তরুন ইউসুফ
জন্ম ১৯৮৯ সালের ২৬ মার্চ সিরাজগঞ্জের সলঙ্গায়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পাশের পর বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপপরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন। উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থ: না গৃহী না সন্ন্যাসী (২০১৮), কান্না হাসি রম্য রাশি (২০১৯)।
তরুন ইউসুফ

আত্মরক্ষার হাতিয়ার

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

সাহিত্য আমার আত্মরক্ষার হাতিয়ার।

এই লাইন থেকে গল্প শুরু করতে যাচ্ছি। যারা গল্পটি পড়া শুরু করতে যাচ্ছেন, তারা খানিকটা খটকায় পড়ে যাবেন। এভাবেও গল্প হয় নাকি?

সাধারণত এখনকার গল্প শুরু হয় হঠাৎ করে। যেমন আজ ‘রহিমার মন খারাপ’ অথবা ‘সুনয়না ঘুম থেকে উঠে দেখল দশটা বেজে গেছে’ এই টাইপের লাইন দিয়ে। আর শেষ হবে এমন চমক দিয়ে যে পাঠক বেকুব বনে যাবেন। অথবা টাসকি খেয়ে হেঁচকি তুলে আবার হেঁচকি গিলে ফেলবেন। কিংবা যাদের হার্ট দুর্বল তারা বুকের বা পাশে চেপে ধরে খানিকক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকবেন। এটা না হলে গল্প হয়?

হবে না কেন, হয়। হওয়ালেই হয়। বিশেষ করে পাঠক যদি মনে করেন। ভাবছেন শুরুর আগেই এতকিছু, আসল কথাটা কী? আসল কথাটা বলো। বহুত হয়েছে এবার ঝেড়ে কাশ তো বাপ।

হ্যাঁ, চিন্তা করবেন না। খুক খুক করে গলা খাকড়ি দিচ্ছি বটে তবে নিশ্চিন্ত থাকুন, আমি ঝেড়েই কাশব। সাথে আরও কিছু হবে। বর্ণনা হবে, রোমাঞ্চ হবে, কান্নাকাটিও হতে পারে। শেষে আপনি তৃপ্তির ঢেকুর তুলবেন, সেকথাও হলফ করে বলতে পারি। তবে চলুন শুরু করা যাক।

আমি কবিতা লিখি। কেন লিখি, কিভাবে লিখি এসব বলতে গেলে নানান ফিরিস্তি গাইতে হবে। আবার ফিরিস্তি না গাইলেও মুশকিল। বুঝবেন কিভাবে?

ছোটবেলা থেকে বই পড়ার শখ। কেন শখ? পড়তে ভালো লাগে তাই। পড়তে পড়তে একসময় মাথায় ঢুকে গেলো, আমারও তো কিছু কথা আছে বলার। তেনারা যেভাবে ইনিয়ে-বিনিয়ে রং চড়িয়ে লিখেছেন, ততটুকু হয়ত পারব না কিন্তু চেষ্টা করলে কিছু তো পারব। সেই ভাবনা থেকে লিখতে শুরু করলাম। কলমের ডগা ছেদা হয়ে অঝর ধারায় কবিতা আসতে লাগলো। পাশাপাশি চুটকি টাইপের ফাজলামো কিছু। ফেসবুকে পোস্ট দেবার জন্য। এইসব করতে করতে একসময় দেখলাম বেশকিছু কবিতা জমে গেছে। মনের খায়েশ জাগলো, একখানা বই করি।

বাস্তব জীবনে আমি চাকুরে। খাঁটি সরকারি কর্মচারী। দশটা-ছয়টা অফিস। অফিস শেষে বউয়ের হ্যালো। মোবাইল মেসেজে আধুনিক বাজারের লিস্ট। ব্যাস, সোজা খিলগাঁও বাজার। তেল, নুন, পেঁয়াজ, রসুন। জ্যাতা মাছ কেনার প্রবল প্রচেষ্টা। না পেলে মরা মাছের পেট টিপে, কানকা উল্টে পরীক্ষান্তে ব্যাগে ভরি। তারপর নেড়ি কুকুরের ভাব নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে যাত্রা।

আমার ফ্লাট লিফটের পাঁচ। কিন্তু বাসায় লিফট নেই। তাই নির্ঘাত হেঁটে উঠতে হবে। সিঁড়ি ভেঙে তবেই পাঁচতলা। আমি সিঁড়ি ভাঙি সিঁড়িও আমাকে ভাঙে। পাঁচতলায় উঠে জিহ্বা বেরিয়ে যাওয়ার অবস্থা। দরজায় নক করতে করতে এলিয়ে পড়ি। গিন্নি ত্রস্তপায়ে দরজা খুলে যতটা যত্নে বাজারের ব্যাগ নেয় ঠিক ততটা অবজ্ঞায় আমার দিকে তাকিয়ে বলে, কাপড় ছাড়ো। তারপর কোনোমতে কাপড় ছেড়ে মুখহাত ধুয়ে এলিয়ে কেলিয়ে পড়ি বিছানায়। অত কষ্টের চাকরি না হলেও মনে হয় সারাদিন মাটি কুপিয়েছি। মাঝে মাঝে হাড্ডি কটকট করে।

তারপর কিছুক্ষণ টিভির রিমোট নিয়ে এ চ্যানেল ও চ্যানেল। সানি লিওনি কিংবা ক্যাটরিনার ড্যানস হলে খানিকটা থেমে বউয়ের হাতে ধরা খেলে নিশ্চিত ঝাড়ি। খুব দেখা হচ্ছে মেয়েমানুষ তাই না। সাথে বউয়ের অভাব-অভিযোগ সম্বলিত সাংসারিক আলাপ। রাত্রের খাবার পর গিন্নি খুশি থাকলে এখন যৌবন যুদ্ধে যাবার সময় তার। উল্টো শুয়ে সটান একটা ঘুম। হিপ হিপ হুররে।

সকালে মোবাইলের অ্যালার্মে, খানিকটা প্রকৃতির ডাকে পড়িমরি করে ঘুম থেকে ওঠা। নেয়ে খেয়ে অফিসে দৌড়। এইরকম ঘড়ির কাটার মত জীবন ঘড়ি। শিল্প চর্চা কই? নিদেনপক্ষে একটু বই পড়া, সিনেমা দেখা, খানিকটা লেখালেখি, এসব না হলে মনের সুকুমারবৃত্তিগুলো কি বাঁচে?

এইবার হয়তো দু’একজন পাঠক তেড়েফুড়ে উঠে বলবেন, এসব কি বলছেন মশাই? সুকুমার রায় তো সেই কবেই মরে ভূত। সে বৃত্তি পাবে কোথা থেকে?

এই তো বুঝলেন উল্টো আবোল তাবোল। এই সুকুমার সেই আবোল-তাবোলের সুকুমার নয়। এটা হলো মনের শৈল্পিক কোমল কিছু একটা। সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্পসাধনা মনের এই কোমল জিনিসটাকে বাঁচিয়ে রেখে মানবিক আত্মাটাকে রক্ষা করে। এইবার সবাই খানিকটা রুষ্ট হয়ে বলবেন, আরে এই কথাটা আগে বললেই তো হতো। এর জন্য এত ভূমিকার কি দরকার আছে। অবশ্যই আছে। কারণ আমি মানবিক আত্মরক্ষার কথা মোটেই বলছি না। আমি বলছি জান বাঁচানোর আত্মরক্ষার কথা। সবাই যেমন বলে চাচা আপন প্রাণ বাঁচা।

যাই হোক, আসল গল্পে আসি। টুকটাক কবিতা লিখলেও সেগুলো বেশির ভাগই ছড়ানো ছিটানো ছিল। সেই ছড়ানো ছিটানো কবিতাগুলো একসাথে করে একটা বই করলাম। এতে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন রকম প্রতিক্রিয়া হলো।

বিজ্ঞজন যারা; তারা গম্ভীর হলেন।

প্রিয়জনেরা পিঠ চাপড়ে উৎসাহ দিলেন।

শত্রুরা মুখ বাকালেন। টাকা লাগবে বলে বউ মৌন হলেন।

তবে বইমেলা শেষ হলে ধীরে ধীরে সবকিছু আবার স্বাভাবিক হতে লাগলো।

অফিসে আমরা যারা সাহিত্যচর্চা করি; তাদের একটা ছোটখাট সংগঠন আছে। মাঝে মাঝে আমরা সবাই সংগঠনের পক্ষ থেকে বসি। একটু আধটু সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করি। বিভিন্ন দিবস উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠান করি। না হলে মাঝে মাঝে চা খাই, গান গাই। সংগঠনের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, এবছর বইমেলায় যাদের বই প্রকাশিত হয়েছে, প্রতিবারের মতো এবারও তাদেরকে সংবর্ধনা দেয়া হবে। কথামতো কাজ শুরু হলো।

অনুষ্ঠান পরিকল্পনায় সিদ্ধান্ত হলো– প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনকে প্রধান আলোচক হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হবে। যাদেরকে সম্মাননা জানানো হবে; তাদেরকে ক্রেস্ট প্রদান করা হবে। আমি অবশ্য এই প্রস্তাবের বিপক্ষে গিয়ে প্রস্তাব দিলাম, সম্মাননা স্মারক হিসেবে বই প্রদান করতে। বই সবসময়ই আমার কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়। কিন্তু বেশিরভাগ সদস্যের মতামত যেহেতু ক্রেস্ট প্রদানের দিকে, তাই গণতন্ত্রের প্রতি সম্মান রেখে ক্রেস্ট প্রদানের সিদ্ধান্তই সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলো। আমিও বিনাবাক্য ব্যয়ে মেনে নিলাম।

নির্ধারিত দিনে অনুষ্ঠান শুরু হলো। আমরা কয়েকজন মিলে অতিথিদের ফুল দিয়ে বরণ করলাম। লেখকদের মধ্য থেকে দুজনকে বলা হলো অনুভূতি প্রকাশ করার জন্য। তারা আবেগী গলায় অনুভূতি ব্যক্ত করলেন। এরপর শুরু হলো সম্মাননা হিসেবে ক্রেস্ট প্রদান পর্ব। ক্রেস্ট প্রদান করছেন আমাদের প্রধান আলোচক সেলিনা হোসেন। আমার ডাক আসল। আমি দুরুদুরু বক্ষে সেলিনা হোসেনের হাত থেকে ক্রেস্ট নিলাম। বেশ দর্শনদারী ক্রেস্ট। কাঠের পাটাতনের উপর কাঠের ফ্রেম। ফ্রেমের উপরের দিকে লেখকের নাম। তার নিচে সংগঠনের নাম এবং লোগো। বেশ বড়সড় সাইজের ক্রেস্ট। দেখলে সমীহ জাগে। ইচ্ছা করলে মারামারির সময় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায় এইরকম। ক্রেস্ট প্রদান পর্ব শেষ হলে প্রধান আলোচকের আলোচনা পর্ব। সেলিনা হোসেন অনেক কিছুই বললেন। প্রকাশিত বই, বাংলাদেশের সাহিত্য, মুক্তিযুদ্ধ আরও কত কি। চমৎকার বলেন উনি। বক্তব্য মুগ্ধ হয়ে শুনলাম আর তার পদযুগলে কতবার যে সালাম করলাম তার ইয়ত্তা নেই। অবশেষে সময় হলো, সভা ভাঙলো। রাতের খাবার শেষে যখন বাসার দিকে রওনা দিলাম, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ১১টা বেজে গেছে।

বাসে যেতে ইচ্ছে করছে না। ওদিকে সরাসরি বাসও নেই। চিন্তা করলাম রিকশায় যাই। ছুটির দিন বলে রাস্তায় রিকশার সংখ্যা কম। যে দু’একটা ছিল তাদের জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু তারা ওদিকে যাবে না। অগত্যা বাসেই যেতে হবে। বাসে খানিকটা গিয়ে তারপর লেগুনা। বাসার কাছাকাছি যখন পৌঁছলাম, তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা। মেইন রোড থেকে আমার বাসা একটু ভেতরে। গলির শেষ প্রান্তে। মিনিট পাঁচেক হাঁটাপথ। হেঁটেই রওনা হলাম। গলির ভেতরে অন্য কোনো সমস্যা নাই। তবে একটু সমস্যা আছে সেটা হলো কুকুর। বেশ কয়েক ঘর কুকুর এখানে বসবাস করে। রাত্রের বেলা এদের পোয়াবারো। যাচ্ছেতাইভাবে ঘোরাঘুরি, ডাকাডাকি, হাঁকাহাকি করে। যেহেতু আমার বাসা গলির শেষ মাথায় তাই কুকুর সম্প্রদায়কে পাশ কাটিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।

যদিও এ পর্যন্ত কুকুর নিয়ে তেমন কোন বাজে অভিজ্ঞতা হয়নি। তবু আজকে কেমন যেন ভয় ভয় লাগছিলো। ভয় ভয়েই এগুচ্ছিলাম। এগোতে এগোতে বাসার কাছাকাছি চলে এসেছি প্রায়। এমন সময় বলা নেই কওয়া নেই, দুই নেড়ি এসে ঘেউ ঘেউ করতে করতে আমার পথ আগলে দাঁড়ালো। পশম উঠে দুটোরই বেহাল দশা। জাত নেড়ি কুকুর হলে যা হয়। ভাবলাম হেই হেই করলে হয়ত চলে যাবে। হেই হেই করতেই ফল হলো উল্টো। দুটোই দাত খিঁচিয়ে তেড়ে আসে। মহা মুশকিল। এদিকে ক্লান্তিতে নিজের বেহাল দশা। কি করি কি করি ভাবতে ভাবতে বেশ রাগই হলো। কুকুর দুইটা ঘেউ ঘেউ করে আমার আরেকটু কাছে আসতেই অনুষ্ঠানে পাওয়া সম্মাননা ক্রেস্ট দিয়ে দুজনার পিঠে জোরসে দু’ঘা বসিয়ে দিলাম। ম্যাজিকের মতো কাজ হলো। মার খেয়ে ঘেউ ঘেউ করতে করতে পালিয়ে গেল। বইয়ের বদলে ক্রেস্ট দেওয়াতে আমি খানিকটা মনোক্ষুণ্ণ ছিলাম। একনিমিষে সেই মনোক্ষুণ্ণের ভাব কেটে গিয়ে ক্রেস্টের প্রতি দারুণ ভক্তি জাগলো আমার। ভাগ্যিস, কাব্যগ্রন্থ লিখেছিলাম বলে ক্রেস্টটা পেয়েছি। না হলে কুকুর কামড়ে নির্ঘাত জলাতঙ্ক বাধিয়ে দিত। শুরু করেছিলাম এই বলে যে, সাহিত্য আমার আত্মরক্ষার হাতিয়ার। বিষয়টা কিন্তু অদ্যোপান্ত আমি বুঝিয়ে দিয়েছি।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu