সন্তোষ কুমার শীলের গল্প
বিলাসবহুল হোটেলের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুমে শুয়ে ভূপতিবাবু সারাদিন যানবাহনে চলার এক বোঝা ক্লান্তি নিয়ে মরার মতো অসাড়ে ঘুমিয়েছিলেন। আগামী দিন নতুন বাড়িটা নিয়ে মামলার তারিখ। এ সময় মাথাটা পরিষ্কার রাখা দরকার, শরীরটাও। কতক্ষণ সেলুলার ফোনটা একটানা ঘুমভাঙানি গান শোনানোর পর একরাশ বিরক্তি নিয়ে কাঁচা ঘুম থেকে জেগে খবরটা শোনা মাত্র সেই যে ঘুম ছুটে গেছে হাজার চেষ্টাতেও তা আর ফেরানো গেলনা। কারখানায় শ্রমিক ইউনিয়ন ধর্মঘট ডেকেছে। উৎপাদন বন্ধ। এদিকে এত সাধের বাড়িটা প্রায় হাতছাড়া হবার জোগাড়। এই দুরবস্থার মধ্যে কোন বেকুবের চোখেও ঘুম থাকে! একটা চেয়ার টেনে তিন তলার ব্যালকনিতে বসে বেনসন এ্যান্ড হেজেস কোম্পানির একটা স্টিক জ্বালিয়ে আনমনে আলতো করে ঠোঁটে ছোঁয়াচ্ছিলেন ভূপতিবাবু।
দোতলায় চোখ পড়তেই দেখেন একটা লোক দুই হাতে বিশাল দুই ব্যাগ নিয়ে হোটেলের করিডোরে হাঁটছে। চোখাচোখি হতে তাকে চেনা চেনা মনে হলো। কিন্তু কোথায় দেখেছেন কিছুতেই মনে করতে পারলেন না। হাতের ইশারায় তাকে ডাক দিয়ে মনে মনে ভাবলেন– একটু কথা তো বলা যাক। মাথাটা কেমন গুম্ মেরে রয়েছে।
লোকটা সামনে এসে যখন আদাব দিয়ে দাঁড়ালো তখন ভূপতিবাবুর মনে হলো, তার চেয়েও এই লোকটা বেশি ক্লান্ত। পাশের চেয়ারটার দিকে আঙ্গুল তুলে বসার ইঙ্গিত করে বললেন– তোমায় চেনা চেনা লাগছে কেন বলতো?
– হইতে পারে স্যার। এই তিরিশটা বছর তো হাট-বাজার, ট্রেন-বাস, লঞ্চ-স্টীমার করেই কাটালাম। কোথাও দেখে থাকবেন হয়তো। তো আমারে কি জন্যে ডাকচেন স্যার?
– এই একটু গল্প করার জন্যে আর কি- ভূপতি বাবু অন্যমনস্কের মতো বলেন।
– আমার সাথে গল্প করায় বিপদ আছে স্যার।
– নড়ে চড়ে বসে ভূপতি বাবু বলেন, সে কি রকম?
– এই তিরিশ বছর শুধু কথাই বলে এসেছি তো! তাই থামতে ভুলে গেছি। কথা একবার বলতে শুরু করলে কী যে রোগে পায় বুঝি না। শুধু বলতে ইচ্ছা করে।
– তুমি কী কাজ করো?
– শুনলে আপনার পছন্দ হবে না স্যার। তেমন কিছু নয়, ক্যানভাসার। বলেই এক মিনিট ভূপতিবাবুর চোখে চোখ রাখে।
কোটিপতি ব্যবসায়ী ভূপতিবাবুর অনেক দুশ্চিন্তার মধ্যেও লোকটার কথা মন্দ লাগে না। বলেন– কী কী জিনিস বিক্রি করো তুমি?
– তেমন কিছু না স্যার। দুই তিন ধরনের টুথ পাউডার আর একটা কাটা-পোড়া-মাথাব্যথার মলম। আপনার বোধহয় মাথা ব্যথার সমস্যা আছে। একটু লাগিয়ে দেব নাকি স্যার?
