোকটা কতগুলো বল একটা পানি ভর্তি বোতলে ফেলল। দেখতে দেখতে বলগুলো বড় হতে লাগল। আফজাল সাহেব একটু অবাক হলেন। ব্যাপারটা যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং। তিনি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন। এখন তাকে দেখে কে বলবে যে তিনি একজন দায়িত্বশীল গম্ভীর রাগী প্রকৃতির মানুষ। তিন তিনটা ইন্ডাস্ট্রির মালিক তিনি। তাঁর প্রতিটা কর্মচারি তাকে আজরাইলের মতো ভয় পায়। যদিও তিনি কখনো কোনো কর্মচারিকে ধমক পর্যন্ত দেন না। বলতে গেলে দুদিন পর পর আফজাল সাহেব দেশের বাইরে যান। ছেলেমেয়েদের জন্য কত কী আনেন। কিন্তু এমন কিছুতো কোথাও দেখেননি। তিনি একহাজার টাকা দিয়ে সবগুলো ম্যাজিক বল কিনে ফেললেন।  জানা কথা ছেলে বা মেয়ে কেউ ছুঁয়েও দেখবে না এগুলো। যাকগে, পার্কে গেলে কোনো বাচ্চাকে দিয়ে দিলেই হবে। ওরা নিশ্চয়ই খুশি হবে।

বলগুলো মতির হাতে দিয়ে ফের হাঁটতে লাগলেন আফজাল সাহেব। মুশতারি তাঁর স্ত্রী, হয়তো পছন্দ করবেন না, তা হলেও তাঁর জন্য দুটা দামী শাড়ি কিনলেন। বেডশিট কিনলেন তিনটা। তাদের স্বামী স্ত্রী দুইজনের জন্য একটা, আর দু ছেলে মেয়ের জন্য দুটা। মতি মিয়া তাঁর পেছনেই আছে। সে জিনিসগুলো গাড়িতে রেখে আসছে। একটু ভেবে মতির বউয়ের জন্যও একটা শাড়ি কিনলেন। মতির ছোট মেয়েটার জন্য একটা পুতুল। মতি তেমন অবাক হল না। আফজাল সাহেব মাঝে মাঝে মতির জন্যও এটা সেটা কিনেন। তার ছেলে মেয়ের জন্য খেলনা কিনেন।

 

      খ.

আফজাল সাহেব ঘুরতে ঘুরতে চশমার  দোকানের সামনে চলে এলেন। হঠাৎ মনে পড়ল তাঁর চশমার পাওয়ার চেঞ্জ হয়েছে। চশমাটা পাল্টানো দরকার। প্রেসক্রিপসনটা মানিব্যাগে নিয়ে অনেকবার নিউমার্কেটে এসেছেন। কিন্তু চশমা পাল্টানো হয়নি। কেন জানি শেষ পর্যন্ত চশমা পাল্টানোর কথা আর মনে থাকে না। আজ কোনো একটা দোকান থেকে পাল্টে নেবেন। তবে হাতে সময় আছে অনেক। চশমার দোকানে একটু পরে ঢুকলেও হবে। তার আগে আরও কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলে হয়।

