পিন্টু রহমান
১৩ অক্টোবর ১৯৭৫ খ্রি: চুয়াডাঙ্গার কুমারী গ্রামে জন্ম, পৈত্রিক ঘরবসতি কুষ্টিয়া জেলার বাজিতপুর গ্রামে। মাতা: জিন্নাতুন নেছা ও পিতা: বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিবর রহমান। তিনি একজন কথাসাহিত্যিক। গল্পের ছলে ভাষার আঞ্চলিকতায় চিত্রায়ণ করেন বাঙাল-জনপদের বহুমাত্রিক জীবনাচার। উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থ: পাললিক ঘ্রাণ (গল্পগ্রন্থ), পূরাণভূমি (উপন্যাস), কমরেড (উপন্যাস), পরাণ পাখি (গল্পগ্রন্থ)
পিন্টু রহমান

গাছটিও যোদ্ধা ছিল

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

পিন্টু রহমান-এর কিশোর গল্প


গাছটিও যোদ্ধা ছিল


সব হারিয়ে ছেলেটি বৃক্ষের শাখায় আশ্রয় নেয়। ছেলে বলতে আমার বন্ধু বিপু। কতই বা বয়স তখন! এই বারো কিংবা তের। লেখাপড়া ভালো লাগতো না তার। স্কুল পালিয়ে গাছের শাখায় বসে থাকতো। নানান সুরে বাঁশি বাজিয়ে পথচলতি মানুষকে চমকে দিত। বিপুকে যেমন আমার পছন্দ তেমনি বাঁশিকে; সুর শিখতে তাকে ওস্তাদ মেনেছিলাম। ঝোপের আড়ালে বই লুকিয়ে মাঝে মাঝে আমিও স্কুল পালাতাম। পায়ে পায়ে গাছের কাছে পৌঁছে যেতাম; পৌঁছে যেতাম বিপুর কাছে।

ভয়ে গাঁ ছমছম করতো। কী বিশাল গাছরে বাপ! নির্জন মাঠের মাঝখানে বটপাকুড়ের গাছ। বামে সোনাকান্দরের বিল ও ডানে খরস্রোতা কুমার নদ। গাছের নিচ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে সরু রাস্তা। রাস্তার সামনে পিছনে বেশ কয়েকটি গ্রাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় গ্রামগুলো বেশ নিরাপদ ছিল। রাস্তার অভাবে পাকসেনারা এদিকটা এড়িয়ে চলতো। তাদের যাতায়াত ছিল আলমডাঙ্গা শহর থেকে হাটবোয়ালিয়া পর্যন্ত। মাঝে মাঝে গাংনী হয়ে মেহেরপুর কিংবা কুষ্টিয়া পর্যন্ত পাকসেনাদের বহনকারী গাড়ি সাঁই সাঁই করে এগিয়ে চলতো।

পরিস্থিতি দ্রুত বদলে গেল। মুজিবনগরে প্রবাসী সরকারের শপথ অনুষ্ঠিত হলে বাংলাদেশের কোনো এলাকাই আর নিরাপদ রইলো না। মুক্তিযোদ্ধাদের আনাগোনাও বেড়ে চললো। কাঁধে অস্ত্র ঝুলিয়ে সারিবদ্ধভাবে গাছের নিচ দিয়ে তারা বীরদর্পে হেঁটে যেত। একদল মুক্তিযোদ্ধাকে ওই গাছের নিচে আমি থামতে দেখেছিলাম। বিপুর নাম ধরে একবার ডাক দিয়েছিল। আমিতো অবাক। গাছের ঘন-সবুজ পাতার আড়ালে বিপুকে দেখলো কী করে? নাকি আগে থেকেই ওরা বিপুর খবর জানতো?

বিপু দেরি করে না; চোখের পলকে গাছের মগডাল থেকে নিচে নেমে আসে। ডান হাত কাপাল বরাবর উঁচু করে বিপু তাদের স্যালুট জানায়। নিচু কণ্ঠে কমাণ্ডার জিজ্ঞেস করে, এদিক দিয়ে অপরিচিত কাউকে যেতে দেখেছো?

জ্বি, দেখেছি।

উদ্বিগ্ন মুখে কমাণ্ডার জিজ্ঞেস করে, কে?

দুজন ফকির। আমি তাদের চিনি।

একসাথে গেছে?

না, আলাদা আলাদা।

ঝোলা ছিল তাদের কাছে?

ছিল। তবে চেক করে দেখেছি।

বিপুর পরের কথাগুলো ঠিকঠাক বুঝতে পারি না। ফকিরের কাঁধে ঝোলা থাকবে না? তাছাড়া চেক করার মতো কি আছে? আমি জানতে চাইলে বিপু বলে– ধুর বোকা, ওসব তুই বুঝবি না!

বলে কি বিপু! আমি বোকা! মনে মনে কষ্ট পেয়েছিলাম। পরে বুঝিয়ে বলেছিল– দিনকাল ভালো না মিন্টু, কার মনে কি আছে বোঝা দায়; তাছাড়া পাগল-ছাগল, ফকির-ফাকরার বেশ ধরে এলাকায় গুপ্তচররা ঘুরছে, মানুষের চোখ ফাঁকি দিয়ে রাজাকারদের হাতে অস্ত্র পৌঁছে দিচ্ছে।

বিপুর কথা পরে বুঝেছিলাম। ওই মুহূর্তে ছেলেটিকে অনেক বড় ও বুদ্ধিমান মনে হয়েছিল– বিপু, তুই মুক্তিযোদ্ধা?