– না থাক। ও এমনিতেই যাবে, আমতা আমতা করে বলেন ভূপতি বাবু।
– থাকবে কেন স্যার? আমার সঙ্গেই আছে, বলেই অনুমতির অপেক্ষা না করে ভূপতি বাবুর কপালে দক্ষ হাতখানা রাখে।
ভূপতি বাবু বলেন, কী করে বুঝলে আমার মাথা ব্যথা করছে?
– মুখ দেখে স্যার। জীবনভর মানুষের মুখ দেখেই তো সম্মতি-অসম্মতি, বিরক্তি বুঝে এসেছি। বলতে পারেন এখন ফেস রিডার হয়ে গেছি। চোখ মুখের দিকে চাইলে যেন ফুসফুস-হৃদপিন্ড-পাকস্থলী পর্যন্ত দেখতে পাই।
ভূপতি বাবুর কপালে ক্যানভাসারের হাতখানা যেন যাদুর খেলা খেলে চলছে। আরামে চোখ বুজে বলেন, তুমি মাসে কত টাকা মাইনে পাও?
– মাইনে আর কি? ওই কোনমতে চলে যায়।
– তুমি কি কোম্পানির সেলসম্যান?
– শুধু সেলসম্যান নয় স্যার, সুইপার থেকে ম্যানেজিং ডিরেক্টর সব আমিই।
লোকটার ইংরেজি উচ্চারণ শুনে সোজা হয়ে বসেন ভূপতিবাবু। জিজ্ঞেস করে– পড়াশুনা করেছো কতদূর?
– তা বেশি দূর পারি নাই স্যার। গরীব ঘরে জন্ম তো! আই.এস.সি পর্যন্ত গেছিলাম।
– তুমি তো ইচ্ছে করলে চাকরি করতে পারতে? তা করলে না কেন?
– কপালে নেই স্যার। কিছু দিনের জন্যে করেছি, কিন্তু ভাগ্যে সয় নাই। প্রথম বাচ্চাটা যখন হয় তখন এম.ডি-র কাছে ছুটির দরখাস্ত লিখে নিচে ‘ইওর মোস্ট ওবিডিয়েন্ট সার্ভেন্ট’ না লিখে ‘ইউর ফেইথফুলি’ লেখার অপরাধে ছুটি নামঞ্জুর হয়। অনেক বলে কয়েও যখন ছুটি না পাওয়া নিশ্চিত হলাম তখন ভাবলাম একটা সত্য কথা বলে বিদায় হই। বললাম, স্যার আপনার ঘরে স্ত্রী থাকতে বাজারের নষ্ট মেয়েমানুষ নিয়ে যখন তখন ছুটি ভোগ করেন তো তাই আমাদের দাম্পত্য সম্পর্ক, সন্তানের প্রতি ভালবাসার মূল্য দিতে শেখেন নাই– তা আপনার কাছে শিখে গেলাম। আমি কোনদিন এম.ডি হলে মানুষের প্রতি অন্তত অবিচার করতাম না।
বোঝেনইতো এম.ডি-রা কেমন ভাষায় কথা শুনতে অভ্যস্ত। একবার শুধু দাঁত কটমট করে বললেন, ইউ শাট আপ রাস্কেল। তোমাকে এই মুহুর্তে ডিসচার্স করা হলো।
– আমিও আপনাকে ডিসচার্স করছি।
রক্তচক্ষু করে জলদগম্ভীর স্বরে বললেন– মানে?
– সহজ, আমাকে চার্জ করার দায় থেকে আপনাকে মুক্তি দিলাম। এমন চাকরীর মুখে ঝাড়ু।
– এ নিয়ে তারপর কিছু হয় নাই?
ভূপতি বাবু প্রশ্ন করেন।
– হ্যা, বেশ শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। এম.ডির উপর সবাই কমবেশি ক্ষুব্ধ ছিল। তাই সবাই ঘটনাটা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তাকে এমন নাজেহাল করে যে স্বয়ং মালিক এসেছিলেন আমাকে নিয়ে যাবার অনুরোধ করতে। অবশ্য আমার উপর তার আস্থা ছিল দীর্ঘ দিনের। কিন্তু সেদিন থেকে জেদ চেপেছে মাথায়– নিজেকে একটা কিছু করতে হবে। আপনাদের দয়ায় পেরেছি। আর কথাও রেখেছি। আমি ছাড়া আরও ডজন দুই কর্মী আছে। তাদের সুখ সুবিধা দেখার চেষ্টা করি। বিনিময়ে ওরাও নিজেদের উজাড় করে শ্রম দেয়। কারখানাটা সবাই নিজের মনে করে।
– তোমার ছেলে মেয়ে ক’জন?
ভূপতিবাবু জিজ্ঞেস করেন।
– দুই জন। মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেটি অর্গানিক কেমিষ্ট্রিতে এম.এস.সি পড়ছে।
ভূপতি বাবুর মানসচক্ষে ভেসে ওঠে– টাকার দম্ভে বখে যাওয়া একদল কুশিক্ষিত ছেলেমেয়ের মুখ। কয়েকদিন আগে সেজ ছেলেটা মদ্যপ অবস্থায় বাড়ী ফিরে মাকে মারধোর করে গয়না কেড়ে নিয়ে বিক্রি করেছিল। ভিতরে যেন একটা চির ধরে কোথাও। প্রশ্ন করেন, তুমি তো শহরে একটা দোকান দিয়ে বসতে পার। এত ছোটাছুটির দরকার কী?
– তা আগেই পারতাম। আপনাদের আশীর্বাদে চারপাশে ছোটখাট এমন কোন শহর নাই যেখানে আমি অপরিচিত। আর না হোক দোকানে গিয়ে যদি কেউ বলে যে, গান গেয়ে একটা লোক মলম-মাজন বিক্রি করে, সেগুলো আছে কিনা? এই এক কথায় সবাই চিনবে। কিন্তু একটা শহরে বসলে তো আর জনসেবা হয় না। ধরুন, এই যে আপনার উপকারে লাগতে পারছি– এই শহরে না এলে কি পারতাম? স্যার, কঠিন কথাতো বুঝি না। সহজভাবে বুঝি পৃথিবীতে এই যে মানুষ হয়ে জন্মেছি তা এমনি নয়। মানুষের জন্য কিছু একটা করা উচিৎ। মরার পর কোথায় কী হয় তার কি ঠিক আছে? এই নিয়ে স্যার একটা গান বাঁধছি, শুনবেন?
উত্তরের অপেক্ষা না করে লোকটা গাইতে শুরু করে –
“এই যে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, এ সংসারে সুখের বন্যা
সবই ফুরাবে, যেদিন শমন আসিবে।
সেদিনে তোর কি আর রবে, সবকিছু ত্যাজিতে হবে
সব পড়ে রবে, মনরে শমন আসিবে।”
ভূপতি বাবু যে সঙ্গীতের সমঝদার তা নয়। কিন্তু তার মনে হলো– নির্জন হোটেল কক্ষের দেয়ালে দেয়ালে গানের সুর যেন তরঙ্গ তুলে স্বনিত হচ্ছে। সেই গুমোটবাঁধা সন্ধ্যায় ক্যানভাসারের যন্ত্রহীন কর্কশ গলায় ভূপতি বাবু এক পরম মধুর সঙ্গীত শ্রবণ করেন। গান শেষ হলে কয়েক মুহুর্ত নীরব থেকে ভূপতি বাবু বললেন, তুমি বেশ ভাল আছো দেখছি।
– ভাল মন্দ জানি না স্যার। সারা সময় কাজ করি। করি মানে করতে হয়। দিনে অন্তত দশ-বার মাইল পথ পায়ে হাঁটি। পেটে আগুনের মত সর্বগ্রাসী ক্ষুধা লাগে। শাক মরিচ যা জোটে অমৃতের স্বাদে খাই। ধনীর পোলাও-বিরানিতে মনে হয় এত স্বাদ থাকে না।
কোথায় যেন একটা খোঁচা লাগে ভূপতি বাবুর। এত প্রাচুর্যের মধ্যে বাস অথচ ভোগের উপায় নাই। প্রতিদিন দুজন চাকরে বাজার করে আনে। কিন্তু ভূপতিবাবুর সকাল সন্ধ্যা দুই রুটি আর দুপুরে শাক-ভাতের উপর যাবার উপায় নাই। ডায়বেটিকস তার লোভটাকে লৌহমুষ্টিতে আটকে রেখেছে। একটু অনিয়ম হলেই সে চূর্ণ হয়ে যাবে। লোকটা বলতে থাকে, সহজভাবে থাকি বলেই সৃষ্টিকর্তা ভালো চোখে দেখছেন। এইতো এই শহরেই জামাল হোসেন নামের এক লোক তার কালো মাজন চলে না বলে একদিন এসে আমাকে ধরে পড়লো– “আপনার তো বেশ পরিচিতি আছে, আমার এ মাজনটার কথা যদি আপনার ক্রেতাদের একবার বলে দেন তো বেঁচে যাই।” ভাবলাম গরীব মানুষ! ওর যদি একটা হিল্লে হয় তো মন্দ কি!
ক’মাস ওকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে দোকানদারদের বললাম ওর মাল কিনতে। আর অবসরে মাজনটাকে ভাল করে তৈরী করার পদ্ধতি শেখালাম। সে-ই কিনা দু’দিন পরে আমার নাম করে দোকানে মাল গছিয়ে দিয়ে গেল। পরে যখন জানতে পারি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। তারপর থেকে এই যে দেখেন কৌটার গায়ে ছবি লাগিয়ে দিয়েছি। এই বলে এত সময় ম্যাসেজ করা মলমের কৌটাটা ভূপতি বাবুর সামনে ধরে।
ভূপতি বাবু কৌটাটা হাতে নিয়ে পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একশ’ টাকার একটা নোট বের করে লোকটার সামনে ধরে বললেন, তোমার এটা আমি নিলাম, এই নাও টাকা।
– কিন্তু স্যার আমার কাছে যে ভাংতি নাই!
– না না ভাংতি লাগবে না। এটা আমি তোমায় দিয়েছি।
– তা হয় না স্যার। আমি কারো কাছে হাত পাতি না। হয় আপনাকে দশটা মলম নিতে হবে। নয়তো একটাও বেচতে পারব না।
ভূপতিবাবু কোন কথা না বলে দশটা মলম হাতে নিয়ে বললেন, এতে তোমার কত লাভ হলো?
– দশ টাকা।
সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে ভূপতি বাবু চেয়ে বললেন– মাত্র দশ টাকা?
– হ্যাঁ স্যার। এতেই চলে যায়। মাত্র পাঁচশ’ টাকা নিয়ে যখন ব্যবসা শুরু করি ঢাকার এক লোক বলেছিল, “পকেটে টেয়া নাই; তার আবার ব্যবছার ছখ!” সেই থেকে আজ পর্যন্ত আট-দশ লাখ টাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। মিথ্যা কথা বলে অসাধু ব্যবসার ইচ্ছা নাই।
– তোমার অনেক বড় হবার শখ নেই?
– আঁতকে উঠে লোকটা বলে, না স্যার। এই বেশ আছি। ছেলেটার পড়াশুনা শেষ হলে একমাত্র অপূর্ণ শখ একটা লন্ড্রী সাবান বাজারজাত করার ইচ্ছা আছে। ও চাকরী করবে না। আমাদের দেশের অফিস আদালতের অবস্থা তো জানেনই। মা-বাবা সন্তানকে পড়াশোনা করিয়ে একটা ঘুষ খাওয়ার যন্ত্র করে অফিসে পাঠিয়ে দেন। আমার তো ঘুষ দেবার সামর্থ নাই আর ইচ্ছাও নাই। তাই চাকরীর আশাও নাই। তবে এ নিয়ে চিন্তা করি না। বেশ তো আছি। মিছেমিছি কেন অস্থির হয়ে ছুটে চলবো? স্যার আপনি বোধ হয় বিরক্ত হয়েছেন। আমি তাহলে উঠি। যদি কষ্ট দিয়ে থাকি তো মাফ করবেন।
ভূপতি বাবু টের পান লোকটা চলে যাচ্ছে। তবু চুপ করে থাকেন। তার ভিতর থেকে কি যেন একটা আবরণ খসে যাচ্ছে।
আরও কিছুদিন পরে কি হয়েছিল জানি না। কিন্তু পরদিন ভোরে মামলা ফেলে ভূপতিবাবু বাড়ী চলে এসেছিলেন। তার মন-প্রাণ জুড়ে একটা কথাই স্বনিত হচ্ছিল– বেশ তো আছি; মিছেমিছি কেন অস্থির হয়ে ছুটে চলবো!