নয়ন মাহমুদ
কবি ও কথাসাহিত্যিক
নয়ন মাহমুদ

একুশ বছর আগের একদিন

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

আকাশে অশোক গাছের ছায়া, বিশাল সমুদ্রে মানুষের বসতি, সন্ধ্যার ফ্রাগমেন্ট সবকিছুর মিথস্ক্রিয়ায় গড়ে ওঠা জাদু ও বাস্তবিক প্লাটফর্মে ফুহাদ ভাবে, বস্তুত পাখিরা জানেনা মৃত্যুতে প্রাণের বিনাশ। কিন্তু সে জানে: এই জানার মধ্যে অনাবিল শূন্যতাবোধ, কৌতূহল, বিষণ্ণতা এবং কখনো কখনো মৃত্যু ভীতিও কাজ করে। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে নিজের মধ্যে সঞ্চিত স্ববিরোধের দিকে যখন সে তাকায়, তখন একটি লাল কুকুর বেলাভূমিতে মুখে তুলে নেয় সভ্যতার উচ্ছিষ্ট। সে স্বপ্নে নিকটাত্মীয়ের সাথে রতিক্রিয়ায় মেতে ওঠে, আবার ভোরের আলোয় বিবেকের মানদণ্ডে আত্মশ্লাঘায় জর্জরিত হয়ে স্রেফ জীবনের সাথে নিজের প্রাণকে মানিয়ে নেয়। কিন্তু সে জানে না এই স্ববিরোধের অর্থ। যেভাবে সে জানে না, নিজের সঙ্গে নিজের সম্পর্কের কথা। জীবনের অধিকাংশ সময় এই সমীকরণের সমাধান খুঁজতে সে মগ্ন, যখন মগজের কুঠরীতে বাস করে তার স্বপ্নে দেখা লাল কুকুর।

অন্ধত্ব ও জাগ্রত মুহূর্তে জীবন্মৃত আবু অন্তর্দ্বন্দের সমাধান খোঁজে শাহানার খোঁপায়, চিবুকে, স্তনে, পিঠে ও যোনিতে। সন্তান ফুহাদ যাদের বিস্মৃত অতীতের স্মৃতিচিহ্ন। হাসপাতালে মা, ছোট ভাইয়ের সফল সুইসাইড, অর্থের অনটন, বাবার পাগলামি, নির্জন একাকীত্ব আবুকে ঠেলে দ্যায় কঠিন পাথরের নিস্তব্ধ পরাবাস্তবতার দিকে।

সকালের আলোয় উঠানে উদ্ভাসিত অনাবিল নীলিমার ছায়া এসে পড়ে। প্রথম কোপে প্রাচীন আমগাছের তলায় বিগত দিনের গু কোদালে উঠে আসে। একটু সইরা গিয়া গর্ত কর, ফুহাদ। শাহানা হাঁক দ্যায়। পরম আনন্দে ভাঙা চেয়ারে বসে সিগারেটে ফুঁ দিতে দিতে হাগে আবু। ফুহাদের ‘স্বপ্নে দেখা লাল কুকুর’ এসে ঘুরঘুর ঘুরঘুর করে আশপাশে। একসময় গু খেয়ে পরিতৃপ্তির ঢেকুর তোলে ফুহাদের ‘স্বপ্নে দেখা লাল কুকুর’। এভাবে ‘স্বপ্ন’ বিনির্মিত বাস্তব কাঠামোয় এসে পেরেক ঠুকে? আবুর শরীরের পুরো বাম সাইড নিথর, অবশ, কিঞ্চিৎ কেজো, জড়। অদম্য স্পৃহায় ভাষার আশ্রয় নিয়ে যখন সে প্রকাশ করে নিজের সাব-কনশাস অনুভূতি, তখন আবুর চিন্তাচ্ছন্ন মনন বিচরণ করে মিনিমাম একুশ বছর আগের একদিনে। যদিও সময় বয়ে চলে অবিরাম এবং আকাশে রংধনুর মতো ঘটনাপ্রবাহ গড়ে তোলে বাস্তব আঙ্গিক। আবুর পরাবাস্তব দৃষ্টি সূর্যমূখীর মতো তাকিয়ে থাকে স্থবির অতীতে। আবুর আব্বা নিরুদ্দেশ, হাসপাতাল থেকে মায়ের লাশ কবেকার কোনদিন গোরস্থানে সমাহিত, ছোট ভাইয়ের সুইসাইড ডায়েরির পাতা লুপ্ত: এসব তথ্য মুছে গেছে আবুর মস্তিষ্ক থেকে। আবু ভগ্ন, ক্ষয়িত, বিপন্ন। শাহানার বিগত ফেলে আসা একুশ বছরের অতীত যখন আবুর বর্তমান।

