হঠাৎ মেঝেতে খসখস একটা শব্দ শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল। ব্যথাতুর ঝাপসা চোখে দেখলাম কে যেন একজন পাশ কেটে চলে গেল। তলপেটের নিচের দিকটায় অসহ্য ব্যাথা। যন্ত্রণার প্রচণ্ডতায় চোখে তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। কথায় বলে, অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর। গতকাল রাত থেকে অসহ্য যন্ত্রণায় সারা শরীর যেনো পাথর হয়ে গেছে। আবারও চোখে তন্দ্রা এসে জড়ো হতে লাগলো। বুঝতে পারলাম আমি অতলে হারিয়ে যেতে চলেছি। নিজের উপর ঘৃণা হতে লাগলো। কেনো যে বিড়াল হয়ে এ পৃথিবীতে জন্মেছিলাম!– যার জন্য আজ আমার এই শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে। অবশ্য এই সব কিছুই যে সৃষ্টিকর্তার লীলা। আর আমি এই বিশ্বলীলার ক্ষুদ্র ও নগণ্য একটা জীব মাত্র। সারা শরীরটা আবারো ঝনঝনিয়ে উঠলো, ব্যথার একটা স্রোত যেনো মেরুদন্ড বেয়ে তড়িৎ গতিতে সারা দেহে নেচে চলেছে। গত কালকের কথা মনে পড়তে লাগলো।
‘সকাল থেকেই তেমন কিছুই খাওয়া হয়নি। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চললো। ক্ষুধার তাড়নায় একটা বাসা বাড়িতে জানালা টপকে ঢুকে পড়লাম। নজরে পড়লো একটা ছোট বাচ্চা ছেলে টেবিলের সামনে মাথা নিচু করে ঝিমুচ্ছে। তাকে কোনো রকমে পাশ কাটিয়ে চুপিসারে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। ক্ষণিক বাদে পায়ের শব্দে বুঝতে পারলাম কেউ একজন আমার দিকেই এগিয়ে আসছে, ধরা পড়লে রক্ষে থাকবে না– এই ভেবে দেয়ালের পাশে সোফাটার পিছনে দ্রুত গা ঢাকা দিলাম। উঁকি মেরে দেখলাম একজন মহিলা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন। রান্নাঘর এবার ফাঁকা। এই সুযোগে গুটি-গুটি পায়ে রান্নাঘরে ঢুকে পড়ি। দ্রুত চারপাশটায় চোখ বুলাই, খাবারের ঘ্রাণে ঘরটা ভরে গিয়েছে। মাচানের উপর একটা পাতিল চোখে পড়লো, নিশ্চয়ই কিছু না কিছু খাবার রাখা আছে এতে। একেতো ক্ষুধার যন্ত্রণা তার উপর খাবারের কথা ভেবে নিজের লোভটাকে আর সামলাতে পারলাম না। দিলাম একটা লাফ, ব্যাস নিজের ভার সামলাতে না পেরে পাতিলসহ মেঝেতে ধপাস। ঝনঝনিয়ে একটা শব্দ হলো। ওপাশ থেকে আওয়াজ আসলো– খোকা দেখতো রান্নাঘরে বিড়াল ঢুকেছে বোধহয়! ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম সেই বাচ্চা ছেলেটা, আমাকে দেখে বাঘের মতো গর্জে উঠল, হাতের কলমটা আমার উপর ছুঁড়ে মারলো। কোনো রকমে পাশ কাটিয়ে দেয়াল টপকে রাস্তায় এসে পড়লাম। পেছনে ফিরে দেখি একটা বড় ইটের টুকরো হাতে ছেলেটা আমার দিকেই ধেয়ে আসছে। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে দিলাম ভোঁ-দৌড়, রাস্তা পেরুতেই বিশাল ড্রেনটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। গতির কারণে দেহটাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলাম না, প্রচণ্ড গতিতে ড্রেনের দেয়ালে আছড়ে পড়লাম। ড্রেনের পানিতে টুপ করে একটা শব্দই কেবল শুনতে পেলাম। তারপর?’
তারপর কী হয়েছিলো কিছুই মনে নেই। চোখ খুলেই একটা নতুন জায়গায় নিজেকে আবিষ্কার করলাম।
একপাশে বিশাল একটা দেয়াল গাম্ভীর্যের প্রতীকস্বরূপ ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়েছে, অন্যপাশে পায়ে হাঁটার একটা রাস্তা। জায়গাটা সংকীর্ণ, এই সমাজের মানুষগুলোর বিবেক-বোধের মতো। বিশাল এক শূন্যতায় বুকটা হাহাকার করে উঠলো। সারা শরীর কাদা আর পানিতে ভিজে একাকার হয়ে আছে। কেউ হয়ত সকালে ড্রেন থেকে কুড়িয়ে এনে এখানে রেখে গেছে। গা ঝাড়া দিয়ে উঠার চেষ্টা করলাম, একটুও নড়তে পারলাম না! পেটের নিচের দিকটায় ডানপাশে কিছু একটা লক্ষ্য করলাম, ভালো করে দেখি একটা গভীর গর্ত, ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। নাড়ীগুলো দেখা যাচ্ছে, কাদা আর পানিতে নাড়ি-ভুড়ি সব ফুলে ফেঁপে উঠেছে। উঠে দাঁড়াতে চাইলাম, পারলাম না। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সামনে আগানোর চেষ্টা করলাম। নাহ তাও পারলাম না। কোমরটা থেকে পা পর্যন্ত কেমন অসার হয়ে রয়েছে, বোধহয় মাজার হাড়গুলো ভেঙ্গে গেছে। শতচেষ্টা করেও কোনো লাভ হবে না। আমি আর হাঁটতে পারব না। এ কোন পাপের শাস্তি আমাকে ভোগ করতে হচ্ছে?
দেখলাম একজন মানুষ আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। নিশ্চয়ই কোনো দেবদূত হবে, আমাকে নিতে আসছে। আমার চিকিৎসা করে সারিয়ে তুলবে নিশ্চয়ই, আমি আবারো হাঁটতে পারবো। কিন্তু না লোকটা সোজা হেঁটে আমার পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম ‘আমাকে বাচাও!’ কিন্তু তা এতটাই ক্ষীণ যে, আমার কান পর্যন্ত পৌঁছাতেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। আমি ছটফট করতে লাগলাম। লোকটা একটি বারের জন্য তাকালো মাত্র। তারপর? চলে গেল! নিরাশ হলাম এই ভেবে যে, সৃষ্টির সেরা জীবের শ্রেষ্ঠত্ব আজ কোথায়? এই কী তবে তার নমুনা?
ততক্ষণে ব্যথাটা সারা দেহে ছড়িয়ে পড়েছে। কষ্টে থাকলে নাকি মায়ের কথা মনে পরে, আমারও তাই হলো। আমরা তিন ভাই, ছোটবেলায় মা একদিন প্রাণপনে দৌড়াতে দৌড়াতে আমাদের নিকট আসলো, মুখে একটা মাংসের আস্ত টুকরা, মা তখন হাঁপাচ্ছিল। টুকরাটি মাটিতে রাখতেই আমরা তিন ভাই হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। রীতিমতো যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল, বড় ভাইটা থাবা মেরে সমস্ত টুকরাটা নিজের করে নিলো। আমি আর ছোট মায়ের কাছে গিয়ে কান্না শুরু করে দিলাম। মা আমাদের জড়িয়ে ধরে বললো, ‘পৃথিবীটা যে বড্ড কঠিনরে বাবা, বড্ড কঠিন।’ চোখ মুছতে মুছতে আমি বললাম, ‘কই না তো! আমার পৃথিবীটা যে অনেক সুন্দর মা, এই যে তুমি আমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসো, আমরা খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম থেকে উঠে তিন ভাই মিলে খেলাধুলা করি। আমার অনেক ভালো লাগে, পৃথিবীটা অনেক সুন্দর তাই না মা?’ মা আমার দিকে একটু মুচকি হাসলেন। তবে আমি আমার প্রশ্নের কোনো জবাব পেলাম না।
আজ এতদিন পর সেই হাসির তাৎপর্য আমি বুঝতে পারলাম, যেখানে এক লোকমা খাবারের জন্য প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হয়, পেটের দায়ে প্রতিদিন চুরি করতে হয়, এই সেই পৃথিবী। চুরি করতে গিয়ে ধরা খেলে আমার মতোন করুণ পরিণতির স্বীকার হতে হয়।
ভাবতে ভাবতেই একদল আমার পাশ কেটে চলে গেলো, ফিরেও দেখলো না।
আচ্ছা? আমিতো বেশি কিছু চাইনি, শুধু কিছু খাবার চেয়েছিলাম, তাও বেঁচে থাকার জন্য। তাহলে আজ কেন আমার এ পরিণতি! বেঁচে থাকাটাই যেখানে সংকটাপন্ন, জন্ম যে সেখানে নিরর্থক!
সকাল থেকেই পথচারীদের যাতায়াতে এ রাস্তা ব্যস্ত ছিল সদাই। আমি ছাড়া আজ এ জগতের সবাই ব্যস্ত, এরা আমাকে বাঁচানোর এতটুকু চেষ্টা করলো না। আমি মারা গেলে জগতের রীতিতে এতটুকু পরিবর্তন আসবে না তাই হয়ত। আমিতো আর মানুষ নই! অনেকে আবার আমার পাশে এসে ভিড় জমায়, মায়াভরা নয়নে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে আপন মনে বিড়বিড় করতে করতে চলেও যায় সবাই। এই দরদটা তাদের হৃদয়ে এতটুকু রক্তক্ষরণ করতে পারে নাই যে, আমায় একবার ছুঁয়ে দেখবে। দাড়িওয়ালা একজন আবার আমার সামনে ঝোলে মাখা একমুঠো অর্ধ-সাদা ভাত আর খানিকটা মাংস সমৃদ্ধ মুরগির একটা হাড় রেখে গেল। এই সেই খাবার যার জন্য এত সংগ্রাম অথচ অসার জিহ্বাটা একবারের জন্যও নড়েচড়ে উঠল না, চোখের দৃষ্টি আবারও রাস্তায়। চোখদুটো আজ বড্ড ক্লান্ত। মৃত্যুক্ষুধা যাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, এই দুনিয়ার কোনো খাবারের সাধ্য কী তার পেট ভরায়!
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো। চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করলাম, অবশ দেহটা মাটিতে মিশে যেতে চাচ্ছে। বুঝলাম আমার সময় শেষ হয়ে গিয়েছে। চোর অপবাদটা তাহলে ঘুচবে এতদিনে। একটা তীক্ষ্ণ শব্দ ক্রমাগত আমার দিকেই ধেয়ে আসছে। শরীরের শেষ শক্তি দিয়ে মাথা তোলার চেষ্ঠা করলাম, ঝাপসা চোখে দুটো বিশাল ছায়া বাতাসের বেগে আমার দিকেই ধেয়ে আসছে। ছায়াদুটো দুপাশ থেকে আমাকে সম্পূর্ণরূপে ঢেকে ফেললো। চোখের কোণায় জলের ফোঁটায় তাদের পাহাড়াসম বিশাল প্রতিবিম্ব ফুটে উঠলো। আজরাইল তাহলে চলে এসেছে তার সঙ্গীকে নিয়ে। আমি তাহলে সত্যিই অতলে হারিয়ে যাচ্ছি? খুব কষ্ট হচ্ছে এই ভেবে আমি আর কোনোদিনও এই পৃথিবীর বুকে ছুটে চলতে পারব না। নিষ্ঠুর এই পৃথিবীটা যেন রাক্ষসপুরীর সেই মায়াবতী রাক্ষসী, নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও যা সবসময় আকৃষ্ট করে। একটা ছায়া তার বিশাল হাত দুটো বাড়িয়ে আমাকে তুলে নিলো। আমাকে নিয়ে ছুটে চললো উর্ধ্ব আকাশ পানে? মৃত্যুর সময় নাকি খুব কষ্ট হয়? আমার তেমন কষ্ট হচ্ছে না। কষ্টগুলো তাহলে পৃথিবীতেই ছেড়ে এসেছি আমি। একটা ঘোর অন্ধকার চারপাশটাকে ঢেকে রেখেছে। ছুটছি আমি মৃত্যু ছন্দের তালে। আচ্ছা আমি কোথায় যাচ্ছি স্বর্গে নাকি নরকে?
