বিশ্ববিদ্যালয় পাস করে বাঙালি যুবকেরা চাকুরির পিছনে ছোটার সাথে সাথে আরেকটি জিনিসের পিছনে ছুটতে থাকে, সেটা হলো বউ। চাকুরি পেতে যতটুকু দেরি, এপয়ন্টমেন্ট লেটার ঘরে পৌঁছানোর সাথে সাথে বউ খোঁজার মহান দায়িত্ব বিভিন্ন জনে নিজেদের ঘাড়ে তুলে নেন। ছেলের বাবাকে বউ খোঁজার ফুসরত দেয় না কেউ– ছেলের বাবার কাছেই গন্ডা গন্ডা ঘটকদের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। শুধু কী জেতেল ঘটক, দূর সম্পর্কের আত্মীয়রাও তখন ঘটকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ডাগর মেয়ের যে বাজার এই সময়ে, তার চেয়ে চাকুরিওয়ালা ছেলের বাজার যে কোন অংশে কম নয় এটা নিশ্চিত। অথচ এইসব ছেলেরাই চাকুরি পাবার আগে কত মেয়ের পিছনে ঘুরে লাথি খেয়েছে তার কী কোনো ঠিক ঠিকানা আছে। উচ্চশিক্ষিত এসব ছেলেরা চাকুরির আগে একরকম থাকে, চাকুরি পাবার পর আরেক রকম। পুরুষেরাও যে ক্ষণে ক্ষণে বহুরূপী হয়ে উঠতে পারে তার যতসামান্য উদহারণ এটি।
তবে তপু ওরকম নয়। এককথায় আজকালকার দিনে তপুর মতো ছেলে খুঁজে পাওয়া দায়। তার উপর আবার চাকুরিওয়ালা। তাও যে সে চাকুরী নয়, ব্যাংকে চাকুরী। সে এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সহকারী পরিচালক। এই যোগ্যতা নিয়ে সে দশটা মেয়েকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাতে পারতো, ইচ্ছে করলেই ঢাকার কোনো আধুনিক মেয়েকে বিয়ে করতে পারতো। তবে তপু তা করেনি।
চাকুরী পাবার পর তপুর বাবা তপুকে বলেছিল, ‘তপু, তোর তো বয়েস হয়েছে। বিয়েটা এবার করে ফেল।’
বাড়িতে যে ঘটকের আনাগোনা বেড়ে গেছে তা অজানা ছিল না তপুর। উত্তরে সে বলেছিল, ‘কটা দিন যেতে দাও বাবা, নিজেকে একটু গুছিয়ে নিই।’
এই গুছিয়ে নিতে নিতে পাঁচটি বছর কেটে গেছে। তপুর বয়স যখন ত্রিশ ছুঁই ছুঁই হলো, সেবার আর তপুর বিয়েটা না করলেই নয়। অবশেষে বিয়েটা সম্পন্ন হলো এক কুরবানি ঈদের ছুটিতে। তপুর তেমন কোনো বিশেষ পছন্দ ছিল না। তার কথা ছিল– বাবা-মা যা ভালো বোঝে তাই করুক।
অবসরের আগে তপুর বাবা পোস্টঅফিসে চাকুরী করতেন। একসময় এলাকায় তার তেমন কোনো খ্যাতিই ছিল না। তবে আজকাল ছেলের উন্নতির বদৌলতে বেশ নাম-ডাক হয়েছে। মসজিদের ম্যানেজিং কমিটির মিটিং-এ এখন তাঁর ডাক পড়ে। মহল্লার বিচার-সালিসে তাকে এখন মুরুব্বিরা সাথে নেন। তিনি বড্ড বিচক্ষণ মানুষও বটে। কোনো সিদ্ধান্ত নেবার আগে সাত-পাঁচ ভেবে তারপর সিদ্ধান্ত নেন। এক্ষেত্রেও অনেক যাচাই-বাছাইয়ের পর তপুর বাবা ঠিক করলেন ম্যাট্রিক পাশ এক গ্রামের মেয়ের সাথে তপুর বিয়ে দেবেন। মেয়েটির নাম ঊষা। ব্যাপারটা তপুর কাছে সুপাত্রে ঘোল ঢালার মতো মনে হলেও তা অতিশয় নীরবে মেনে নিল।
ঊষা তপুর জীবনে আসার পর তপুর জীবনটা পাল্টে গেল। ঊষা আলো-আঁধারের সন্ধিক্ষণ। তাই বুঝি ঊষার আগমনে তপুর জীবন এক বায়বীয় অবস্থায় পতিত হলো। প্রথম কয়েক মাস তপু ভেবেছিল, সে একি ভুল করেছে!
এর উত্তম কারণও ছিল। তপুর কাছের ঢাকাইয়া বন্ধু-বান্ধবেরা সবাই আধুনিক গোছের। তারা তাদের আধুনিক বউদের নিয়ে এখানে ওখানে দাবড়ে বেড়ায়। অন্যদিকে ঊষা? মাধ্যমিকে পাশ করলেও সে গ্রামের কোকিল, ঢাকাতে থেকেও গত ছ’মাসে ভাষার আঞ্চলিকতাটা পর্যন্ত ছাড়তে পারেনি। বাইরে বের হলে যানবাহনের ধুয়াতে অস্থির হয়ে ওঠে সে। উপরের সমাজে যে এরকম বউ চলে না তা হাড়ে হাড়ে টের পেল তপু। তবু সে তাকে ছাড়তে পারে না। বাবার পছন্দ বলে কথা!
না ছাড়তে পারলেও এসকল বিষয়ের জের ধরে ধীরে ধীরে তাদের সম্পর্ক ম্লান হতে থাকে। তবে ঊষা কিছুতেই বুঝতে পারে না– কী জন্য কী হয়ে চলেছে। এ শিক্ষিত সমাজে সে বন্দী বোবা পাখির ন্যায় জীবন যাপন করতে থাকে। মুখ ফুটে কিছু বলতেও তার ভয়, কখন বুঝি ভুল কিছু বলে ফেলে। তার সহজ-সরল স্বামী যেন তার কাছে প্রভু, ভীতির সঞ্চালক।
সকাল থেকে রাত অবধি একা একাই থাকতে হত তাকে। রাত দশটার আগে তপুর খোঁজ মেলে না। রাতের খাবারের সময় অবশ্য দুচারটা কথা হয় তাদের মাঝে, তবে তা অতি স্বল্প। এ অল্প কথাতে আত্মা মেটে না ঊষার। মাঝে মাঝে সে ভাবে, এসব কিছু ছেড়ে গ্রামে চলে যাই, বাবাকে বলি– হেডমাস্টারের বখাটে ছেলে সুমনের সাথে আমার নিকা দাও। সেখানে আর যাই হোক, মুক্ত বাতাস তো খেতে পারবে। তারপর ভাবে, না, তা কী করে হবে? এতে যে বাবা কষ্ট পাবে। তাই ঊষা ঠিক করলো, যে করেই হোক, এ সংসারে তাকে টিকতে হবে এবং ভালোমত টিকতে হবে। এই ভালোমতো টেকার জন্য রীতিমতো সে জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করতে লাগল। এমনকি ব্যাকরণী ভাষায় কথা বলার জন্যও যাবতীয় বইপত্র ঘাটাঘাটি শুরু করে দিল। ফলস্বরূপ তার ভাষার যে ধীরে ধীরে উন্নতি সাধন হচ্ছে তা বোধহয় তপু অতটা আঁচ করতে পারেনি।
তপু অসন্তুষ্ট হলেও তপুর বাবা-মা বউমার রূপে-গুণে মুগ্ধ। ঢাকাতে আসলে তপুর বাবা বলতো, এ আমার ভাগ্য যে এযুগেও আমি আমার মায়ের হাতে রান্না খেতে পারছি। তপুর বউ নাকি স্বাদে এবং গুনগত মানে তপুর দাদীর মতোই রান্না করে। তপুর বাবা একারণে সর্বদা ঊষার গুণগানে পঞ্চমুখ থাকে।
তপুও অবশ্য এ কথা স্বীকার করে। অফিসে যখন নানান জনে লাঞ্চের সময় নিজেদের বউ সম্পর্কে নানান রকম বাণী শোনায়, তপু তখন গর্ব করেই বলে, ‘আমার বউ একখান, তার রান্না খেলে যে কেউ পাগল না হয়ে পার পাবে না।’
এই একটি ব্যাপার ছাড়া নিজের বউকে নিয়ে আর তেমন সন্তোষের জায়গা সে খুঁজে পায় না। রূপে সে রূপবতী, তবে শুধু রূপ দিয়ে এ যুগে চলা যায় না। এযুগে চলতে হলে মেয়েদেরকেও ছেলেদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয়।
আজ হয়তো তপুর বউটি এমন হতে পারত, যে কিনা তার সাথে সাথে অফিসে বের হত। কোনো কোনো দিন ফেরার পথে চাইনিজে গল্প করে গভীর রাতে রিক্সাতে করে বাসায় ফিরতে পারত। অথবা ছুটির দিনে পার্ক কিংবা শপিং মলে ঘুরতে পারত। এসব শহুরে কল্পনা করে তপু আরও উতলা হয়ে পড়ত।
কখনো কখনো তপুর মনে হয়, ঊষার ভীমরতির শেষ নেই। শপিং মলের চলন্ত সিঁড়িতে উঠতে শত ভয় তার। আর পার্ক? সে তো তার মতে, অশালীনতায় ভরপুর নরকপুরী। এতকিছুর দোষ একপেশেভাবে ঊষার উপর দেওয়াও অনুচিত। হয়তো তপু তার কোমল হাতে হাত রাখলে সে আঁখিজোড়া বুজে পাড়ি দিতে পারত সাত সমুদ্র। হয়তো রোমান্টিক আলাপচারিতায় পার্ক হয়ে উঠতে পারত স্বর্গপুরী। তবে তা হয়নি, তপু ঊষার বর হয়েছে ঠিকই তবে সরোবর হতে পারেনি। এ নতুন পরিবেশে তাকে পথ চিনিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তপুর হলেও, তা নিয়ে তপুর কিঞ্চিৎ মাথা ব্যথা ছিল না। এজন্য এ সংসারে সে অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েও তপুর নিকট পর হয়ে রইলো।
তার উপর আরেকটা ঘটনা ঘটে গেল কয়েকদিন আগে, যেটা তাদের সম্পর্ক অবনতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত করল। বন্ধুর জন্মদিনের এক পার্টিতে ঊষাকে নিয়ে গিয়েছিল তপু। শত রকমের খাবারের আয়োজন ছিল সেখানে। ভরা মজলিসে ঊষা বিভিন্ন খাবারের নাম জিজ্ঞাসা করছিল তপুর কাছে। সেখানে খাবার তালিকাতে সাপ-ব্যাঙ থেকে শুরু করে নানা অখাদ্যের স্থানও ছিল। একথা জানতে পেরে ঊষার মাথা ঘুরতে লাগল, বমি বমি লাগতে লাগল। তাই ঊষা তপুর হাত ধরে টানতে টানতে বলে, ‘চলো আমরা বাড়ি যাই। এসব অখাদ্য খেতে নি এসেছ জানলি তুমাকে আসতি দিতাম না।’
ঊষার টানাটানিতে শেষপর্যন্ত তপুকে অনুষ্ঠান শেষ না করেই বাসাতে চলে আসতে হলো। এসেই তপু রাগে গর গর করতে করতে ঘোষণা দিল, ‘তোমাকে আর কোন অনুষ্ঠানে নিয়ে যাচ্ছি না।’
ঊষা কোনরূপ রাগঢাগ না করেই উত্তর করল, ‘আমি গেলে তো নি যাবা। তুমার সাপ-ব্যাঙ খাতি আমি যাব ভাবলে কীভাবে? তুমি পারলি যেও, আচ্ছা মত খেও।’
এ শুভ্র বালিকাসুলভ বাক্য তপুর হৃদয়কে সেদিন স্পর্শ করতে পারল না। তার কাছে ঊষাকে বরং অসামাজিক মনে হতে লাগল। এরকম আরো কিছু পুঞ্জীভূত ক্ষোভের রেশ ধরে ধীরে ধীরে তপুর মন আগ্নেগিরিরতোমত অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠলো। অগ্নুপাত হতেও বেশি দেরি হলো না, হঠাৎ করে একদিন বাসায় ফিরে তপু তার বউকে সব শঙ্কা ছুঁড়ে বলে দিল, ‘তোমার বাবাকে খবর পাঠাও, তোমার সাথে আমি আর থাকতে পারব না।’ কিছুক্ষণ চুপ থেকে তপু আবার বলে, ‘জানি তুমি কষ্ট পাবে, তবে আমার দ্বিতীয় কোন উপায় নেই।’
ঊষার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তপুর বাক্যে সে ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ বনে গেল। তার হৃদয়ে দমকা ঝড়ের মতো কিছু একটা বয়ে যেতে লাগল। এতটা যৌগিক অবস্থায় তার মন পতিত হলো যে তা সংজ্ঞায়িত করা দুঃসাধ্য। তবু মনের অসারতা দূর করে সরল মনে ঊষা একটি মাত্র বাক্যই বলল, ‘বললেই কী হলো, আমি কী দোষ করিছি শুনি!’
সেদিনের পর থেকে ঊষার মুখের ক্ষীণ হাসিও বিলীন হতে চলল। তপু অফিসে বের হবার সাথে সাথে তার দুনয়নে অশ্রুপাতের সূচনা হত। আর তপু বাসায় ফিরলে, কোনোমতে শড়ির আঁচল দিয়ে জল মুছে তার সম্মুখে স্বাভাবিক থাকার নিখুঁত অভিনয় করে যেত।
শহরের এই একক পরিবারে যে অতি সংগোপনে গৃহদাহ চলতে লাগল তা এ জগতের আর কেউ জানতে পারল না। এমনকি তাদের পাশের বাসার প্রতিবেশীও তা জানত না। শহরের প্রতিবেশী আর আকাশের নক্ষত্র একি বিষয়। তাই তাদের জীবন, দ্বন্দ্ব, আনন্দ, দুঃখ, অনুভূতি যা প্রকাশ হবার তা শুধু দুজনের ভিতরেই সীমাবদ্ধ ছিল।
আসলেই তো কী দোষ করেছে মেয়েটা? তপু চিন্তায় পড়ে গেল। অন্য মেয়েদের মতো ঝগড়া করার অভ্যাসটা পর্যন্ত নেই ঊষার। মনোবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে অনেক খুঁজোখুঁজির পর শুধু একটা দোষই তপু খুঁজে পেল, তা হলো, সেই জন্মদিনের অনুষ্ঠান। তবে একটা গ্রাম্য মেয়ের কাছে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই দোষের ফলে আর যাই হোক, তাকে এ সংসার থেকে বিতারণ করে দেওয়াটা অতিশয় অন্যায়।
তপু এটাও বুঝতে পারল, ঊষার গুরুতর কোনো দোষ উদঘাটন তাকে করতেই হবে। তা না হলে তাকে ছেড়ে দেওয়াটাও সহজ কাজ হবে না। এ উদ্দেশ্য সফল করার জন্য তপু কারণে অকারণে বাড়িতে ঝগড়া বাঁধাবার চেষ্টা করতে লাগল। তবে কিছুতেই কিছু হয় না। ঊষা কোনোদিন ঝগড়া করে নি, করতেও পারে না। তাই তপু ঝগড়া করতে আসলে মিষ্টি ভাষায় দু’চারটা কথা শুনিয়ে দিত। এই ঝগড়ার সুবাদে তাদের ভিতর কথাবার্তা বেড়ে গেল।
একদিন রাতের বেলায় খাবার সময় একদিন তপু ইচ্ছে করেই একটা ঝগড়ার পটভূমি সৃষ্টির জন্য বলে উঠল, ‘কি বিচ্ছিরি রেঁধেছ? এ ছাই-পাশ কী খাওয়া যায়?’
একথার উত্তরে ঊষা বলে, ‘তুমি ঠিকই বলেছ! আমিও ভাবছি কী করে আজকের রান্নাটা এমন যাচ্ছেতাই হলো। তুমি চিন্তা করো না, কালকে সব ঠিক হয়ে যাবে।’ এতে তপু কিছুটা হলেও লজ্জা পেল। কেননা তার মুখে তখনো তার বউয়ের হাতের অমৃত সুধা।
ঝগড়া-বিবাদের কয়দিনে তপু দুইটি বিষয় বুঝতে পারল। এক, তার নিজের পক্ষে ঊষার সাথে ঝগড়া বাঁধানো সম্ভব নয়। দুই, ঊষার যথেষ্ট ভাষার উন্নতি হয়েছে। এতেও তপুর মন গলল না, তার চাহিদা একজন পূর্ণ আধুনিকা বউ। তার অটল সিদ্ধান্তের কথাটা আরেকবার জানিয়ে দিতে সে আরেকদিন ঊষাকে বলল, ‘সামনে সপ্তাহে তোমার বাবাকে ডেকো।’
তবে সে সুযোগ বুঝি আর হলো না। সেই সপ্তাহেই এক রাতে তীব্র জ্বরে পড়লো তপু। জ্বরের চোটে ঘুমের ঘোরে প্রলাপ বকতে লাগল। তপুর প্রলাপে ঊষার ঘুম ভেঙে গেল। তপুর কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বরে কপাল পুড়ে যাচ্ছে। ঊষা তার স্বামীর এ ঘোর বিপদে অস্থির হয়ে পড়ল। সেই ভোর রাত থেকেই পতি সেবায় মগ্ন হয়ে উঠলো। শিউরে বসে মাথায় পানি পট্টি করে দিল, থার্মোমিটার এনে জ্বর মেপে দিল, আরও কত্ত কী!
তার ব্যতিব্যস্ততা দেখে আজ বড্ড মায়ের কথা মনে পড়ে গেল তপুর। আসলে মা ছাড়া এমনটি এযুগে কেউ করে না। তারা সর্বোচ্চ পারে ওষুধটা খাইয়ে দিতে। মমতা কাকে বলে তাদের বুঝি অজানা। তাই ঊষার হাতের স্পর্শ তার কাছে স্বর্গীয় কোনো পরীর স্পর্শ বলেই মনে হতে লাগল।
এইতো কদিন আগে তপুর এক সহকর্মী ইমনের একটু জ্বর হয়েছিল। তাতেই আধুনিক গিন্নীর মাথা নষ্ট। শেষঅবধি আধুনিক গিন্নীর পিড়াপীড়িতে সামান্য জ্বর নিয়েই দুদিন হাসপাতালে কাটাতে হয়েছে ইমনকে। অথচ সেই গিন্নী যদি একটিবার তার মমতাভরা হাত তার পতির কপালে রাখত, তাহলে সে জ্বর হয়তো বাতাসেই উবে যেত। আজ সব কিছুই তপুর কাছে পরিষ্কার হতে লাগল। তার বাবা যে তাকে কী রত্ন উপহার দিয়েছে তা উপলব্ধি করতে পারল।
দুদিন জোর জ্বর ছিল তপুর। জোরের চোটে অফিসেও যেতে পারেনি সে। এই দুদিনে যা যা করা দরকার সবই যথাযথভাবে করেছে ঊষা। তপুকে ডাক্তার দেখানো থেকে শুরু করে যাবতীয় কেনাকাটা সবই করেছে। এমনকি কোনো কাজে কিংবা হিসাব নিকাশে কিঞ্চিৎ ভুলচুকও নেই। তপুকে শুধু বলে দেওয়া লেগেছে, কোথা থেকে কীভাবে করতে হবে। এছাড়া তার ১০২ ডিগ্রী জ্বর দুদিনে চলে যাবার পিছনে যে তার বউয়ের বড় রকমের হাত ছিল তা বুঝতে বাকী ছিল না তপুর।
জ্বর চলে গেলে আবার অফিসে গেল তপু। যাবার সময় দুপুরের খাবার দিতে দিতে ঊষা জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কী আমায় সত্যিই বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেবে?’
তপু কথাটা না শোনার ভান করে অফিসের পথে পা বাড়াল। তবে সারাদিন তপুর মনে ওই প্রশ্নটিই শুধু বাজতে লাগল। সবকিছু ভেবে তার মনে হলো, উষা এক শুভ্র পবিত্র নারী। তার বিষয়ে নিন্দা করা যায় না। ঊষা কী অনিন্দিতা? অনিন্দিতা বলে কী কেউ হয়, কেউ আছে এ জগতে? এসব নানান প্রশ্ন নিয়ে তপুর মনে আবারও আলো-আঁধারের খেলা শুরু হলো। অবশেষে সে খেলার সমাপ্তি ঘটেছিল সেদিন রাতেই।
সেদিন রাতে তপু বাসায় ফিরে দেখে লঙ্কাকাণ্ড। তপুর বাবা-মা এসে হাজীর, সাথে শ্বশুর মশাইও। কী উদ্দেশ্যে এতজনের আগমন তা ধারণা করতে পারল না তপু। সে যে জ্বরে পড়েছিল একথাও তো কারো জানা নেই। তবে তারা এসেছেনই বা কেন?
যাই হোক, সব প্রকাশিত হলো রাতের খাওয়া দাওয়ার পর। সেদিনও বউমার রান্নার ভূয়সী প্রশংসা করতে ভুললেন না তপুর বাবা। খাওয়া দাওয়ার পর বিশ্রাম ও আড্ডার জন্য সবাই একসাথে বসেছে মাত্র, কোনো কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ করেই ঊষা তার শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে নালিশ করলো, ‘দেখো বাবা, আপনার ছেলে নাকি আমাকে তালাক দেবে। আমি কী এমন করেছি যে ও আমাকে তালাক দেবে?’
তপুর বাবা অবাক চাহনিতে তপুর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়।
তপু থ বনে গেল। ওদিকে আর কী কী কথা হলো, সেদিকে খেয়াল নেই তপুর। সে শুধু শঙ্কায় ভরা ঊষার ছলছল চোখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারলো– সারা পৃথিবী তাহাকে ছাড়িতে পারে, কিন্তু এ নারী তাহাকে ছাড়িবে না।