নাহ, বিপু সেদিন নির্দিষ্ট কিছু বলতে পারেনি। তার মধ্যেও সংশয়। অস্ত্র না থাকলে যুদ্ধ করবে কিভাবে! অথচ আমাদের বিপু যুদ্ধ করেছে। গাছটাকে সঙ্গী করে ছেলেটি অসম যুদ্ধে নেমেছিল। নির্জন মাঠের ওই গাছটিই হয়ে উঠেছিল বিপুর শেষ আশ্রয়। অতর্কিতে একদিন পাকবাহিনী ও রাজাকাররা আমাদের গ্রামে হামলা চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের না পেয়ে নির্বিচারে সাধারণ মানুষকে হত্যা করে; বাড়িঘরে আগুন লাগায়। দিপু শুধু ঘর নয় বাবা-মাকেও হারিয়েছে!

কেউ নেই ছেলেটির। এতিম। বাবা-মার লাশ সামনে নিয়ে খুব কেঁদেছে বিপু। তার কান্নায় কেউ চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি। বন্ধুর পিঠে হাত রেখে আমিও কাঁদি। আমাকে জাপটে ধরে বিপু বলে– আমার এখন কী হবে রে মিন্টু! কে আমাকে আদর করবে?

মুক্তিযোদ্ধারা নির্বিকার। সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পায় না। বিপুর কাছে ঋণী তারা। তার জন্যই অল্পের জন্য পাকবাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে! গাছের নিচ দিয়ে হানাদারদের যেতে দেখে দিপু লাল পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিল! মুক্তিযোদ্ধারা বুঝে গিয়েছিল, বিপদ আসন্ন। সেদিন যদি গাছের মাথায় লাল নিশান উড়িয়ে না দিতো, যোদ্ধারা নিশ্চিত হাতেনাতে ধরা পড়তো।

দিপু বাঁশি বাজায়। মাঠের কিনারে বসে আগের মতোই বাঁশিতে সুর তোলে। কিন্তু সুর বদলে গেছে– করুণ সুর ছাড়া আর সব সুর ভুলে গেছে। রাত নামলে ওই সুর ভিন্ন মাত্রা পায়। সুরের মূর্ছনায় আসমান জমিন একাকার হয়! দিনের আলোয় দিপু খুব ব্যস্তসমস্ত। গাছের মাথায় পতাকা হাতে পাকবাহিনীর জন্য অপেক্ষা করে। আলামত খারাপ দেখলে গাছের মাথায় লাল পতাকা উড়িয়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা তখন নিরাপদে আশ্রয় নেয়। কিংবা ফেরার পথে তাদের গতিরোধ করে। চোখের সামনে ছেলেটি অনেক পাকসেনা ও রাজাকারকে মরতে দেখেছে। মন-মেজাজ ভালো থাকলে আমাকে কাছে ডেকে শোনায়– তোর মতো গাছটিও আমার বন্ধু। আমি যোদ্ধা হলে গাছটি হবে সহযোদ্ধা, কী বলিস?

আমি কিছু বলতে পারি না। গাছের ভাগ্য দেখে হিংসে হয়। হায়, আমিও যদি যোদ্ধা হতে পারতাম!

বহু বছর পরে আমার আক্ষেপ ঘুঁচেছে। রাজনৈতিক পরিচয় ও অর্থকড়ি খরচ করে আমি এখন তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা। আমি একা না, যুদ্ধ না করেও অনেকে তালিকাভুক্ত হয়েছে; সরকারের দেওয়া বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা তারা ভোগ করছে। কিন্ত কোনো তালিকাতে বিপু কিংবা গাছটির নাম নেই! থাকবে কি করে, গাছটিও যে আর নেই! রাজাকাররা কেটে ফেলেছে। সেদিন ছিল শনিবার– বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পেতে দুজন রাজাকার ও আটজন পাকিস্থানী সৈন্য গাছের নিচে আশ্রয় নিয়েছিল। বিপু সম্ভবত এমন একটা দিনের জন্যই অপেক্ষা করতো। লাল পতাকার পরিবর্তে তার চোখ বৃক্ষের সবুজ পাতায়। গভীরভাবে শত্রুদের অবস্থান লক্ষ করে। তারপর হাতে থাকা গ্রেনেড ছুঁড়ে মারে। সেকি ভয়নক বিস্ফোরণ! এলাকাটি কেঁপে ওঠে। মানুষের মাঝে আতঙ্ক আর উত্তেজনা। গাছের মাথায় সবুজ পতাকা। পতপত করে উড়ছে। নির্ভয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ছুঁটে আসে। অবাক কাণ্ড! চারদিকে ছড়ানো ছিটানো লাশ। কিন্তু বিপু কোথায়! না, বিপু নেই; দশটি লাশের মধ্যে একটি লাশ তার নিজের! রক্তে ভেজা শরীর! শত্রুপক্ষকে নিধন করতে ছেলেটি আত্মহুতি দিয়েছে!

অনেকদিন গত হয়েছে। বিপুও নেই গাছও নেই। অনেকেই তাকে ভুলতে বসেছে। কিন্তু আমি পারি না, বিপু আমার বন্ধু। মুক্তিযোদ্ধা। গাছটির কথাও মনে আছে। নতুন আরেকটি গাছ লাগিয়েছি। মাঝে মাঝে সেখানে গিয়ে দাঁড়াই। বিপুর স্মৃতি তখন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ওইতো বিপু দাঁড়িয়ে। লাল-সবুজের পতাকায় পতপত করে উড়ছে!

———-সমাপ্ত———-

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu