প্রাককথন
সকালে, ডিজিটাল ঘড়ি দশ ঘটিকার সিগন্যাল দিলে মান্না মুমিন মিকিমাউস হয়ে স্টোর রুম থেকে বাহির হয়ে আসে। ততোক্ষণে ডিজিটাল প্লাসের সকল চাকুরে যদিও অফিসে যোগ দিয়ে পারে নাই কিন্তু মান্না মুমিনদের লেট করে আসার কোনো সুযোগ নাই। অফিস খোলার কুড়ি মিনিট আগে অথবা, তারও আগে এসে মান্না মুমিনরা মনুষ্য স্টাইলের পোশাক বদলে মিকিমাউস হয়ে দশ ঘটিকার অপেক্ষা করে। আর অপেক্ষা বলতে মিকিমাউস হয়ে বসে থাকা মুশকিল বলে স্টোর রুমের জানালার গ্লাস আয়না বানিয়ে নতুন ভঙিমায় ট্রায়াল দেয়। বাচ্চারা তো বটেই বড়োরাও এখন ভঙ্গিমা প্রিয়, এবং ভঙ্গিমা যতো অদ্ভুত হয় তারা ততো বেশি পুলক অনুভব করে। অফিস তাই মিটিংগুলোতে নতুন নতুন আর অদ্ভুত সব ভঙ্গিমার কথা বলে। কিন্তু এতো নতুন নতুন ভঙ্গিমা আর কোথায় পাওয়া যায়। মান্না মুমিনের মনে হয়, ঘুরে ফিরে শেষ পর্যন্ত ভঙ্গিমা সব একই রকম হয়ে যায়। তবু আশার কথা, বাচ্চারা মিকিমাউসের সাধারণ চলাফেরা দেখলেও হাসে, এক সাথে নাচে গায়। কিন্তু বড়োদের চোখের উপর অস্বস্তির ছায়া ঝুলে থাকে যে, এই একরকম জিনিস একই রকম কতোদিন আর সহ্য করা যায়। কী আর করার এখন, পৃথিবীর গতি বেড়ে গেছে বলে নতুন খুব তাড়াতাড়িই পুরাতনের তকমা পেয়ে যায়। জীবনটাও আসলে পুরনো এক সিন্দুক, নতুন নতুন বস্তু দিয়ে ভরিয়ে নেয়ার জন্য মানুষ এমন হন্যে হয়ে ছোটাছুটি লাগায়। সেই-ই কেবল হয়ে থাকলো আধেক সচল আধেক অচল পুরনো মিকিমাউস। কারণ অর্থকড়ি অন্তত মানুষের জীবনে এখন পর্যন্ত পুরনো হয়ে ওঠে নাই। এ জন্যই হয়তো দশ বছর যাবত সে ডিজিটাল প্লাসের মিকিমাউস। বছর বছর তার বেতন বাড়লেও পদের কোনো উন্নতি নাই আর সম্মান বিষয়ে বলা যায় এমন কোনো ভাষ্য নাই। তবু দশটা বছর, এখানেই যে পার হয়ে গেলো আর যেনো কোনো রাস্তা নাই। তবে এটাই চির সত্য কথা নয় বরং অন্য বাস্তবতাও তার জীবনের সাথে ঘনিষ্টভাবে জড়িয়ে আছে। সেটা বলার আগে শুরুর কথাটা আগে বলা যাক, যখন দেশের অবস্থা এমন মরণাপন্ন যে, সে গ্রাজুয়েট হয়ে চাকরির জন্য ঘুরছিলো আর ছোটো এ দেশে বছর বছর লাখ লাখ গ্রাজুয়েট বাহির হয় কিন্তু, উল্লেখযোগ্য কোনো নিয়োগ নাই। পৃথিবী যে এতোদূর এগোলো কিন্তু এ দেশের কপাল থেকে আর পোড়া দাগ মোছে না। কর্মহীন যুবসমাজ হাজারে হাজারে রাস্তায় নেমে অবরোধ করে, চারদিক ছাই হয় নীরব আগুনে পুড়ে। আর যুবকেরাই বা কী করে; তাদের মাথার উপরে পরিবার আর ছায়া হয়ে থাকে না। সারাজীবনের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে প্রেমিকারা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে সুবিধা মতো ঘর বাঁধে। সে এক জীবন বটে যে জীবনে চলাচল আছে কিন্তু কোনো গতি নাই এবং, ট্রাজেডির বাহিরে আর কোনো পরিণতি নাই। তখন এমনি এক জীবন নিয়ে মান্না মুমিন মাতালের মতো পথে পথে। মাথার ভেতরটা বড্ড ফাঁকা, হৃদয় বলে কিছু আছে কিনা অনুভব করার ফুসরত নাই। আর যতোটুকু আছে তার আবার বারো আনা অভিনয়। যদিও পরিবার তখনো পুরোপুরি ছায়া উঠিয়ে নেয় নাই কিন্তু খানিকটা মুখ ফেরাতে শুরু করেছে বটে। তবে আশার কথা হলো, প্রেমিকা তখনো বারবার ধৈর্য্যরে পরীক্ষায় উৎরে গিয়ে যুগের বিপরীত স্রােতে চলার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে। এমনি সময়ে, আতেলের মোড়ে একদিন হোঁচট খেতে খেতে বেসরকারী নোটিশ বোর্ডে লাল কালারের প্রজ্ঞাপন চোখে পড়ে। ডিজিটাল প্লাসের জন্য তিনজন কর্মচারী আবশ্যক যার আবার, যোগ্যতাও তার ভেতরে পুরোপুরি। সুস্বাস্থ্য ও লম্বায় পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চি, এবং গ্রাজুয়েট। মাইনেটাও লোভনীয়।
শেষ পর্যন্ত হোঁচটকে কপাল মনে করে, সাক্ষাৎকারের নির্দিষ্ট সময়ে মান্না মুমিন ডিজিটাল প্লাসের অফিসে গিয়ে হাজিরা দেয়। ততোক্ষণে অনেক চাকরি প্রার্থী আশা ভরসায় মুখ বাড়িয়ে বসে গেছে। কিন্তু চাকরি বিষয়ে হাতে হাতে বিস্তারিত নোটিশ দেয়া হলে সবার মুখ থেকে আলো ঝরে যায়। চাকরিটা হলো মিকিমাউসের যে কিনা নেচে-কুদে লম্প-ঝম্প করে মানুষকে বাড়তি বিনোদন দেয়। তবু যে সময়টা দারুণ অসহায় সে সময়ের কথা ভেবে অনেকে পিটিশনে নাম লেখায় এবং, চূড়ান্ত বাছাইয়ে আরো দুজনের সাথে মান্না মুমিন ডিজিটাল প্লাসের মিকিমাউস পদে চাকরি পেয়ে যায়। তাতে করে মনে হয় জীবন থেকে একটা অভিশপ্ত অধ্যায় শেষ হয়ে গেলো। জীবনটা যে ভারি ক্লিশে, উপস্থিত উদ্ধারের সময় কে আর সেটা মাথায় আনতে চায়।
অর্থকষ্ট দূর হয়ে যায় বটে কিংবা পরিবার আর প্রেমিকার বুকের দীর্ঘশ্বাস মুক্তি পেয়ে গেলেও আরো কিছু জটিলতা তৈরি হয়ে যেতে সময় নেয় না। প্রথমত, চাকরির বিষয় সম্পর্কে ঠিক মতো কাউকে আর বলা যায় না। দূরের এক অফিসে ভালো বেতনের একটা চাকরি এবং অমুক তমুক পোস্ট; এমন কিছু একটা বলে-কয়ে মানুষকে আশ্বস্ত করে ঠিক মতো স্বস্তিও পাওয়া যায় না। তবুও তো চলছিলো, খোলা চোখে দেখলে যেটা মন্দ নয়। মিকিমাউসের মুখোশে সকাল বিকাল নেচে-কুদে ছেলে-বুড়োকে মজা দিয়ে যায় ভেতরের বিষণ্ণ অপমানিত মানুষ এক, যে মানুষের মুখ দেখা যায় না বলে একে চেনাও যায় না, তার অন্তর্গত বেদনা ছাড়া। তবু ভেতরে ভেতরে তার নেশা জমে ওঠে মানুষের বিভ্রান্ত ও অন্তর্গত ভাঙ্গনের রূপ দেখার। পৃথিবী, সভ্যতা ও মানুষ যতোটা দূর এগিয়েছে মানুষ ততোটাই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে, ভেতরে নগ্ন ভাঙন মানুষকে বোধশূণ্য করে দিয়েছে। যেনো, একটা জীবনের আর কোনো পরিণতি নাই ক্ষয় ছাড়া। মিকিমাউসের আড়ালে দুটি চোখ সিসিক্যামেরার চেয়েও গোপনে, অন্তর্গত ও বাহিরগত কতো বেদনা ও ভাঙনের দৃশ্য সে ধরেছে। এটাকেই সম্ভবত বলে মানুষ দেখার নেশা, এবং তার জীবনের আড়ালের সে গল্পের সাথে এ নেশা এক হয়ে তার মিকিমাউস জীবন দীর্ঘায়িত করেছে।
ডিজিটাল প্লাসের সংক্ষিপ্ত পরিচয়
এই ডিজিটাল প্লাস, যেটা কিনা তিন বয়সের মানুষের বিনোদন কেন্দ্র এবং তার জন্য রয়েছে আলাদা তিনটা সেক্টর। প্রথমটা হলো শিশুদের, যেখানে আছে লাইভ গেমস পয়েন্ট এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে জার্নি করার বিভিন্ন অপশন। এখানে অবশ্য বুড়ো এবং যুববয়সীরাও জার্নি করতে পারে শিশুদের সাথে।
দ্বিতীয় সেক্টর, যেটা শুধুমাত্র এ্যাডাল্টদের জন্য এবং প্রবেশ করার শর্ত হলো আদম হাওয়ার মতো জোড়া থাকতে হবে। এখানে যুববয়সীদের রোমান্স করবার মতো বিভিন্ন উপায় উপকরণ তৈরি করে রাখা আছে।
শেষ সেক্টরটা হলো বুড়োবয়সীদের জন্য যেখানে আছে শান্ত পরিচ্ছন্ন পারিপার্শিক পরিবেশ, উদ্যান ও লেক, লাইব্রেরী এবং নিঃসঙ্গদের সঙ্গ দেবার জন্য কর্মরত কয়েকজন বুড়োবুড়ি।
এই তিনটা সেক্টরের জন্যই মূলত, তিনটা মিকিমাউস নিয়োগ দেয়া হয়েছে মানুষজনের বিনোদন পূর্বক দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কিংবা আগতদের অভিবাদনের জন্য। এ বিষয়ে মান্না মুমিনের বিশ্বাস এমন যে, এখানে যারা আসে তারা কৃত্তিম বিনোদনে ডুবতে আসে বিষণ্ণতার ভেতর দিয়েই সাঁতার কাটতে কাটতে। চারপাশের ভাঙন থেকে, নোংরা ক্লেদ অস্বস্তিকর গর্ভ থেকে, দীর্ঘ পায়ে হাঁপাতে হাঁপাতে মৃতের মতো ফ্যাকাশে মুখে তারা আসে। হায় মানুষ, উপরে উঠতে উঠতে কখন যে সঙ্কটের তলানিতে ঠেকে গেছে তা নিয়ে বোধ হয় কারো কোনো ধারণা নাই। তবে মানুষ, মুক্তির জন্য কখনো এখানে ওখানে ছোটে যেখানে গেলে বুক ভরে সবুজ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা যায় অন্তত। কিন্তু ডিজিটাল প্লাস মানুষের ভেতরে কতোটুকু বাঁচার সবুজ প্রণোদনা জাগায় তা নিয়ে মান্না মুমিনের ঢের সন্দেহ হয়। সে অন্তত এখানে রুগি হয়ে নিরাময়ের জন্য আসে নাই, যেখানে তার রোগ হলো চিরস্থায়ী ফোঁড়ার মতো যা সারবার নয়। তবে এই বিষয়ে বিশ্বাস রাখা যেতে পারে যে, যতো বীভৎস গহ্বর থেকেই উঠে আসুক না কেনো এখানে এলে কিছু সময়ের জন্য হলেও মানুষ প্রাণের একটু একটু স্বাদ পায়। প্রাণের পরে মিথ্যে আড়াল হলেও জেগে ওঠে অন্তত, যেটা মানুষের চোখ মুখ দেখেই অনুমান করা যায়।
অন্তর্গত বেদনার গল্প
এবার, প্রথম দিককার কথা মনে করা যায় যেটা মূলত তার জীবনের আড়ালের সে গল্পের খোঁজ-খবরের জন্যই যখন, মান্না মুমিন ডিজিটাল প্লাসে এসে একটু একটু মানুষের ভেতরে ভাঙনের সুর টের পেতে শুরু করে। কিন্তু ভাঙনের বিষয় প্রকরণ সম্পর্কে তখনো মনের ভেতরে অবছা অন্ধকার। তার নিজের ভেতরে এবং নিজের মানুষদের ভেতরে কেমন ভাঙন তৈরি হয়ে যায় এবং দিনে দিনে কেমন ক্ষয় বাড়ে সে বিষয়ে তখনো পষ্ট বোধ হয় নাই। শুধু অনেক দূর থেকে বেদনার কেমন এক সুর বয়ে আসে, মাঝে মাঝে সেটা অনুভব করা যায়।
এখানে, চাকরিতে এসে, প্রথমেই চার দেয়ালের ঘেরাটোপে পড়ে যেতে হয় এবং সেই সাথে চাকরি বিষয়ক বিড়ম্বনার বিষয়টাও বাদ দেয়া যায় না। তার প্রেমিকা হিরে পান্না তখন দারুণ খুশি হয়ে মিলন করবার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির বিষয় তুলতে লাগে ঘন ঘন। মান্না মুমিনের যদিও তাতে বাঁধা দেবার মতো আর কোনো ছুতনো নাই কিন্তু, সে কিসের যেনো অপেক্ষা করে। অঢেল অর্থ-সম্পদ জমানোর বিষয় কিনা যদিও তাদের জীবনে তার বিশেষ কোনো দরকার নাই। কিংবা, সে আরো ভালো কোনো চাকরির প্রত্যাশায় থেকে থাকবে বিয়ে করার আগে, অথবা মিকিমাউস পদ থেকে অন্তত অন্যপদে ট্রান্সফার করার প্রত্যাশা হয়তো। না হিরে পান্নার ওপর থেকে মন সরে আসতে লাগে কিনা অথবা, সামাজিকতা এবং বিয়ে প্রথার ওপর ঘোর বিরক্তি কিনা সে বিষয়ে মনের চিন্তাধারা ভালো বোঝা যায় না তখন। তবে এটুকু বোঝা যায় যে, বিয়েশাদি বিষয়ে মনের ভেতরে বেশ অনিহা বিস্তার হয়ে আছে সে সময়ের পুরোটাজুড়ে।
কী আর করণীয়, তখন মাথার ভেতরে কোন সমাধান কাজ করে না এবং হিরে পান্নাকেও বুঝিয়ে কিছু বলা যায় না। আবার তার সম্পর্কে উদাসীন হয়ে থাকতেও মনের ভেতরে সায় পাওয়া যায় না যে কিনা তার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করে আছে। আর এ হলো একটা দিকের কথা অন্যদিকে, আরো আরো দিক আছে যেগুলো তাকে আরোও বিভ্রান্ত করে তোলে। সেখানে চাকরিটা পাবার পর, মান্না মুমিন আর আগের মতো সময় বের করতে পারে না, যে সময়টা প্রিয়দের সাথে কাটানো যায়। একটা সময় অতীত হয়ে গেছে যখন চাকরি ছিলো না কিন্তু জীবনটা ছিলো বিন্দাস, খাও দাও মজা লও আর যখন তখন প্রেমিকার সাথে চিপা গলিতে পাকের্র বেঞ্চে বসে ডেটিং মারো। ঘোরাফেরার পয়সা নিয়ে তখন অতোটা ভাবতে হয় নাই হিরে পান্নার পার্টটাইম জব আছে বলে। হায়, কোন জীবন যে সুখের আর দুঃখের কোনটা সেটা আর ঠাহর করা যায় না যখন পুরো জীবনটা এক রকম সন্ধিক্ষণ মনে হয়। কিন্তু, অতীত স্মৃতি হয়ে যায় বলে তাকে ভোলা যায় না আর ভোলা না গেলে তাকে বারবার মনে পড়তে থাকলে সে সময়কে ফিরে পেতে মন চায়। বাস্তবতা আবার এইসব জীবনের মতো ঘিনঘিনে, বর্তমান থেকে বাহির হতে পারে এমন সাধ্য আছে কার। মান্না মুমিনও বর্তমান ও বাস্তবতার বাহিরের কেউ নয় যে, ইচ্ছে মতো জীবন থেকে মুহূর্ত বেছে নেয়। তবু, হিরে পান্নার সাথে কাটানো সে সময়ের কথাই বারবার মনে পড়ে যখন ঠিকঠাক মতো ইচ্ছের বাতাসের ভাবগতি আর টের পাওয়া যায় না।
হিরে পান্নাও বুঝি ম্লান হয়ে যেতে থাকে যখন মান্না মুমিন আর তার জন্য সময় রাখতে পারে না। কিন্তু মান্না মুমিন-ই বা কী করে; তার অফিসের সাপ্তাহিক ছুটি এমন দিনে যার সাথে আর কোনো প্রতিষ্ঠানের হলিডে’র মিল পড়ে না। অন্যদিকে অফিস আওয়ার সকাল দশটা টু রাত আটটা, যেখান থেকে সম্ভব না আর কিছুর জন্য সময় বাহির করা। হিরে পান্না এর ভেতরে একদিন, ফোনে অসহায় আকুতি করে ডিজিটাল প্লাসের এডাল্ট সেক্টরে ভিজিটের কথা কয়। সেটা অবশ্য তার (মান্না মুমিনের) সাপ্তাহিক ছুটির দিনটাতেই যখন তার অবসর হয়। মান্না মুমিন তখন স্বপন দেখে, চারপাশে তার প্রাগৈতিহাসিক বন, যখন কিনা বান্দরের দল পৃথিবীতে মানুষে বিবর্তন হয়ে পারে নাই। একমাত্র সে-ই, যেনো বিবর্তন হয়ে পাকা আপেলের মতো টুপ করে মাটিতে পড়ে গেছে আর, বিশাল সব হিংস্র প্রাণীদের ভেতরে থেকে জীবনের তুমুল সংকটে প্রাণ রক্ষার কথা ভাবতে লেগেছে। কিন্তু হায়, প্রাণ রক্ষার বুঝি আর কোনো সুযোগ নাই। কী আর করার তবু, উদ্ধার যদি মেলে সে আশায় সে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে পাঁচ-দশরকমের কথা বলে হিরে পান্নার কানে মন্ত্রণা দেয়। আর হিরে পান্না কিছু বোঝে কি বোঝে না, শুধু এ বিষয়ে সে আর কোনো কথা বলে না। মান্না মুমিনের ভেতরজুড়ে তখন তুমুল তোলপাড় হয়, কেনো যে শুরু থেকে সে মানুষকে ফাঁকি দিতে লেগেছিলো, এখন যে সে নিজেই তুমুল ফাঁকিতে পড়ে গেছে। জীবনের বাঁকে বাঁকে যে এতো ফাঁদ আর কখন যে তাতে আটকা পড়তে হয় অনুমানটুকু করা যায় না।
কিন্তু এভাবে আর কতোদিন চলা যায়; একটা সিদ্ধান্তে আসার সময় হয়েছে বলে মনে হলে সে প্রথমত চাকরিটা পাল্টানোর কথা ভাবে। যে ফাঁকিতে সে একবার পড়েছে তার থেকে ভালোভাবে উদ্ধারের এ ছাড়া আর পথ নাই। যদিও চাকরির বাজার আগের চে কোনো ভাবেই উন্নত হয় নাই তবু চেষ্টা করলে যে সফলতা মেলে, এ বাক্যে মন এখনো বিশ্বাস হারায় নাই। এখানে আবার সমস্যার জায়গা হলো সে চেষ্টা সফলতার মুখ দেখবে কবে তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নাই। কিন্তু এখন কী করে হিরে পান্নার সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটানো যায় সে বিষয়ে মাথায় কোনো বুদ্ধি আসে না। আর বুদ্ধি আসে না বলে, সম্পর্ক তাদের টিকে থাকে বটে সে এক আড়াল নিয়ে, আগের মতো কোথাও আর প্রাণ পাওয়া যায় না। এভাবে যেতে থাকলে, বছর দুই পার হয়েছে কি হয় নাই ঠিক এমন এক সময়ে, তার আরেকটা চাকরির কথা পাকা হয় এবং এমন চাকরি, যার কথা গর্ব করে সবার কাছে বলা-কওয়া যায়। কিন্তু শুরুতেই সে কথা সে হিরে পান্নার কাছে বলে না। কীভাবে তাকে সারপ্রইজ দেবে, সে কথা ভাবতে ভাবতে দুয়েক সপ্তাহ পার হয়ে যায়। তারপর ডেট একটা ঠিক করে যেদিন, তার সাপ্তাহিক ছুটির দিন এবং সেদিন নাকি হিরে পান্নারও কোনো কারণে অফিস নাই এমনি একটা দিনে। তার আগের দিন সন্ধে বেলার আগে, যখন সূর্য লাল হতে হতে তখনো রক্তের মতো গাঢ় হয়ে পারে নাই, মান্না মুমিন তখন আগামীর কথা ভেবে দারুণ লালায়িত হয়ে এ্যাডাল্ট সেক্টরে ডিউটি করতে করতে নিজেরে বলে- এই তো আর কটা দিন তারপর এই নরকযাপনের দিন শেষ হবে। জীবনটা যে সত্যিই সুন্দর আর রোমাঞ্চকর সেটা বুঝি এমন সব মুহূর্তের জন্যেই খাটে। তখন টিকিট হাতে ধরে এ্যাডাল্ট সেক্টরের দিকে এগিয়ে আসে দুই জোড়া তরুণ-তরুণী। মান্না মুমিন এগিয়ে যায় আর তাদের স্বাগত জানাতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। তখন এগিয়ে আসে দুইজোড়া তরুণ তরুণী আর তাদের ভেতরে একজন, সে হিরে পান্না, কাছে এসে আঘাত লেগেছে কিনা জিজ্ঞেস করে। মান্না মুমিন নির্বাক চোখে পেছনে সরে এসে প্রতিক্রিয়াহীন দাঁড়িয়ে থাকলে তরুণীর দল অবাক হয়ে তাদের পুরুষ সঙ্গীর হাত ধরে এ্যাডাল্ট সেক্টরের ভেতরে ভিজিট করে।
মান্না মুমিনের বোধ যেনো স্ট্রাইক করে বসে, তখন, আসলে তার কী করণীয় হতে পারে সে তা বুঝে ওঠে না। এবং তার ভেতরে তখন কেমন ভাঙ্গাচোরা চলে তাৎক্ষণিক সে বিষয়েও ভালো কিছু টের পায় না শুধু মনে হয়, দেহ মন অবশ হয়ে আসতে লেগেছে। হঠাৎ দুর্ঘটনায় যেনো দেহের সব রক্ত ঝরে গিয়ে দেহটা পৃথিবীর মতো ভার হয়ে গেছে। হায় হায়; সাজানো গোছানো ফুলের বাসরে বুঝি এভাবেই ঝড় এসে সব ললণ্ডভণ্ড করে দেয়। নাকি এটাই ছিলো প্রাপ্তি কিংবা কর্মফল; এসব ভেবে মনের অলিতে গলিতে সে সান্ত্বনা হাতড়ে চলে। কিন্তু সান্ত্বনা তো আর সহজে আসে না বরং খুব গভীর থেকে বল্কে বল্কে কান্না উঠতে চায়, যে কান্না কিনা বহুদিন প্রকাশ্যে হাজিরা দেয় নাই। এভাবে, কতোক্ষণ সে বেদনার ক্ষতের ভেতরে ডুবে থেকে শেষে হঠাৎ জেগে উঠে এ্যাডাল্ট সেক্টরের গেটের দিকে তাকায়। সে কি আসলে বড্ড বোকার মতো কাজকারবার শুরু করে দেয় নাই যেখানে, একটা মেয়ে একটা ছেলের সাথে কোথাও বেড়াতে আসতেই পারে, তারা যদি পরস্পরে মতামত দিয়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে সম্পর্ককে বিশেষ বিশেষণ দিয়ে বিশেষায়িত করার কোনো অর্থ নাই। তবে মনের ভেতরে আশঙ্কা জাগায় ডিজিটাল প্লাসের এ্যাডাল্ট সেক্টর নিয়ে যেখানে বিশেষ সম্পর্কের কেউ ছাড়া সহজে ভিজিট করে না।
মান্না মুমিন এবার হিরে পান্নার খোঁজ করতে দুরু দুরু বুক নিয়ে এ্যাডাল্ট সেক্টরের ভেতরে ঢোকে। ভেতরে ঢুকেই মান্না মুমিন আরেক দফা হোঁচট খায় এবং যে হোঁচটকে সে একদিন ভাগ্য মেনেছিলো, তাকেই আজকে দুর্ভাগ্যের নমুনা মনে করে। ভেতরে এসেও সে নমুনা প্রতিফলিত হয় যখন চারপাশে কোথাও কোনো জুটি চোখে পড়ে না। অথচ দুপুরের পর থেকে কতো জুটি ভেতরে ঢুকেছে বাহির হয়েছে তার হিসাব কিতাব সে রাখে নাই। সবাই তবে কোথায় গেলো অথবা কোথায় যায় এতো গভীর হয়ে কখনো সে খোঁজ লাগায় নাই।
তারপর সে ঘন উদ্যানের দিকে যায় এবং সেখানে গিয়ে সে দীর্ঘ কান্নার সিম্ফনি শুনতে পায়। এরচে অবাক হবার আর কী আছে যে, রোমান্স পয়েন্ট থেকে হু হু কান্নার সিম্ফনি শোনা যায়! দারুণ কৌতুহল মান্না মুমিনের চলার গতি দ্বিগুণ করে দিলে দ্রুতই উদ্যানের ভেতরে এসে দেখে, লাভট্রির ঘনপাতার আড়ালে বসে হিরে পান্না তার পুরুষ সঙ্গীর হাত ধরে হু হু কান্নার সিম্ফনি বাজায়। আর তার তালে তালে, আশে পাশের সব জুটি শোকের মতো নৃত্য করে।
মান্না মুমিন মোহগ্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, তার ভেতরে আকণ্ঠ ডুবে যেতে যেতে কান্নার একটি সরোবর খুঁজে পায়। কিন্তু বাহির হয়ে আসে ঠা-ঠা হাসি, যার প্রতিক্রিয়ায় হিরে পান্নার কান্নার সিম্ফনি থেমে যায়।
একটি মিকিমাউস হো হো করে হাসতে হাসতে ঘন উদ্যান ছেড়ে আসলেও পেছন থেকে তখন আর দীর্ঘস্বরের কান্নার সিম্ফনি শোনা যায় না।
সমাপ্তি, যদিও বেদনার কোনো শেষ হয় না
মান্না মুমিন সেদিন রাতে ঘরে এসে হিরে পান্নার পক্ষ থেকে একটি নেমন্তন্নের কার্ড পায় যে, আগামি এক তারিখে, তারা (হিরে পান্না+ নামটা তার চোখে ঝাপসা ঠ্যাকে) মিলন করবার সামাজিক বৈধতার জন্য আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন করতে চলেছে।
তারপর,
সে মাস চলে গিয়ে এক-দুই করে বছর চলে যায় আরো আটটি, তবু তার চাকরিটা আর পাল্টানো হয় নাই।