এই দুপুরেরও মার্কেটে লোকজনের অভাব নেই। মহিলার সংখ্যাই বেশি যেন। কারো কারো দুহাত ভর্তি ব্যাগ। তারপরও এটা সেটা কিনছেই। বোঝা যায় এখন মানুষের হাতে বেশ টাকা পয়সা আছে। আফজাল সাহেবের তাড়া নেই। তিনি ধীর পায়ে হাঁটেন। গয়নার দোকানে সুন্দর সুন্দর গয়না সাজানো। ঢুকে কিছুক্ষণ গয়নার ডিজাইন দেখলেন। একবার ভাবলেন মুসতারির জন্য কিছু কিনবেন। পরক্ষণেই চিন্তাটা বাদ দিলেন। মুসতারি তাঁর কেনা গয়না কখনোই পছন্দ করেননি। আফজাল সাহেব নাকি গয়নার ডিজাইন চেনেন না। তা মুশতারি তাঁর কীইবা পছন্দ করেন! আফজাল সাহেব গয়না চিনেন না, শাড়ি চিনেন না, পর্দার কাপড়ের রং বুঝেন না। সোফার কাভার কিনেন কটকটে রঙের, কার্পেট কিনলে হয় ম্যাড়ম্যাড় রঙের। বলতে কী মুশতাড়ি হল বিরাট বড়লোকের মেয়ে, তাঁর পছন্দতো অন্যরকম হবেই। তাঁর মতোতো অভাবী ঘরের ছেলে না। আফজাল সাহেবের তো যা দেখেন তাই ভাল লাগে! কী জানি হয়তো তাঁর কো্নো রুচি নেই। অথবা একসময় কোনো কিছুই কেনার সামর্থ ছিল না, এখন হয়েছে বলে যা পান তাই কিনেন। তা কোনটা যে সত্য কে জানে!

দরকার নেই, তবুও আফজাল সাহেব বড় বড় দুটা টাওয়েল কিনলেন। হাতলে সুন্দর কাজ করা একটা ছুরি কিনলেন। ঘুরতে ঘুরতে সামনে একটা চশমার দোকান পেয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লেন। সেলসম্যান লোক চড়িয়ে খায়। তাকে দেখেই বুঝল শাঁসালো খদ্দের। দোকানের ভেতরটা বেশ বাহারি। একপাশে চশমা আরেক পাশে ঘড়ি সাজানো।

আমাকে চশমার ফ্রেম দেখান, হালকা এবং কালোর মধ্যে। আয়নায় আফজাল সাহেব নিজের চেহারা দেখেন। তাঁর চেহারায় বেশ ব্যক্তিত্ব আছে। মাথা ভর্তি কাঁচা পাকা চুলগুলো চেহারার সাথে মানানসই। এমনি এমনি তাঁর কর্মচারীরা তাকে ভয় পায় না।

এই যে স্যার, এই কয়টা ফ্রেম দেখেন পছন্দ হয় কিনা। আফজাল সাহেব আয়না থেকে চোখ সরান। ফ্রেম দেখায় মন দেন। সেলসম্যান আরও কিছু ফ্রেম দেখায়। নাহ, কোনোটাই মনমতো হচ্ছে না। আর একটা দোকান দেখবেন কিনা ভাবেন। যাওয়া যায়। হাতে সময়ওতো আছে।

এখন মাসের শেষ, তিন হাজার টাকা দিয়ে ঘড়ি কেনার সামর্থ আমার নাই। পাঁচ সাতশ টাকায় কেনা যায় এমন একটা ঘড়ি পছন্দ কর। কিছু একটা পছন্দ করার আগে আমার সামর্থটাতো দেখবে। তুমি একা নও, আরো দুবোন আছে তোমার। এখনো সংসারের কথা ভাবতে শিখলে না, আর কবে ভাববে। মৃদু স্বরে বললেও কথাগুলো আফজাল সাহেবের কানে ঠিকই যায়। ব্যপারটা ঠিক শোভন নয় জেনেও তিনি ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকান।

প্রায় আফজাল সাহেবের বয়সীই ভদ্রলোক, একটা ছেলেকে নিয়ে তাঁর পেছনে পেছনে দোকান থেকে বের হয়ে আসছে। ভদ্রলোকের চেহারা ঘামে ভেজা, অবসন্ন। ছেলেটা মুখ নিচু করে আছে। মনে হয় দুজনে বাপ ছেলেই হবে। আফজাল সাহেবের ভদ্রতাজ্ঞান প্রবল। তিনি অকারণে কৌতূহল দেখান না। কিন্তু এখন কী ভেবে তিনি ওদের পেছন পেছন হাঁটতে লাগলেন। পেছনে আছেন বলে ছেলেটার মুখ দেখতে পাচ্ছেন না। তবে ছেলেটার অভিমানী চেহারাটা ঠিকই তাঁর চোখে ভেসে উঠল। কত হবে ছেলেটার বয়স? পনের কী ষোল? এর বেশি হওয়ার কথা না। হয়তো এখনো এসএসসি পরীক্ষা দেয়নি। হয়তো এসএসসি পরীক্ষা দিবে বলেই ঘড়িটা কিনতে চেয়েছে ছেলেটা। এসব ভেবে টেবে আফজাল সাহেব ওদের পেছনে লেগে রইলেন। হাঁটতে হাঁটতে অনেক অনেক বছর আগের কথা মনে পড়ে গেল তাঁর। ছেলেটার বয়সীই ছিলেন তখন তিনি।

মাটির মেঝেতে পাটি বিছানো। গায়ে কাঁথা জড়িয়ে বালিশে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছেন আব্বা। পাশে কিশোর আফজাল আর চাচাত বোন রুবিনা আপা। দু‘জনের দৃষ্টিই আফজালের আব্বার মুখে। মলিন সে মুখে হতাশা আর অসহায়তা মাখামাখি।

আব্বা ছোটখাট একটা সরকারি চাকুরি করতেন। বেতনের টাকায় সাতজনের সংসার চালাতে হিমসিম খেত মা। তা হলেও কেমন কেমন করে যেন মাস চলে যেত। পাঁচ ভাইবোনের কারোরই দু‘টার বেশি পরার কাপড় ছিল না। আফজালের স্কুলের ড্রেস ছাড়া আর একটা মাত্র শার্ট ছিল তখন। অন্যেরা স্কুলে যেত জুতা মোজা পরে আর তাকে স্কুলে যেতে হত রাবারের স্যান্ডেল পরে। সেই স্যান্ডেলও ফিতা ছেঁড়া। গুনা দিয়ে ছেঁড়া ফিতা জোড়া দিয়ে পায়ে দিতে হত। কোনো কোনো দিন হয়তো জোড়া খুলে ফিতা আলাদা হয়ে যেত।সবাই সুন্দর সুন্দর ব্যাগে করে বই নিতো আর আফজালকে বই নিতে হত পলিথিন ব্যাগে করে। নতুন বইও কিনা সম্ভব হত না। এক ক্লাস উপরে ছিল বড় বোন, তার পুরনো বইই পড়তে হত। বোন ছিল আর্টসে। ভাল ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও সায়েন্সে পড়া সম্ভব হয়নি আফজালের। তাহলে নতুন বই কিনতে হয়। তাছাড়া সায়েন্সে পড়লে প্রাইভেটও পড়া লাগে। এমনিতে বড় বোনই সমস্যা হলে পড়া দেখিয়ে দিত।  দুপুরে টিফিন খাওয়ার জন্য দু‘টাকা দিতেন আব্বা। কোনো কোনো দিন সেই দু‘টাকাও পাওয়া যেত না। কী কষ্টের দিন যে গেছে। তখন তো আর বুঝতেন না, আব্বা উপর খুব রাগ হত, অভিমান হত।

আফজাল তখন ক্লাস টেনে । হঠাৎ আব্বার সারা শরীর বেলুনের মতো ফুলে গেল। মারাত্মক অবস্থায় ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি পরীক্ষা শেষে জানালেন দুটা কিডনিই ড্যামেজ। একেবারে শেষ পর্যায়ে। আচমকা এমন একটা খবরে পরিবারের সবার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। রোগটা ধরা পড়েছে একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে। ডাক্তাররা কোনো আশাই দিলেন না। ডায়ালাইসিস করে বললেন বাড়ি নিয়ে যেতে। অথবা নতুন কিডনি সংযোজনের ব্যবস্থা করতে। নতুন কিডনি সংযোজনের জন্য লাখ তিনেক টাকা লাগবে। তাও যদি ডোনার ফ্রি ডোনেট করে। এমনই কপাল, পাঁচ ভাইবোন আর মায়ের কিডনির সাথে আব্বার কিডনি ম্যাচ করল না। রক্তের গ্রুপই আলাদা। শেষ পর্যন্ত  দাদীর সাথে মিলল সব কিছু। কিন্তু বয়স বেশি বলে ডাক্তাররা দাদীর কিডনি নেওয়ার ঝুঁকি নিতে চাইলেন না। আব্বাও রাজী না। আর রাজী হলেও কে দিবে কিডনি সংযোজনের টাকা?  দাদা নেই বেঁচে। বাবার ভাগের জমি সব আগেই বিক্রি করা শেষ। সম্পত্তি বলতে শুধু ভিটা। ভিটা বেচলে তাদের দাঁড়ানোর জায়গাও থাকে না। মামারা কী চাচারা কেউ এগিয়ে এল না। সব ভেবেই বুঝি আব্বা নিজেও গ্রামে চলে যেতে চাইলেন।

গ্রামে নিয়ে গিয়ে কত রকমের চিকিৎসা করানো হল। কবিরাজী, হোমিওপ্যাথি। পানি পড়া, ঝাড় ফুঁক। যে যা বলেছে, তাই করা হয়েছে। ডাক্তারাতো আর হায়াত মউতের মালিক না। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। চিকিৎসায় বোধহয় কিছুটা কাজ হয়েছে। আব্বা যেন কিছুটা সুস্থ বোধ করছেন। হাত পায়ের পানি সরে গেছে। মুখের ফোলা ভাবটাও নেই। একদিন অসুস্থ পিতার পাশে কিশোর আফজাল বসা। কিশোর মন বিশ্বাসই করতে পারেনি আব্বাকে চিরতরে হারাবে। ডাক্তাররা তেমন ভরসা দেয়নি তাতে কী। করিরাজী ওষুধে তো আব্বার অবস্থা আগের চেয়ে ভাল। তের বছরের কিশোরের জীবন সম্পর্কে আর কতটুকু অভিজ্ঞতা। সে তো আর জানে না, নিভে যাওয়ার আগে প্রদীপ একটু দপদপ করেই।

মেঝেতে পাটি বিছানো। আব্বা শরীরে একটা কাঁথা জড়িয়ে বালিশে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছেন। মুখটা একটু মলিন যেন। এছাড়া অসুস্থতার কোনো লক্ষণ নেই। তখন আব্বার পাশে আফজাল আর চাচাতো বোন রুবিনা আপা। আব্বা হঠাৎ আফজালকে উদ্দেশ্য করে বললেন, বাবারে জানি আমি আর বেশি দিন নাই। তোদের জন্য তেমন কিছু রেখে যেতে পারলাম না। কষ্ট করে হলেও পড়ালেখাটা করিস। মানুষ হওয়ার চেষ্টা করিস। কেউ যেন বলতে না পারে আমি নেই বলে তোরা অমানুষ হয়েছিস। ছোট ভাইবোনদের দেখিস।

রুবিনা আপা বললেন, কেন চাচা, আপনি কি কম করেছেন ওদের জন্য। কোনো আহ্লাদটা না পূরণ করেছেন। খাওয়া পরা কোনোটার অভাব আছে ওদের।

হ্যাঁ বলেছে আপনাকে ! আফজালের অভিমানী কন্ঠ । আমার একজোড়া জুতা পর্যন্ত নাই। স্যান্ডেল পরে স্কুলে যাই। তাও ছেঁড়া।কতদিন বলেছি একটা ঘড়ি কিনে দেওয়ার জন্য। দিয়েছেন আব্বা। স্কুলে যাওয়ার আগে সময় জানার জন্য রাস্তায় গিয়ে গিয়ে লোকদের জিজ্ঞেস করতে হয়। ক্লাসের সবারই বোধহয় ঘড়ি আছে, আমার ছাড়া । একটা ঘড়ির কত আর দাম, তাও কিনে দেন নাই আব্বা। আমি ক্লাস টেনে পড়ি আমার একটা ঘড়ির দরকার হয় না। কদিন পর এসএসসি পরীক্ষা।

আফজালে কথা শুনে আব্বা কেমন অদ্ভুত কন্ঠে বলেন, আমি মরে গেলেতো ঠিকমত খাবারই জুটবে নারে বাপ, আবার ঘড়ি! আর পারলে কি তোকে একটা ঘড়ি কিনে দিতাম না! বেতনের টাকায় সংসার চালিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারি না বলেই

তখন কী আর বুঝেছেন আফজাল, সেই কন্ঠে কতটা হতাশা, কতটা না পারার অক্ষমতা ছিল।

তুমি নিজেই আরও দুএকটা দোকান ঘুরে অন্য কোনো ঘড়ি পছন্দ কর। আমি সোফার কাভারগুলো নিয়ে আসি । টাকা খরচ হয়ে গেলে পরে মুশকিলে পড়ব। শেষে তোমার মা চিল্লাচিল্লি করবে।

বাপ চলে যেতেই ছেলেটা যে দোকান থেকে বের হয়েছিল সে দোকানে আবার ঢুকল। আফজাল সাহেবও পেছনে পেছনে ঢুকলেন। তাকে দেখে সেলসম্যান উৎসাহী হল। ওরা ধুরন্ধর লোক। লোক চরিয়ে খায়। খরিদ্দার দেখলে চিনবেই।

কোন ফ্রেমটা পছন্দ স্যার? নাকি আরও দু একটা দেখবেন?

আমাকে ঐ ঘড়িটা আরেকবার দেখান না।

ছেলেটা ঘড়িটা আবার দেখতে চাইছে। কিন্তু সেলসম্যান তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। বুঝে গেছে ঘড়িটা কেনার সামর্থ ছেলেটার নেই। তবু শেষে ছেলেটার পীড়াপীড়িতে সেলসম্যান ঘড়িটা বের করে। ছেলেটা আগ্রহ নিয়ে ঘড়িটা হাতে পরে। আফজাল সাহেব আড়চোখে দেখেন, ছেলেটার চোখ চকচক করছে।তিনি একটা চশমার ফ্রেম পছন্দ করলেন। খামাখা দোকানে কতকক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকা যায়।

তুই আবার এই দোকানে ঢুকলি কেন?

ছেলেটার বাবা দুহাতে দুটা ব্যাগ নিয়ে ঘেমে টেমে  দোকানে ঢুকলেন। বাবাকে দেখে তড়িঘড়ি করে ছেলেটা হাত থেকে ঘড়ি খুলে ফেলল। আফজাল সাহেব একবার ভাবলেন, ছেলেটাকে ঘড়িটা কিনে দিবেন। পরক্ষণেই মনে হল, না থাক। বাবা ছেলের কাছে ছোট হয়ে যাবেন তাহলে। তাছাড়া, সব কিছু পেতে নেই। তাঁর ছেলে মেয়ে সব চাইলেই পেয়ে যায় বলেইতো তাদের পাওয়ার কোনো আলাদা আনন্দ নেই। অভাব সবসময়ই খারাপ তা নয়।ছেলেটা বাবার সাথে বের হয়ে গেল।

 

গ.

আফজাল সাহেব কী মনে করে ঘড়িটা কিনে ফেললেন। সেলসম্যান যা দাম বলল সেই দামেই কিনলেন। সেলসম্যান খুশি খুশি গলায় বলল, স্যার আপনার ছেলের জন্য নিচ্ছেন বুঝি? এই ডিজাইনটা অল্পবয়সী ছেলেরা খুব পছন্দ করছে। তা সেলসম্যানের খুশি হওয়ারই কথা। আফজাল সাহেব নিজেও জানেন ঘড়িটা বেশ দাম দিয়েই কিনেছেন। আসলে দরদাম করতেই ইচ্ছা করল না। কিছু টাকা হয়তো বেশি গেল। যাক। টাকাতো খরচ করার জন্যই। কত টাকা তাঁর! এখন একটা ঘড়ি কেন, পুরো দোকানটাই কিনে ফেলার সামর্থ আছে। তবে তাঁর ছেলে এই ঘড়ি পরা দূরে থাক ছুঁয়েও হয়তো দেখবে না। ওরাতো নিজেদের জিনিস নিজেরাই কিনে। সে সব বেশিরভাগই দেশের বাইরের জিনিস। অন্যরকম।ঘড়িটা আসলে তিনি নিজের জন্যই কিনেছেন। ঠিক নিজের জন্য নয়। কিশোর আফজালের জন্য।

ঝড় আসবে বোধহয়! ঠান্ডা বাতাসটা আরো ঘন হয়েছে। ছেঁড়া পলিথিন আর কাগজ উড়ছে বাতাসে। সেই সাথে ধুলা। খোলা দোকানগুলো উঠে যাচ্ছে তড়িঘড়ি।

আফজাল সাহেব ঘড়িটা হাতে নিয়ে গাড়ির দিকে হাঁটতে থাকেন। পেছনে পেছনে মতি আসছে। মতির দু‘হাত ভর্তি বিভিন্ন কিছু। তা সে ঘড়িটাও নিতে চেয়েছিল। আফজাল সাহেব দেননি, ঘড়িটা নিজের হাতেই রেখেছেন।

বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আফজাল সাহেবের মনে হল গলায় কী যেন আটকে আছে। ঢোক গিলতে কষ্ট হচ্ছে। চোখ দুটো জ্বালা করছে। বৃষ্টির ঠান্ডা পানিতে জ্বালা যেন আরও বেড়ে গেল। বেগ বাড়তে থাকে বৃষ্টির। সেই সাথে জোর বাতাস।

বৃষ্টিতে দৃষ্টি ঝাপসা হলেও তিনি স্পষ্ট দেখতে পান। মলিন মুখে তাঁর অসুস্থ আব্বা বালিশে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছেন। তাঁর দুচোখে উৎকন্ঠা। স্ত্রী ছেলে মেয়েদের জন্য।আহা তিন লাখ টাকা। মাত্র তিন লাখ টাকা! হয়তো নতুন কিডনি নিয়েও বেশিদিন বাঁচতেন না আব্বা, ডাক্তারা এমনই বলেছিলেন। তা হলেও পৃথিবীর আলো হাওয়ায় স্ত্রী সমত্মানদের মাঝে আরও কটা দিন বেশি বাঁচার আকাঙ্খা কি ছিল না আব্বার! এখন তাঁর কত টাকা! তিন লাখ টাকার বান্ডিল অবহেলায় গাড়ির সিটেই ফেলে রাখেন আফজাল সাহেব।

ফেলে আসা জীবনের কত স্মৃতি মুছে গেছে তাঁর মন থেকে। কিন্তু আব্বা বালিশে হেলান দিয়ে পাটিতে বসে আছেন পা ছড়িয়ে। তাঁর চোখে মুখে উৎকন্ঠা হতাশা আর পরাজয়। এই দৃশ্যটা চেষ্টা করেও কিছুতেই ভুলতে পারেন না আফজাল সাহেব। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে গাড়ির দিকে এগিয়ে যান তিনি। কখন যে তাঁর দুচোখ জলে ভরে উঠে, গাল বেয়ে নামতে থাকে সে গরম জল। ঘড়িটা হাতের মুঠোয় নিয়ে হাঁটতে থাকেন তিনি। ঘড়িটা কখনো পরবেন না আফজাল সাহেব। তিনিতো হাতে কখনোই ঘড়ি পরেননি!


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu