দরজাটা আধখোলা করে সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে ভেতরে আসার অনুমতি চায় অরিন। মিষ্টি গলাটায় বিনয় মেশানো। তার পরনে সাদা-কালো রঙের একটা সালোয়ার কামিজ। চিকন ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিকের রেখা। ঠোঁট দুটির দিকে তাকালে মনে হয় সন্ধ্যায় পশ্চিমাকাশে জেগে ওঠা নতুন চাঁদ। ভ্রু-এর নিচে কুরঙ্গের মতো দুটি স্বচ্ছ চোখ। তার চেহারায় এক ধরনের মাদকতা আছে। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে!
‘আসেন, আসেন। আপনাকে কী হেল্প করতে পারি?’ রুমেল আগ্রহ নিয়ে বলে।
রুমে ঢুকে চেয়ারে বসতে বসতে অরিন বলে,’ধুর, রাখেন আপনার হেল্প! আগে বলেন আপনার ম্যানেজার স্যার কি বিবাহিত?’
এরকম একটি অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নের জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিল না রুমেল। ম্যানেজার এন্তাজ সাহেব বিবাহিত কিনা সে জানে না। জানবে কি করে! এই শাখায় নতুন জয়েন করেছে সে।
চিটাগাং ইউনির্ভাসিটি থেকে ম্যাথমেটিকসে অর্নাস-মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে সে। পাশ করেই হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকেনি। বিভিন্ন চাকুরির পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য রাতদিন এক করে পড়াশোনা চলিয়ে গেছে। এক বছরের মাথায় হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ফলাফলও হাতেনাতে পেয়েছে। একটা সরকারি ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে। গত মাসে টেকনাফ শাখায় জয়েন করেছে। এখনো চাকুরি জীবনের নতুন প্রতিষ্ঠানের সাথে এডজাস্ট করে উঠতে পারে নাই সে।
‘চুপ করে আছেন যে!’
‘না, এমনি। স্যার বিবাহিত কিনা আমি তো জানি না। আমি এই শাখায় নতুন জয়েন করেছি।’
‘হু, জানি আমি।’
পিয়নকে ডেকে দু’কাপ কফি দিয়ে যেতে বলে রুমেল। প্রথমে কফি খেতে অসম্মতি জানায় অরিন, পরে কী যেন ভেবে কফির মগে সাঁতরায়। তাকে যদিও বেশ কয়েকবার ব্যাংকে আসতে দেখেছে রুমেল, কিন্তু কখনো কথা হয় নি। আজ সামনাসামনি বসে কথা হচ্ছে।
‘আচ্ছা, আপনি ফেসবুকে অমন সেড স্ট্যাটাস কেন দেন?’
‘আপনি আমার আইডি ফলো করেন?’ কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে রুমেল।
‘হু।’
‘আপনার আইডির নাম কী?’
‘বলা যাবে না।’ বলে হা হা করে হাসে অরিন।
কফির মগে ঠোঁট ভেজানোর ফাঁকে ফাঁকে তার ডিপিএসের ঝামেলাটা মিটিয়ে দেয় রুমেল।
‘রাতে আপনাকে নক দিবো।’ চলে যাওয়ার সময় বলে অরিন। তার এই শেষ কথাটা শুনে একটু অবাকই হলো রুমেল।
দুজনের মধ্যে যোগাযোগের ভিতটা খুব ভালোভাবে গড়ে উঠেছে। গভীর রাত অব্ধি ওয়াটঅ্যাপে অডিও-ভিডিও কলে কথা হয়। কখনো-সখনো কথা বলতে বলতে ফজরের আজানও পড়ে যায়। রুমেল অবশ্য রাত জেগে কথা বলার পক্ষে না। রাত জাগলে সকালে ঘুম থেকে উঠতে খুব কষ্ট হয়ে যায় তার। সকাল সাড়ে নয়টার পরপরই তাকে অফিসে ঢুকতে হয়।
কথা চালাচালি থেকে সম্পর্কটা এখন প্রেম পর্যন্ত গড়িয়েছে। তারা আপনি থেকে তুমিতে নেমেছে। গত কয়েক মাসে রাত-বিরেতে টেকনাফ বিচ থেকে সাবরাং জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত চষে বেড়িয়েছে তারা।
অরিন বারবার ফোন দিয়ে যাচ্ছে। এদিকে ব্যাংকে আজ খুবই বিজি রুমেল। ফোনটা রিসিভ করে যে একটু কথা বলবে সেই ফুরসতটুকুও নেই। অরিনের কল বলে কথা! না ধরে কোনো উপায় নেই। ফোন ধরতেই আবদার, তাকে নিয়ে রেইনড্রপ রেস্টুরেন্টে খেতে যেতে হবে!
আজ ব্যাংকে প্রচুর কাজের চাপ। কোনোমতেই কাজ ফেলে বের হতে পারছে না রুমেল। তাতে অরিনের কি! সে তো দমে যাওয়ার পাত্রী না।
‘তুমি বিশ মিনিটের মধ্যে যদি না আসো, আমি ব্যাংকে গিয়ে সিন ক্রিয়েট করবো!’
‘বিশ মিনিট না, আমি দশ মিনিটের মধ্যে তোমাদের বাড়ির সামনে আসতেছি।’ বলে ফোন কেটে দিল রুমেল।
আজ আর কাজ করা হলো না। আগামীকালের জন্যে কাজ পেন্ডিং রেখে বেরিয়ে পড়ল সে।
রেইনড্রপ রেস্টুরেন্টটি বিচের পাশে একদম লাগোয়া। খাবারের মান এবং পরিবেশ দুটিই যথেষ্ট ভালো। খুব সুন্দর করে লাইটিংও করেছে।
তারা বিচে সপ্তাহে দুদিন আসে। শুক্রবার ও শনিবার। বিচে আধভেজা বালুর ওপর পা ছড়িয়ে পাশাপাশি বসে থাকে। হাত ধরাধরি করে সূর্যাস্ত দেখে। কীভাবে লাল টুকটুকে সূর্যটা টুপ করে পশ্চিমাকাশে ডুব দেয়!
অরিন গাল ফুলিয়ে বসে আছে। আজ মোড অফ তার। কারণ বেশ সংগ্রাম করেই রুমেলকে ব্যাংক থেকে বের করতে হয়েছে।
গ্রিল্ড চিকেন আর স্পেশাল নান অর্ডার করা হয়েছে। খাবার খেয়ে তাদের আজ রেস্টুরেন্টে বসে আড্ডা দেয়া হবে না। এখানে এলে খাবার শেষে অনেকক্ষণ বসে গল্পগুজব করা হয়। আজ কফিতে চুমুক দেয়ার সময়টুকুও হবে না, রুমেলের তাড়া আছে।
খাবারটা শেষ করে বেরিয়ে পড়ল তারা। রেস্টুরেন্টের সামনে তাদের রিজার্ভ করা টমটম রাখা। বসে বসে ঝিমুচ্ছে ড্রাইভার।
‘ভাই, ঘুম কি বেশি পাচ্ছে?’
‘নারে ভাই। উঠেন, উঠেন।’
টমটমে উঠলো তারা। অরিনকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে বাসায় তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে রুমেলকে। রাত আটটায় বুয়া আসার কথা। এখন সাড়ে আটটা বাজে।৷ বাসায় তালা ঝুলানো দেখে হয়তো ফিরে গেছে বুয়া। ফোন দিলে হয়তো আবার আসতে পারে!
তাড়া থাকায় একটা বাই-রোড়ে টমটম ঢুকিয়ে দিলো ড্রাইভার।
‘এই রোড দিয়ে কেন?’ ব্যতিব্যস্ত হয়ে রুমেলের প্রশ্ন।
‘অনর তাড়া আছে হইয়ুন দে ইতারলাই।’ ড্রাইভার বলে।
‘সমস্যা নাই। আপনি চালান, আমি খুব ভালোভাবে এই রোড চিনি।’ অরিন বলে ওঠে।
টেকনাফের অলিগলি মুখস্থ তার। কারণ এই জনপথে বেড়ে ওঠা মেয়ে সে।
মাদ্রাসার পাশ দিয়ে রোডটি গেছে। মাদ্রাসার গেইটে সাদা রঙ দিয়ে বড় বড় হরফে লেখা— রিয়াদুল জান্নাহ দাখিল মাদ্রাসা।
এ রোড দিয়ে বাড়ি পৌঁছাতে বেশিক্ষণ টাইম লাগবে না। বড়জোর পনের মিনিট।
আঁকাবাঁকা পাকা রাস্তা দিয়ে সাঁইসাঁই করে চলছে টমটম। তাদের গায়ে বেশ জোরেসোরে ফাল্গুন সন্ধ্যার হিমেল হওয়া লাগছে। রাস্তাঘাটে লোকজন তেমন দেখা যাচ্ছে না। বেশ কিছু দূর পরপর দু’একটা দোকানপাট এখনো খোলা আছে। সেখানে বসে দু’চারজন লোক বসে বিড়ি-সিগারেটের মাথায় আগুন জ্বালিয়ে গল্পগুজব করছে।
সাদা পাঞ্জাবি পরা একটা বুড়ো ফকির হঠাৎ টমটমের সামনে এসে দাঁড়ালো। অশ্রাব্য একটা গালি দিয়ে জোরে ব্রেক কষলো ড্রাইভার। ভয়ে গায়ে লোম কাঁটা দিয়ে ওঠলো রুমেলের। আজ একটা বড় ধরনের এক্সিডেন্ট হতে পারতো!
‘দশশো টিয়া দন!’ বুড়ো ফকিরটি বলে।
তাকে উদ্দেশ্য করে গালাগালি করতে থাকে ড্রাইভার। বিড়ালের মতো তাকিয়ে আছে ফকির। কিছু বলছে না। তার চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছে। বিড়ালের চোখ রাতের অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে, কারণ এদের চোখে টেপাটম লুসিডাম নামক একগুচ্ছ কোষ থাকে। নিশ্চয় ফকিরের চোখে টেপাটম লুসিডাম নামক কোষ নেই। তবু ফকিরের চোখ বিড়ালের মতো জ্বলজ্বল করছে কেন!
ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার কড়কড়ে নোট বের করে দিল অরিন। চিলের মতো ছোবল দিয়ে টাকাটা নিয়ে রাস্তা থেকে নেমে হেঁটে চলে গেল ফকির।
টমটম চলছে আর চলছে।কিন্তু রাস্তা শেষ হয় না। এ রোড দিয়ে না ঢোকে মেইনরোড দিয়ে চলে গেলে হয়তো এতোক্ষণে পৌঁছে যেতো। এটা ভেবে মনে মনে ভীষণ বিরক্ত অরিন।
ড্রাইভার রোবটের মতো টমটম চালাচ্ছে। কোনো সাড়াশব্দ নেই।
সামনে একটা স্পীড ব্রেকার। ড্রাইভার টমটমের স্পীড কমালো। একটা বড় গেইটের লেখায় চোখ আটকে গেলো অরিনের। সাদা রঙ দিয়ে বড় বড় হরফে লেখা– রিয়াদুল জান্নাহ দাখিল মাদ্রাসা।
‘টমটম থামান, থামান!’ চিৎকার করে ওঠে অরিন।
‘কী হয়েছে?’ রুমেলের কৌতুহলী প্রশ্ন।
‘আগে নামো!’ বলে টমটম থেকে নেমে ড্রাইভারের দিকে তাকায় অরিন।
ড্রাইভারের কপাল বেয়ে ধড়ধড়িয়ে ঘাম পড়ছে। কিছু জিজ্ঞেস করলে কোনো জবাব দিচ্ছে না। যেন বোবা-পাথর!
এতক্ষণে রুমেল-অরিন বুঝে গেছে তারা পথ হারিয়েছে। ওয়ানওয়ে বাই-রোড দিয়ে কীভাবে আগের জায়গায় ফিরে এসেছে তারা, ঠিক যে পয়েন্ট দিয়ে তারা বাই-রোডটাতে ঢুকেছিল! ভেবে কূলকিনারা পায় না দুজনেই। পরে অবশ্য অন্য একটি টমটম নিয়ে মেইনরোড দিয়ে বাড়ি ফিরেছে তারা।
ফোন-টোন না করেই সাত-সকালে ব্যাংকে এসে হাজির অরিন। সাধারণত ফোন না করে কখনো ব্যাংকে আসে না সে। তাকে দেখে খানিকটা অবাক রুমেল। কিন্তু মুখ ফুটিয়ে কিছু বলে না।
‘রুমেল, আমি কনসিভ করেছি। এখন কী করব আমি?’
‘কেমনে?’ বলে দুম করে লাফিয়ে ওঠে রুমেল।
চুপ থাকে অরিন। কোনো জবাব দেয় না।
‘আমরা পাশাপাশি শুয়েছি ঠিকই, কিন্তু তুমি কনসিভ করার মতো এরকম কিছু তো আমাদের মাঝে হয়নি।’ তীক্ষ্ণ গলায় বলে রুমেল।
তারা একসাথে কক্সবাজারে ছয়-সাতবার ঘুরেছে, খেয়েছে, থেকেছে! সেন্টমার্টিনও একবার গিয়ে দুদিন থেকে এসেছে! তাদের মধ্যে বাচ্চা হওয়ার মতো কি আদৌ কিছু হয়েছে? নাকি হয়নি?
অরিন নীরবে কাঁদছে। তাকে সন্দেহ করছে রুমেল। এটা ভেবেই ইগো হার্ট হচ্ছে তার। ডেস্কের ওপর রাখা ভ্যানিটি ব্যাগটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল সে। রুমেলের সাথে আর কোনো কথা থাকতে পারে না তার। সোজা ব্যাংক ম্যানেজার এন্তাজ সাহেবের রুমের দিকে হেঁটে গেল সে।
টেনশনে গলা শুকিয়ে কাঠ রুমেলের। তার নামে নালিশ করতে ম্যানেজার স্যারের কাছে গেছে অরিন। মান-সম্মানের প্রশ্ন!
পরের দিন বিকেলে একটা ক্লিনিকে গিয়ে বাচ্চা এবরশন করে ফেলে অরিন। এতে অবশ্য দুজনেরই সম্মতি ছিল।
দু’সপ্তাহ পরের ঘটনা। সকালে ফেসবুক ঢুকতেই একটা নিউজ পোর্টালে চোখ আটকে গেল রুমেলের।
‘মৌলভীপাড়ার সুন্দরী অরিন চেক জালিয়াতির মামলায় আটক।’
কলিজাটা ধক করে ওঠে রুমেলের। ডিটেইলস জানার জন্যে ছবিসহ প্রকাশিত নিউজ লিংকে ঢুকে।পুরো নিউজটা পড়ে হতবাক সে।
মামলার বাদী অমুক ব্যাংকের ম্যানেজার জনাব এন্তাজ আহমেদ!
হাত-পা কচিপাতার মতো থিরথিরিয়ে কাঁপে রুমেলের। একহাতে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সে। অরিনের নম্বরে কল দেয়। ফোন সুইসড অফ।
ম্যানেজার স্যারের রুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়ায় সে। তাকে দেখে ম্যানেজার সাহেব বললেন,’ইয়াংম্যান, তুমি আসবা তা আমি জানতাম! এসো, এসো।’
রুমে ঢুকে ডেস্কের সামনের একটা চেয়ারে বসে রুমেল।
‘এই মেয়ে একটা বেশ্যা! এই মেয়ের পেছনে ঘুরা বাদ দাও। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে আমার কাছ থেকে দশ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সে। দাঁড়াও তোমাকে আমি কিছু এভিডেন্স দেখাই।’
ম্যানেজার সাহেব নিজের মোবাইলটা বের করে কিছু ছবি দেখান।
অরিন আর ম্যানেজারের কিছু অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি। কোনো ফোর কিংবা ফাইভ স্টার হোটেলের রুমে তোলা ছবিগুলো। মোবাইলটা টেবিলে রেখে দিয়ে ওঠে দাঁড়ায় রুমেল।
‘খানকিরে চেক জালিয়াতি মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছি, এবার জেলখানায় পঁচুক।’ ম্যানেজার বিড়বিড় করে বলেন।
কথাটা রুমেলের কান পর্যন্ত এসে পৌঁছায় না।