সৌমিত্র চৌধুরী-এর গল্প
আজকেও ঘুম ভেঙে গেল গার্গীর। মাঝ রাত্তির। রাস্তার হাই মাস্টের আলো কাঁচের জানলা গলে ঘরে এসে ঢুকেছে। দৃশ্যমান সবকিছু। পাশের খাটে পাশ ফিরে শুয়ে উড়িষ্যার মেয়ে পানিগ্রাহি। ওর ঘুম না ভাঙিয়ে পা টিপে টিপে বাথরুমে গেল গার্গী। গায়ে মাথায় জলের ঝাপটা দেবে ভেবেছিল, পারল না। কলে জল নেই। জলের বড্ড অভাব, তবে শুধু এখানে নয়। শহর জুড়েই।
শহরটা উন্নত। এলাকাটা ঝাঁ-চকচকে। মালেশ্বেরমের এই দিকটায় বসবাসের সুবিধা অনেক। হাতের কাছেই শপিং মল, রেস্টুরেন্ট, বাসস্ট্যান্ড। মেট্রো রেলস্টেশন মাত্র কয়েক পা। কয়েকটা স্টেশন পেরোলেই মহালক্সমি। তারপর রাস্তায় নেমে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই স্বামীনাথন ইনফোটেক। ওর অফিস। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কম্পিউটর সফটওয়্যার কোম্পানি।
মালেশ্বেরমের গলিতে আধাআধি শেয়ারের এক কামরা ফ্ল্যাট। ওখান থেকে মেট্রোর সিটে মাথা হেলিয়ে ফেসবুকে কয়েকটা পোস্ট ঘাঁটতে ঘাঁটতে অফিসে পৌঁছে যায় গার্গী। কুড়ি মিনিট মাত্র। এ যুগে এত সংক্ষিপ্ত যাত্রায় কর্মস্থলে পৌঁছানো ক’জনের ভাগ্যে ঘটে! বন্ধুদের কথায় ঠেস, ‘তোর মাইরি কপাল। ভালো রেসাল্ট, হাইফাই চাকরি, মোটা মাইনে আর অফিসটাও হাতের নাগালে!’
বন্ধুদের কথার উত্তরে মিটিমিটি হাসে গার্গী। মনে মনে কথা বলে। বুঝলি, সমস্যা একটা আছে রে! বলতে পারি না কাউকে, জানিস। রাতে ঘুম ভেঙে যায়। কী সমস্যা রে! স্টেশনে পৌঁছাতে তো রাস্তা পেরোতে হয়। ভয় লাগে জানিস। কেন? মসৃণ পিচ ঢালা পথ। অনেকটা চওড়া। তিরিশ ফুট তো হবেই। কিন্তু গাড়ির ভিড়ে মনে হয় একদম সরু। রাস্তার কালো বুকে সাঁই সাঁই ছুটছে গাড়িগুলো। ট্রাফিক সিগন্যাল নেই কোথাও। নিয়ন্ত্রণহীন গাড়িগুলো ছুটছে সাঁই সাঁই। তার মধ্য দিয়েই রাস্তা পেরোতে হয়।
মা’কেও বলতে পারিনি জানিস! তিন মাস আগে একবার রাস্তা পেরোতে গিয়ে…। একটা মোটর সাইকেল বাঁদিক থেকে এসে কী জোরে ধাক্কা মারল! রাস্তার মাঝখানে ছিটকে পড়েছিলাম। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। ভাগ্য ভালো অন্য গাড়ি পিষে দেয়নি। হাঁটু আর কোমরে চোট নিয়ে পাঁচ দিন শুয়েছিলাম। ব্যাথা সেরে গেছিল কিন্তু সেই থেকেই ভয়। ডাক্তার বলেছেন, রাস্তা পেরোতে ভয় পাওয়া নাকি একটা রোগ। ড্রোমোফোবিয়া।
জানি না কেমন রোগ। মোড়ের মাথায় পৌঁছে রাস্তাটা পেরোতে হবে ভাবলেই বুকটা ঢিব ঢিব করে। শরীরটা থরথর করে কাঁপতে থাকে। মাঝ রাত্তিরে ঘুম ভেঙে যায়। আজকে যেমন হলো।
বড়ই সাধারণ ঘটনা। ঝাঁ-চকচকে শহরে গাড়ি চাপা পড়বার আতঙ্কে মাঝ রাত্তিরে ঘুম ভেঙে গেল এক তরুণী অফিসযাত্রীর।
———-সমাপ্ত———-