ঘরের বাইরে দু’পা বাড়াতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি, ঘটা করে ভিজিয়ে দিলো। বাড়ির গেইটের সাথে রাস্তা। আবার ঘরে ঢুকে যেতে পারতো। ঘরেও বিশেষ কেউ নেই যে, পিছন থেকে বলবে– এই পরী, তোর ছাতা নে।
গতকালও জানালার লোহার শিকের ফাঁক গলিয়ে দু’হাতে ইচ্ছে মতোন তাগড়া বৃষ্টি ছিটাছিটি করলো নিজের সাথে। চোখেমুখে ধাক্কা লাগা প্রতিটি ফোঁটায় চমকে ওঠেছে। জানালার সামনে যুবতী পেঁপে গাছের কী মধুর ভিজে যাওয়া দেখলো। তেমনি আজ নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখলো রাস্তার ধারে। চুল চুঁইয়ে বৃষ্টি অনবরত মুখে ঢুকে যেতে একরোখা জেদ। মোসাম্বি রঙের থ্রি পিচের ওড়নাটা মাথা থেকে নামিয়ে দিয়ে, পেঁপে গাছের মতো দুই হাত প্রসারিত করে পাখি হয়ে উড়তে চাচ্ছে। মনের কোণে বেজে উঠলো, বর্ষার প্রথম কদম ফুলের গান।
রাস্তার নালার ময়লা খেঁচে বৃষ্টির ঢল স্রোতে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যা আগত এই সময়ে দোকানপাটে জজবা হালে জ্বলে ওঠলো এনার্জি সেভিংস বাল্ব। পথচারীর তেমন আসা যাওয়া নেই। কেবল কয়েকটা সিএনজি, হুডটানা রিক্সা এদিক থেকে যাচ্ছে, ঐদিক থেকে আসছে। পরীর সেদিক খেয়ালও নেই। বৃষ্টিতে ভেজার মধুর সময় পার করছে।
হঠাৎ কড়া টুংটাং শব্দে চোখ মেলে দেখে, নিজের সামনে একটা রিক্সা ! যুবক রিক্সাওয়ালা দরদমাখা গলায় বললো– আপু, এমন করে ভিজছেন কেন! অসুখ হবে তো, রিকসায় উঠেন।
পরী হ্যা, না কিছু বললো না। যুবকের মুখের দিকে তাকাতে তাকাতে কথার টানে রিক্সায় উঠে বসল। হুড টেনে দিলো রিক্সাওয়ালা। টেনে দিলো সামনের প্লাস্টিকের পর্দাটিও। নেমে এলো চারদিকের অন্ধকার। হুডের উপর খৈ ফোটার মতো বৃষ্টি নামলো। সে গলিয়ে পড়ছে যেন, মাছ হয়ে যাচ্ছে, একটা বদ্ধ পুকুরে।
গায়ের ভেজা কাপড় তুলতুলে শরীরটাকে আঁকড়ে ধরলো। মাথায় হাত ঘোরাতে টের পেল, খোঁপায় গুঁজানো গোলাপ ফুলটি এখনো আছে। কয়েকটা হাঁচি এলো পরপর। এতে রিক্সাওয়ালা বলো উঠলো– আপা,কোথায় যাবেন বললেন না তো!
– এই তো, সামনে।
ছিরছির, ছরছর শব্দে পানি ছিটিয়ে রিক্সার টায়ার ঘুরছে। এগুলো খানিক। যাত্রীর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে রিক্সাওয়ালা যুবকটি মুখ খুললো– আপা আপনি যেখান থেকে উঠলেন, সেটা কি আপনাদের বাড়ি?
– হ্যাঁ।
– তাহলে তো আপনি আমেরিকা থেকে আসলেন, সত্যি বলি নি?
পরী খানিক বিচলিত হয়ে বললো– জানলে কীভাবে?
যুবক খুব মজিয়ে হেসে বললো– জানবো না কেন! এই এলাকায় আপনারাই প্রথম আমেরিকা গেলেন। এখানে তো কিছু কাজের লোক থাকে শুধুও…
– হ্যাঁ।
– আচ্ছা আপা, আমেরিকা কতদূর?
পরী এমন প্রশ্ন শুনে রিক্সার সিটে ডানপাশের খালি জায়গাটা আরেকটু ছাড়িয়ে বললো– বহুদূর।
– আচ্ছা, আপনি বৃষ্টিতে ভিজছেন কেন?
– দুঃখে।
– কী বলেন! আমেরিকাওয়ালার আবার দুঃখ থাকে নাকি?
– হুম, থাকে।
– কেন?
– মানুষ হলেই দুঃখ থাকে।
– কেমন দুঃখ?
পরী মুখ ফসকে বলে দেয়– মনের মানুষ না থাকার দুঃখে।
যুবকের মুখ খানিক লাল হয়ে এলো। আঁধারে তেমন দেখা যাচ্ছে না হয়তো। দোকানপাট আর বৈদ্যুতিক খুঁটির আলোয় সামান্য টের পাওয়া যাচ্ছে এই লাজুকতা। কথা না বলে প্যাডেলের পর প্যাডেল চালাচ্ছে। এবার পরীই বলে উঠলো– আচ্ছা, তোমার প্রেমিকা নেই?
যুবক আরো চুপসে যায়। হঠাৎ রয়ে সয়ে প্যাডেল চালাচ্ছে আর কীভাবে এ প্রশ্নের উত্তর দিবে ভেবেই পাচ্ছে না। পরী বলে ওঠে– লজ্জা পাচ্ছ কেন? আর, আমাকে তুমি করেই বলতে পারো।
– কী বলেন, আপা!
– কী মানে?
– আমি তো রিক্সাওয়ালা।
– বলো আগে, তোমার প্রেমিকার নাম কী?
– বৃষ্টি।
– খুব ভালোবাসো ওকে?
– হ্যাঁ,নিজের জীবনের চেয়ে বেশি।
– কোথায় থাকে?
– আপনাদের বাড়ির পিছনের কলোনিতে।
পরী কিছুক্ষণ চুপ। যুবকও কিছু বললো না। কেবল পতিত বৃষ্টি চিরে রিক্সা এগুচ্ছে। যুবক খানিক ক্লান্ত স্বরে বলে ওঠে– কোথায় যাবেন?
– এই তো, সামনে। আচ্ছা, বর্ষার দিনে তোমরা বৃষ্টিতে ভিজো না?
যুবক অট্টহাসি দিলো। পরী খানিক লজ্জা পেল এতে। যুবক বলে ওঠলো– কী বলেন আপা! পাগলের মতো ভিজতে যাবো কেন? আমাদের ঘরের চালার ফুটো দিয়ে আকাশ দেখা যায়। বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়ে ঘুমন্ত চোখে। আর সারাদিন তো ভিজি, রিকসা চালাতে চালাতে।
পরী খানিক চুপ থাকে। ভাবে তাই, তো। যুবককে দেখে হিংসা হয়। নিজে সমৃদ্ধশালী আমেরিকায় বসবাস করেও মাথা গুঁজার মানুষ পেলো না। এসব ভাবনার মধ্যে যুবক বলে উঠলো– আপনার প্রেমিক আছে?
– না, নেই।
– কেন?
– সত্য।
– কী বলেন! আমেরিকায় ছেলের অভাব? টিভিতে দেখি তারা কী খোলামেলায় একজনের গায়ের ওপর আরেকজনে…
যুবকের কথাগুলো শুনতে শুনতে ওয়াক ওয়াক করে শুকনো বমি আসতে চাইলো। যুবক অতি বিচলিত হয়ে জানতে চাইলো– কী হলো আপা?
পরী গলা টেনে থুতু গিলে বলল– না, ঠিক আছি।
– কোথায় যাবেন এটাতো বলছেন না।
– এই তো,আরেকটু সামনে।
– আচ্ছা, আপনার প্রেমিক জুটলো না কেন! বিয়েটাও তো করতে পারতেন।
– বিয়েটা করবে কে এখন! বছরের প্রায় পুরোটা হসপিটালে থাকতে হয়। আমেরিকায় একটু গরমের দিন এলেই কেবল ঘর থেকে বের হয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করতে পারি। এই যেমন গরম আসলো বলে নিজের দেশে বেড়াতে এলাম।
যুবক আধা বুঝে বা না বুঝে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিল। পরী হুট করে বলে– জানো, আমার না লাল টুকটুকে শাড়ি পরে বউ সাজার খুব ইচ্ছে। আমার স্বামীটা আমাকে খুব ভালোবাসবে। মাটির চুলায় আমি ভাত রাঁধবো।
যুবকের মনে ঘুরপাক খায় “আহা, পয়সাওয়ালার কতরকম ইচ্ছে!” অথচ একথা সে মুখ থেকে বের করলো না কোনোমতে। কেবল বলে– আপনার বাবা আপনাকে বিয়ে দিতে চায়নি?
পরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে– বাবা তো মারা গেছে কিশোরীবেলায়।
– ওও…
অতঃপর দুজনে চুপচাপ হয়ে গেল। কোনো কথা নেই। রিক্সা এগিয়ে যাচ্ছে। ধুপধাপ, টুসটাস বৃষ্টি দাপাচ্ছে রিক্সার হুডে। পর্দার আড়ালে বাড়ছে শ্বাসের ওপর আরো শ্বাস। সে বুঝি তলিয়ে যাচ্ছে। যুবকের সাহসে কুলাচ্ছে না একটু পিছ ফিরে উঁকি দিতে। বুকে কাচুরমাচুর শুরু হলো। জেদি ঘোড়ার মতো রিক্সার বেল বাজিয়ে ছুটছে। পতিত বৃষ্টির ফোঁটায় ক্লান্ত হয়ে কিছুক্ষণ পর যুবক বলল– আপা, আর কতদূর?
পরীর সাড়াশব্দ নেই। গোঙাচ্ছে। শ্বাসের ওপরে শ্বাসের বাড়াবাড়ি। যুবক আবার জিজ্ঞেস করে– আপা, আর কতদূর?
এবারও কথা নেই। বুকে ছুরি দিয়ে কে যেন কাটছে। প্যাডেল মেরে এগুতে পারছে না। কে যেন পা ধরে রাখছে। বৃষ্টি কমার কোনো লক্ষণ নেই। বৃষ্টি কেবল ঝরে যাওয়ার জেদে বাড়ছে। এতোক্ষণ টানা ভেজার পরে যুবক যেন রতিক্লান্ত। সে কান খাড়া করে শুনতে চাইলো, পর্দার আড়ালে শ্বাসের ওপর শ্বাসের আঘাত। এখন আর শোনা যাচ্ছে না হঠাৎ! যুবক এবার চেঁচিয়ে ওঠে– আর কতদূর!
পর্দার আড়াল থেকে কোনো জবাব আসেই না। যুবক ব্রেক চেপে রিক্সা দাঁড় করিয়ে ভীষণ জেদে পর্দা উল্টায় আর চোখের পলক দাঁড়িয়ে গেল। যেন দৃষ্টিতে বজ্রপাত। দুচোখকে বিশ্বাস করাতে পারছে না। রিক্সার হুডের বামপাশে হেলে থাকা পরীর ফেনায়িত মুখের উপর যুবক হাত দিয়ে পরখ করে শ্বাস-প্রশ্বাস আছে কি না!
যুবক এদিকওদিক তাকিয়ে দেখে। এতোদূর এসে রাস্তায় মেয়েটিকে ফেলে যাবে তেমন অমানুষ সে নয়। আবার রিক্সা ঘুরায় পিছনের সেই আগের ঠিকানায়।
অথচ রাত তখন দশটা পেরিয়ে গেছে।