প্রত্যয় হামিদ
প্রত্যয় হামিদের জন্ম নওগাঁ জেলায় ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৮। পড়াশুনা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। লেখালিখির অভ্যাস ছোটবেলা থেকেই। তিনি সাধারণত গল্প ও কবিতা লেখেন। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: বুদ্ধিমান মোরগ ও বোকা কাকের গল্প (শিশু-কিশোর গল্পগ্রন্থ), অন্তরালের গল্প (গল্পগ্রন্থ), তৃষ্ণা ও অন্যান্য।
প্রত্যয় হামিদ

আমি আবার তোমার আঙুল ধরতে চাই

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

ইদানীং সন্ধ্যাগুলো আসে বড় বেশি নিঃসঙ্গতা, অনেক বেশি অসহায়ত্বকে সাথে নিয়ে। চারপাশের এলোপাথারি শব্দ যেন পরিস্থিতেকে আরও বেশি দুর্বিষহ করে তোলে। প্রতিদিনই চারিদিক থেকে হা-করা অন্ধকার যেন দা বল্লম নিয়ে ছুটে আসে কেন্দ্র ছুঁয়ে বসে থাকা ভিতু প্রাণীটাকে মারবে বলে। আর প্রাণীটা নিজেকে বাঁচাবে বলে কেন্দ্র ছেড়ে এদিক সেদিক দৌড়াতে থাকে। কিন্তু যেদিকেই নিরঙ্কুশ ফাঁকা ভেবে সে ছুটে যায়, দেখে শক্ত, কনক্রিট দেয়াল। নিকষ অন্ধকার বলে তা খালি চোখে ধরা পড়ে না। ধাক্কা লাগলেই কেবল তার অস্তিত্ব বোঝা যায়।

এই রকম সন্ধ্যায় কত আপনজনকে খুঁজি মনে মনে। খুঁজি একান্ত নিজের সেইজনকে যার হাতের ছোঁয়ায় সকল ভয়, সকল অন্ধকার মুহূর্তেই উধাও হয়ে যাবে। তাদেরকে চিনি, তাদের চিরচেনা মুখ এসে সব সময়ই সামনে দাঁড়ায়, কিন্তু তাদের ভরসা এসে কাঁধে হাত রাখে না। প্যারালাইজড মা একটা ঘরে বাধ্যবন্দী। তারও নিশ্চয় অনেক বেশি নিঃসঙ্গতা চারিদিকে। ঘুরে ফিরে সেই বিছানা, সেই বালিশ আর টুকরো টুকরো ছড়ানো ছিটানো সুখ-স্মৃতি! আমরা ব্যস্ত সদস্যরা চাইলেও মা-র সঙ্গী হতে পারি না। হয়তো সব সময় চাই-ও না। তবু শান্তি লাগে, মায়ের হাতটি ধরা যায়। খুব বেশি অসহায় বোধ করলে ভাবার জায়গা আছে যে, কেউ একজন মাথার উপর আছে। দিনশেষে মা বলে কাউকে ডাকা যায়। মায়ের হাত যখন মুখের ভাষা হয়ে হাতড়ে বেড়ায় মুখ, গাল, মাথা– জানি, বিশ্বাস করি, এইখানেও একটা স্বর্গ তৈরি হয়। তখন সেই হাতড়ে বেড়ানো হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে নিজের কাছ থেকে নিজেই পালাই। পালিয়ে শান্তি পাই।

কিন্তু তারপরও, আরও বেশি যখন অন্ধকার চারিদিকে, তখন কি একটা শক্ত হাত আশা করি না! মনের কষ্ট, একাকীত্ব না হয় মায়ের কোমল, মায়াস্পর্শ ঘুঁচিয়ে দেয়। কিন্তু তার বাইরের যে হাজার রকম সমস্যা, হাজার রকম বাহ্যিক প্রতিকূলতা, তার বিরুদ্ধে তো কেবল একজনই আছে যে আমার জন্য বিনাশর্তে লড়তে পারতো। তখনই সেই ভরসার মুখটা ভেসে ওঠে। সে মুখ দেখতে পাই, ছুঁতে পারি না। সে মুখ কেবলই দেখতে পাই চারিদিকে, মুখের মানুষটিকে পাশে পাই না। তার হাত আঁকড়ে ধরে নির্ভার হতে পারি না। সেই কবে থেকে বাবার এই নির্ভার হাত নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে কোথায়, কোন্ না ফেরার দেশে চলে গেছে!

বাবা, তুমি সেই কবে থেকে নেই আমাদের সাথে। আমার সাথে। যখন আমি চাকুরিতে ঢুকলাম, যখন তোমাকে একটু বিশ্রাম দেয়ার মত যোগ্যতা হলো, তখন তুমি আমাদেরকে তোমার সেবা করার সুযোগটুকু দিলে না। কত কত পরিকল্পনা ছিল তোমাকে নিয়ে আমার, আমাদের সবার। কিন্তু তুমি হয়তো ঠিক করেই রেখেছিলে, সে সুযোগ আমাদেরকে দেবে না। তুমি যে কেবল দিতেই এসেছো, এতটুকুও নিতে আসোনি কারও কাছে– তা এভাবে না জানালেও পারতে, বাবা।

তুমি তো জানো, আমি বরাবরই কতটা ভীতু ছিলাম! সন্ধ্যার পর বাইরে বের হতেই পারতাম না। বিদ্যুৎহীন গ্রামের সাঁঝ আঁধার যেন কামড় বসাতো সারা শরীরে। কিন্তু তবুও এ সময়ের মতো এতটা ভয় তো তখনও পাইনি! এসব সন্ধ্যায় যখন বাইরে বা বারান্দায় চাঁদের আলোয় বসতাম, তোমার হাতের আঙুল চেপে ধরে থাকতাম। চাপের মাত্রা দেখে তুমি বুঝে নিতে কতটা ভীতি আমাকে তাড়া করছে, কতটা নিবিঢ় আলিঙ্গন আমি চাই তোমার কাছে। তুমি ডান হাত দিয়ে জড়িয়ে রাখতে। আমি পরম নিশ্চিন্তে তোমার কোলে বসে গল্প শুনতাম। গল্পের লাইন থেকে উঠে আসা দৈত্য দানবরা আমাকে এতটুকু ভয় দেখাতে পারেনি কখনও!

সেই আমাকে তুমি যে শুধু দৈত্য দানব আর রাক্ষস খোক্ষস থেকেই রক্ষা করেছো, তা নয়– যে কোনো প্রয়োজনে আগলে রেখেছো পরম মমতায়। মনে আছে কি তোমার? ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় বৃত্তিগাইড কেনার টাকা জোগাড় হচ্ছিল না। তুমি কত ভাবেই না চেষ্টা করলে! যে দু একটা উঠতি গাছ ছোট্ট ভিটেটার মাটি কামড়ে পড়েছিল, আমার খাতা কলম কেনার জন্য তাদেরকে অনেক আগেই বিসর্জন দিয়েছো। উপায় ছিল না বলেই তুমি সেদিন বিকেলে মাটির ব্যাংকটা তাক থেকে নামিয়ে আনলে।

কত টাকা লাগবে? যেন কোন মহা অপরাধ করেছো, এমনভাবে কণ্ঠ নামিয়ে জিজ্ঞেস করলে।

আমি উদাসভাবে বললাম, পঞ্চাশ টাকা।

তুমি বললে, আয়, দেখি তো, এখানে কয় টাকা হয়।

তুমি মাটির ব্যাংকটায় হাত বুলালে কয়েক বার। কুরবানীর আগে পোষা ছাগলটার গায়ে মানুষ যেভাবে পরম ভালোবাসার হাত বুলিয়ে দেন, ঠিক সেভাবে। আমি তোমার মুখের দিকে যতবার না তাকালাম, তারচে বেশিবার তাকালাম মাটির ব্যাংকটার দিকে। আমার সমস্ত চিন্তা জুড়ে তখন টেস্টপেপার। আমি তখন তোমার হাতে ব্যাংক না– নতুন টেস্টপেপার দেখতে পাচ্ছিলাম। নতুন, চকচকে টেস্টপেপার। নতুন বইয়ের গন্ধ ভেসে আসছিল নাকে। আমি উন্মাতাল হয়ে উঠলাম। আমার তর সইছিল না।

ব্যাংক ভাঙার শব্দে চমকে উঠলাম। তুমি ব্যাংকটি মাটিতে ছেড়ে দিয়েছো ভাঙার জন্য, নাকি হাত থেকে ওটা পড়ে গেছে, তা বুঝতে পারলাম না। বোঝার চেষ্টাও ছিল না। দেখলাম, তোমার কাঁপা কাঁপা হাত মাটি থেকে পয়সা গোছাচ্ছে। পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা, বিশ পয়সা, পঞ্চাশ পয়সা আর এক টাকার কয়েন। তুমি সবগুলো কয়েন আলাদা আলাদা করলে। আমাকে গুণতে বললে। আর আমি সোৎসাহে গুণতে বসলাম। পয়সার ঝনঝন শব্দ আমাকে একেবারে বিমোহিত করে দিল। কী এক ঘোর আমাকে ঘিরে ছিল তখন। সবগুলো পয়সা আমি নিজের হাতে গুণলাম।

দু তিনটা এক টাকার কয়েন ও এক টাকার নোট ছাড়া বেশিরভাগই ছিল ছোট ছোট মুদ্রা। সেজন্য এত ভারি একটা ব্যাংক থেকে বের হলো মাত্র তেতাল্লিশ টাকা। তবু তুমি কী যে খুশি হলে! আমাকে সবগুলো টাকা দিয়ে বললে, এই নে। আর তোর মায়ের কাছে ছয় সাত টাকা আছে হয়তো। সব মিলিয়ে হয়ে যাবে।

সেদিন খুব স্বাভাবিকভাবে হাত বাড়িয়ে পয়সাগুলো নিয়েছিলাম। যেন সেটাই আমার অধিকার। যেন সেটাই তুমি করতে বাধ্য। আজ তো বুঝি, কতটা ভালোবাসা আর কষ্ট যুগপৎ মেশানো ছিল সেদিনের ঘটনায়।

বাবা, আজ চাইলে ও রকম বৃত্তির গাইড আমি কয়েক হাজার কিনতে পারি এক মাসের উপার্জনে। কিন্তু তাতে কী! আমি তো তোমাকে সেই সময়টা ফিরিয়ে দিতে পারব না। আমি এখন কেবলই ভাবি, যে টাকাটা আমার একটা বই কেনার জন্য তুমি হাসিমুখে দিয়ে দিলে, সে হাসিটাতে কি কেবল আমার জন্যই ভালোবাসা ছিল? সংসারকে বঞ্চিত করার কোন দুঃখ একটুও কি ছিল না? ছিল, ছিল। কিন্তু আমার তো আর সেসব ভাবার মতো মতি ছিল না। মগজ জুড়ে কেবলই অধিকারের কথা। অন্যদের সাথে তুলনা করে নিজেকে বঞ্চিত ভাবার আক্ষেপের কথা। তখন কেবলই ভাবতাম, কেন আমি এটা নেব না। কেন আমি ওদের মতো করে সবকিছু পাবো না। কেন আমাকে কোনো কিছু চাইতে গেলে প্রতিবার চাইতে হবে অনেক বার, প্রতিবার দিতে হবে অনেক কৈফিয়ত!

আমি অনেক পরে জেনেছি, একটা একটা করে সেই টাকা তুমি জমিয়েছিলে ঘরের টিন কেনার জন্য। বৃষ্টি এলে বাইরের বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘরের টিন যে কী পরিমাণ জল ছড়াতো, তা আজও আমি স্পষ্ট মনে করতে পারি। হয়তো তুমি ভেবে রেখেছিলে, আর কিছুদিন পর ব্যাংকটা ভেঙে টাকা নিয়ে টিন কিনে আনবে। বর্ষাকালে ঘর-বারান্দা আর উঠোনের মধ্যে একটা দৃশ্যমান বিভাজন তৈরি করার জন্য তুমি নিশ্চয় দিনক্ষণ ঠিক করে রেখেছিলে। অথচ দেখ, তার আগেই আমি কেমন আমার একার জন্য পুরো টাকাটা নিয়ে নিয়েছিলাম।

আজ টাকার কোনো অভাব নেই, বাবা। কিন্তু দিনশেষে বাড়ি ফিরলে ঘরের ভিতরে, বাড়ির বাইরে যে একাকী সময়টুকু, তার মধ্যে কত কত ভয় যে ঢুকে পড়ে প্রতিনিয়ত! ভূমিকম্পের ভয়, সন্ত্রাসী-জঙ্গীদের ভয়, সড়কপথে মৃত্যুর ভয়, চাঁদাবাজদের হাতে খুন হবার ভয়, গুম হবার ভয়, ধর্ষণের ভয়, সমালোচনার ভয়… আরও কত শত ভয়।

বাবা, এসব থেকে মুক্তি পেতে আমি আবার তোমার আঙুল ধরতে চাই। আঙুলে চাপ দিয়ে আমি আমার ভয়ের মাত্রাটা বুঝাব, আর তুমি আমাকে জড়িয়ে রাখবে তোমার নির্ভয় হাত দিয়ে।

আমি পরম নিশ্চিন্তে তোমার কোলে মাথা রেখে সমস্ত ভয় থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে চাই।

তুমি কি সে সুযোগটা আমায় দেবে, বাবা!


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu