ইশরাত জাহান নিপার বিয়ে হয়েছে তৌফিক ইমাম পান্নার সাথে তের বছর পূর্বে। ব্যাংক কর্মকর্তা পান্না বিয়ের সময় ছাত্র ছিলেন। পরে তিনি একটি ব্যাংকে চাকরী পান। বিয়ের দুবছর পর তাদের একটি কন্যা সন্তান হয়। মৌ নামে তাদের ফুটফুটে মেয়েটির বয়স এখন এগার বছর। তারা শহরের মধ্যেই একটি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। নিপার যখন বিয়ে হয় পান্না তখন হলে থেকে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। পুরোপুরি প্রেমের সম্পর্ক না হলেও বিয়ের পূর্বে থেকে তারা দুজন দুজনকে জানত। পান্না নিপাকে তাদের বাড়িতে পড়াতে আসত। এরই মধ্যে পান্নার পিতা পান্নার বিয়ে ঠিক করলেন। পান্না সুযোগ বুঝে তার পিতাকে নিপার কথা বলল। পান্নার পিতা ছেলের কথামত নিপাকে দেখতে এসে দারুণ পছন্দ করলেন। পান্নার পছন্দেই যে তার পিতা দেখতে এসেছেন এটি নিপা বা তার পরিবারের কেউ জানত না। অবশেষে দু’পরিবারের সম্মতিক্রমে তাদের বিয়ে হয়ে গেল। পান্না বাসর ঘরে নিপাকে জিজ্ঞাসা করলো– এই যে আমার সাথে তোমার বিয়ে হল, এতে তোমার সম্মতি ছিল ?
নিপা লজ্জাবনত দৃষ্টিতে চোখ তুলে একটু পান্নার দিকে তাকালো এরপর একটু সুন্দর হাসি হাসলো। এতে যদিও পান্না নিপার মনের ভাব বুঝতে পারলো তারপরেও আবার জিজ্ঞাসা করলো– এ বিয়েতে তুমি খুশি তো ?
নিপা আলতো সুরে ‘দারুণ’ বলে তার মুখ পান্নার বুকের সাথে গুঁজলো। পান্না তার দুবাহুতে দুনিয়ার সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে নিপাকে জড়িয়ে ধরল। নিপা তার সঞ্চিত উনিশ ফাগুন পান্নার কাছে সঁপে দিল।
প্রত্যেক দিন সকালে মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া আবার নিয়ে আসা তারপরে সংসারের অন্যান্য কাজ কর্মে নিপার দিন মোটামুটি ব্যস্ততার মধ্যে কেটে যায়। পান্না সন্ধ্যার পর মেয়েকে নিয়ে বসেন পড়াতে। ঐ সময়টাই একটু অবসর পায় নিপা। ছুটির দিনে তারা পুরো ফ্যামিলি মিলে বাইরে বেড়াতে যায়। নিপার বাবা আ. সালাম ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সাত বছর পর নিপার বয়স যখন সাত বছর তিন মাস তখন তিনি মারা যান। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার তিন মাস পর নিপার জন্ম। সালাম সাহেব মুক্তিযুদ্ধ করে ফিরে এসে তিন মাস পরে ফুটফুটে কন্যা সন্তানের মুখ দেখতে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন। তিনি ভাবলেন অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার পর দেশ স্বাধীন করার পর আল্লাহ তাকে পুরস্কারস্বরূপ এই মেয়েকে দিয়েছেন। মেয়েকে তিনি অনেক আদর করতেন। এভাবে যেতে যেতে সাত বছর পর হঠাৎ হার্ট এ্যাটাক করে তিনি মারা গেলেন।
নিপার মা নাজমা একটি সরকারী প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করেন। সালাম সাহেব মারা যাবার পর তিনি একমাত্র মেয়েকে নিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে শুরু করেন। যদিও নাজমার মা-বাবা তার আবার বিয়ে দেয়ার অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু নাজমা এ ব্যাপারে একেবারে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। তার মতে মেয়েদের বিয়ে একবারই হয়। তারও হয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তার স্বামীকে তার থেকে কেড়ে নিয়েছে। এসব ভেবে সে আর বিয়ের পথে পা বাড়ায়নি। তার মনের মধ্যে নিজের উপর একটা রাগও ছিল। এটাকে রাগ না বলে আক্ষেপও বলা যায়। এতে সে সবসময় নিজেকে শাস্তি দিতে চাইতো। এরপর থেকে আর বিয়ের পিঁড়িতে না বসে তিনি শরীর ও মনকে কষ্ট দিয়ে রাখলো।
আজ দুপুর দুইটার দিকে পান্না অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এলো। নিপা তাড়াতাড়ি করে পান্নার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো– এখন চলে এলে যে। শরীর খারাপ লাগছে নাকি ?
– না শরীর ঠিক আছে।
– তাহলে! অফিস থাকলে এ সময় তো তুমি বাড়ি আসো না।
– আসলে ক্ষতি আছে? একটু ধমকের সুরে জবাব দিল পান্না। হকচকিয়ে উঠলো নিপা। এরকম ধমক বিয়ের পরে এই প্রথম।
কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে সে আবার জিজ্ঞাসা করলো– নিশ্চয় তোমার কিছু হয়েছে। তুমিতো আগে কখনো এমন করোনি। দেখি গায়ে জ্বর এসেছে কিনা।
এই বলে সে হাত বাড়িয়ে পান্নার কপালে ঠেকাতে গেল। এসময় পান্না তার হাতটিকে ঝাটকা মেরে সরিয়ে দিয়ে বলল– বললাম না আমার কিছু হয়নি। শুধু শুধু বিরক্ত করছ কেন!
নিপা এবার বুঝলো নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছে, যার কারণে সে এত রেগে আছে। তাদের তের বছরের বিবাহিত জীবনে কখনো নিপা পান্নাকে এমন আচরণ করতে দেখেনি। কিন্তু সে কেন এমন আচরণ করছে তা নিপা বুঝতে পারছে না। নিপা তাড়াতাড়ি করে টেবিলে খাবার দিল। পান্না ড্রইং রুমে এমনভাবে বসে আছে নিপার ভয় করছে খেতে ডাকতে। এরকম পরিস্থিতিতে সে আগে কখনো পড়েনি। সে ভাবলো কি এমন ঘটনা ঘটেছে? আজ কেন পান্না সম্পূর্ণ আলাদা আচরণ করছে? এসব চিন্তা করতে করতে নিপা ভয়ে ভয়ে পান্নার কাছে গিয়ে বলল– টেবিলে খাবার দিয়েছি, খেতে এসো।
পান্না কোন কথা না বলে উঠে এসে টেবিলে বসে অল্প কিছু ভাত খেয়ে উঠে গেল। নিপার সাথে একটি কথাও বলল না। মেয়ে মৌ খেয়েছে কিনা, নিপা খাবে কিনা কোন কথাই সে বলল না। অথচ এর পূর্বে প্রতি সাঁঝে তারা তিন জন মিলে মজা করে খায়। একজন না খেলে আরেকজন খায় না। পান্নার আজকের আচরণে নিপা আরো মর্মাহত হলো। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। ভাবল তার নিশ্চয় বড় ধরনের কোন সমস্যা হয়েছে। নইলে তো সে এরকম আচরণ করবে না। নিপা মৌ কে খাইয়ে দিল। মৌ জিজ্ঞাসা করলো– আম্মু তুমি খাবে না ?
নিপা বলল– আমার খেতে ইচ্ছা করছে না মা মনি। তুমি খেয়ে নাও।
– কেন খেতে ভাল লাগছে না? আব্বু খেল না তাই তুমিও খাবে না?
– বড়দের বিষয় নিয়ে কথা বলতে হয় না। তুমি খাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমাও। একটু ধমকের সুরে নিপা বলল।
মৌ আর কোন কথা না বলে খাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে চলে গেল। নিপা টেবিলের খাবার-দাবার গুছিয়ে রেখে শোবার ঘরে এলো। দেখলো পান্না খাটের সাথে বালিশ ঠেকা দিয়ে সেখানে হেলান দিয়ে আধা শুয়া অবস্থায় বসে আছে। দুপুরে পান্না বাড়িতে না থাকলে নিপা মেয়েকে সাথে নিয়ে একটু ঘুমায়। আজ পান্না বাড়িতে আছে তাই মৌ তার ঘরে গেছে। নিপা আস্তে করে খাটের উপর গিয়ে একটা বালিশ নিয়ে পান্নার পাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। দুজনে একই খাটে তবুও নিপার মনে হলো তাদের মাঝে হঠাৎ করে হিমালয় পর্বত এসে দেয়াল সৃষ্টি করেছে। পাহাড়ের ওপারে আকাশের গায়ে লেগে থাকা সমস্ত কালো মেঘ এসে পান্নার মুখে ভর করেছে। চোখে বিজলী চমকাচ্ছে। মনে হচ্ছে যে কোনো সময় বজ্রপাত হবে। নিপা মনে করতে পারলো না, এ তের বছরে সে কখনো পান্নাকে জড়িয়ে ছাড়া শুয়েছে কিনা। কখনো নিপা তার মায়ের বাড়িতে গেলে পান্নাও তার সাথে গেছে। কারণ একটাই দুজন দুজনকে ছাড়া ঘুম তো দূরের কথা বিছানাতে শুতেও পারে না। আজ নিপার কাছে পান্নাকে কেমন যেন অপরিচিত মনে হলো। এভাবে ঘন্টাখানিক নিস্তব্ধ নীরবতার পর নিপা আর স্থির থাকতে পারলো না। কিন্তু কিছু জিজ্ঞাসা করবে সে সাহসও পাচ্ছে না। জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে আবার থেমে যাচ্ছে। এভাবে চলতে চলতে অনেক সাহস করে সে পান্নাকে জিজ্ঞাসা করল– তোমার কি হয়েছে বল না প্লিজ!
পান্না এর সরাসরি উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো– আচ্ছা স্বাধীনতা যুদ্ধের কত দিন পর তুমি হয়েছিলে?
দীর্ঘক্ষণ পর পান্না একটু নরম সুরে কথা বলেছে, এটাই নিপার কাছে অনেক কিছু মনে হলো। তাই সে তড়িৎ উত্তর দিল– মা বলতে পারবে।
– হ্যাঁ তোমার মা-ই তোমার জন্মের ইতিহাস জানেন। তিনিই তো সঠিক করে বলতে পারবেন তুমি কবে হয়েছিলে, কিভাবে হয়েছিলে।
এ কথায় নিপা এবার একটু নড়ে-চড়ে উঠলো। কথাগুলো বুঝতে না পেরে সে বলল- আমার জন্মের ইতিহাস মানে? আমি তো এর কিছুই বুঝতে পারছি না। আর আজ হঠাৎ তুমি আমার জন্মের ব্যাপারে জানতে চাইছো কেন! ব্যাপারটি একটু খুলে বলবে?
এবার পান্না ভারী গলায় বলল– তোমাকে কিছু জানতে হবে না। তুমি আজই তোমার মায়ের কাছে যাবে। তোমার জন্মের ইতিহাসটা ভালোভাবে জেনে তারপরে আসবে।
নিপা বলল– আরো পরিষ্কার করে বল। তুমি কি বলছ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
– আমাদের অফিসে নতুন এক ভদ্রলোক বদলী হয়ে এসেছেন। তিনি নাকি মুক্তিযোদ্ধা। কথায় কথায় তিনি মুক্তিযুদ্ধের অনেক কথা বললেন। তার বাড়ি নাকি তোমাদের এলাকায়। তবে আমি তোমাদের পরিচয় দেইনি। কিন্তু তোমার আব্বার কথা জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বললেন, হ্যাঁ আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় একসাথেই ছিলাম। একসাথে থেকেছি, খেয়েছি, যুদ্ধ করেছি। খুব ভালো মানুষ ছিলেন। কিন্তু স্বাধীনের কয়েক বছর পরেই তিনি মারা গেলেন। শুনেছি, আমরা যখন যুদ্ধে ছিলাম তখন তার স্ত্রীকে পাক-হানাদার বাহিনীরা তুলে নিয়ে পাঁচ দিন আটকে রেখেছিল। একথা অবশ্য সালাম সাহেব জানতেন না। পরে আমরা শুনে সালাম সাহেবকে আর বলিনি। বলে কি হতো বলেন। শুধু শুধু একটা সংসারে ভাঙ্গন শুরু করে দেয়া, তাইনা, বলেন?
আমি তাকে জিজ্ঞসা করেছিলাম, এরপরে আর কি জানেন তিনি। এতে তিনি যা বলেছেন তাতে বিষয়টি তোমার মা পরিষ্কার করে বলতে পারবেন।
নিপার মাথায় এবার আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। এই প্রখর দুপুরেও যেন তার ঘরে গাঢ় কালো অমানিশা এসে ভর করলো। সে চোখে আর কিছু দেখতে পাচ্ছে না। তার মনে হতে লাগলো হঠাৎ পৃথিবীটা এত অন্ধকার হয়ে আসছে কেন? তার শরীরের সমস্ত রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করলো। শরীরের সব শিরা-উপশিরার কার্যক্ষমতা হ্রাস পেতে লাগলো। পুরো শরীর অবশ হয়ে যেতে লাগলো। আচমকা চৈতন্য ফিরে পেয়ে দেয়াল ঘড়ির দিকে খেয়াল করলো সন্ধ্যে সাতটা বেজে গেছে। দুপুর ও বিকাল গড়িয়ে কখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে সে বুঝতে পারেনি। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠলো। দেখলো পান্না বিছানায় নেই। বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো। বাড়ির মধ্যে কোথাও পান্নাকে খুঁজে পেলো না। মৌকে জিজ্ঞাসা করল– তোমার আব্বু কোথায়?
মৌ বলল– আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি দরজা খোলা। তোমার ঘরে গিয়ে দেখি তুমি ঘুমাচ্ছো। আব্বু ঘরে নেই। তাই ভাবলাম আব্বু হয়তো উঠে বেরিয়ে গেছে। তখন আমি দরজা আটকিয়ে দিয়েছি।
নিপা এখন কি করবে ভাবছে। সেকি এখন তার মায়ের কাছে যাবে নাকি এখানে থাকবে? একা একা এসব ভাবতে শুরু করলো। এসব ভাবতে ভাবতে কিছুক্ষণ পর তার মাথা এলোমেলো হতে লাগল। সে তাড়াতাড়ি বাথরুমে গিয়ে মাথায় পানি দিল। এতেও কাজ হলো না। সে ভাবলো চা খেলে হয়ত মাথা খুলবে। এক কাপ চা করে খেল। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। তার চোখের সামনে শুধুই ভাসছে তার মায়ের নিষ্পাপ চেহারা। যার পাশে কয়েকজন নখওয়ালা শকুন। খামচাচ্ছে, আচড়াচ্ছে, মাংস তুলে তুলে খাচ্ছে। তার মায়ের আর্তচিৎকারে আশ-পাশ কেঁপে কেঁপে উঠছে। নাহ্ সে আর ভাবতে পারছে না। একজন অচেনা অজানা মানুষের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে সে কি এসব আবোল-তাবোল ভাবছে। নাহ্ এভাবে নয়, বিষয়টি নিয়ে সরাসরি মায়ের সাথে আলোচনা করলে ভাল হয়। এ ভেবে নিপা মৌকে বাড়িতে রেখে বাইরে যাব আর আসব বলে একাই মায়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।
নিপার মা নাজমা কেবল মাগরিবের নামাজ পড়ে উঠেছেন। এসময় নিপা গিয়ে হাজির। অনেক দিন পর নাজমা মেয়েকে পেয়ে ভীষণ খুশি হলেন।
নাজমা বললেন– কিরে মা এ সময়ে একা, ভাল আছিস। মৌকে নিয়ে এলি না? তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন ?
– এক সাথে এত প্রশ্ন করলে উত্তর দেবো কিভাবে। আমি ভাল আছি, তুমি কেমন আছো?
– ভাল। মৌ ও জামাই কেমন আছে, তারা এলো না ?
– মা তোমার সাথে আমার জরুরী কথা আছে।
– ঠিক আছে, তোর সব জরুরী কথা শুনবো। আগে বস। কতদিন পরে আসলি, কিছু রান্না-বান্না করি। খাওয়া-দাওয়ার পর আরাম করে কথা শোনা যাবে।
– না মা আমি কথা বলেই চলে যাব, আর আসবো না।
– আসবি না মানে? নাজমা বুঝলেন কোন ব্যাপার আছে। তিনি বললেন, আমি তোকে দেখেই বুঝেছি কোন ব্যাপার আছে। বল কি হয়েছে? জামাইয়ের সাথে কিছু হয়েছে, নাকি অন্য কিছু।
নিপা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। সে মাথা গরম করে কিছু করার মেয়ে না। ভাবতে লাগল যে মা দশ মাস পেটে রেখেছে, আবার বাবা মারা যাওয়ার পর একাই সকল ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে বাঁচিয়ে মানুষ করেছেন সে মাকে কিভাবে প্রশ্নটি করা যায়। এত বড় কলঙ্ক মাখা প্রশ্ন করলে মা কিভাবে নিবে। মা কি এটি শুনেই বাবার মত দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবে। এ রকম নানা প্রশ্ন ভীড় করতে লাগল নিপার মনে। নিপা তার মাকে বলল– মা আমি যাচ্ছি।
– কেন মা কি হলো তোর? এসেই চলে যেতে চাচ্ছিস। বসলিওনা। আবার কি যেন বলতে চাইলি। তাও বললি না। আবার হুট করে বলছিস যাচ্ছি। কি ব্যাপার মা খুলে বলতো। কোন ব্যাপার না মা। মৌ একা বাড়ি আছে, আমি যাচ্ছি। এই বলে সে আর এক মুহুর্তের জন্য দেরি না করে বেরিয়ে পড়লো।
বাড়ি গিয়ে নিপা দেখলো পান্না বাড়ি এসেছে। নিপাকে দেখে পান্না বলল– কি বললেন তোমার মা। বললেন, পাক সেনাদের ঔরসে তোমার জন্ম?
কথা শুনে নিপার প্রচন্ড রাগ হলো। সে কোন মতে রাগ সামলে নিয়ে বলল– না মাকে আমি একথা বলিনি।
– কেন বলোনি? আবার যাও, গিয়ে জেনে এসো তোমার আসল জন্ম পরিচয়। আমি অবাঞ্চিত মেয়ের সাথে ঘর করতে চাই না। চিৎকার করে পান্না বলে উঠলো।
নিপার মনে হলো– পান্না তার সাথে কথা বলছে না। সরাসরি মাথায় হ্যামার দিয়ে আঘাত করছে। নিপা আর কোন কথা না বলে বেরিয়ে যেতে লাগলো। এ সময় মৌ দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল। বলল– মা কোথায় যাচ্ছো, আমিও যাবো।
নিপা মৌকে বুকে জড়িয়ে ধরতেই পান্না এক টানে মৌকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল– তুমি তোমার জন্মের সঠিক ইতিহাস না জানা পর্যন্ত এ বাড়িতেও আসবে না আর আমার মৌকেও ছোঁবে না।
এবার নিপার আর চোখের পানি বাঁধা মানলো না। নিপা দৌড় দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
রাস্তায় বেরিয়ে ভাবতে লাগলো এখন সে কোথায় যাবে, মার কাছে গেলে সে কি বলবে। এসব কথা তো মাকে কখনো বলতে পারবে না। তাহলে সে এখন কোথায় যাবে? এই রাতে অজানার উদ্দেশ্যে হাঁটতে হাঁটতে আরো ভাবতে লাগলো– সে কি সত্যি সত্যি পাক সেনাদের ফসল? আর যদি তাই হয় তাহলে তার জন্মের ভার এখন কে নেবে? আর এজন্য যে তার সাজানো সংসার তছনছ হয়ে গেল এর ভারই বা কে নেবে ?