সেই নরকটা কি পৃথিবী নামক নরক থেকেও জঘন্য?
জন্মের পর থেকে কোনোদিন তিনবেলা পেট পুরে খেয়েছি এমন দিনের কথা আমার মনে পরে না। কই কেউই তো আমার কষ্টে একবারও ব্যথিত হলো না। কোনো সংস্থা আমার অধিকার আদায়ের আন্দোলনে মাঠে নামল না। শুধু পারে চোর অপবাদটা দিতে, অথচ এই চোরের চোর হওয়ার কাহিনিটা কেউ কোনোদিনও জানতে চায়নি, যারা চেয়েছিল তাদের সংখ্যা অতি নগণ্য। একদিন ভেবেছিলাম আজ চুরি করব না, যে যা দেয় তা খেয়েই থাকব। ঐদিন আমি প্রায় না খেয়েই থেকেছি সারাদিন, সন্ধ্যার সময় ডাস্টবিনের কিছু পচা গলা উচ্ছিষ্ট খেয়েই দিনটা পার করি। সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম, সৎ ভাবে এ সমাজে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
ছোটবেলায় বড় ভাইয়ের সাথে আমার তেমন একটা বনিবনা হতো না। কারণটাও ছিলো স্বাভাবিক, আমাদের জন্য মা যে খাবার নিয়ে আসত, তার প্রায় বেশিরভাগটাই তার পেটে যেত। তাই আমি আর ছোট ভাই একপক্ষে থাকতাম সবসময়। একদিন বিকেল বেলায় ছোট ভাইটা আমার পাশে খেলতেছিল। হঠাৎ কানের পাশ দিয়ে সাঁই করে একটা শব্দ শুনতে পেলাম। ছোট ভাইটা আবার ‘মাগো!’ বলে একটা চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ি। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি একটা মাঝ বয়সী ছোকরা লাঠি হাতে আমার পিছে দাঁড়িয়ে। ‘মা বাঁচাও!’ বলে একটা চিৎকার দিয়ে জীবন বাঁচাতে ছুটে চলি। কোনো রকমে একটা ঝোপের আড়ালে গা ঢাকা দেই। দূর থেকে ছোট ভাইয়ের নিথর দেহটা মাটিতে টানটান হয়ে পরে থাকতে দেখি। সেদিন মা একেবারে নির্বাক হয়ে গিয়েছিল। মাকে প্রায়ই দেখতাম মুখ লুকিয়ে কাঁদতে, হয়ত ছোটর কথা মনে পড়তো। সতেজ মুখের সেই হাসিটা আর কোনোদিনও ফিরে আসেনি। অথচ এরাই নাকি আবার সৃষ্টির সেরা জীব! আচ্ছা শ্রেষ্ঠত্বের মুকুটটা তারা নিজের ঝুলিতে পুরল কী দিয়ে? একটা নিষ্পাপ প্রাণ কেড়ে নেওয়ার মধ্যে এ কোন শ্রেষ্ঠত্ব লুকায়িত!
দেহটা নড়েচড়ে উঠলো। আজরাইল এখনো আমাকে বয়ে নিয়ে চলছে। স্বর্গে নাকি খাবারের অভাব নেই, সেখানে নাকি প্রচুর খাবার। স্বর্গে গেলে আর কোনো কষ্ট থাকবে না। ভাবতে ভাবতে তলপেটে একটা মোচড় দিয়ে উঠলো, ব্যথাটা বাড়তে থাকলো হু-হু করে। আমি বেহুশ হয়ে পড়লাম।
‘আরেকটা ইনজেকশন এখনি দিয়ে দাও।’ কথাটা পরিষ্কারভাবেই শুনতে পেলাম। চোখ খুলে দেখি ধবধবে পরিষ্কার একটা বিছানায় শুয়ে আছি। একটা মেয়ে আমার বিছানায় পাশেই দাড়িয়ে ছিলো। বেশ সুস্থ অনুভব করলাম। গায়ের কাদা মাটি সব উধাও। তলপেটটায় লক্ষ্য করলাম সেলাই করা হয়েছে। মাথায় সাদা টুপি পড়া ছোটোখাটো এক মহিলা এসে আমাকে একটা ইনজেকশন দিয়ে গেল। পাশে বসা মেয়েটা উনার সাথে বিড়বিড় করে কিছু একটা বললো। ব্যথাটাও এখন অনেকটা কমে এসেছে, তবে পুরোপুরি যায়নি। মেয়েটা এসে নরম গদিযুক্ত একটা ঝুড়িতে রেখে আমাকে নিয়ে চললো। ঝুড়ির ছিদ্র দিয়ে বাহিরের সব কিছুই দেখা যাচ্ছিলো। বড় কামড়াটার ভেতর আমার মতোই অসংখ্য প্রাণী উপস্থিত, পাশের বেডের বিড়ালটার পুরো দেহটাই সাদা কাপড় দিয়ে মুড়ানো, ওপাশে একটা কুকুর দেখলাম ব্যথায় গোঙ্গাচ্ছে, ওর পিছনের ডান পা-টা ভাঙ্গা। মায়ের কাছে একবার এমনই একটা জায়গার গল্প শুনেছিলাম। এই মানুষগুলির নাকি অসম্ভব রকমের ক্ষমতা, যেকোনো রোগাক্রান্ত পশুকেই নাকি সারিয়ে তুলতে পারে। আমি তাহলে আবারো পুরোপুরিভাবে সুস্থ হয়ে যাবো। আবারো ছুটবো এই ধরাতে। এই মেয়েটাই হয়ত আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। মেয়েটার বয়স বছর পঁচিশেক হবে। মন থেকে একটা দোয়া চলে আসলো আপুটার জন্য। অবশ্য আমার দোয়াতে তার তেমন কিছুই উপকারে আসবে না, ছোটবেলাতে কত দোয়াই না করতাম তার কয়টাই বা পূরণ হয়েছে। চোখের কোণে এক ফোঁটা অশ্রু জমাট বাঁধলো। মানুষে মানুষে কত বিস্তর পার্থক্য! বিলুপ্তপ্রায় মনুষ্যত্ব আজও নিজের অস্তিত্ব রক্ষার্থে নীরবে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
আমরা একটা রিকশায় উঠলাম, আপুটার হাতে একটা ব্যাগ দেখতে পেলাম। ওটাতে কী আছে বোঝা গেলো না। রিকশার একটা চাকা গর্তে পরে গেলো, ব্যথা পেয়ে আমি গোঙ্গিয়ে উঠলাম। আপুটা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আমার শব্দের মানে তো আর তার বোধগম্য হবার কথা নয়, হয়তবা ভাবছে আমার কষ্ট হচ্ছে তাই শব্দ করছি। রিকশা থেকে নেমে সোজা একটা বাসায় গিয়ে উঠলাম। ছোট একটা রুম। তবে অনেক সুন্দর, পরিপাটি, সাজানো রুমটা। নরম ছোফাটায় আমাকে শুইয়ে দিলেন। একটু নোনতা পানি খাইয়ে দিয়ে কাপড় দিয়ে কাটা অংশটা ঢেকে দিলেন। আমি চুপটি করে শুয়ে রইলাম। শরীরে শক্তিটা অনেকটা ফিরে এসেছে। ভাবলাম এনারাই আসলে সৃষ্টির সেরা জীব, সকল জীবের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।
সন্ধ্যার দিকে আপুটা বের হয়ে গেলেন। ঘুম ঘুম পাচ্ছে আমার, ক্লান্তিতে অবসাদপূর্ণ গা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
‘পাশের বাসার একচোখ ট্যারা বিড়ালটা আমাকে ধাওয়া করল, আমি দৌড়ে সড়কটা পার হয়ে গেলাম। ধুপ করে একটা শব্দ হলো। পিছনে ফিরে দেখি একটা অটোরিক্সা দ্রুতগতিতে পাশ কেটে গেলো আর ট্যারাটা রাস্তায় পরে কাতরাচ্ছে। রাস্তাটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে, ট্যারাটা কই মাছের মতো লাফাচ্ছে শুধু। আশেপাশে কেউ নেই যে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। ক্রমেই তার অশান্ত দেহটা শান্ত হয়ে গেলো। আমি চিৎকার করে আপুটাকে ডাকলাম, আপু!’
ঘুম ভেঙ্গে গেল, সারা দেহ হতে ঘাম ঝরছে। সারা ঘরটায় অন্ধকার। শরীরে প্রচণ্ড জ্বর, থরথরিয়ে কাঁপছি আমি। আপু, আপু বলে ডাকলাম, কোনো সাড়া পেলাম না। কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে আসছে। ভয় হতে লাগলো, আবারো হারিয়ে যেতে চলেছি অন্ধকারের অতল গহ্বরে। সেই গহ্বরের নীচ হতে ছোটভাইটা যেনো আমায় ডাকছে। আসো ভাই, এখানে আসো, এখানে অনেক শান্তি। ইহকালের লীলা আমার সাঙ্গ হতে চললো, পরপার আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে তার কোলে। জানি না সেখানে আমার জন্য কী অপেক্ষা করছে। শেষ রক্ষাটা আর হলো না। শরীর প্রচণ্ডভাবে ঘামতে শুরু করলো। সবকিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগলো। মা, মাংসের টুকরো, মনুষ্যত্ব, রক্ত, মৃত্যু…
হ্যা, মৃত্যু আমাকে আলিঙ্গন করতে আসছে। সেই মৃত্যু– যা ছিলো পূর্বনির্ধারিত। যা আমার গল্পের সমাপ্তিরেখা। যার মাধ্যমে আমি নবজীবন লাভ করব। সে জীবন নয় যা পদ্মার চরের মতো পদ্মাপারের বাসিন্দাদের আশা দেখিয়ে হতাশায় ডুবিয়ে মারে। বরং সেই জীবন যেখানে কোনো হতাশা থাকবে না, অভাব থাকবে না, সেখানে আমাকে আর এমন করুণ পরিণতির স্বীকার হতে হবে না। মহাপ্রলয়ের তাণ্ডবে মনে হচ্ছে সবকিছু তুলোধুনো হয়ে যাচ্ছে। প্রলয়ের পর হয়ত আমি আবারো জেগে উঠবো শস্যের কচি চারার মতো। প্রলয় সেকি ধ্বংসের প্রতীক নাকি সৃষ্টির সূচনা? প্রকৃতিটা হঠাৎ বড্ড নিশ্চুপ হয়ে গেলো। মহাপ্রলয়ের অবসান তাহলে ঘটলো বৈকি। হিম শীতল একটা হাওয়া বয়ে চললো আমার চারপাশ ঘিরে, বেদনার শান্তি বিরাজ করছে চারিদিকে। বড়ই অদ্ভুত সেই নিস্তব্ধতা।