চন্দনকৃষ্ণ পাল

ডাস্টবিন

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

ডাস্টবিনটার পাশের ফুটপাতে চারজন বসে আছে। আজ বেশ সুখী সুখী চেহারা চারজনেরই। মেয়েটা মাথায় বোধ হয় তেল দিয়েছে। পুরনো লাল রঙের একটা ফিতে দিয়ে চার পাপড়ির একটি ফুল ও বেঁধেছে। চারজনের বয়সই পাঁচ থেকে আটের মধ্যে। মেয়েটার চেহারায় আলাদা একটু লাবণ্য। মায়াভরা চোখ। একমাথা চুল অন্যদিন উসকো খুসকো থাকলেও আজ পরিপাটি। প্রায় বছর দুই ধরে এদের দেখছি এখানে। এই ডাস্টবিনটা ওদের মালিকানায়। সারাদিন যে সব ময়লা এখানে ফেলা হয় এসব ময়লা ওরা ছাড়া কেউ ঘাটতে পারে না। কাগজ, নানান ধরনের কৌটা, টুকটাক জিনিসপত্র ওদের বস্তায় ঢুকাতে দেখেছি অনেকদিন। রায়ের বাজারের কিছু দোকানে ওরা ওসব বিক্রি করে। চারজনের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক যে তাও স্পষ্ট হয়েছে একদিন। একটা আইসক্রিম কিনে চারজন পালা করে খাচ্ছিল সেদিন। মেয়েটা বোধ হয় তাদের নেত্রী। ধানমন্ডির মাঝামাঝি এলাকা এটা। চারদিকে ছায়া ঢাকা বিশাল এসব অট্টালিকা। চমৎকার সব গাড়ি ছোটে সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত। কিন্ডারগার্টেন, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল এনজিও আর একটা স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলো অফিস এ এলাকায়। ভীষণ রকমের এক বৈপরীত্যের মধ্যে এই শিশুগুলোর অবস্থান। প্রতিদিন ওদের চোখের সামনে ওদের বয়সী ছেলে মেয়েরা চকচকে গাড়ী চড়ে ঝকঝকে পোষাক পরে দামী খাবার খেতে খেতে যাওয়া আসা করে। অথচ এসব দেখেও ওরা নির্বাক। যেন এটাই স্বাভাবিক। যেন ওরা জেনে গেছে ওরা ডাস্টবিন ঘাটতেই পৃথিবীতে এসেছে। আজকের পরিবর্তন আমার চোখে লাগে। আলাপ জমানোর ইচ্ছায় কাছাকাছি এগিয়ে যাই। চারজনই সচকিত।

: কেমন আছো তোমরা?

আলাপ জমানোর চেষ্টায় কথা বলি আমি। ওরা পরস্পরের দিকে তাকায়। আমার দিকেও সন্দেহ নিয়ে তাকায়।

: কি ব্যাপার কথা বলছো না।

নেত্রীর কাছে প্রশ্ন রাখি আমি। এবার নেত্রী স্বাভাবিক। একটু হাসি খেলে যায় মুখে। ঝকঝকে দুসারি ছোট ছোট দাঁত চোখে পড়ে।

: কি কমু?

: ঐ যে বললাম কেমন আছো?

: ভালো।

এবার চমৎকার হাসে।

: তা আজ যে সেজে গুজে।

লজ্জার হাসি নেত্রীর মুখে।

: বাড়ী যামু।

: সত্যি।

: তা বাড়ী কোথায়?

: মুনশীগঞ্জে।

: তোমার নাম কী?

: লতিফা।

: এখানে থাকো কোথায়?

: রায়ের বাজার?

লতিফা রায়ের বাজার বস্তিতে থাকে। পশ্চিম ধানমন্ডির বিশাল বিশাল বাড়ীগুলোর পাশে ঝুপড়িওলা বেশ বড় সড় একটা বস্তি রয়েছে। বর্ষায় প্রতিটি ঘরে পানি ওঠে। তখন বড় কষ্ট হয় লতিফাদের। ঘরে আর এক চিলতে উঠোনে প্যাঁচ প্যাঁচে কাদা হয়ে যায়। লতিফার বাবা নেই। কোথায় ওর বাবা সে জানে না। যখন থেকে বুঝতে পারে তখন থেকেই বাবাকে দেখেনি লতিফা। মা একটা মেসে রান্না করেন। লতিফা আর ওর ভাই রমু ডাস্টবিন ঘেটে নানা জিনিস বের করে। ওগুলো বিক্রি করে কিছু পয়সা হয়। আর মায়ের আনা ভাত ও কিছু টাকা পয়সা দিয়ে দিন চলে ওদের। লতিফা মাঝেমাঝে ফুলের মালা বিক্রি করে। কিন্তু আজকাল পুলিশেরা ওদের পিছনে লাগে।

: তোমার পড়তে ইচ্ছে করে না লতিফা?

লতিফা আমার চোখে চোখ রাখে। একধরণের বিষাদ ওর শিশু মুখে ছায়া ফেলে। একটু হাসে লতিফা।

: না। পড়াশুনা ওরা করবো।

হাত দিয়ে রাস্তার মোড়ে দাড়ানো গাব্দগোব্দা এক মা ও শিশুকে দেখিয়ে দেয় লতিফা।

: তুমি ডাস্টবিন ঘাটো ঘেন্না লাগে না?

: লাগে। একটু বড় হলে ডাষ্টবিন ঘাটমু না। আমি কোনো বাসায় কাজ নিমু আর রমু বাদাম বেচবো। এখন তো ছোড তাই কেউ আমাগো বাসার কজে রাখে না।

এমন সময় পলিথিন ব্যাগ ভর্তি ময়লা নিয়ে দুটো কাজের মেয়ে ডাস্টবিনের কাছে আসে। লতিফা তার সাথীদের নিয়ে ময়লা ঘাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কাজের মেয়েগুলো নাকে আঙুল চেপে সন্দেহ ভরা দৃষ্টিতে আমাকে দেখতে দেখতে চলে যায়। আমি পনেরো নম্বর বাস স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটি। মাথার ভেতর নিষ্পাপ শিশু লতিফার কথাগুলো ঘুরে ঘুরে আসে। একটু পরেই বাস স্ট্যান্ডে পৌছে যাই। আমার ক্ষোভ কষ্টে পরিণত হয়। নীল মিনিবাসের পেট ভর্তি মানুষ নামক আবর্জনার গাদায় নিজেকে ছুঁড়ে দেই আমি।


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu