পরিবারের সবাই খাবার টেবিলে বসে রাতের আহার সারছে। চামচের টুংটাং শব্দের পাশাপাশি “এই সবজি আজ বেশ ভালো হয়েছে” কিংবা “কি হল ভাত নে” এমন আহার্য আবদার চলছে সমান তালে। কারো মুখ থেকে আবার খাবারের শব্দ অর্থাৎ ভাত চাবানোর শব্দ বেরুচ্ছে। শব্দ করে খাওয়া নিতান্তই অভদ্রতার শামিল। চল্লিশোর্ধ খালেক সাহেবের ডান পাশে বসা কিশোরী কন্যা তুতুল বলে– বাবা,তুমি সব সময় শব্দ করে খাও কেনো? তুমি শব্দ করে খাও বলে আমার খাবারের মনোযোগ নষ্ট হয়ে যায়। আমি অমনোযোগী হয়ে মাছের কাঁটা খেয়ে ফেলি! খালেক সাহেব বলল– শব্দ করে না খেলে খাবার খেয়ে আমার তৃপ্তি মিটে না। তোর যদি ভালো না লাগে তুই আমার আগে খেতে বসিস। বিড়ালের মতো নিঃশব্দে খেয়ে উঠে যাবি !
রুপু ভাতের প্লেটে চোখ স্থির রেখে রমণীয় মুখে বিরক্তির ভাব করে ঠোঁট বাঁকালো। যেন খাবার খেতে তার বিস্বাদ লাগছে। রুপুর মনে হচ্ছে ভেতরে প্রবেশ করা ভাত গুলো এক সাথে বেরিয়ে আসতে চাইছে। গুলিয়ে বমি হবে। রুপুর বসে থাকা দেখে মা বলল– কি রে, বসে আছিস যে? নে ভাত নে। রুপু বলল– পাতেরগুলোই শেষ করিনি তুমি আবার বলছো ভাত নিতে। এই বলেই ওয়াক শব্দ করে রুপু দ্রুত বেসিনে গিয়ে বমি করা শুরু করলো। ওয়াক, ওয়া, ওয়া, ওয়াক। টেবিলের সবাই নীরব হয়ে যে যার মত খেতে লাগলো। তুতুল বলল- উহ,আপু। প্রতি বেলাতে খেতে খাওয়ার সময় তুই বমি করিস। বমির শব্দ শুনলে কি আর খেতে ইচ্ছে করে? রুপুর বাম পাশে টেবিলে বসে ছিলো তুতুল। রুপুর পাশে বসে ছিলো খালেক সাহেবের চাচাতো বোন। ডায়াবেটিকসের চিকিৎসা নিতে এক সপ্তাহ হল ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় এসেছেন। সম্পর্কে যিনি রুপু ও তুতুলের ফুফু। রুপু বমি করে মুখ ধুয়ে তার রুমে চলে গেলো। ভাত চিবোতে চিবোতে ফুফু বললেন– আসার দিন থেইকা দেখতাছি রুপু বমি করতাছে। কোনো অসুখ টসুখ বাঁধলো নাকি, খালেক? খালেক সাহেব উত্তর দিলেন– না। মা বললেন– রুপুরে জিগ্যেস করছিলাম, বুবু। ও তো বললো শরীর ঠিক আছে। খাইতে আসলেই নাকি বমি আসে। ফুফু– শরীর ঠিক, খাইতে আইলেই বমি! এটা তো মাইয়া লোকের ভারী পরিচিত সমিস্যা ! খালেক সাহেব বললো– বমি হয় কারণ হইলো, ভার্সিটিতে গিয়া ফুচকা, আইসক্রীম, বিরানী এটা সেটা খায় সেই জন্যে। বাইরের এসব খাবার তো ভালো না। বমি তো এসবের কারণেই হয়। ফুফুর মুখে কথাটি শোনার পর থেকে মা ফুফুর মুখের দিকে আনমনে তাকিয়েছিলো। সম্ভবত উনার বলা শেষ কথাটি বারংবার কানে বাজছিলো বলে নিজের মনে মনে কথাগুলো মনোযোগী হয়ে পড়ছিলেন। বিশেষ করে মাইয়া লোকের ভারী পরিচিত সমিস্যা!
খেতে গেলেই কেনো বমি হচ্ছে? পানি ছাড়া যে কোনো দানাই পেটে টিকতে পারছে না। কোনো কোনো সময় আবার পানিও বেরিয়ে আসে। ইদানীং আবার বমি হলে শরীরটা মেরে আসে। মাথা ঘুরায়, দুর্বল লাগে। ইতোমধ্যে বমি না হওয়ার জন্য ফার্মেসী থেকে বমির কথা বলে টেবলেট এনে খাবার আগে খালি পেটে খেয়েছে কয়েকবার। কিন্তু কিছু থেকে কিছু হয়নি। বরং বমি হলে এতিমের মত টেবলেটটা বেরিয়ে আসে। তবে সমস্যা কোথায়? কেনো বমি হচ্ছে? লাইট নেভানো রুমে চোখ বুজে শুয়ে শুয়ে রুপু কথাগুলো ভাবছিলো। ভাবনার পরিবেশ কেমন অন্ধকারময়। চোখ খুললে অন্ধকার আবার চোখ বুজলেও অন্ধকার!
মা-বাবা পাশাপাশি খাটে শুয়ে আছে। বুবু একটা কথা বললো কথাটি তো ফেলানো যায় না রুপুর বাবা। বাবা খালেক সাহেব বললেন– কি বলতে চাও বলো। বুবুর রেফারেন্স পরে দিও। মা– না, মানে উনি তো মুরব্বি মানুষ। বললেন এমন বমি হওয়া তো মাইয়া লোকের ভারী চিনা সমিস্যা! বাবা– তোমার কথা পরিষ্কার করো। মা একটু চুপ থেকে বলল– দেড় মাস আগে গত ডিসম্বরে রুপু ওদের ক্যাম্পাস থেকে তিন দিনের সফরে সিলেট রাতারগুল পিকনিকে গিয়েছিলো। মনে আছে তোমার? বাবা– মনে আছে,তারপর? মা– গিয়েছিলো তিন দিনের সফরে কিন্তু আসলো পাঁচ দিন পর। বাবা তখনো স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে বলল– সবাই চলে আসছিলো। শুধু ওরা চার জন ফ্রেন্ড থেকে গিয়েছিলো। রুপুকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিলো ওর ফ্রেন্ড নাদিম! মা একটু অস্থির হয়ে বললেন– হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি তোমাকে এটাই বলতে চাচ্ছিলাম। বাবা আাবারো স্বাভাবিক স্বরে বললেন– তো হয়েছে কী? জায়গাটা ভালো লেগেছিলো বলে ওরা আরো দুই দিন না হয় রইল সেখানে। তাছাড়া বন্ধু বন্ধুকে বাসায় পৌঁছে দিতেই পারে। বন্ধুকে বন্ধু সেফটি দিতেই পারে। মা নিচু স্বরে বললেন– বুবুর কথাটি মনে আছে? মাথায় নাও। বাবা– দূর, কী যে বলো না। তুমি দেখছি বুবুর মতো। একজন আন্দাজে কী না কী বলল আর তাতেই তোমার রাজ্য তালাশ, ঘুমাও।
সকালে বাসা থেকে বেরুনোর সময় রুপু মাকে বলে গিয়েছিলো ফিরতে দেরি হবে। মা কারণ জিগ্যেস করলে বলেছিল কাজ আাছে। মায়ের সন্দেহে বুবু চোখ মারে!
রুপু ক্লাস করেনি। নাদিমকে নিয়ে সোজা ডাক্তার কাছে গেছে। নাদিম রুপুর কথা মত রুপুদের গলির মুখ থেকে রুপুর সাথে যোগ হয়েছে। যা গতকাল রাতে ফোন করে রুপু নাদিমকে অবগত করেছিল।
ডাক্তার প্রেসক্রিপশনে কিছু টেস্ট লিখে দিলো। বললো টেস্টের রিপোর্টগুলো নিয়ে দুই দিন পর দেখা করতে। তার আগে ডাক্তার রুপুকে চেকআপ করেছিলো। জিজ্ঞাসু ডাক্তারকে বমির সমস্যার কথা বলা শেষে ডাক্তার রুপুকে বললেন– উনি আপনার কি হন? নাদিম বলল– আমরা ফ্রেন্ড। ডাক্তার– সরি টু সে, ইউ লায়ার! নাদিম– এক দন্ড মিথ্যে বলছি না। ডাক্তার– আপনি যদি মিথ্যে নাই বলেন তবে উনি প্রেগনেন্ট কেনো? ডাক্তারের কথা শুনে রুপু বলল– আপনি কী বলতে চাইছেন ক্লিয়ার করবেন প্লীজ। ডাক্তার বলল– আপনার সাথে পরিবারের কেউ আসেননি। আপনার বমির বর্ননা শুনে এবং সাথে বন্ধুকে নিয়ে আসায় আমার কৌতূহল আকাশচুম্বী। এই কথা শুনে নাদিম বলল– ডক্টর, আমাদের মধ্যে একটি সম্পর্ক আছে ঠিক কিন্তু আমরা ভুলেও বিতর্কিত কিছু করতে পারি না। আমরা যথেষ্ট ম্যাচুউড। আমি কম্পিউটার সায়েন্সের এবং রুপু বিবিএ ফাইনাল ইয়ারে পড়ছি। একটা সম্পর্ক থাকা এবং বন্ধুকে বন্ধু ডাক্তার দেখাতে নিয়ে আসা মানে এই নয় যে কোনো অঘটন ঘটে গেছে। ডাক্তার নাদিমের কথার সমর্থন জানিয়ে বলল–হুম, ঠিক বলেছেন। তবে ভুলেও কিছু করতে পারেন না সেটা মানতে পারলাম না। আপনারা বয়সে তরুণ। মনে করুন, আপনারা কোথাও টুরে গিয়েছেন। অনেক দিনের আশা রমণীয় প্রেমিকাকে কাছে পাওয়ার। মনের মধ্যে বাসনা জেগে উঠলো এবং পরস্পর মিলে গেলেন কিংবা প্রেমিকার অনিচ্ছা সত্ত্বেও সুকৌশলে আপনি তার শয্যায় সুযোগ নিলেন যা কখনো প্রেমিকা ঘুণাক্ষরে বুঝল না। এমনটি অহরহ হচ্ছে। আমি সিঙ্গাপুর থেকে ডিগ্রী নিয়ে এসছি সাথে আছে পনের বছরের ডাক্তারী অভিজ্ঞতা। সুতরাং কথার ঢেকুর শুনলেই বুঝতে পারি রোগী কোন রোগে আক্রান্ত! রুপু অসহায়ের মতো মুখ করে নাদিমের নীরব মুখের দিকে তাকালো। শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত ডাক্তারের চেম্বারে রুপুর গলার সোনার চেইন ভিজিয়ে ঘাম ঝরে পড়ছে। ডাক্তার বলল– শুনুন, আমার ওয়াইফের যখন প্রথম সন্তান গর্ভে এলো। দেড়মাস হয়ে গেলো আমরা কেউ কিছু বুঝতে পারলাম না। অথচ আমরা একসাথে থাকছি, তাকে দেখছি, তার দৈহিক বৃদ্ধি দেখছি। একদিন আমার ওয়াইফ বলল– শুনছো আমি সম্ভবত মা হতে চলেছি। জবাবে আমি বললাম– একদম সম্ভাবনা নেই। বেশি খাচ্ছো বলে মোটা হচ্ছো। পরে টেস্ট করে দেখলাম সত্যিই আমার ওয়াইফ প্রেগন্যান্ট! আমি কি বলতে চেয়েছি নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন?
কোনো কিছু বলা ছাড়া রুপু ডাক্তারের চেম্বার ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। ডাক্তার নাদিমকে প্রেসক্রিপশন এগিয়ে দিয়ে বলল– দুই দিন পর আসুন।
নাদিম রাস্তায় এসে দেখল রুপু যাত্রী ছাউনির বেঞ্চিতে বসে মাথা নিচু করে কাঁদছে। নাদিম পাশে বসে রুপুর মাথায় হাত রাখলে রুপু মাথা তুলে বলল– সবাই এমন ভাবে কেনো? নাদিম বেঞ্চিতে হেলান দিয়ে বলল– হাজার বছরের মিথ্যে ধারণা এখনো আমাদের সমাজে জীবন্ত। বুঝে না বুঝে কিছু মানুষ সেই সব ধারনাগুলো বিশ্বাস করে গিলে খায় আর ঠিকভাবে হজম করতে না পেরে পরক্ষণে তারাই যত্রতত্র বমি করে!
আজ রাতেও খেতে বসে রুপু বমি করলো। বমি করে ওর রুমে চলে গেলো। রুপুর বমি দেখে ফুফু সরাসরি বলেই দিলেন আজ– তোর মাইয়ার বাচ্চা কাচ্চা হইবো নাকি রে খালেক? মাইয়া লোকের এই লক্ষণটা ভারী পরিচিত। খালেক সাহেব বোনকে বললেন– মেয়ের বিয়েই তো দিলাম না। বাচ্চা হয় কেমনে? এই বলে খালেক সাহেব টেবিল থেকে উঠে গেলো। বোন বমির বিষয়টি কিভাবে নিয়েছেন সেটি বুঝতে খালেক সাহেবের বেশি সময় লাগলো না। পারে তো বোন মুখ ফুটে বলে– তোর মেয়ে কারো সাথে পেট বাজাইছে, খালেক?
রাতেই খালেক সাহেব দম্পতি সিদ্ধান্ত নিলো আগামীকাল রুপুকে নিয়ে ডাক্তার কাছে যাবে। সিদ্ধান্তের শেষে ফুফু এসে ঘরে ঢুকে বলল তাকে যেনো আগামীকাল সকালে গাড়িতে তুলে দেয়। খালেক সাহেব দম্পতি অনেক করে বলল আরো কয়টা দিন থেকে যেতে কিন্তু তিনি রাজী হলেন না। বললেন– গোলাঘরে চব্বিশ কাটা জমির ধান। পাহারা দেয়ার কেউ নাই। ছেলে তিনটা আছে বাড়িতে। থাকলে হবে কি? সারাদিন থাকে বাজারে আড্ডা ফাড্ডা দিয়া। ভাবছিলাম আমার বড় ছেলের লাইগা তোর রুপুর কথা বলমু কিন্তু। বুবুর কথা বুঝতে পেরে মা ফুফুকে কিন্তুতে থামিয়ে বললেন– বুবু, রাত অনেক হয়েছে। জানেন তো আপনার ভাইকে খুব সকাল উঠতে হয়। বুবু ভাইয়ের বউকে আচ্ছা ঘুমাও বলে চলে গেলে খালেক সাহেব বলল– হুম, আমি বসে আছি আমার মেয়েকে বুবুর ছেলের সাথে বিয়ে দিতে। ছেলে তিনটারে এসএসসি পর্যন্ত পড়িয়ে আর পড়ালো না। বলতো টাকা খরচ করে এতো পড়ায়ে কোন লাভ আছে? অথচ ভাইসাবের মতো এতো জমি তাদের গ্রামে আর কারো নাই।
সকালে ফুফুকে গাড়িতে তুলে দিল। সন্ধ্যায় রুপুকে নিয়ে খালেক সাহেব ডাক্তার কাছে গেলো। ডাক্তার অনেকগুলো টেস্ট দিলো বলল রিপোর্ট নিয়ে দুদিন পর দেখা করতে।
রুপু বিছানায় শুয়ে আছে। মা রুপুকে স্যুপ খাওয়াচ্ছে। মা রুপুকে বলল– তোর ফুফুর কথা শুনছিস? রুপু মায়ের কোলে মুখ চেপে ফ্যালফ্যাল করে কেঁদে দিয়ে বলল– তোমার মাতৃত্ব কলঙ্কিত করার আগে আমার মরণ হোক মা। আজকের মতো কখনো রুপুকে এমন অসহায় মনে হয়নি মায়ের। মেয়ের এমন অসহায়ত্ব ক্রন্দন দেখে মা কেঁদে দিলেন।
একদিন সময় বেশি নিয়ে তিনদিন পর নাদিম ডাক্তারকে রিপোর্ট নিয়ে দেখালো। ডাক্তার যা বললো তা কেবল ডাক্তারের বিশাল ডাক্তারী অর্জনগুলোকে ভেংচি কাটে। নাদিম রাস্তা দিয়ে হাঁটছে আর মনে হচ্ছে তার মাথা কেউ লাঠিমের মত ঘুরাচ্ছে। নাদিম চেয়েছিলো রিপোর্টগুলো ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিবে। একবার ছুঁড়ে ফেলতে গিয়েও পারলো না। ভাবলো রুপুকে নিয়ে রিপোর্টগুলো দেখানো প্রয়োজন এবং দেখিয়ে বলা রুপু দ্যাখো তুমি একা বমি করো না। ডাক্তারও বমি করে অনির্দিষ্ট অনুমানে।
রিপোর্ট নিয়ে খালেক সাহেব ঘরে ঢুকতেই মা ব্যস্ত হয়ে বলল– শুনছো? গ্রামের বাড়ি থেকে সবাই ফোন করতেছে। বুবু গিয়ে বলছে রুপু নাকি প্রেগন্যান্ট! মান সম্মান সব বুঝি গেলো। খালেক সাহেব স্থির দাঁড়িয়ে থেকে কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন– আমাদের রুপুর লিভার ক্যান্সার হয়েছে! ভেতরের রুম থেকে রুপু দৌড়ে এসে বেসিনে বমি করা শুরু করলো আর সেই বমিগুলো পড়তে লাগলো ফুফুর কুসংস্কারে কলুষিত মিথ্যে ধারণার মুখে।