গত চার ঘন্টা ঘরে রাতুলের শরীরের উপর গণপিটুনীর ষ্ট্রিমরোলার চলেছে। সে ক্ষতবিক্ষত। তার বিকৃত অবস্থার দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে দুর্বল চিত্তের অনেকে সরে পড়েছে। অনেকে গণপিটুনীর মহানায়কদের হাতে ধরে অনুরোধ করেছেন, ‘আর মাইরো না বাবা, এইবার ছাইড়া দেও, নইলে ছাওয়ালডা মারা পড়বো।’
কিন্তু তাতে অবশ্য কারো মনে করুণার উদ্রেক হয় না। সবাই নির্বাকার। কিছুক্ষণ পরপর একজন করে রাতুলের সামনে এসে লোহার রড দিয়ে তাকে পেটায়। মা-বাপ নিয়ে খিস্তি তুলে গালাগাল করে। রাতুলের শরীর থেকে রক্তের ধারা ছুটে চলে পাশের ড্রেনে।
সে যন্ত্রণায় চিৎকার করে। উপস্থিত জনতা সিনেমার দর্শকের মতো তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে, হাততালি দেয়, কটু-ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য করে। হাসতে হাসতে নিজেরা গড়াগড়ি খায়।
এতদিন সিনেমা নির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে রাতুল বেঁচে ছিলো। হয়তো তার স্বপ্নের কারখানার পাঠ আজকেই চুকে যাবে। তার জীবন প্রদীপ নিভু নিভু করছে। হয়তো আজকেই মিশে যাবে তার সকল চাওয়া-পাওয়া।
রাতুল চারপাশে তাকায়, মুখে তার করুণার আর্তি। যেন হিংস্র নেকড়ের সামনে একটি হরিণ শাবকের আর্তি, অসহায় ক্ষমার অনুরোধ।
অনেকদিন আগে রাতুল তার শেষ সিনেমা বানিয়েছিল। কিন্তু টাকার অভাবে সেটির এডিটিং শেষ করতে পারেনি। ফলে সিনেমাটি আলোর মুখ দেখেনি।
এটাই প্রথম নয়, রাতুলের আরো দুটি সিনেমার ভাগ্যেও এমন পরিণতি ঘটেছে। প্রতিদিনই রাতুল ভাবে আজকে হয়তো কোনো প্রডিউসার জোগাড় হবে। আজকে হয়তো কোনো এডিটিং প্যানেলের মালিক ফোন দিয়ে বলবে, ‘নিয়ে আসো তোমার সিনেমা, আমি কেটে দিচ্ছি।’
রাতুলের মনের ভেতর হরেক রঙের স্বপ্ন। সেগুলো ছুটে বেড়ায় আকাশের মেঘে, কচি সবুজ ঘাসের মাঠে, ফড়িংয়ের পেছনে, মাছরাঙার টুপ করে জলে ডুব দিয়ে মাছ ধরার দৃশ্যে। অথবা ট্রেন স্টেশনে, বাস স্টপেজে মানুষের অপেক্ষায়, হুডখোলা রিকশায় এক ঝলক দেখা সুন্দরী তন্বীর চাহনিতে; হাসিমাখা অপূর্ব মুখচ্ছবিতে। নয়তো ঘোড়ার আস্তাবলে হ্রষধ্বণির অবৈধ যৌনাচারে। হয়তো স্বপ্নের ভেতর কখনও ঘুমিয়ে পড়ে, আবার ঘুম ভেঙ্গে যায় সদরঘাটের লঞ্চের ভেঁপুতে। কখনও বুড়িগঙ্গার তীর ধরে চলে যায় ফতুল্লার দিকে। আবার হয়তো থেমে যায় পোস্তগোলা শ্মশানঘাটে। পুড়তে থাকা মৃত শরীরের নিশ্চুপ চিৎকার শুনে দৌড়ে পালায়। পাশেই লোহা পেটানো শ্রমিকের হাতুড়ির শব্দ তার পা খামচে ধরে। যেখানে কালো শরীরগুলো থেকে অনবরত ঘাম ঝরছে। রাতুল লিখতে শুরু করে, অদেখা এক ভূবনের গল্প। যাকে সেলুলয়েডে বন্দি করার বাসনায় মন অস্থির হয়ে উঠেছে।
মোবাইলের রিংটোন লেখার বিরতি টানে। রাতুল মোবাইল হাতে উঠিয়ে নেয়। অপর পাশ থেকে ভেসে আসে সেলিম আজাদের কথা–‘রাতুল, তুই আজকে বিকেল ৫টায় টিএসসি চলে আয়। আমরা হয়তো শিগগিরই কাজটা শুরু করতে পারবো।’
রাতুলের মনে আনন্দধ্বনি বেজে ওঠে। ‘অবশেষে কিছু টাকা হাতে আসার সম্ভবনা দেখা দিচ্ছে, এবার যদি কম্পিউটারটা কেনা যায়! তাহলে হয়তো সিনেমাগুলোর একটা গতি হয়।’
রাতুলের মন আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। সেলিম আজাদ একজন প্রথিতযশা সংবাদকর্মী। একটি জাতীয় দৈনিকে কাজ করার পাশাপাশি তার নেশা মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছে কিন্তু নানাবিধ কারণে যেসব মানুষ লোকচক্ষুর অন্তরালে পড়ে আছেন, সেইসব মানুষজনকে খুঁজে বের করে তাঁদের যথাযথ সম্মান পেতে সহযোগিতা করা।