চোখ খোলার আপ্রাণ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবার পর নিজেকে অন্ধ ভেবে, সীমাহীন বেদনা অনুভব করে আবু। নিমেষেই সে দেখে মৃতের হাড়ের ভেতর আলোর অস্তিত্ব বিবর্জিত অন্ধকার। যা ক্রমশ তার বিশুদ্ধ প্রাণে বিষাদের তীব্র কটু স্বাদের জন্ম দ্যায়। আবুর কণ্ঠস্বরে কুকুরের গুমড়ে ওঠা কান্নার স্বর। শাহানা দীর্ঘদিন যাপিত সাংসারিক অভিজ্ঞতায় একান্ত সংগোপনে জেনে ফেলে, প্রগাঢ় স্বপ্নের ধূম্র জটাজালে আবু বন্দী, শৃঙ্খলিত। আবুর প্রতিটি সংলাপ, কর্মকাণ্ড ঘটে একুশ বছর আগের পারিপার্শ্বিকতায় যেখানে শাহানা নববধূ, ফুহাদ জন্মায়নি, ছোট ভাই জাহিদ তখন তরুণ, কলেজে অধ্যয়নরত। মা পুরোদস্তুর সুস্থ বাড়ির কর্তা, পাগল বাবার পায়ে শিকল। গরুটি ভূতের আস্তানা বলে খ্যাত তেতুল গাছে বাঁধা। শাহানাকে (গ্রামের মানুষদের ভাষায়) এই বড্ড উন্মাদ মানুষটির সাথে একুশ বছরের ব্যবধানকে সমন্বয় করে চলতে হয়। কিন্তু শাহানা উপলব্ধি করতে সমর্থ হয় ‘ইহা মিথ্যা’। যদিও সে বুঝতে অসমর্থ, কিভাবে বিগত ঘটনা আবুর মুখ নিঃসৃত বাণীতে বিরামচিহ্ন সহ অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়? প্রমাণ, আবুর হস্তাক্ষরে লেখা দীর্ঘ একুশ বছরের ডায়েরি। আবুর মধ্যে তবে কি সুপার হিউম্যান পাওয়ার কাজ করে? শাহানা বেঁচে আছে বিরুদ্ধ বেদনাকে সঙ্গী করে আবুর একুশ বছর আগের একদিনের পুনরাবৃত্তি নিয়ে। কিন্তু এই একুশ বছরের ব্যবধান ঘুচে যাওয়া খুব জরুরী। কোথায় যেন সময়ের হিসাবে গড়মিল ঘটে গেছে। কিন্তু তারা জানে না, সময়ের সংজ্ঞা। খুব সম্ভবত মহাবিশ্বের কোথাও বিচ্ছিন্ন কোনো ত্রুটির ফল এই সময়। অথবা এটিও স্রেফ তাদের মনের বিভ্রান্তি। পাগল বাবার জিন বহন করা আবুও যে একদিন পাগল হবে, এওতো হেমন্তের আকাশের মতো স্বচ্ছ। অনুভূতিকে বুঝতে হলে শব্দ নয়, নৈঃশব্দের সন্নিকটে আসতে হয়। যেখানে নিজের অস্তিত্বকে বুঝবার দায় এড়ানোর সুযোগ কারোরই নেই।

কিন্তু একদিন সত্যিই এই একুশ বছরের ব্যবধানের দূরত্ব ঘুচে যায় অবিশ্বাস্যভাবে। সেদিন ফুহাদ সটান উঠানে দাঁড়িয়ে দেখে, তার মা শাহানা বেগম তাকে জন্ম দিচ্ছে শরতের বিকেল বেলা। জাহিদ চাচা নিয়ে আসে বয়সের ভারে ন্যূব্জ জরিনা দাইকে। বুড়ি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে আসে, ঢুকে পড়ে গোয়ালঘরের পাশে নির্জন চালায়। ভূতের আস্তানা বলে খ্যাত তেতুলের গাছ থেকে গরুটি হাম্বা হাম্বা ডাকে। দাদুর পা শিকলে বাঁধা। মুখভর্তি দাড়ি, অগোছালো চুল, কণ্ঠে বীভৎস হাসি। দাদী চালার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলে, আহ্লাদ করো আহ্লাদ, তোমার নাতি হইছে, নাতি। আহা, পান পাতার মতোন তার মুখ। একুশ বছরের ব্যবধান ঘুচে পুনরায় এই দিন থেকে শুরু হয় নতুন জীবন? শিশু আবু শুনতে পায় কুদ্দুস চাচার আজানের হাঁক। আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার। আশহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহ। আবু সদ্য সন্তানের নাম রাখে দুটি খাসি জবাই করে ‘ফুহাদ বিন আবু’।

ফুহাদ জন্মের এক সপ্তাহ পর, শাহানা তার স্বামী আবুকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে। সূর্যের বর্ণচ্ছটা ভোরের আলোয় সদ্য গোসল সেরে আসা শাহানা তখন প্রকটিত, সুন্দর, কাব্যিক ও নির্ভীক।

– কি দ্যাহেন?

– তরে দেহি। পদ্মফুলের মতো তর চেহারা।

– অমন কইরা কন, আমার যে শরম করে!

– হাছা কই। তুই আসলেই খুব সুন্দর।

– ধ্যাত, যান তো, খালি বানায়া বানায়া মিছা কথা কয়।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu