‘একটি শুক সংবাদ’, ‘একটি শুক সংবাদ…’ বাক্যটা রিপিট হওয়ার আগেই আমার কানে আসে। কান খাড়া করি, সুখ সংবাদের কথাই তো বলছে। মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। নতুন এলাকা, নতুন কর্মস্থলের দিকে পাড়ি জমানো। নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ পথ, জিরোপয়েন্টে দিয়ে ঢুকতেই এমন খোশখবরে কার না দিল আনন্দে আত্মহারা হয়। ভাবলাম এইবার নিশ্চয় আমি সৌভাগ্য বয়ে এনেছি, শাল্টিমাল্টির দিন শেষ। অন্যের জন্য নাইবা আনি, অন্তত নিজের জন্যে বাঁচি।
পাশ করে বেরুনোর পর ঢাকার একটি নামজাদা কলেজে আমার চাকুরি জুটে যায়, পার্টটাইম। অভাবের দিনে মন্দ না। মাস গেলেই বিশ হাজার টাকা। অবশ্য ফুলটাইমের অর্ধেকের চেয়েও কম। মাস্টারি করবার সখ ছিলো, তাই অফারটাকে আশীর্বাদই মনে হলো। বিধি বাম! অল্পদিন সেখানে কাটানো সময়টুকু তেমন আনন্দময় হয়নি।
আমার অগোছালো মন সে জন্যে বেশ খানিকটা দায়ী। এই যেমন: ক্লাস বিকেল ৩.১০ মিনিটে, রেডি হয়ে বসে আছি, ঘুরছি, হাঁটছি, ভাবছি, এলোমেলো! হঠাৎ মোসলেম স্যার তাঁর শ্মশ্রুমণ্ডিত হাস্যজ্জ্বল নূরানী মুখখান নিয়ে হাজির।
‘কি কামাল সাব, আপনার না ক্লাস আছে।’
‘জ্বি স্যার! আসসালামু আলাইকুম; কেমন আছেন?’
‘আছি ভালই, তো ক্লাসে যান না কেন?’
‘যাব স্যার, রেডি হয়ে আছি। ৩.১০ বাজলেই চলে যাব।’ তিনি একটু হাসি নিয়ে বললেন: ‘সে ভাল কথা যাইয়েন, তবে এখন আপাতত ঘড়িটা একটু চেক কইরা নেন, কয়টা বাজে।’
সত্যিই তো, ঘড়িতে বাজে ৩.১৫ মিনিট। মুখটায় চুনাকালি পড়ে গেলো। আমার নারী সহকর্মীগণ হো হো করে হেসে উঠলো। এই হাসিটা একটা সংক্রামক ব্যাপার। সবাই শুধু হাসে, হো হো, হা হা করেই। পুরুষগণ আড়চোখে তাকালো এর দিকে, ওর দিকে, গোঁফে হাসি। একজন মন্তব্য করলেন, ‘কবি মানুষ, একটু আলাভোলা মন! সমস্যা নাই।’ ‘সমস্যা নাই’ কথাটা আমারই মুদ্রাদোষ। তারা এইটা নিয়ে মশকরা করে বেশি মজা পান।
তাই সুযোগ পেলেই কথাটা শুনিয়ে দেন ‘সমস্যা নাই।’ প্রথম দিকে মন খারাপ হতো, এখন আমিও মুখ টিপে হেসে বলি, ‘সমস্যা নাই’।
কথা শেষ না হতেই আরেকজন এসে বলেন, ‘রেজাল্টতো ভালো, কোন ভার্সিটিতে যাবেন, তাই মনে মনে চয়েস করতেছেন হয়তো। ভদ্রলোকের তো দোষ নেই। ক্লাসের টাইম হেরফের হলো কিনা, কাদের ক্লাস হচ্ছে না, কেন হচ্ছে না, সে সব তথ্য অধ্যক্ষকে জানানোই তার কাজ। বড় কলেজ একটুতেই গণ্ডগোল পাকিয়ে যায়। ছাত্রগুলো যে বিটলার বিটলা, একটু এদিক সেদিক হলেই, পাঁচিল টপকে পালিয়ে যায়, দৌড়ঝাঁপ শুরু করে, হট্টগোল লাগায়, হৈহুল্লোড় করে। সুতরাং নিজেকে চারটে কষে গালি দিয়ে ক্লাস নিতে চলে যাই।
সবার সাথে কেন ঠিকভাবে মিশিনা, খোশগল্পে যোগ দেই না কেন, অত ভাব নেওয়ার কি আছে, আমরা কি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়িনি, অত বই সামনে নিয়া ভাব নিলেই কি পড়া হয়ে যায়, ডিউটাইমের আধাঘন্টা আগে আসলেন এমন কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়, সিনিয়রদের দুএকটা ক্লাস অতিরিক্ত নিয়ে দিলে এমন কি কষ্ট হয়, অত চুপচাপ সিরিয়াস হওয়ারই বা কি দরকার, শিক্ষকতা সম্মানের পেশা, আগে ভালবাসতে শেখো- এমন অসংখ্য অযোগ্যতা অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে জমতে থাকে। সপ্তায় ২০/২২ টা ক্লাস নিতে সমস্যা ছিলো না। তবে ডে শিফটের অধিকাংশ বাংলা ক্লাস বিকেলে। তখন সমাস, প্রত্যয়, কারক পড়তে কার বাপের দায় পড়েছে। তবু ম্যানেজ হয়ে গিয়েছিল কিছুদিনের মধ্যে।
চেয়ারম্যান ম্যাডাম অধ্যক্ষ স্যারের রুম থেকে এসেছেন, তিনি এসে জানালেন অধ্যক্ষ আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে। শান্তশিষ্ট ভাবের মানুষ তিনি। ধীরে ধীরে বললেন, ‘দেখুন, কামাল সাব, চুক্তি অনুযায়ী আজই আপনার চারমাস পূর্ণ হচ্ছে। কাল থেকে আর না আসলেও চলবে।’ সাধারণত এমন করে না। চুক্তি প্রায়ই নবায়ন করে। আমি বলতে চাইলাম, ‘স্যার, না আসলে আপনাদের চলবে, কিন্তু আমার তো চলবে না।’ কিন্তু তার বলার ভঙ্গিতে রিকোয়েস্ট করবার আর রুচি জন্মালো না। একটা সংক্ষিপ্ত সালাম দিয়ে বিদায় জানালাম।
দুর্দিন কেটে যাবে, সুদিন আসবে, সুদিন এসেছে। সুখ সংবাদে এবারের যাত্রা শুরু হলো। কিন্তু সুসংবাদটাই তো এখনও শোনা হলো না। এইবার শোনবার নিয়তে মনোযোগ দিলাম। মাইক দূরে চলে গেছে। তবুও আবছা আওয়াজ আসে। ‘ত্রিশাল উপজেলার নামাপাড়া গ্রামের মৎসসংঘের সাবেক ২ নাম্বার সিনিয়র সহসভাপতি, ৪নং ওয়ার্ডের কমিশনার, গরিব দুখী মানুষের নয়নের মনি জনাব আলহাজ্ব কুদরত আলীর পিতা জনাব মোহাম্মদ কুরবান আলী আশি বছর বয়সে ইন্তেকাল ফরমাইয়াছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন।’
মনটা ধপাস করে মাটিতে পড়ে খানখান হয়ে গেল। জিরোপয়েন্টের কিছুটা পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় জয়বাংলার মোড় পর্যন্ত রাস্তার দুপাশে কৃষ্ণচূড়া ও সোনালু ফুলের সারি। সাথে সাথে দুচারটে কদমগাছ প্রকৃতির মাঝে দাঁড়িয়ে আছে ক্যাম্পাস। প্রশাসনিক ভবন ও একাডেমিক ভবনের মাঝে একটা ছোট পুকুর, নানাজাতের শাপলা ফুটে আছে। দেখতেই মনটা জুড়িয়ে যায়। একপাশে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, ছেলেদের হল অগ্নি-বীণা, মাঝে একটি জলাশয় স্বচ্ছ কাচের মতো পানি আর মেয়েদের হল দোলনচাঁপা। কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়া, চক্রবাক সংলগ্ন ভিসি-বাংলো আর শিক্ষকদের আবাস, ডরমেটরি। আমার জায়গা হলো ডরমেটরির একটা গেস্টরুমে।
পৌঁছতে বিকেল চারটা বেজে গেল। একটু ফ্রেশ হয়েই বের হয়ে পড়লাম ঘুরে দেখতে। বেশ কয়েকজন পরিচিত মুখের দেখা পেলাম, যারা এখন আমার সহকর্মী। ভার্সিটির একপাশ দিয়ে একটি রাস্তা ত্রিশাল গরুর হাট থেকে শুরু করে ধুরধুরিয়ার দিকে চলে গেছে। রাস্তাটার অবস্থা দেখে মনে হয় এখনই স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটবে। জলে পা ডুবিয়ে শুয়ে আছে। বছর দেড়েক আগে কাগজে নিউজ হয়েছিল, রাস্তায় ছাত্র-শিক্ষকরা মিলে ধানের চাষ করছে, তার মাঝে চলছে ল্যাঠা আর কই মাছের চাষ। পৌর সভার লোকজন বলেন এইটা এলজিইডির কাজ, এলজিইডি মনে করে এই এলাকা পৌরসভায় পড়েছে। ভার্সিটির উল্টো দিকে রাস্তা বরাবর বেশ কয়েকটা দোকান। তিনটে ভাতের ছোটখাটো হোটেল। ঠিকমতো ডিম ভাজতে জানে না। পরোটায় আটা বেশি পড়ে। তরকারিতে লবণ আর মরিচের আগ্রাসন। তবুও বেশ চলে। কারণ ছাত্ররা অধিকাংশ বাইরে থাকে। হোটেলগুলোতে খায়। ফটোকপির দোকানগুলো ভিড় একটু বেশি। কারণ ছাত্ররা ফটোকপি পড়তে ভালোবাসে। তিনটে ফার্মেসি। দুটো কসমেটিক্স দোকান, পাঁচটা চায়ের, বাকি কয়েকটা মুদি দোকান। বৃহস্পতিবার। চারদিকে সুনসান নীরবতা। মনে হয় কোন এক বিরানভূমি। মানুষজনের চলাফেরা নাই। দুচারটে দোকান ছাড়া সব বন্ধ। এগুলোর খদ্দের বলতে স্টুডেন্টরাই। শুক্রবার-শনিবার ক্যাম্পাস বন্ধ তাই দল বেঁধে সব বাড়ি চলে যায়, অধিকাংশের ময়মনসিংহের বিভিন্ন শহরে বাড়ি। পাঁচটার পর থেকেই উত্তুরে হাওয়া বইতে শুরু করেছে। শীতকাল। আট বছর ঢাকায় থাকতে থাকতে শীতের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম, ত্রিশালে এসে বুঝলাম শীত আছে, বহাল তবিয়তেই আছে।
আমার এক সহকর্মী তার গত দশবছরের ত্রিশাল জীবনের নানান কাহিনীর বয়ান করে চলেছেন। আমি শুনে অবাক হচ্ছিলাম, আর ভাবছিলাম পরবর্তী সময়গুলোর কথা। আমার মতোই এক নতুন সহকর্মী জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তো এলাকার মানুষ কেমন সম্মান করেন? তখন তিনি হা হা হা করে হাসির রব তুলে বললেন, ‘হেরা নজরুলরেই পাত্তা দিল না, বেচারা পালায়া গেলো, আর তুমি কোন স্যার।’ বলেই তিনি একটা গল্প শোনালেন। একবার এক লোক ধুরধুরিয়া থেকে গরুহাটায় গেছে গরু বেচতে। কিন্তু বেচতে পারলেন না। কারণ তিনি দাম চেয়েছেন তিন হাজার টাকা, ক্রেতা চায় দিতে দুই হাজার টাকা। আড়াই হাজার বললে হয়তো দিয়েই দিতেন। বর্ষায় কাদাপথের যে বিড়ম্বনা তাতে পাঁচশ টাকার হার মেনে নেয়া যায়। দুঃখ মনে তিনি বাড়ি ফিরে চলেছেন গরুসঙ্গে। সন্ধ্যায় ঘুটঘুটে অন্ধকার। বটতলায় এসেই ধমক, ‘দাড়ুইন যে, যা আছে দেইন’। গরুওয়ালা এই অঞ্চলের মানুষ, সুতরাং তিনি জানেন, এখানে সন্ধ্যার পর ডাকাতি হয়। বটতলায় ভাগাভাগি হয়। কারো সাহস বেশি হলে সে কল্লা রেখে চলে যায়, পরপারে। এ প্রমাণ এখনও আছে। ভিসিবাংলো তৈরির সময় মাটির নিচে মানুষের খুলি, হাড়গোড় পাওয়া যায়। সেই থেকে বাংলোর পিছনের সে জায়গাটা ঘিরে রাখা হয়, এখন রাত হলে লাইট জ্বলে। অনেকে মনে করেন, উপাচার্য মশায় যাতে জ্বিন-ভূতের ভয় না পান সে জন্যে লাইট জ্বলে।
বটতলাটাও নাকি ঐতিহাসিক! নজরুল যেখানে বসে বাঁশি বাজাতেন এ নাকি সেই বটতলা- এমন হাজারো গল্পে চাউর ত্রিশাল। গরুওয়ালা কিন্তু ভয় পেলেন না। কারণ গরু বিক্রি হয়নি, সুতরাং টাকাও নাই। একজন ডাকাত জিগাইলো, ‘কিরে, গরু বেচুইন নাই কেরে?’ গরুওয়ালা অতি বিনয়ের সুরে জানালেন, দাম ঠিকমতো হয়নি।
ক্রেতা তাকে একহাজার টাকা লস করাতে চেয়েছিল, তাই সে বেচেনি। এক ডাকাত কানের মধ্যে ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে জানতে চায়, ‘আরে বেকুব, লসটা কি তোর হইতো নাকি আঙ্গো হইতো যে তুই বেচুইন না। এখন যে আঙ্গো পুরোটাই লস হইলো, তার ক্ষতিপূরণ কে দিবো?’ গল্পটা বলেই তিরি আবারও হাসির রোল তুললেন।
গল্পগুলো তিনি রসিকতা করে বলছিলেন বটে। কিন্তু বাস্তবিক, সেই শতবছর আগে একজন ১২/১৩ বছরের উচ্ছ্বসিত দুর্মদ তরুণ এই এলাকায় বছরদেড়েক ছিলেন কেমন করে! সে সময় তো রাস্তাঘাট ছিলো না। বিদ্যুত ছিলো না। জায়গির থাকতেন বিচুতিয়া ব্যাপারীর বাড়িতে। আর স্কুলে সেই মাইল দেড়েক দূরে, দরিরামপুর হাইস্কুল। নজরুল বছর খানেকের বেশি সময় ত্রিশালে ছিলেন। তারপর একরাতে বেচারা কাউকে কিচ্ছু না জানিয়ে চলে গেলেন ত্রিশাল ছেড়ে। আর কখনও মনেও করেননি ত্রিশালের কথা, তা না মনে করুক ত্রিশাল তাকে মনে রেখেছে। সেই জায়গির বাড়িটাই এখন নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র। পাশেই বিচুতিয়া ব্যাপারীর কবর। আমার সহকর্মী যোগ করলেন ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, সেই নজরুলের নামেই আজ বিশ্ববিদ্যালয়, মজা করে বললেন, ‘না হলে আমাদের রুটি-রুজ জুটতো কিভাবে।’ আমি বিষয়গুলোকে নিছক রসিকতা মনে করলাম না। তিনি বলেই চলেছেন, এই ধরেন আপনার গায়ে ধাক্কা লাগলো, সরি বলা তো দূরে থাক, উল্টো আপনাকেই ধমকাবে।
ধাক্কা তো লাগতেই পারে। সমস্যা হলে সরে দাঁড়ান। রাস্তার মাঝেই রিক্সাটা পার্কিং করা, সরতে বললেন, উলটা ধমকে বললে, এত জায়গা আছে, সেখান দিয়ে যান। আপনি বাজারে কেনাকাটা করতে গেলেন, দোকানি বুঝলো আপনি বাইরের মানুষ, জিনিসের দাম প্রতিকেজিতে ৪/৫ টাকা বেড়ে গেলো। এমন কতো রঙ্গ দেখবেন, দুদিন হতে দেন। বোঝা গেল, আমার এই সহকর্মী যারপরনাই বিরক্ত ত্রিশালের উপর।
শীতের দিন তবুও বেশ কয়েকবার বিদ্যুত চলে গেলো, আর এক সহকর্মী, তিনি ময়মনসিংহ শহরে থাকেন। তিনি বললেন, ‘ভুলেও ত্রিশালে বাসা নেবেন না, গরমের দিন কিন্তু বিদ্যুতের দেখাই পাবেন না। এই অঞ্চল কম বিদ্যুত খরচ করায় বারবার গোল্ড মেডেল প্রাপ্ত হয়।’ আমি ভাবলাম যে এলাকায় এত ফিসারিজ আর ফার্মস, সেখানে এত কম বিদ্যুত সাপ্লাই দেওয়ার কারণ কি? আমার সন্দেহ হলো, বিল পরিশোধের ব্যাপারটা নিয়ে। চায়ের উত্তাপের চেয়ে শীতের তীব্রতা বেশি ছিল। আমার গায়ে তাপমাত্রা বেড়ে গেল, জ্বর বলেই মনে হলো, আমার সহকর্মী বললেন, ‘প্যারসিটামল নিতে হবে, কিন্তু একটা ফার্মেসিও খোলা পেলাম না।’
রাতের খাবার খেতে হবে। দুপুরে গাড়িতে ছিলাম। বিকালে সামান্য নাস্তা করা হয়েছে। দোকানপাটের ভাব বুঝে, ‘মায়ের দোয়া’ হোটেলের ম্যানেজার কাম মালিককে রাতের খাবারের অর্ডার দিয়ে রেখেছিলাম। তিনি বারবার অভয় দিয়ে বলেছিলেন, ‘স্যার, চিন্তা করুইন না যে, তয় নয়টা বাজার আগেই আইহুন।’
নয়টা বাজতে আরও দশ মিনিট বাকি। গিয়ে দেখলাম হোটেল বন্ধ করে চলে গেছেন তিনি। অবশ্য তার দোষ দেওয়া চলে না। যে তীব্র ঠাণ্ডা, আর ঘুটঘুটে অন্ধকার! ইতোমধ্যে শিয়াল ডাক ভেসে আসছে ‘হুক্কাহুয়া’, দুএকটাকে রাস্তা পার হয়ে ভার্সিটির দিকেও ঢুকতে দেখলাম।
সবাই চাইলেন ত্রিশাল বাজার যাবেন। কিন্তু কোনো যানবাহন নাই। এই পথের মূল যান ব্যাটারিচালিত ভ্যানগাড়ি, তবে কিছু ইজিবাইক বা সিএনজি চলে, দুচারটে রিক্সাও। ১ কি.মি. পথ। ভাড়া রাখে ১০ টাকা। রিক্সায় ভাড়া রাখে ২০ টাকা। কিন্তু এখন একমাত্র পায়ের উপর ভরসা রাখতে হবে। আমার শরীর ভেঙে আসছিল। আমি একটা কলা আর একটা পাউরুটি কিনে বাসায় ফিরলাম। তখনও সেই বিকেলের আওয়াজটাই কানে ভেসে আসল। ‘একটি শুক সংবাদ… আগামীকাল বাদ ফজর মরহুমের জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। আপনারা সবাই দলে দলে যোগদান করে মরহুমের আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’ কিন্তু আমি বিস্মিত হলাম ঘোষকের কণ্ঠ শুনে। বিকেলেও যে কণ্ঠ, এখনও সেই একই সুর। মৃত্যু সংবাদ জানাচ্ছেন। কিন্তু তার গলায় কাঁপন নাই। স্বরে ভগ্নতা নাই। মৃত্যু খবর এমন নিস্পৃহ নিষ্ঠুরভাবে কেউ বলে যায়, সেটা আমার ধারণায় ছিল না, আমি অবাক হয়ে গেলাম।
আমার মনে হল, লোকটা নিশ্চয় খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ হবেন, যেহেতু সারাদিন ঘোষণা চলছে। কিন্তু আমার ভুল ভাঙতে দেরি হয়নি, দু-একদিন পরপরই এমন ঘোষণা আসতে থাকে। ‘একটি শুক সংবাদ, একটি শুক সংবাদ।’
ত্রিশাল বিরাট এলাকা। তাই প্রতিদিন কেউ না কেউ মরে, আর ঘোষক ঘোষণা দিয়ে চলেছেন অবিরাম। মৃত্যুর পর থেকে শুরু হয়, আর প্রায় জানাজা দেওয়ার আগ পর্যন্ত চলতে থাকে। ব্যক্তি যদি রাত তিনটেয় মরে, মাইকিং তখনই শুরু হয়। ঘোষক রেকর্ডিং করে ছেড়ে দেন। ব্যাটারিরিক্সা একটা রিজার্ভ থাকে। ঘণ্টা চুক্তিতে তিনি ঘুরেন ত্রিশালময়। এর কিছুদিন পর থেকে আমি বুঝে নিয়েছিলাম এই ঘোষণা দেওয়াই সোহরাব সাহেবের পেশা।
মানুষ মরলে তার কাজ থাকে। এলাকার মানুষেরা তাকে অপরিসীম শ্রদ্ধা করেন। কারণ তিনি একাই সবার গুরু দায়িত্ব পালন করে চলেছেন প্রায় একযুগ ধরে। ত্রিশালের সবকিছুতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম।
কষ্ট হচ্ছিল। মাস দুয়েক পর এক ছাত্রী বললো, ‘স্যার, আপনি আগের থেকে অহন স্মার্ট হইছুন।’ আমি বুঝলাম ঢাবিতে থাকতে আনস্মার্ট ছিলাম। পাশের আর এক ছাত্র আমাকে সহযোগিতা করলো, ‘স্যার, তার মানে আপনি খাঁটি ত্রিশাইল্যা হয়া উঠছেন।’
ত্রিশালের জীবনে বদলে কেটে যাচ্ছে। তবে একটি শুক সংবাদের কণ্ঠস্বরকে ঠিক মেনে নিতে পারতাম না।
সেদিন সন্ধ্যায় নতুন রাস্তা ধরে হাঁটতে বেরিয়েছি। এইটা আমার প্রতিদিনকার অভ্যাস, সন্ধ্যায় চিকনার মোড়, কোনো কোনো দিন জিরোপয়েন্ট পর্যন্ত হাঁটতে থাকি। সাথে স্টুডেন্টরা থাকে, কখনো কলিগরাও থাকেন। ভার্সিটির চেকপোস্ট পার হয়েই দীঘালিয়া গ্রামের শুরু। রাস্তার উপর বেশ জটলা, সোহরাব সাহেবের ছেলে মারা গেছেন বিকেলে। কিন্তু রেকর্ডিং করার কোনো লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা ভিড় রেখে সামনে এগিয়ে গেলাম।
যখন ফিরছি, দেখলাম সেই পরিচিত রিক্সাওয়ালা, সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর, ‘একটি শুক সংবাদ ‘একটি শুক সংবাদ’।
আমি সেই প্রথম দিনটার মতো কানটা খাড়া করে নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমি আবিষ্কার করবার চেষ্টা করলাম ঘোষকের কণ্ঠটা একটু কেঁপে উঠলো কিনা! কিন্তু আমি নিঃসন্দিহান হতে পারলাম না। শুধু দূর থেকে বাতাসের সাথে ভেসে আসতে লাগলো, ‘একটি শুক সংবাদ’, ‘একটি শুক সংবাদ’, ‘একটি শুক সংবাদ…’ ।