গত বছরের নভেম্বর মাসে পত্রিকার সংবাদ সংগ্রহের জন্য তিনি গিয়েছিলেন দেশের নামকরা এক পতিতালয়ে। সেখানে কাজ করতে গিয়ে তিনি খুঁজে পান একাত্তরের এক বীরাঙ্গনাকে। তাঁকে নিয়ে সে ডকুমেন্টরী করতে চায়, সেই বীরাঙ্গনার কাছে অঙ্গীকারও করে এসেছেন।
ঢাকায় আসার পর নানা ব্যস্ততার কারণে আজকে কালকে করে সেলিম আজাদ এখনও ডকুমেন্টরীটির কাজে হাত দিতে পারেননি। অনেকবার রাতুলকে সে বলেছে সেই কথা। রাতুলও নতুন কিছুর গন্ধ পেয়ে ক্ষুধার্তের মতো আশায় দিন গুনেছে। কিন্তু কাজটি এখনও হয়েই ওঠেনি।
সেলিম আজাদের ফোন রাতুলের ক্ষুধাটাকে আবার চাগিয়ে দেয়। রাতুল স্বপ্নের জাল বুনে। এই কাজটির সমাধা করতে পারলেই হয়তো তার একটা গতি হয়। এইসব কাজের অনেক ভেল্যু সমাজে। এমন কাজ সমাজের সবার নজরে আসে। সবাই বাহবা দেয়, এবং সংশ্লিষ্টদের ভাগ্যে অনেক সুনামও জোটে। সেটাকে পুঁজি করে রাতুল এবার নিশ্চয় কিছু একটা করবে। এছাড়া তার হাতে অসম্পাদিত তিনটি শর্টফিল্ম রয়েছে। এবার নিশ্চয় সেগুলোর একটা গতি করতে পারবে।
দুপুরের পরই রাতুল টিএসসি চলে আসে। তার দুই সহযোগী শাওন ও রোকনকে সে আগেই ফোন করে আসতে বলে দিয়েছিল।
যথাসময়েই সেলিম আজাদ উপস্থিত হয়। কথায় কথায় তাদের স্বপ্নের রেলগাড়ী এগিয়ে চলে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে। এরমধ্যে রাতুল একটি গ্রাফও করে ফেলেছে। আলোচনা করে ডকুমেন্টরীর মোটামুটি একটা ফাইনাল লাইনআপও দাঁড় করিয়ে ফেলে।
লোকেশন রেডি করার জন্য সেলিম আজাদ ফোন করে সেই বীরাঙ্গনার সোর্সে। একবার, দুইবার, তিনবার। রিং হয়, কিন্তু ওপাশ থেকে কেউ ফোন তোলে না। সেলিম আজাদ ফোন রেখে দেয়। সে একটু চিন্তিত। অল্প কিছুক্ষণ পরই তার মোবাইলে সেই নাম্বার থেকে ফোন আসে। ফোন রিসিভ করে সেলিম আজাদ কথা বলেন। রাতুল রোকন শাওন সবাই বেশ আগ্রহ নিয়ে সেলিম আজাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
সেলিম আজাদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঘাসের উপর ফোনটা রাখে। সিগারেট ধরায়। তার মুখে মৃদু হাসির রেশ, তবে উচ্ছ্বাস নেই, কেমন বিমর্ষ একটা ভাব।
রাতুল তাকে প্রশ্ন করে, ‘কি হলো ভাই?’
সেলিম আজাদ রাতুলে দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। জানায়, কিছুদিন আগে সেই বীরাঙ্গণা সরকারের স্বীকৃতি পেয়েছে। এখন নিয়মিত ভাতা পাচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যেই বাড়ী তৈরির জমি-টাকা পাবে।
কথাটা শুনে ওদের সবার আনন্দে লাফিয়ে ওঠার কথা। মনের ভেতরে সেই আনন্দের রেশও আছে। কিন্তু কোথায় যেন; কি একটা নেই, বুকের ভেতর কোথায় যেন একটা সুক্ষ্ণ কাঁটা বিঁধে আছে। আনন্দ উচ্ছ্বাসটাকে উগড়ে বেরিয়ে আসতে দিতে চাচ্ছে না। সবাই চুপচাপ। সবার মুখে মৃদু ম্লান হাসি।
রাতুল নিজেকে প্রশ্ন করে, তাহলে সেকি একজন বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি চায়নি! নাকি সে সিনেমাটা বানাতে পারছে না বলে মন খারাপ লাগছে! এই প্রশ্নের কোনো সমাধান সে খুঁজে পায় না। রাতুল আত্মদহনের জ্বালায় পুড়ে চলে। আর ভাবে… হঠাৎ পানির ঝাপটায় রাতুলের চোখ খুলে যায়। ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে এখনও বাঁধা তার শরীর। চারপাশে তাকিয়ে দেখে শত শত মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে। অনেকক্ষণ ধরে হাত-পা বাধা থাকার কারণে তার শরীরের রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই হয়তো তার বুকের বাঁ পাশটা চিনচিন করে ব্যথা করছে। রাতুল কিছু একটা বলতে যাবে…
তখনই ভিড়ের মধ্য থেকে একজন লোক এগিয়ে আসে। রাতুলের মুখ তুলে ধরে, বলে– ‘কি ডিরেকটর সাহেব, মেকাপ তো দেখি নষ্ট হয়ে গেছে।’