দীলতাজ রহমান
জন্ম ১৯৬১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ জেলার চন্দ্রদিঘলয়া গ্রামে। কবিতা দিয়ে লেখালিখি শুরু করলেও পাঠকদের কাছে গল্প দিয়েই বেশি সমাদৃত। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: তারান্নুম (গল্পগ্রন্থ), গল্পসমগ্র-১
দীলতাজ রহমান

বিন্দু

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

এই চাকরিটি হওয়ার পর রুনু যেদিন প্রথম অফিসে গিয়েছিলো, সেদিনই রিকশাটি অফিসের গেটের কাছে পৌঁছুতে না পৌঁছুতেই দেখতে পেয়েছিলো হন্তদন্ত হয়ে বিন্দু যাচ্ছে। রুনুর বুকের ভেতরে যেনো বিদ্যুৎ ছলকে উঠেছিলো তাতে। সে রিকশা থামিয়ে দ্রুত নেমে এগিয়ে গিয়েছিলো ওর পিছনে পিছনে। বিন্দু… বিন্দু… ডাক শুনে ঘাড় ফিরিয়েছিলো যে, রুনু দেখলো সে বিন্দু নয়। বিন্দুর মতো দেখতেও নয়। এগোনো কদম ক’টি রুনু পিছোতেই সেদিন রিকশাওয়ালার কথায় বুঝেছিলো, সে রিকশা ভাড়া না মিটিয়েই উল্টোদিকে অমন ছুটেছিলো।

কতো বছর বিন্দুকে দেখে না রুনু, তবু কেনো অহরহ ওকেই সে দেখে? দূর থেকে কোনো মেয়েকে দেখলেই যতোক্ষণ না সে চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে ততোক্ষণ বিন্দু ছাড়া আর কারো ছায়া রুনুর মনে আসে না। অথচ বিন্দু একা ওর এতোখানি তখন ছিলো না। ক্রমশ হয়ে উঠেছে নিজের দীঘল ছায়ার মতো।

সময়টা ছিলো দেশ স্বাধীনের পরের বছর। রুনু তখন স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। হঠাৎ-ই স্কুলে উস্কখুস্ক চুল রুক্ষ, হাঘরে, হা-ভাতে মার্কা কতোগুলো ছেলেমেয়ে এসে ওদের স্কুলে ভর্তি হয়েছিলো। তবে সস্তা দামের হলেও তাদের পরনের পোশাক ছিলো পরিচ্ছন্ন। এদের মধ্যে ওদের ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলো একটি মেয়ে, নাম উম্মে কুলসুম ওরফে বিন্দু। স্কুলের অন্যান্য ক্লাসে ওরা একই সঙ্গে ভর্তি হওয়া ছেলেমেয়েদের মুখে ওকে বিন্দু নামে ডাকতে শুনে, ক্লাসের সবাই ওকে বিন্দু বলেই ডাকতো।

স্কুলে কো-এডুকেশন সিস্টেম হলেও ছেলেগুলোর সঙ্গে ওদের কোনো কথাই হতো না। একটা দূরত্ব সব সময় বহমান থাকতো। আর এটাই ছিলো তখন সম্মানের। যেনো এটা পরস্পরের প্রতি সম্ভ্রমের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু বিন্দুকে এড়িয়ে চলতো স্কুলের সবাই অর্থাৎ মেয়েরাও। ওকে পাত্তাই দিতো না কেউ! সবাই ওর থেকে সরে থাকতো। তাদের ভাবাখানা ছিলো যেনো এখনই বিন্দু ওদের কারো কাছে কিছু চেয়ে বসবে। বিন্দু সুযোগ বা প্রশ্রয় পেলে ওদের কাছে কিছু চেয়ে বসতো কি না ওধরনের নিরীক্ষা ওকে নিয়ে  রুনু কখনো পারেনি।

তবে এটুকু বুঝতে পারতো সে, বিন্দুর চোখে-মুখে ভাসতো রাজ্যের ক্ষুধা। ওর মতো ছাত্রছাত্রী অন্য আরো যে সব ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলো হঠাৎ এসে, তাদের সবার অভিব্যক্তি প্রায় একই রকম ছিলো। চোখের কোটরে এতোটুকু আলো নেই, ক্ষুধার আগুন ছাড়া।

স্কুলের খুব কাছে রুনুদের বাড়ি। টিফিনের ঘণ্টা পড়তেই হুড়মুড় করে যারা বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করতো, তাদের মধ্যে রুনুও একজন ছিলো। রুনুকে ক্যাবলাকান্ত দেখেই বোধহয় পায়ে পায়ে ওর সঙ্গে রওয়ানা হতো বিন্দু। হিসাবের রান্না ওদের কখনো হতো না। তাই বলে অঢেলও হতো না। তবু তাদের ভাইবোনদের সঙ্গে কেউ গেলে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তারও খেতে বসে পড়ার আহ্বান থাকতো। এভাবে প্রায় প্রতিদিন টিফিনে বিন্দু ওর সঙ্গে দুপুরের খাওয়াটা সেরে আসতো।

ততদিনে বিন্দুর প্রতি রুনুর প্রগাঢ় মায়া বসে গেছে। কারণ স্কুলে প্রায়ই মেয়েদের মধ্যে একজনের জন্যে আরেকজনের এক ধরনের টান দেখে, ওধরনের টানের লোভ রুনুরও হতো। কিন্তু তেমন কারো সঙ্গে ওর ওরকম বিশেষ ভাবটি হয়ে উঠেনি। কারণ দ্বিধা-জড়তা। হয়তো বা তা নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ার হীনমন্যতাও ছিলো রুনুর। আর সেটুকু ভেদ করে কেউ ওর কাছে আসেনি বা ও নিজেও এগোতে পারেনি কারো বন্ধুত্ব চেয়ে। তাই বিন্দুর এই সেঁটে থাকাটা এক সময় ভালো লাগতে শুরু করে রুনুর।

বিন্দুর সঙ্গে ভাবের আদান প্রদানে রুনু বুঝতে পারে, ও ওদের থেকে অনেক বেশি বোঝে; কম সময়ে হলেও জীবনের বিভিন্ন দিক ওর ওপর আলো ফেলে গেছে। কিন্তু তার থেকে কতোটুকু বলতে হবে, কতোটুকু চেপে যেতে হবে, ও ওইটুকু বয়সে তাও জানতো। আর তারই কিছু বিকিরণে রুনু আজো ঝলসে যায়। বিন্দুই রুনুকে চিনিয়েছিলো তার নিজের বাপকে। প্রকট করে দিয়েছিলো মা নামক অস্তিত্বের অবস্থান কতো ঠুনকো এক একটি পরিবারের মধ্যে।

একদিন বিন্দু টিফিনের সময় রুনুদের বাসায় না গিয়ে বরং ওকে টেনে নিয়ে গেলো উল্টো দিকে। যেতে যেতে যেখানে গিয়ে ও রুনুকে নিয়ে পৌঁছালো, রুনু দেখলো সেটা একটা এতিমখানার মতো। অসহায় কিছু ছেলেমেয়ের রক্ষণাবেক্ষণকারী দু’তিনজন খ্রিস্টান মহিলা। একবারে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় সেটা। যা হোক, বিন্দু ওকে নিয়ে মুখে-শরীরে ভাঁজ পড়া, কালসিটে এক মহিলার সামনে দাঁড় করিয়ে বলেছিলো ‘মাদার! ও আমর ক্লাসে পড়ে। স্কুলের কাছে ওদের বাড়ি। ও আমাকে ওদের বাড়ি আজ রাতে থাকতে বলেছে, থাকবো মাদার?’

মাদার রুনুকে মিষ্টি কৈফিয়ত তলবের মতো ঘাড় নিচু করে, বড় চোখে বললো, ‘ঠিক তো?’

