স্ত্রীটি ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে, ‘নিজের গলদ চোখে পড়ে না, শুধু শুধু আমার দোষ। আমি তো আবাদি জমি। আমার কী করার আছে। নিজে শোধরাও। তোমার কোনো খুঁত আছে কিনা সেইটে চিন্তে কর।’
‘অন্য জায়গায় বিয়ে করলে এতদিন ঠিকই একটা কিছু হতো। দেখোনা মা তার একটা নাতির জন্যে দিনরাত কবরেজ, বৈদ্যবাড়ি কীভাবে দৌড়ে বেড়াচ্ছে।’
‘ছেলেপিলে তো আমিও নিতে চাই। আমার কষ্ট তো তুমি বুঝতে চাও না। সন্তান ছাড়া যে মেয়ে মানুষের জীবন বৃথা, আমার এ জ্বালা তোমাকে বুঝাতে পারব না। অযথা ঝগড়া করে লাভ নেই। চল দুজনই আবার ভালো ডাক্তার দেখায়।’
তারপর আপনা থেকেই ক্রমাগত বকবক করতে থাকে, ‘স্কুলে গিয়ে সামান্য মাস্টারগিরি কর আর সারাদিন কাজ কর্ম নেই। বাড়ি এসে মাঝেমাঝেই মা’র সাথে খামাখা ছেলেমেয়ে করে সুর মেলাতে থাক। অনেকেরই তো ছেলেপিলে নেই, তাদের জীবন চলছে না। এতই যদি ছেলেপিলের শখ, তাহলে আরো বড় ডাক্তারের কাছে নেওনা ক্যানে।’
‘কই, কম তো দেখালাম না। ইন্ডিয়াতেও দুবার নিয়ে গেলাম, এখন আর কী করব।’
স্বামীর বিরক্তিসূচক কথা শোনার পর তার গলার স্বর উচ্চগ্রামে ওঠে, ‘কী! তাই বলে চুপচাপ বসে থাকবে। আর কোথাও যাবে না। জায়গামত যেতে পারলে ঠিকই একটা ব্যবস্থা হবে। অকর্মের ধাড়ি কোথাকার!’
‘কে অকামের, কে ঢিমা, সময় হলে ঠিকই বুঝা যাবে। কিছু বললেই যখন তখন গোখরো সাপের মতো শুধু ফোঁস করে ওঠো।’
স্ত্রীটি সত্যি সত্যি এবার ফোঁস করে ওঠে, ‘কি আমি গোখরো সাপ!’ এবং ক্রোধাম্মত্ত হয়ে আক্রোশের সাথে গরগর করতে থাকে, ‘হ্যাঁ আমিতো গোখরো সাপই। আমার ঠিকই বিষ আছে তোমার তা থাকলে এতদিন বাসাটা ফুলে ফলে ভরে উঠতো।’ আবার একটু দম নিয়ে রাগ সামলাতে না পেরে বলতেই থাকে, ‘তুমি তো একটা ঢোঁড়া সাপ, শুধু শরীর ভর্তি রাগ। সামনে পেলেই ছোবল-কামড়। কিন্তু তাতে লাভ কী? বিষ নেই। বিষ থাকলে এক ছোবলেই লেগে যায়।’
এভাবে দুটিতে লেগেই ছিল। দু’চার দিন ভালোই কাটে, তখন প্রণয়লীলায় জীবন পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। আবার মেজাজ বিগড়ে যায়। কখনো পুরুষটির, কখনো স্ত্রীলোকটির। জ্বলে আর নেভে জোনাকির মতো। তাদের বিয়ে হয়েছে প্রায় আট বছর। মাঝেমধ্যে ঝগড়া লাগলেও অধিকাংশ সময় একে অপরের প্রতি তীব্র অভিনিবেশ। নিখাদ অনুরাগ এবং প্রবল টান। দুজনের একজন টিচার, অন্যজন হাউজওয়াইফ। সংসারে বিত্ত-বৈভব না থাকলেও অভাব নেই। কিন্তু অনুযোগ আছে, একজনের কাছে অন্যের সন্তান প্রাপ্তির অভিযোগ। এই অভিযোগ প্রায়শ মনেমনে এবং কদাচিৎ প্রকাশ্যে।
রোজিনা কোনোমতে এসএসসি পরীক্ষায় পাশ করলেও কোনোদিন কলেজে পা রাখেনি। পাশ করে বেশিদিন বসে থাকতে হয়নি। দু’বছরের মাথায় বিয়েটা হয়ে যায়। বিয়ের সাত বছর অতিক্রান্ত হলেও ফলাফল শূন্য। বয়স ছাব্বিশ পেরিয়ে সাতাশে পা দিয়েছে। এখন আর কিশোরী ভাবটি নেই। জলজ্যান্ত দীর্ঘাঙ্গিনী মহিলা। একটু মোটা, আঁটসাট শরীর। দুই বাহুতে পুরুষের মতো লোম দৃশ্যমান। শ্যামলা ডিমালো মুখখানায় কোথাও ক্লান্তির ছাপ না থাকলেও কেমন যেন দুঃখী দুঃখী মনে হয়। সবসময় পান খেয়ে ঠোট জোড়া লাল করে রাখে। সন্তান না হলেও শরীরের কোথাও রূপ-মাধুর্যের ঘাটতি নেই। বর্ষার প্রথম কদম ফুলের মতো দৃষ্টিনন্দন ফিগার। হাঁটতে গেলে তার পেছনদিকও প্রকৃতিগতভাবে শরীরের পূর্বভাগ দেখার জন্যে আকর্ষণ করে।
চারপাঁচ বছর খুব একটা গা মাখেনি। পাঁচ বছর যেতে না যেতেই সন্তানের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে রোজিনা। বন্ধ্যা অপবাদ ঘোচানোর জন্যে সবলে অস্থির হয়ে পড়ে। স্বামীও পিতৃত্বের দাবীদারে, অপারগতায় যত্রতত্র প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে। টনক নড়ে দুজনেরই। তাদের সাধ্যানুযায়ী ক্রমাগত শরণাপন্ন হয়- কবরেজি, হেকিমি, হোমিওপ্যাথি এবং এলোপ্যাথি। কেউই যথাযথ মাসিককে হার মানাতে পারেনি। ফলে তার উদর একজন অনুঢ়া ললনার ন্যায় অপুষ্ট, অনুন্নত ও অপরিবর্তনশীলই রয়ে যায়। নিষিক্ত বা স্ফীত হবার কোনো সুযোগই আসে না।
ছোট সীমান্ত শহর মেহেরপুর। মাত্র চার-পাঁচ মাইল দুরেই নদীয়ার সীমানা। অনতিদূরেই শান্তিপুর এবং কৃষ্ণনগর। এই শহরের প্রায় ষাট শতাংশ লোকের শেকড়ই ওপার বাংলায়- নদীয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, কৃষ্ণনগরে। দেশভাগের আগে-পরে মাইগ্রেশনে এদেশে। রোজিনাদের শেকড় ওপারেই। সন্তানের প্রত্যাশায় সাবলীলভাবেই পাড়ি দেয় ওপারে। কৃষ্ণনগর, কলকাতায় ডাক্তার দেখিয়ে ফেরে আবার মেহেরপুরে, বাংলাদেশে। দিন যায়, ওষুধ খায়। তবু শরীরে বর্ষা এসে ভর করে না। কিন্তু মাদুলি, তাবিজ, কবজে শরীর ভরে যায়।
মফস্বলের টিচার রজবালি কারো কাছে শুনেছে, বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় নিঃসন্তান দম্পতিদের সন্তান প্রাপ্তির বিষয়ে নানারকম বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। তারপর নিয়মিত পাবলিক লাইব্রেরিতে বিভিন্ন দৈনিকে বিজ্ঞাপন অন্বেষণ। ইত্তেফাক, প্রথম আলো, কালের কণ্ঠ, যুগান্তর, ভোরের কাগজ, যায়যায়দিন, সমকাল ইত্যাদিতে র্যাডার সার্চিং।
একদিন কোনো এক দৈনিকে কাঙ্ক্ষিত বিজ্ঞাপন পেয়ে যায়। স্বামী-স্ত্রীতে অমিল, প্রেমে ব্যর্থতা, ব্যবসায়ে লোকসান, রতিক্রিয়ায় অপারগতা, সন্তান লাভে অক্ষমতা ইত্যাদি সমস্যার নিশ্চিত চিরস্থায়ী অবসান। বিফলে মূল্য ফেরত। বিজ্ঞাপনের উদ্দিষ্ট অংশটুকু ফটোকপি করে বাসায় ফেরে, আর ইউরেকা! ইউরেকা! বলে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে। তারপর বিজ্ঞাপন দেখায়। চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে দু’জনেই খুশি। জীবনের শেষ চিকিৎসা হিসেবে বিজ্ঞাপনদাতা খাজায়ে তকদির, সুলতানুল মহব্বত, পিরে নসিবাবাদী পিরবাবার দর্শনলাভের জন্যে দুজনেই একমত পোষণ করে। সন্তানলাভের আশায় নিশ্চিতভাবে বুক বাঁধে।
গাঁয়ের নিকটতম পড়শির ঢাকার বাড়ি বাসাবো। পিরবাবার কাছে চিকিৎসার জন্যে ঢাকায় এসে প্রথমে তারা বাসাবোয় ওঠে। রজবালি এর আগে ঢাকায় দু’একবার এলেও নির্ধারিত স্থানের বাইরে সবই অজ্ঞাত। বাসাবো থেকে সায়েদাবাদের উদ্দ্যেশে রিকশায় রওনা দিয়ে সায়েদাবাদ আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালে না পৌঁছেই ভুলক্রমে তারা গোলাপবাগে নেমে পড়ে। একজনকে অভিপ্রেত বিষয় জিজ্ঞেস করতেই টিটিপাড়া মহাসাধক সিদ্ধিবাবার দর্শনলাভের জন্যে পথ বাতলে দেয়। কিন্তু গোলাপবাগেই চোখে পড়ে পত্রিকায় দেখা কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যস্থানের বিজ্ঞাপনের চেয়ে আরো জোরালো এবং উদ্দীপ্ত সাইনবোর্ড। এসব চিত্তগ্রাহী সাইনবোর্ডের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য আশপাশে জিজ্ঞাসা করে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। স্ত্রীটি বলে,‘যার দর্শন লাভের জন্যে ঢাকায় এসেছি, সেই হুজুর নসিবাবাদীর কাছেই যাব।’
তারপর তাদের রিকশা পিরে নসিবাবাদীর অবস্থানস্থল সায়েদাবাদের উদ্দেশ্যে চলতে থাকে। পথে গোলাপবাগ, টিটিপাড়ার ন্যায় একই অভীষ্ট লক্ষে প্রদর্শিত আরো চোখ ধাঁধাঁনো, প্রাণজুড়ানো সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। তবু তাদের রিকশা থামে না। সুমুখে চলতে থাকে। এবং চলতেই থাকে।
একসময় তারা কাঙ্ক্ষিত পিরবাবা নসিবাবাদীর দরবারে পৌঁছে যায়। পাকা দোতলা চমৎকার ফ্লাট বাড়ি। সামনে রুগি দেখার জন্য দোকানের মতো বড় রুম। ভেতরে আরও চারটে রুম। যেখানে মহিলাদের সাহায্যে মহিলা রোগি দেখা হয়, যেখানে ওষুধ তৈরি করা হয় ইত্যাদি। সামনের রুমটায় বড় হরফে আরবিতে লেখা একটা বিস্তৃত প্রাচীরপত্র। পিরবাবার সামনে ৫ ফিট ৩ ফিট সাইজের বড় একটা টেবিল, তার ওপর পুরু স্বচ্ছ কাঁচ, যার নিচে রয়েছে বিভিন্ন দোয়া দাওয়ার গুনাগুন সম্পর্কিত বিশদ বিবরণ। টেবিলটাকে সামনে রেখে স্প্রিং লোডেড রিভলভিং চেয়ারে উপবিষ্ঠ পিরবাবা। তার পেছনে একটা নরকংকাল, একটা হোমিও চিকিৎসার অগ্রদূত হ্যানিম্যানের প্রতিকৃতি, একটা ইউনানি ভেষজ গুনাগুন সংক্রান্ত পোস্টার। আর র্যাকগুলোয় থরে বিথরে সাজানো ইউনানি, হালুয়া এবং মোদকজাতীয় কবরেজি ওষুধ। ডানপাশে পর্দার আড়ালে কম্পাউন্ডার নিবিষ্টচিত্তে কর্মরত। বামপাশে আগত রোগিদের ওয়েটিং প্লেস।
পিরবাবার সুরতে আভিজাত্যের নকশা। মাঝারি গড়নের পেটানো শরীর। মজবুত পেশি। কব্জিগুলি বেশ মোটা মোটা। নয় ইঞ্চি বিঘতেও বেড় পাওয়া সম্ভব নয়। পিরবাবার মুখে সুবিন্যস্ত মুখভর্তি কাল কুচকুচে দাঁড়ি। দেখলেই বোঝা যায়, দাড়িগুলো সবসময় ছোট করে ইঞ্চির ভেতর সীমাবদ্ধ রাখতে পছন্দ করেন। অনেকটা হিন্দি ফিল্মি হিরো নানা পাটেকরের মতো। তবে মাথায় পানসি নৌকোর মতো কালো জিন্নাহ টুপি। পরনে শ্বেতশুভ্র পাজামা পাঞ্জাবি। পঞ্চাশ অতিক্রম করলেও সুন্দর মুখশ্রী পিরবাবার বয়সকে আড়াল করে রেখেছে। মহাতান্ত্রিক ধর্মনিষ্ঠ পিরবাবা প্রথমেই উপস্থিতি রোজিনার সহগামি স্বামীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন।
‘কখনো ভাল ডাক্তার দেখিয়েছেন? সেমিনাল এনালাইসিস করিয়েছেন? কোনো সমস্যা পাওয়া গিয়েছিল?’
‘ডাক্তার দেখিয়ে পরীক্ষা করিয়েছি। আমার কোনো সমস্যা পাওয়া যায়নি।’
‘সবুর করেন। আর আমার ওপর বিশ্বাস রাখেন, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
এরপর পিরবাবা রোজিনার কাছে জানতে চান, ‘আপনি কোনো লজ্জা করবেন না। যা যা জানতে চাই, কোনোকিছু গোপন করবেন না। আপনার কি কখনো এসব ব্যাপারে ব্লাড, ইউরিন টেস্ট করা হয়েছিল? রিপোর্ট কি ছিল?’
রোজিনা জানায়, ‘সব টেস্টই করা হয়েছে। কেউ কোনো সমস্যার কথা বলেনি।’
তারপর বলে, ‘পিরিয়ড কি নিয়মিত হয়? ’
‘জি কোনো সমস্যা নেই।’
‘দিন-সময় হিসেব করে কি কখনো একত্রিত হয়েছে?’ অত্যন্ত মোলায়েম এবং মার্জিতভাবে সমস্যাগুলো জেনে নেন পিরবাবা। যেহেতু অতি জটিল, গোপনীয় এবং পুরাতন (যেমন হোমিওপ্যাথিক সাইনবোর্ডে দৃশ্যমান) রোগের চিকিৎসক, সে কারণে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পিরবাবা ভাল জ্ঞান রাখেন। ধর্মধ্বজি পিরবাবা অত্যন্ত পটু ও কুশলি ব্যক্তি। সকল বিষয়ে ওয়াকিবহাল একজন চৌকস চিকিৎসক, বিজ্ঞ কবরেজ এবং সর্বোপরি একজন মহাতান্ত্রিক সাধক পুরুষ। তার কাছে তন্ত্র-মন্ত্র, দোয়া-দাওয়া, কবরেজি, ভেষজ, ইউনানি সকল চিকিৎসাই রয়েছে। কেউ তার কাছে এলে ফেরত বা বিফলে যাবার অবকাশ নেই।
মহাতান্ত্রিক সাধক পিরবাবা সরল অংকটা এভাবে মেলান। এমনও তো হতে পারে। কোনো কারণে গত সাত বছরে আগত দম্পতি যথার্থ এভ্যুলেশনের সময় মিলিত হতে পারেনি। এভ্যুলেশনের সময় অভীষ্ট লক্ষে যথাযথ কপ্যুলেশন করা হলে প্রয়োজনীয় সুফল আশা করা যেতে পারে। পিরবাবা ভাবেন, ওভ্যুলেশনের সময়টাই হয়তো তারা বোঝে না। এবং বিষয়টি নিয়ে হয়ত তারা গভীরভাবে মাথাও ঘামায়নি। ওভ্যুলেশনের সময় হল পিরিয়ডের বারোতম দিন থেকে ষোলতম দিন পর্যন্ত। হতে পারে দর্শনার্থী দম্পত্তির অন্যকোনো সমস্যা আছে। আর যদি তা না হয়, স্বাভাবিকভাবে কনসিভ ব্যাহত হলে সন্তানলাভের উদ্দেশ্যে প্রথম মাসে বারোতম দিন, দ্বিতীয় মাসে তেরোতম দিন, তৃতীয় মাসে চৌদ্দতম দিন, এভাবে ষোলতম দিন পর্যন্ত। হিসেব নিকেশ করে নিরলসভাবে চেষ্টা করে যেতে হবে।
জিজ্ঞাসাবাদের পর পিরবাবা বলেন, ‘খোদার প্রতি বিশ্বাস রাখবেন আর আমার প্রতি ভরসা রাখবেন। নিশ্চিত আপনাদের সন্তান হবে। কোনো চিন্তা করবেন না।’
পিরবাবার আশ্বাসে খুশিতে রোজিনার দেহমন বিগলিত হয়ে ওঠে। বিরাণ তপ্ত মরুভুমিতে বর্ষণের আগে মেঘের আভা দেখে তার চোখ জ্বলজ্বল করে। ফসলের আশাবাদে শূন্য বুক তৃপ্তিতে ভরে যায়। ময়ুরের মতো পেখম মেলে নাচতে ইচ্ছে করে। কারণ ইতিপূর্বে দুজনেই দেখেছে– পিরবাবার দরবারে এসে কেউ নিরাশ হয়নি। এইতো কদিন আগেও পত্রিকায় দেখেছে, পিরে নসিবাবাদীর দোয়ায় এক নিঃসন্তান দম্পতির কোলে হাস্যোজ্জ্বল শিশুর ছবি। সবই পিরবাবার কেরামতি। সবই দর্শনলাভের ফলশ্রুতি। অব্যর্থ ফয়সালা।
মহাসাধক পিরবাবা কাঁচের বোতলে পানি ফুঁ দিয়ে পড়ে দেন। একটা মাদুলি ধারণ করতে বলেন, কিছু ভেষজ ওষুধ দেন। এবং নিয়মিত সেবনের জন্য ব্যবস্থাপত্র লিখে দেন। তারপর বলেন, ‘পিরিয়ডের বারোতম দিন গোসল করে পাক সাফ হয়ে সকাল দশটার মধ্যে এখানে আসার চেষ্টা করবেন। আসার আগের দিন রাতে ‘মোকাব্বি আজম’ নামে যে হালুয়া জাতীয় ওষুধটা দেয়া হয়েছে, সেটা দুই ডোজ খাবেন।’
পর্দার আড়াল থেকে এ সময় মহিলা হেকিম তাকে ডেকে নেয় এবং পিরবাবার পরামর্শ ও বিধানগুলো বিশদভাবে পঁইপঁই করে তাকে বুঝিয়ে দেয়, ‘নিয়মের কোনোরকম হেরফের করা যাবে না। এদিক ওদিক হলে সব গড়বড় হয়ে যেতে পারে। পিরবাবা অনেক জ্ঞানী মানুষ, উনি বেশি কথা বলা পছন্দ করেন না। উনার এককথা আমাদের হাজার কথার সমান। তার মুখের কথা কখনো বিফলে যায় না।’
নির্ধারিত দিন কাঁটায় কাঁটায় সকাল দশটায় রোজিনা স্বামীসহ পিরবাবার দর্শনার্থী হিসেবে হাজির হয়। দুএকজন পুরনো, জটিল রুগি ছাড়া অন্যদেরকে সেদিনের মতো তাড়াতাড়ি বিদেয় করে পিরবাবা রোজিনার কেসটা হাতে নেন। এবার তার সামনে রোগির আসনে বসে রোজিনা। পিরবাবা জেরা শুরু করেন, ‘এ কয়দিন কেমন কাটলো। ওষুধ নিয়মিত সেবন করেছেন তো। আজকে আরো কিছু নতুন দোয়া-দাওয়া দিতে হবে। প্রয়োজন হলে আরো দুই একবার আসতে হবে। তার আগে এখন আমার মহিলা হেকিম দ্বারা আপনার একটু স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো দরকার।’
বলতে বলতেই ভেতর থেকে সেই মহিলা হেকিম রোজিনাকে ডেকে নেয়। আর পিরবাবা স্বস্থানে উপবিষ্ট থেকে রোজিনার স্বামীকে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ এবং দাওয়াই খাবার ব্যাপারে উপদেশ দিতে থাকেন। অনেক বিশ্বাসযোগ্য ঘটনার বিষয় অবতারণা করেন। বলতে থাকেন, ‘এখানে এসে অমুক শিল্পপতির ছেলের বাচ্চা হয়েছে, অমুক অফিসার দম্পতির সন্তান হয়েছে। কেউই খোদার দয়া থেকে নিরাশ হয়নি।’
মহিলা হেকিম পিরবাবার বিশেষ চিকিৎসা রুমে নিয়ে রোজিনাকে প্রথমেই ‘মারদুমি সঞ্চয়’ নামে তরল দুই ডোজ যৌন উদ্দীপক ওষুধ খাইয়ে দেয়। তারপর বলতে থাকে, ‘দেখো বোন জগতে যে নারীর সন্তান নেই, তার জীবন বৃথা। তার বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়া সমান কথা। লোকে বলে, বাজাঁ। আটকুঁড়ি বলে অনেকেই সাক্ষাতে অসাক্ষাতে গালি দেয়। অনেক মহিলাই আটকুঁড়ির কোলে তার শিশু সন্তান দিতে চায় না। সকালে এমন মহিলার মুখদর্শনও অনেকে কুলক্ষণ ভাবে।’ একটু থেমে আবার বলতে থাকে, ‘বাচ্চা না হওয়ার জন্যে এদেশের অনেক মেয়েরই সুখের সংসার ভেঙ্গে গেছে। তুমি কি চাও না? তোমার কোল আলো করে একটা ফুটফটে বাচ্চা আসুক। নাহলে তোমার শাশুড়িই একদিন বলবে, আমার এমন বাঁজা বউয়ের দরকার নেই। ও ব্যাটা, তুই ওই বৌকে তালাক দে। তোকে আবার বিয়ে দেব।’
রোজিনার বুকটা হাহাকার করে ওঠে, ‘আপা আর বলবেন না, আমার একটা বাচ্চা চাই। আপনারা দোয়া-দাওয়া দিয়ে যেভাবেই হোক ব্যবস্থা করেন।’
মহিলা হেকিম বুঝতে পারে, মোটিভেশনে বরফ গলতে শুরু করেছে। পুনরায় বলেন, ‘এখন পিরবাবা এখানে এসে তোমাকে ভাল করে দেখবেন। যা যা বলবেন কোনোকিছুতেই না করো না। এমন মানুষের সাক্ষাত পাওয়াও চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্যি। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সন্তান না হলে তোমার জীবনের কোনো দাম নেই। ঠিক আছে, তুমি বস, আমি তাকে ডাকছি।’
এই বলে মহিলা হেকিম আবার সামনের রুমের দরজার কাছে যায়। ‘স্যার, আপনি কি রোগিকে একটু দেখবেন?’
সামনে আগত মক্কেলকে একমিনিট বলে পিরবাবা ভেতরের রুমে চলে আসেন। পিরবাবাকে লক্ষ করে মহিলা হেকিম বলে, ‘এই যে বোন, ঠিকঠাক মতো উনার খেদমত করো। মনেরেখ সেবাতেই সিদ্ধিলাভ।’ কথাগুলো রোজিনা বোবার মতো শোনে কিন্তু কোনো উত্তর দেয় না। মহিলা হেকিম তার তালিম ও প্রণোদনা শেষ করে তাকে পিরের কাছে রেখে কক্ষত্যাগ করে।
পিরবাবা জিজ্ঞাসা করেন, ‘সব ঠিক আছে তো?’
শুনে রোজিনা রা করে না। রোজিনা চুপচাপ থাকে। একেবারে বোবা বনে যায়। দুরাচার ধড়িবাজ পির নিজ থেকেই অগ্রসর হয়। সুযোগ বুঝে সে দেয়ালে ঢাকা নীল কাপড়ের পর্দাটা টেনে সরিয়ে ফেলে। ভেসে ওঠে নারী-পুরুষের যুগল মৈথূন দৃশ্যের আবক্ষ পোস্টার। এসব দেখে রোজিনা ঘোরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। এবং শয়তান পির ক্রমশ উম্মোচনে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
রোজিনা লাগোয়া বাথরুমে ফ্রেস হয়ে বের হওয়ার আগেই ফন্দিবাজ পির রুম থেকে বার হয়ে যায়। আর এ সময়েই মহিলা হেকিম রঙ্গলীলা স্থানে প্রবেশ করে। এবং বলতে থাকে, ‘দেখো বোন, এ ঘটনা জীবনে ভুলক্রমেও কাউকে বলবে না। বললে তোমারই ক্ষতি। জানলে তোমার স্বামী তোমাকে তালাক দেবে। তোমার সংসার ভেঙে যাবে। আর একটা সন্তান হলে ঐ পরিবারে তোমার কদর বেড়ে যাবে, আদর যত্নের সীমা থাকবে না। সবাই তোমাকে মাথায় তুলে রাখবে।’
যাতে বিষয়টি রোজিনার কাছে সহজবোধ্য ও স্বাভাবিক মনেহয় এজন্যে পলকমাত্র বিরতি দিয়ে পুনরায় বলতে থাকে, ‘তোমার একটা বাচ্চা হলে মানুষের থোতা মুখ ভোতা হয়ে যাবে। কেউ আটকুঁড়ি, অলক্ষ্মী বলে নিন্দা করবে না। শোনো বোন, কিছু বুঝা না গেলে কিন্তু আগের মতো একইভাবে আবার পিরিয়ডের তেরোতম দিনে আসা লাগবে।’
কাকতালীয়ভাবে যথাসময়ে পিরিয়ড না হওয়ায় তারা দেড়মাস পরে পিরবাবার দরবারে উপস্থিত হয়। সবকিছূ শুনে পিরবাবা বলেন, ‘সবই নসীব। আশা করছি, আপনাদের মনোবাসনা পূরণ হতে যাচ্ছে। আমার কিছু করার নেই, আমি একজন অসিলামাত্র। এখন ক্লিনিকে গিয়ে একটা টেস্ট করে আসেন। মালিক চাইলে সবই সম্ভব।’
সায়েদাবাদ পলিক্লিনিক ডায়াগোনস্টিক সেন্টার। সেখানে অতি সহজেই পরখ প্রকরণ নমুনা প্রস্রাবে ডোবানো পদ্ধতিতে মুহুর্তেই ইউরিন টেস্ট করা হয়। ইউরিন টেস্ট রিপোর্ট পজিটিভ পাওয়া যায়। রোজিনা-রজবালি দম্পতির মাঝে নবজীবন ফিরে আসে। আনন্দে তারা উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। এ খুশিতে স্বামী-স্ত্রী দুজন হাসিমুখে কথিত খাজায়ে নসিব, সুলতানুল মহব্বত, পিরে নসিবাবাদী পিরবাবার সামনে সওগাতস্বরূপ ঢাউস সাইজের একটি মিষ্টির প্যাকেটসহ হাজির হয়। এরপর দরকারি কথাবার্তা সেরে প্রয়োজনীয় দোয়া-দাওয়া গ্রহণ করে। সবশেষে কার্যোদ্ধারের জন্যে কৃতজ্ঞতার প্রতিদান হিসেবে বিনিময়ে তারা এক হাজার এক টাকা নজরানা দিয়ে তাদের মফস্বল শহরের উদ্দেশ্যে প্রস্থান করে।