ভয়ে শীতলাগা শুরু হয়ে গেলো রুনুর। দুপুরে খাওয়ার সময় উৎপাত সহ্য করতে ওদের বাড়ির মানুষেরা অভ্যস্ত। তাই বলে রাতে থাকা? মা-বাবা একদমে আছড়ে মারবেন ওকে, এমন রাতে পরের বাড়ি থাকতে চাওয়া মেয়েকে নিয়ে তুললে। তবু ভয়ে ভয়ে, মানে মাদারের ভয়েই রুনু বললো, ‘হ্যাঁ’।

মাদারকে ভয় পাওয়ার কারণ মাদারও গল্পে পড়া নাটকে দেখার মতো নয়। ওদের মতোই হাঘরে। ওইটুকু সময়ের মধ্যেই রুনু বুঝতে পারে এদের কার ওপর বিশ্রি রকমের অভিযোগ তিনজন মাদারেরই। কারণ, পরিদর্শন করতে আসা কোনো কোনো পরিদর্শককে কোনো কোনো ছেলেমেয়ে বলেছে, আমরা ঠিকমতো খাবার পাচ্ছি। এতেই তিনজন মাদার তিনরকম করে খিঁচে আছেন ‘কেনো এমন বলা? থাকিস তো দু’বেলা আধপেটা খেয়ে, আর এক বেলা না খেয়ে… কে এ কথা এদেরকে শিখিয়ে দিয়েছে!’ এখন এদের পেটে পাড়া দিয়ে তা বের করতে এরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

বিন্দু তারপর থেকে প্রায়ই রাতে রুনুদের বাড়ি থাকতে শুরু করে দিলো। ওদের একগাদা ভাইবোনের মধ্যে ওকে ছাড়াও সে ওর অন্য বোনদের সঙ্গেও ঢালা বিছানায় ঘুমোতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো। একদিন ঘুম থেকে উঠিয়ে নিয়ে মা রুনুকে নিয়ে চলে গেলেন একেবারে বাড়ির ঢালে, তারপর আচ্ছা মত শাসালেন। প্রচণ্ড থাপ্পরের প্রস্তুতি নিয়ে বললেন, ‘আর যদি ও মেয়েকে এ বাড়িতে আনিস!’

রুনু ভেবেছিলো, বিন্দু বুঝি কিছু চুরি করে খেয়েছে, অথবা ভেঙেছে। মা’র ধেয়ে আসা থাপ্পর থেকে মুখখানা সরিয়ে ভয়ার্ত কণ্ঠে তাই বলেছিলো, ‘কী হয়েছে?’

মা দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ওর দিকে তোর বাবার নজর পড়েছে!’

নজর পড়ার কোনো অভিজ্ঞতা তখনো রুনুর জীবনে না ঘটলেও সে তার মা’র মুখে বাবার নজরের ওটুকু ইঙ্গিত শুনেই তার মানে বুঝে গিয়েছিলো। এবং এও তার মনে হয়েছিলো, এতে বিন্দুর দোষ মা কোথায় দেখলেন? তবু একপেশে শাস্তিটা মেয়েরা এভাবেই পায়। আমার মাও তো পাচ্ছেন। সেরকম নির্দয়-নির্বোধ শাস্তিটা মা তার নরকে বসে দিচ্ছেনও ঠিক তার মতো আরেকজনকে।

পঞ্চাশোর্ধ্ব বাপ তার মেয়ের সমান বয়সীই শুধু নয়, মেয়ের ক্লাসে পড়া একটি মেয়ের দিকে কুনজর দেবেন, আর রুনুর মা সেই মেয়েটির এ বাড়ি আসা নির্দয়ভাবে বন্ধ করবেন, মেয়েটি এতো অসহায় জেনেও। কিন্তু সর্বস্ব বিসর্জন দিয়েও মা পারেন না নিজের স্বামীর নজর শুদ্ধ করে নিতে। এতোটা বিশ্বাসঘাতকতা নিয়েও মায়েরা তাদের স্বামী সম্পর্কিত পুরুষটির সন্তানের মা হতে প্রস্তুতি নেন! রুনুরা জন্ম নেয়। অথচ মায়েদের এতোটুকু স্খলন টের পেলে রুনুদের বাবারা হিল্লা বিয়ে মেনে আবার তাকে ঘরে তুললেও তুলতে পারেন। না হলে কুকুরের মুখেও ছুড়ে দিতে পারেন, পঁচাবাসি খাদ্যের মতো। শুধু কলমার জোরে ওদেরই কেউ শুঁকে ছুড়ে ফেলে দিলেও তারা অশুদ্ধ অন্ততঃ হন না। রুনু সেই যে খেই হারালো, আর তা খুঁজে পেলো না। বিন্দুই তার সব তছনছ করে দিয়ে গেছে।

ওরা কয়েকটি মেয়ে স্কুলের আশপাশে কারো বাড়িতে কখনো দলবেঁধে গেলেও, তাদের ঢ্যাংগা ভাই, অথবা কাকা-মামারা রাস্তার কলের পানি আঁজলা ভরে খাওয়া পিপাসার্ত’র মতো বিন্দুর উদ্ধত বুকের দিতে তাকিয়ে থেকেছে। আর কারো দিকে তাকানোর থেকে ওর দিকে তাকানোটাই যেনো সহজ। অথবা ওর প্রকটিত যৌবন মানানসই আবরণ পায়নি, তাই। তবু বিন্দুর কিছু মনে কড়াকড়ির বালাই ছিলো না তাতে। বিন্দু কী ওদের ওসবের কিছুই বুঝতো না? নাকি ক্ষুধা মানুষের সব মূল্যবোধ খাক করে ফেলে! ওভাবে। বিন্দুর মতো। না হলে ও কোনোদিন রুনুকে রুনুর বাবা সম্পর্কে কোনো অভিযোগ করেনি কেনো? রুনু তো ওর মায়ের মুখে বাবার সম্পর্কে বাজে কথা শোনার পর একরকম শিটিয়ে ছিলো, কখন জানি বিন্দু কোন ঘটনার বর্ণনা শুরু করে দেয়।

বিন্দু কোথায় যেনো হঠাৎই রুনুকে নির্জন করে ফেলেছে। এক ঝটকায় টেনে বের করে এনেছে বদ্ধমূল ধারণার গণ্ডি থেকে। এক ধরনের ঘেন্না-দ্বদ্বেও একা একা ধুঁকছে। কিন্তু ওর মা তো তেমনই আছেন, স্বামীর সঙ্গে নির্বিরোধ অবস্থায়! তবু ক’দিন থেকে টিফিনের সময় আর বাসায় যেতে পারে না রুনু বিন্দুর ভয়ে। অমন ক্ষুধার্ত ড্যাবড্যাবে দু’টি চোখ রুনু পায়ে দলে কীভাবে বাসার দিকে যাবে! না, এতোটা জোর ওর নেই। একগাদা ভাইবোন থেকে দু’একজন দু’একবেলা না খেলেও আরেকটি ওয়াক্ত পর্যন্ত অনেকেরই তা মনে থাকার কথা নয়। আর মা তো ওর ওপরই চটেই আছেন। কিন্তু যখন প্রায় বাধ্য হয়েই রুনু বলতে যাচ্ছে, বিন্দু তুই আর আমাদের বাড়ি যাসনে!’ ঠিক তখনই রুনু টের পেলো ও বিন্দুর সত্তাকে আত্মস্থ করে ফেলেছে। সেটা আয়নার মতো নয়, শিকারীর মতো। তবে রক্ত-মাংস নয়। ছায়ার মতো।

এসএসসিতে ওরা কেউ ফার্স্ট ডিভিশন, কেউ সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করলেও যে গ্রুপটি ফেল করা থেকে বেঁচে গিয়ে থার্ড ডিভিশন পেয়েছিলো, বিন্দু সে দলেই ছিলো। এবং ক’দিনের মধ্যে আশ্রমের পক্ষ থেকে ওকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিলো। অথবা ও একাই চলে গিয়েছিলো। অথবা ওদের বাড়ির কেউ এসে নিয়ে চলে গিয়েছিলো। হঠাৎ-ই ওভাবে বিন্দু ওকে অন্তত না বলে চলে যাওয়াটা এখনও ওকে জর্জরিত করে। যদিও ওখানে আর ওদের থাকার অনুমতি ছিলো না।

বিন্দু সঙ্গে যাবে বলে যে দুপুরগুলো রুনু বাসায় যেতো না, তেমনি এক দুপুরে টিফিন পিরিয়ডে রুনু দেখেছিলো বিন্দু কী যেনো লিখছে। লিখতে লিখতে তার চোখ ভেসে যাচ্ছে পানিতে। রক্তের ভেতর থেকে, বুকের ভেতর থেকে, চোখের কোটর, মগজ ঘেন্না-গ্লানি, অনটনের ক্লেদ সব ছেঁকে পানিটুকু তুলতে যে গর্জন বিন্দু চেপে রাখার চেষ্টা করছে, তাতে ও নির্মমভাবে বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আর আর তাই লক্ষ্য করে রুনুও ছিন্নভিন্ন হয়ে হয়ে গিয়েছিলো তার সঙ্গে। কিন্তু বিব্রতবোধ হওয়া থেকে বাঁচতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে আরো কারো কারো চোখের পাতাও তখন শিশিরের মতো ভেজা।

সেদিন স্কুল ছুটি হলে বিন্দু রুনুকে দিয়ে তার নিজের মাথা ছুঁইয়ে শপথ করিয়ে বলেছিলো, ‘আমার ভাইয়ের কাছে চিঠি লিখলাম। কিন্তু ইনভেলপ কেনার পয়সা নেই, তুই পোস্ট করে দিস বোন। কিন্তু খুলিস না।’ চিঠিখানা সে আরেকখানা কাগজ দিয়ে পেঁচিয়ে তার ওপর ঠিকানা লিখে ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে সেদিন স্কুল ছুটির পর হনহন করে হেঁটে রুনুর ঠিক বিপরীত দিকের ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়েছিলো।

কোনো অবলম্বন ছাড়া ঊর্ধ্বমুখি কোনো লতাকে যেমন মনে হয়, বিন্দুর পা ফেলার ধরণও সেদিন রুনুর সেরকম মনে হয়েছিলো। পরবর্তী সময়ে ওই বিন্দুই কী রুনুর ঘর-সংসারের অন্তরায় হয়ে থাকলো। তাই-ই হবে। নিজের মায়ের যে অবস্থান দেখেছে সংসারে, তবুও বাবার দেখেছে যে দাপট, ওটুকু দেখে আর রুচি হয়নি মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে স্বামীত্বের অধিকার চাপিয়ে কোনো পুরুষের আশ্রয় ও অধিকারে থাকে।

রুনু পারেনি বিন্দুর চিঠি খানা না পড়ে থাকতে। পোস্ট করতে পাঠাবে আগামীকাল সকালে। কিন্তু ভরসন্ধ্যায় গায়ে কাঁটা দেয়া ভয় নিয়ে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে চিঠিখানা ভাঁজ খুলে ফেললো ও। সে চিঠির কথা আজ ওর মনে নেই। শুধু এটুকু ভোলেনি বা ভুলতে পারেনি – ‘ভাই, মা এলে তাকে তাড়িয়ে দিও না ভাই! একজন মেয়েমানুষ স্বামী ছাড়া অর্থাৎ একজন পুরুষের অধীন হয়ে থাকা ছাড়া ঘরে, বাইরে কতো যে অসহায়! তা আমি যতো বড় হচ্ছি, ততোই বুঝতে পারছি। তাইতো প্রায় না খেয়ে থাকতে হলেও লেখাপড়ার যেটুকু সুযোগ পেয়েছি, সেটুকু কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি।’

বিন্দু কথায় কথায় বলেছিলো ওর ভাই ওর থেকে মাত্র দু’বছরের বড়। তবে বিন্দুর বয়সের ব্যবধান রুনুদের থেকে ছিলো বছর চারেকের। বাবা ছিলো না বিন্দুর। মার দ্বিতীয়বার বিয়ে হয়েছিলো। সে লোকও ওর মাকে রাখেনি। ওরা এর-ওর ঘরে খেতো। ভিক্ষে করে নয় অবশ্য। কিন্তু তাদের প্রতি বাড়ির মানুষদের অনাচার দেখে কেউ একজন ওকে এনে ওই আশ্রমে তুলে দিয়েছিলো। লেখাপড়া শিখতে। আর ওর ভাইকে দিয়েছিলো ওয়ার্কশপে কাজ শিখতে।

ক’দিন আগে রুনু টের পেলো ওদের বিল্ডিং-এর পাশের বস্তিতে খুব হাঙ্গামা হচ্ছে। জানালায় তেছরা করে চোখ গলিয়ে দেখলো একটা মেয়েকে ঘিরে আছে এক দঙ্গল উঠতি বয়সী ছেলে। মেয়েটিকে বিন্দু মতো মনে হলো। তবে আরো কালচে, আরো রোগা। লিফটের বোতাম টিপে বুঝলো বিদ্যুৎ নেই। উর্ধ্বশ্বাসে তাই নেমে গিয়ে ওখানে পৌঁছাতে না পৌঁছাতে সে দেখলো, পা বেয়ে রক্ত গড়ানো অবস্থায় মেয়েটিকে ক’জন পুলিশ ধমকাতে ধমকাতে নিয়ে যাচ্ছে। যেনো সব দোষ মেয়েটির।

ছেলেদের বচসা থেকে এবং আরো দু’চারজন বাজখাই মহিলার কথোপথনে বোঝা গেলো একটা ছেলের সঙ্গে মেয়েটা গিয়েছিলো কোনো কাজী অফিসে। কিন্তু উপযুক্ত ফিস না থাকায় কাজী বিয়ে না পড়িয়ে উল্টো হাঙ্গামা সৃষ্টি করে। আর তারই সুযোগ নিয়ে এলাকার বখাটে ছেলেরা মেয়েটিকে টেনে-হিঁচড়ে এখানে নিয়ে আসে। ছেলেটারও কোনো খোঁজ নেই। হয়তো সে প্রাণের ভয়ে পালিয়েছে। না হলে কোথাও তাকে আটকে রেখেছে বখাটেরা।

আবার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হাঁফ ধরে গেলো রুনুর। অনেকদিন সিঁড়ি দিয়ে-ওঠা নামা হয় না বলে ফুসফুসের অবস্থা বুঝতে পারেনি সে। মনে হচ্ছে, শরীরের কাঠোমোটাই আলগা হয়ে গেছে। রোদ-বৃষ্টি মেনে চলতে হয় এখন। এক-আধটু মেকাপ ছাড়া চলেই না। চুলের সাদা জেগে ওঠার আগেই দৌড়েতে হয় বিউটি পার্লারে। প্রায়ই পার্লারের মেয়েগুলোকে দেখা যায় বাসার পরিচারিকার মতো। তবু ওর ভালোলাগে নিজেদের স্বার্থে হলেও কেউ কেউ এদের শিখিয়ে, পড়িয়ে কাজে লাগাচ্ছে। যে কোন বিষয়ে যে কেউ যে পটিয়সী হয়ে যে উঠতে পারলে, তাকে অন্য কেউ বৃত্তবন্দি অন্তত করে রাখতে পারে না।

একদিন এমনই এক মেয়ে এক পার্লারে রুনুর ত্বকের পরিচর্যা করতে করতে,পার্লারের মালিক মহিলাকে হাঁ-পিত্যেশ করে বলছে, ‘পাশের পার্লারের আমাগোতন ভালো চলে ম্যাডাম। আইজক্যা দেখলাম সেই মালদার পাট্টি আইয়্যা ওগো গাট্টা – গোট্টা মাইয়াডারে ওই বেলা লইয়া গেলে। আবারকা, মাদ্দম বেলা ফিরাইয়্যা দিয়া গেলো।’ রুনুর তখন ফেসপ্যাক মাখানো, ওই অবস্থায় কথা বলা নিষেধ। কিন্তু মেয়েটির কথা শুনে বজ্রাহতের মতো সে দম বন্ধাবস্থায় বলে ফেললো, ও হাসলে কি ওর গালে বীভৎস একটা টোল পড়ে? ওর নাম কী বিন্দু ?

‘বিন্দু আবার ক্যাডায়?’, বললো সে পরিচর্যাকারী মেয়েটি।

রুনু লম্বা একটি দম নেয়া শেষ করে বললো, ‘বিন্দু? বিন্দু আমার বন্ধু! আমার! আমরা একসঙ্গে স্কুলে পড়তাম।’

মেয়েটি আকাশ থেকে পড়ার মতো আশ্চর্য হয়ে বললো, ‘এইডা অইলো কমবয়স্কা একটা মাইয়া…! আর আপনের বয়স কতো? আপনার বান্ধবীর বয়সও কী আর স্কুলে বইয়া রইছে?’

বিউটি পার্লারের বিল আগেই পরিশোধ করতে হয়। তাই মুখ পরিষ্কার করা হয়ে গেলে হনহন করে নামতে যেয়ে রুনু টের পায় একজনমাত্র বিন্দুকে খুঁজতে গিয়ে অসংখ্য বিন্দুতে শুধু টক্কর খাচ্ছে সে। টক্কর খেয়েই চলেছে।


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu