আমার। এইটা আমার গল্প।
আমি শান্তা। সোহানা শান্তা। সম্মান তৃতীয় বর্ষ, হিসাববিজ্ঞান, সরকারি আনন্দমোহন কলেজ।
আমার, মুখমণ্ডল গোলাকার, গায়ের রঙ ফর্সা, উচ্চতা পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি, বয়স… সরি মেয়েদের বয়স তো গোপন পাসওয়ার্ড! জনসম্মুখে প্রকাশ নিষিদ্ধ!
আমার পরনে জিন্স, হাতে গ্লাভস্, পায়ে…। ভাবছেন হারিয়ে যাবো? নিখোঁজ সংবাদ হবে? জ্বী না, হারিয়ে যাবো না, বেড়াতে যাবো। ও হ্যাঁ, ভালো কথা, মনে মনে আমার ছবিটা এঁকে ফেলেছেন তো? আমার মুখমণ্ডল গোলাকার, গায়ের রঙ ফর্সা, উচ্চতা…।
আমরা বেড়াতে যাচ্ছি। আমরা মানে, আমি আর সোহেল। সোহেল, আমার প্রিয় মানুষ। ওর সাথে যেখানেই বেড়াতে গেছি নানা ঘটনায় সেই ভ্রমণ ঘটনাবহুল হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত সেটার বর্ণনা আর ভ্রমণ কাহিনি থাকেনি, গল্প হয়ে গেছে। কারণ আমার মনে হয়েছে ওগুলো কেবল গল্প, উপন্যাসেই সম্ভব। তাই তো এবার আপনাকে সাথে নিচ্ছি। অদৃশ্য একটা উড়ালযানে চড়ে আমাদের সাথে যাবেন। আপনি তো গল্প ভালোবাসেন, দেখবেন কেমন….! কি, বিশ্বাস হচ্ছে না আপনার? আচ্ছা, চলুন।
২.
“আমি ওদের উড়ালসঙ্গী হলাম।
আমার জন্য এক হিসেবে ভালোই হল। অনেকদিন ধরে গৃহবাসী। এই সুযোগে একটু ঘুরে আসা যাবে। বেড়াতে আমার ভালোই লাগে। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ। কত বিচিত্র চরিত্রের মানুষ যে এ পৃথিবীতে আছে। মানুষের ভিড়ে মিশে গেলে জানা যায়। আরেক হিসেবে খুব ভালো। বিনা খরচে, অল্প পরিশ্রমে বেড়ানোর এমন সুযোগ! অদৃশ্য একটা উড়ালযানে চড়ে হাওয়ায় মিশে চলা! ইস্! শান্তা ছাড়া পৃথিবীর আর সব মানুষের কাছে আমি অদৃশ্য। আমাকে কেউ দেখছে না। আমি আশেপাশের সবাইকে দেখছি। এমন কি মনের কথাগুলোও শুনে ফেলছি! এই যেমন ট্রেনে উঠার সময় আমি শান্তার কাছাকাছি ছিলাম। খুব ভিড়। নানা জনের নানা কথার ফাঁকে হঠাৎ শুনি কে যেন মনে মনে বলছে, হাতটা সরায় না ক্যান? পকেট থেকে হাত বের করে ট্রেনের হাতল ধর। ইস্ মালডা ছুটে যাবনি? ওই শালারা ভিড় বাড়া।
তাকিয়ে দেখি বেশ কয়েকজন ভিড় বাড়াচ্ছে। একজন চোখের কোণা দিয়ে তাকিয়ে আছে শান্তার জিন্সের পকেটের দিকে। বুঝলাম মোবাইলটা তুলতে চাচ্ছে। সাথে সাথে শান্তার কানে ফিসফিস করে বাতাস ঢুকিয়ে দিলাম ‘পকেট সাবধান’। তখনি পেছন দিকে শুনলাম, যাস্ শালা, কপালডাই খারাপ।
অন্যের মনের ভাব সম্পূর্ণ জেনে ফেলা ভীষণ অস্বস্তিকর। মানুষটার প্রতি আকর্ষণ কমে যায়। বিশ্বাস নষ্ট হয়। এই জন্য প্রথম প্রথম খারাপ লাগছিল। কিন্তু শান্তাকে সাবধান করতে পারায় ও-তে ভিন্নমাত্রা যোগ হয়েছে। দেখাই যাক কি হয়।
আমরা যমুনার পাড়ে চলে এসেছি। চারদিক ঘন কুয়াশায় ঢাকা। শান্তা বলছিল ভ্রমণটা গল্পের মতো হয়ে উঠবে। এখন পর্যন্ত খুব একটা এগোয়নি সেদিকে। সামনে প্রকৃতির যে খেয়ালিভাব তাতে আমার মনে হচ্ছে গল্পটা শুরু হবে এখান থেকেই।”
আবহাওয়া খুব খারাপ। বেজায় কুয়াশা পইড়ছে দ্যাহেন না। বিশ হাত দূরে কি বুজা মুসকিল। তাছারা যমুনা এহন যমুনা নাই, মাগী বেজায় ঠাণ্ডা। নাও ছারলে হাত পাও খিচ্চে আসে। বলে লোকটা বেদম কাশতে লাগল। কলজে ফেটে রক্ত বেরুবে এমন কাশি।
আবহাওয়া যে খুব খারাপ তা ওরাও দেখছে। চারদিকে ঘন কুয়াশা। দৃষ্টিসীমা পনের মিটারের বেশি হবে না। অথচ সকালে বাসা থেকে বেরোনোর সময় সোহেল বা শান্তা কেউই ভাবতে পারেনি। কুয়াশা ওদের এত ভোগাবে। এখন ওপাড়ে না যেতে পারলে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু…. না, শান্তা আর কিছু ভাবতে পারছে না। সোহেলের মনটাও দমে গেছে। যমুনার শীতল জলহাওয়া চোয়ালে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। কিছুটা অসহায় দেখাচ্ছে ওকে।
লোকটা সোহেলকে জিজ্ঞেস করে, বাবাজী, কয়ডা বাজে?
সোহেল প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখে এগারটা চুয়ান্ন। বলে, বারটা।
আদা ঘণ্টার মইদ্দে’ত এই কুয়াশা কমব না। তারপরে দিন ভালা হলেও নাও ছারা যাব না। বুজলা বাবা, আসা যাওয়া পাঁচ ঘণ্টা সুমায় দরকার। যাইতে দুই ঘণ্টা, উজান পানি ঠেলে আইসতে তিন ঘণ্টা নাগে। লোকটা কয়েক বার খুক খুক করে কাশল।
যহরের আযানের সুমায় নাও ছারলে ফিরতে ফিরতে মইদ্দের নদীত বেলা ডুবব। তহন নাও ডাও হারামু, জানডাও হারামু। আবার বেদম কাশি উঠল লোকটার।
সোহেল অসহায় চোখে শান্তার দিকে তাকাল। শান্তাও নিরুপায় হয়ে শীতে কাঁপছে। সাহস করে বলল, এখন আমরা কি করব?
সোহেল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ ক্ষিপ্তস্বরে বলল, বাই রোডে গেলে কোন ঝামেলাই হত না। বগুড়া যাওয়ার কত বড় বড় বাস। আরামে যাওয়া যেত। না, না নৌপথে যাবো! সাধের প্রেম যমুনা দেখবো! এখন আমার দিকে তাকিয়ে আছ কেন? তোমার প্রেম যমুনা দেখ, জল ছোঁও, হাত-মুখ ধোও, আমার যমুনার জল দেখতে কালো….।
তুমি রাগ করো কেন? সত্যি করে বল তো তুমিও কি জানতে এদিক দিয়ে আসলে এমন ঝামেলা হবে?
সত্যি, ওরা কেউই ভাবতে পারেনি এমন হবে। ময়মনসিংহ শহরে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করা কাকের দল যখন কর্কশ গলায় ডেকে ডেকে ওদের ঘুম ভাঙিয়েছে তখনও না, তিন ঘণ্টা ট্রেন জার্নির কুয়াচ্ছন্ন দীর্ঘ পথ দেখেও না, পঞ্চাশ মিনিট ধরে বাসে আসার সময়ও না কিংবা পাক্কা দেড় ঘণ্টা হেঁটে মাইজ বাড়ি ঘাটে চলে আসা পর্যন্ত এবারও মনের কোন কোণে উঁকি দেয়নি এ কথা যে, যদি লঞ্চ না চলে! কিন্তু তারা এখন এই কঠিন সত্যের মুখোমুখি।
গতকাল হুট করে ডিসিশান হয়েছে ওরা বগুড়া যাবে। শোভা সাবগ্রামের মেয়ে। শোভাটা তাদের ত্রিভুজ সম্পর্কের নাম্বার তিন। চারদিন আগে বাড়ি গিয়ে গতকাল জানিয়েছে ফিরতে পারবে না চাচাতো বোনের বিয়ে। শান্তার কাছে ফোন দিয়েছিল।
শান্তা আপু পান্তা ভাত শোন্, হুট করে নিতুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ছেলে ইতালি ফেরত টাকার কুমির। হেয়ার-হাইট দুটোই কম, এজ অ্যান্ড হেল্থ পাকা পোক্ত। আমার সব প্ল্যান ভন্ডুল। আজ ফিরতে পাব না। মিনিমাম তিনদিন….।
কি বলিস্! এদিকে সব ওকে। শান্তা ভীষণ অবাক।
দ্যাখ্, বরপক্ষ পাকা কথা জানিয়েছে আজ সকালে, আমি তখন সব গোছগাছ করছি দশটার বাস ধরব বলে। খবর শুনে আমি তো থ’। আমার এত্তো দিনের শখ গজনী যাবো।
সোহেল শুনলে খুব মন খারাপ করবে।
ওকে এসএমএস পাঠিয়েছি। কল করার সাহস পাইনি। আমি জানি আমার জান বুঝবে। আর আমি কি করতে পারি বল্? নিতু কেঁদে কেটে অস্থির। এ অবস্থায় বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবার কথা ভাবা অসম্ভব।
ধ্যাত্! সবকিছু এলোমেলো।
শান্তা এক কাজ কর, তোরা দু’জন কাল চলে আয়। পরশু বিয়ে। তারিখ ওয়ান ইলেভেন। ঐতিহাসিক দিনে বিয়ে। বাড়িতে এত লোকজন কিন্তু কেমন যেন একা একা লাগছে। এত কাজ বাকি কিন্তু কিছু করতে উৎসাহ পাচ্ছি না। তোরা আয়, সব কাজ খুব সুন্দর করে গুছিয়ে করব তিনজন। আয়, মোহনার মত নিতুর জীবনেও দুই লাইনের ছোট্ট ইতিহাস রচনা করে দিই ‘সুন্দর, খুব সুন্দর! অসাধারণ!’
শান্তা তখন শোভাকে ‘হ্যাঁ’ ‘না’ কিছু বলতে পারেনি। বিকেলে সোহেলের সাথে কথা বলে ঠিক করেছে বিয়েতে যাবে। কিন্তু শোভাকে জানিয়ে দিয়েছে তারা যাবে না। কৃত্রিম তাচ্ছিল্যের স্বরে বলেছে ‘দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর কোন ইচ্ছে তাদের নেই’। বেচারি শোভা সে কথা শুনে রাগে-দুঃখে-অভিমানে সেই যে মোবাইল অফ করেছে আর অন করেনি।
সোহেল লোকটাকে অনুরোধ করল, কাকা দেখুন যদি যাওয়া যায়। আমাদের খুব উপকার হবে। ময়মনসিংহ থেকে আসছি, বগুড়ায় যাব। একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে। এখন তো ফিরে যাবার উপায় নাই।
লোকটা বিরক্ত হয়ে বলল, এরুম কুয়াশার মইদ্দে নাও চালানি সম্ভব না। উপকার করমু ক্যামনে?
আপনারা তো নিয়মিত যাওয়া আসা করেন। চেনা পথ। এখন চল্লিশ পঞ্চাশ হাত দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। অনুমান করেও যদি…..।
দ্যাহেন বাবা আপনেরা শহরের মানুষ নদী সমন্দে কি জানেন? আমারে পাস্শ ট্যাহা দিলেও যামু না।
টাকার বিষয়টা সোহেলের মাথায় ঢুকল। বেশি টাকা দিলে মনে হয় কাজ হবে। তাছাড়া কুয়াশা খুব ধীরে ধীরে হালকা হচ্ছে। শান্তা খুব আগ্রহ নিয়ে তাদের কথা শুনছে। টাকার বিষয়টা সেও মনে হয় ধরতে পেরেছে। সোহেল সাবধানে টোপটা লোকটার দিকে ফেলল, কাকা বাজারে এক হাজার টাকার নতুন নোট আসছে, দেখছেন?
না বাবাজী, শুনছি দ্যাহি নাই! লোকটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল।
একটা এক হাজার টাকার নতুন নোট দেব তবু আমাদের উপকারটা করেন।
মধ্য বয়স পেরিয়ে যাওয়া লোকটা সরু চোখে সোহেলকে ভাল করে দেখে নিয়ে বলল, নাম ফহির মাজি হবার পায় কিন্তু মনডা ফহিরনে। মমিসিং থেকে আইচ্চেন সাতে নতুন বউ, যাবেন বিয়ের অনুষ্ঠানে। আপনেগোরে পার করে দেয়া আমার ফরজ কাম। ট্যাহার নোপ দ্যাহাইয়েন না। এহানে খারান, দ্যাহি ভাইস্তেরে ডাইহে আনি।
কুয়াশা ভেদ করে আশার আলো ঝলমল করে উঠল যখন ফকির মাঝি তার ভাতিজা কোরবানকে সঙ্গে করে নিয়ে এল। বিশ কিংবা বাইশের একটা ছেলে। এক নজরে একটা বিশেষত্বই চোখে পড়ে। উজ্জ্বল আর তীক্ষ্ণ দুটো চোখ।
সোহেল আর শান্তাকে দু’পলক দেখে নিয়ে নৌকায় উঠল কোরবান। তারপর নৌকার একপার দিয়ে কায়দা করে হেঁটে হেঁটে শেষ মাথায় মেশিনের কাছে নামল।
তোমার’ত খালি ট্যাহার নোপ। বুড়ে মানুষ, তাও ট্যাহার নাম শুনলে হুশ থাহে না। শীত নাই, ঠাণ্ডা নাই নাও চালানই নাগব।
কোরবান ভীষণ বিরক্ত। মেশিন স্টার্ট দেয়ার জন্য প্রস্তুত করতে করতে বকবক করছে। ফকির মাঝি শান্তাদের নৌকায় উঠতে বলে ওর কথার উত্তর দিল, ট্যাহা কিছু নারে, ঈমান বুঝলি ঈমান। বাবাজী নতুন বউ নিয়ে আইসে বিপদে পড়ছে। পার না করে দিলে বেঈমানী হব না? নে, তার নাম নিয়ে মেশিন ইস্টাট দে।
ফকির মাঝির মুখে দ্বিতীয়বার নতুন বউ কথাটা শুনে শান্তা আড়চোখে সোহেলের দিকে তাকাল। সোহেল নির্বিকার ভঙ্গিতে কোরবানের জোগাড়যন্ত্র দেখছে। কোরবান বলল, মেশিন ইস্টাট দেয়ার আগে ট্যাহা নেও কাহা। পরে গোলমাল করার শখ নাই।
সোহেল মনে মনে রেগে গেল। কিন্তু মুখে কিছু না বলে মানিব্যাগ থেকে একটা এক হাজার টাকার নোট বের করে ফকির মাঝির দিকে বাড়িয়ে ধরল। লোকটা লোভাতুর দৃষ্টি বুলিয়ে নোটটা নিয়ে খুশি মনে উল্টে পাল্টে দেখতে লাগল।
শেষ পর্যন্ত নৌকা চলছে। সামনের ঘন কুয়াশার প্রলেপ হালকা হতে হতে পেছনে সরে যাচ্ছে। পেছনের কুয়াশা ঘন হতে হতে এগিয়ে আসছে যেন নৌকাটাকে তাড়া করছে। চরের পাশ দিয়ে যাচ্ছে নৌকা। পাড় কোথাও খাড়া কোথাও ঢালু। কুয়াশা ভেদ করে যতটুকু দেখা যায়, বালু ছাড়া কিছু নেই।
শান্তা বসেছে নৌকার আগা গলুইয়ে। পা গুটিয়ে। দৃষ্টি চরের দিকে। সোহেল মাঝামাঝি। বাঁশের পাটাতনের উপর। পাশে ফকির মাঝি, ঠা-া বাতাসের তোড়ে কেঁপে কেঁপে এটা সেটা বলছে, চল্লিশ বছর ধরে নাও চালাই। আমরা জাত মাজি। আমার বাপ দাদাও নাও চালাইত। কতবার ভিটে মাটি যমুনায় খাইলো! তাও দূরে গেলাম না। কত কষ্ট করি, তাও…. সব তার ইচ্চে। বাবা!
সোহেল আলাপে যোগ দিচ্ছে না। চুপচাপ শুনছে। ফকির মাঝি একটানা বকে চলেছে, যমুনার পানিত দারণ নিশা। দারণ শান্তি। কাজ কাম সারে আইসে গুছল কইরলে বেজায় শান্তি। কিন্তুক মাগীর সুমায় অসুমায় ঢঙ! বসষায় মারে পানিত আর শীতে মারে ঠাণ্ডায়। কষ্ট নাগে!
একটু থেমে ফের অন্য কথা তোলে ফকির মাঝি, ওইটে আপনের বউ, না বান্দুবি?
সোহেল মুখ ঘুরিয়ে তাকায় ফকির মাঝির দিকে, এতক্ষণ তো বলছিলেন নতুন বউ, নতুন বউ। এখন আবার কি মনে হচ্ছে?
না, মানে মেয়েছেলে পইরছে প্যান-সাট, তাই কই।
সোহেল আর কিছু বলল না। কিন্তু পেছন থেকে চিৎকার করে উঠল কোরবান, ও কাহা, আফারে নায়ের মাঝখানে আসপার কও। আর তুমি পাছাত আসো। সবেই আগাত, ফ্যানে পানি নাই, ঘুরে ঘুরে বাতাস খাইতাছে।
কোরবানের কথা শুনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ফকির মাঝি। ও বেটি, ও মা….
সোহেল বাধা দিয়ে বলল, ও থাক। আমি একটু পিছিয়ে বসি। আর আপনি পেছন দিকটায় যান। ফকির মাঝি ততক্ষণে পেছাতে শুরু করেছে। সোহেল কিছুটা পিছিয়ে বসল। সেলো মেশিনের ফটফট শব্দ ওর কানে আরো একটু বেশি বাজতে লাগল। শান্তা তেমনি বসে আছে। চুপচাপ। চরের দিকে তাকিয়ে। অন্য একটা চরের পাশ দিয়ে যাচ্ছে নৌকা। পাড়টা ঢালু। কোথাও কোথাও ছোট ছোট ঘাসের গুচ্ছ দেখা যাচ্ছে। পানির কোল ঘেঁষে একটা মুন্ডুহীন আধমরা কলাগাছ পড়ে আছে। গোড়া থেকে চারা গজিয়েছে একটা। হাত তিনেক লম্বা।
শান্তার মনে হল একটু আগে এমনই একটা চর দেখে এসেছে। এমনই কোথাও কোথাও ঘাস, আধমরা একটা মুন্ডুহীন কলাগাছ!
মিনিট দশেক পরে যখন অমনই ছড়ানো ছিটানো ঘাসযুক্ত একটা চরের পাশ দিয়ে নৌকা যাচ্ছে। পানির কোল ঘেঁষে পড়ে আছে অমনই একটা চারা গজানো মুন্ডুহীন কলাগাছ। তখন বিস্মিত হয়ে শান্তা মাথা ঘুরিয়ে নৌকার পেছন দিকে তাকাল। দেখল, কোরবান হাল ছেড়ে দিয়ে মেশিন বন্ধ করে ফেলল। ফকির মাঝি হায় হায় করে উঠল, কি ব্যাফার মেশিন বন্দ করলি ক্যা? আহারে তুই মেশিন বন্দ করলি ক্যা কোরবান? ঐ কোরবান, ঐ ছ্যারা!….
নৌকা চরের দিকে এগোচ্ছে। কোরবান এগোচ্ছে নৌকার একপার দিয়ে হেঁটে আগা গলুইয়ের দিকে। সোহেল বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করল, তুমি নৌকা এই চরে লাগাচ্ছ কেন? এই কোরবান!
কানাভুলে ধরছে কানাভুলে! এই এক চরের গোড়া দিয়ে তিন পাক দিলাম!
পাড়ে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল নৌকা। ঝোঁক সামলাতে শান্তা লাফিয়ে নামল বালুর ভেতর। কোরবান ওর পাশে নেমে ওকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বলল, কানাভুলে ধরব না ক্যা? বেজাত মানুষ নিয়ে নাও ছারছি ঠিক দুপুর বেলা। বেহায়া মেয়ে। আর বুড়ের খালি ট্যাহার নোপ! যাও এহন পার করে দেও। আমি পারমু না। বাবা গোসা কইরছে! বাবা! বাবা!….
কোরবানের কথা শুনে রেগে গেল সোহেল। সে চিৎকার করতে করতে নৌকা থেকে নামল। প্রায় তার সাথেই নামল ফকির মাঝি। দু’জনেই চিৎকার করছে। কিন্তু ওসবের কিছুই ঢুকছে না শান্তার কানে। সে কঠিন চোখে কোরবানের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখ-মুখ অপমানে লাল হয়ে গেছে।
বেশ কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে কোরবান বিড় বিড় করতে করতে পেছনে তাকাল। সাথে সাথে কিছু বালুসহ একঝাপটা বাতাস লাগল ওর গায়ে। তাতেই সে ‘বাবা মাফ করে দেও, বাবা, বাবা….’ বলতে বলতে লুটিয়ে পড়ে গোঙাতে লাগল। তখনো কিছু বালু উড়ছে কোরবানের চারপাশে।
শান্তার মুখে হালকা হাসির একটা রেখা ফুটে উঠল। অল্প সময়ের জন্য।
“আমি নিজেও হতবাক। কোরবান যখন বক বক করতে করতে ফিরে তাকাল তখন আমার কেন জানি ওর দিকে ছুটে যেতে ইচ্ছে করল। সাথে সাথে অদৃশ্য উড়ালযানটা আমাকে নিয়ে ছুটে গেল কোরবানের দিকে। তারপর ওকে ঘিরে একবার ঘুরে ফিরে এল শান্তার পাশে। তাতেই লুটিয়ে পড়ল কোরবান। ফকির মাঝি দৌড়ে গিয়ে কোরবানকে তুলে বসালো। সে ভড়কে গেছে।
তারপর কিছুটা সময় পার হলে কোরবান বালুর মধ্যে পা ছড়িয়ে বসে থেকেই হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। আমরা ওর পাশে দাঁড়ালাম। সে কাঁদতে কাঁদতে বলছে, আফা-ভাইজান আমারে মাফ কইরে দেন। যে কানাভুলে ধইরছে, সারাবেল নাও চালায়েও নাব নাই। বাবা গোস্সা করছে। বাবা! বাবা! বাবা! ভা¹ ভালা মাজনদীত নিয়ে নাও ডুবায়ে চাইরজনরে মারে নাই! বাবা! বাবা! আইজ আর নাও চালান যাবনা। এই চরে আমার ছোড বইন থাহে, অর অহানে রাইত থাহে সহালে যাওয়া নাগবে। রাইতে একটা মফিল দেয়া নাগবে। বাবা! বাবা!
আমি ভাবলাম ব্যাটা বানিয়ে বানিয়ে বলছে না তো? শুনি, সে সত্যিই বলছে। তার মনে অন্যকিছু নাই।”
এদিকটায় কুয়াশা কিছুটা কম। তাছাড়া ধীরে ধীরে ঘনত্বও হয়ত কমছে। তাই আবছা হলেও দৃষ্টি চলছে অনেকদূর। চরের ভেতর দেখা যাচ্ছে কিছু ফসলের ক্ষেত, একসাথে কয়েকটা ঘর, কিছু কলাগাছ। সবকিছু সজীব, কিন্তু একদম নিশ্চুপ! চরভরতি নিরবতা। যেন নিভৃতে চলছে প্রাণের স্পন্দন!
কোরবানকে ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ফকির মাঝি। সে ভয় পেয়েছে। দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে নৌকা চালায়। কত সময়, কত জায়গায় গেছে! কত ঝড়-ঝাপটা সয়েছে! এক আধবার ‘কানাভুলে’ তাকেও ধরেছে। কিন্তু এমন ফাঁপড়ে সে কোনদিন পড়েনি।
ওদের পেছনে হাঁটছে শান্তা আর সোহেল। শেষ পর্যন্ত চরে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। কোরবান কিছুতেই আজ আর নৌকায় চড়বে না। ফকির মাঝিরও আমতা আমতা ভাব। অন্য কোন উপায় নেই।
শান্তাকে বেশ উৎসাহী দেখাচ্ছে। কিন্তু সোহেল ভীষণ বিরক্ত! বলল, এই চরে রাতে থাকতে হবে। আশ্চর্য! কেন যে তোমার কথা শুনে এই পথে…
শান্তা বাধা দিয়ে বলল, কেন এখানে বুুঝি মানুষ থাকে না? ওরা সারা বছর থাকতে পারলে আমরা এক রাত থাকতে পারবো না?
নীতিকথা শুনিও না। তুমি চেনো এদের? বদমাশ! হয়ত নেশা-টেশা করে এসেছে। এখন প্রলাপ বকছে। কানাভুলে কি? এক চরের পাশ দিয়ে তিনবার নৌকা যায়?
বিশ্বাস করো, বিষয়টা আমিও খেয়াল করেছি। একই রকম পাড়, পানির কোল ঘেঁষে একটা আধমরা কলাগাছ….।
আহ্! শুধু শুধু বিষয়টা জটিল করে তুলো না তো। ওটা ব্যাটা ইচ্ছে করে করেছে।
কিন্তু ভয় পেয়ে অমন করে কাঁদল যে?
সোহেল হাসল। তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, ওর চেয়ে ভালো অভিনয় আমি পারি।
ওরা সরু একটা মেঠো পথ ধরে হাঁটছে। পথের দু’ধারেই মরিচের ক্ষেত। কাঁচা-পাকা মরিচ ঝুলছে গাছে। কোরবানকে নিয়ে ফকির মাঝি অনেকটা এগিয়ে গেছে। বালুটে পথে হাটার অনভ্যাসের কারণে ওরা পিছিয়ে পড়েছে। একটা বাঁক পেরিয়ে সোহেল বলল, টাকা-পয়সা বা অন্যকিছুর লোভে দু’জনকে খুন করে স্রোতে ভাসিয়ে দিলেও অষ্টমাশ্চর্য হবে না! কেউ জানতেও পারবে না আমরা কিভাবে মারা গেলাম! ভাটির লোকে লাশ পেলে ভাববে উজানে নৌকাডুবি হয়েছে।
শান্তা সোহেলের মুখ দেখে নিল এক পলক। সোহেল বলে চলেছে, পত্রিকায় ছাপা হবে, ‘যমুনায় মর্মান্তিক নৌকাডুবি, নিহত দুই’। বিস্তারিত পড়ে সবাই হায় হায় করবে! তারপর নিন্দুকেরা তৈরি করবে মুখরোচক গল্প! ত্রিভূজ কাহিনির শেষ দৃশ্য! প্রাকৃতিকভাবে মাইনাস টু ফর্মূলা কার্যকর! তিন নম্বর ভীষণ নিঃসঙ্গ! চলুন তার পাশে দাঁড়াই!….’
সোহেলের কথা শুনে শান্তা হাসছে। প্রাণখোলা হাসি। সরু মেঠোপথটার পাশের গমক্ষেত থেকে একঝাঁক শালিক উড়ে গেল। ভয় পেয়ে। এদিকে কুয়াশা অনেক কম। পশ্চিমাকাশে সূর্য দেখা যাচ্ছে। চাঁদের মতো সাদা! ঠাণ্ডা গোলগাল!
বিকেলটা বেশ ব্যস্ততার মাঝে কাটাল সোহেল আর শান্তা। এক সারি ঘরের মধ্যে ছোটখাট একটা ঘরে নিয়ে যখন ফকির মাঝি ওদের বসতে দিল তার অল্প পরেই ঘর ভরে গেল ছোট বড় নানা মানুষে। কেউ ছেলে, কেউ মেয়ে, কেউ মহিলা, কেউ পুরুষ আবার কেউবা বয়োবৃদ্ধা! সবারই উৎসুক দৃষ্টি। মনে তাদের নানান কথার দাপাদাপি, নানান প্রশ্নের ছড়াছড়ি! সব মিলিয়ে খুব অগোছালো। তাই সবার ফিসফিস কথা ও চাপা হাসাহাসিতে খাপছাড়া ভাব। বাসনা নামের এক যুবতি শেষ পর্যন্ত নিজের মনের বাসনা দমাতে না পেরে শান্তাকে বলল, আপনে খুউব ছুন্দর! ছাবনূরের চায়েও ছুন্দর! য্যান পরী!
একটু পরে আবার ফিসফিস করে বলল, উনিও… য্যান নায়ক…. আপনেরা ক’ডা ছবি কইরছেন?
শান্তা হেসে ফেলেছে। মাথা নেড়ে বুঝাতে চেয়েছে ওসব কিছু না। যদিও জানে এই সাধারণ মানুষগুলো বিশ্বাসই করবে না যে, তারা পুরোদস্তুর শহুরে দু’টি মানুষ, নায়ক-নায়িকা বা আকাশের পরী না।
সোহেল সবকিছু দেখে প্রথম থেকেই অস্বস্তিতে ছিল। ওর অস্বস্তির মাত্রা যখন চরমে তখন মাতব্বর গোছের একজন লোক তাদের সেই ঘর থেকে উদ্ধার করে নিয়ে গেলেন তাঁর ঘরে। আধাপাকা দাঁড়িওয়ালা লোকটার মাথায় লাল কাপড়ের পাগড়ি দেখেই ওরা বুঝেছিল পীরভক্ত! তাঁর চারচালা ঘরটা চরের মধ্যে সবচেয়ে বড়, যেটার উপরে বাঁশের মাথায় বাঁধা তিনকোণা একটা লাল নিশান উড়ছে।
তাঁর ঘরেই ওদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। ফকির মাঝি আর কোরবানের কাছে বিস্তারিত বর্ণনা শুনতে শুনতে তিনি বিড় বিড় করে অনেকবার বাবা বাবা ডেকেছেন। তারপর তার বড়োই প্রিয় একটা আয়োজন করেছেন। মাহফিল। রাতের খাওয়া দাওয়া শেষে এখন তারই যোগাড়যন্ত্র চলছে। শান্তা আর সোহেলের আসন হয়েছে খাটের উপর, তিনি বসেছেন খাটের পাশে একটা চেয়ারে, বাকি সবাই মেঝেতে চটের উপর। মাইক লাগানো হয়েছে। তাঁর অনুমতিক্রমে মাহফিল শুরু হল।
মাইজ ভাণ্ডারি গান হচ্ছে। গায়কের গলা অত্যন্ত চড়া। মাইকের মাধ্যমে তা আরো কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়ে চারপাশের নীরব প্রকৃতিকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিচ্ছে। গানের তালে তালে ঢুলে ঢুলে চলছে যিকির-আসগার।
হ্যাজাকবাতির আলোয়, গানের চড়া সুরে আর যিকিরের গুঞ্জনে ঘরের ভেতরে অন্যরকম এক পরিবেশের জন্ম হয়েছে। যার সাথে ওদের পূর্ব পরিচিতি নেই। উচ্চ শব্দ সোহেলের ভীষণ অপছন্দ। কিন্তু আবহটা ওর ভাল লাগতে শুরু করেছে। আরা শান্তা ইতিমধ্যেই মজে গেছে।
নিঃশ্বাস নেয়ার অবসরটুকু ছাড়া একটানা চারটি গান গেয়ে মিয়াজী যখন হাঁপাতে হাঁপাতে থামলেন তখন যিকিরও থেমে গেল।
‘আল্লাহু আল্লাহু’ ধ্বনি ক্রমে দ্রুত হতে হতে ‘হুহ্ হুহ্’ শুনাচ্ছিল। এখন মিয়াজীর সাথে তের-চৌদ্দ জন নারী পুরুষের দলটা জিরিয়ে নিচ্ছে। এই শীতের রাতেও সবাই অল্প-বিস্তর ঘেমে গেছে।
সোহেলের কানের কাছে মুখ নিয়ে শান্তা ফিসফিস করে বলল, কেমন একটা আবহ তৈরি হয়েছে তাই না? আমি একটা লালন গাই? সোহেল মাথাটা একটু পেছনে সরিয়ে শান্তার চোখে চোখ রাখল। দৃষ্টি বিনিময়ের সাথে সম্মতিটাও দিয়ে দিলে শান্তা আবার ফিসফিস করে বলল, কাকাকে তুমিই বল। তিনি চোখ বন্ধ করে আছেন। চেয়ারের উপর দুই পা ভাঁজ করে রেখে পিঠ সোজা করে বসে আছেন বলে মনে হচ্ছে গভীর ধ্যানে মগ্ন। সোহেল একটু ইতস্তত করে তাকে ছোট্ট করে ডাকল, কাকা।
তিনি তেমনি বসে রইলেন। নির্বিকার। নিরুত্তর।
সোহেল আবার ডাকল, কাকা শুনছেন?
এবার তিনি চোখ খুললেন। মেঝে থেকে কেউ একজন অস্ফুট স্বরে বিরক্তি প্রকাশ করল। তাঁর ধ্যানে ব্যাঘাত ঘটানো সে পছন্দ করেনি। তিনি সোহেলের দিকে তাকালেন। জ্বী, আপনে কিছু কইবেন?
না, মানে…. আমরা এমন মাহফিলে আগে কখনো অংশগ্রহণ করিনি। তাই ঠিক….। কিন্তু ভালোই লাগছে। আর গান কম বেশি সবাইকে আনন্দ দেয়। গানের প্রতি টান সবারই কম বেশি থাকে। তাই না? তাই ভালোই লাগছিল।
তারপর শান্তাকে দেখিয়ে বলল, ও খুব ভালো লালনগীতি করে। আপনি যদি…..।
না, না কুনো অসুবিধা নাই। মায় গান গাবো তাতে অসুবিধা কি?
তিনি শান্তাকে হ্যাজাক বাতির আলোয় এক পলক দেখে নিলেন। তাঁর সাথে উপস্থিত সকলেই আরও একবার ভালো করে দেখে নিল শান্তাকে। জিন্স ছেড়ে সালোয়ার কামিজের উপর শাল জড়িয়ে সোহেলের পাশে বসে আছে মেয়েটি। হ্যাজাক বাতির আলোয় ঝলমল করছে তার মুখখানা। অনুরোধের স্বরে মিয়াজী বললেন, গান মা, একখান নালনগীতি গান।
শান্তা সময় নিল। মুহূর্তমাত্র। তারপর কণ্ঠে মাধুর্য ঢেলে শুরু করল, ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি ওহে দয়াময়/ পাড়ে লয়ে যাও আমায়….’ শান্তা গেয়ে চলেছে। মুগ্ধ হয়ে শুনছে সবাই। নিঃশব্দে। সোহেলের মনে হল শান্তা এত ভাল আর কোনদিনই গায়নি।
গান শেষে ঘরে নেমে এল পিন পতন নিরবতা। কেবল টিনের বেড়ার নিচের ফাঁক গলে ঘরের মেঝে ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঢুকে পড়া হিমেল হাওয়ার ফিসফাস ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।
“আমিও খুব অবাক হয়েছি। শান্তা এত ভাল গান করে! শুনেছিলাম সে গান করে। কিন্তু এত ভাল গান করে জানতাম না। আমি মুগ্ধ হয়েছি। শুধু আমি না, শুনলাম উপস্থিত সবার মনেই মুগ্ধতার আলাপন।
রাত বাড়ছে।
একসময় সোহেলের পাশে শুতে গিয়ে শান্তা আমার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, কী জনাব, ভ্রমণটা গল্প হয়ে উঠছে তো?
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শান্তাই ফের বলল, আচ্ছা, সে বিচার পরে হবে। এখন গুড নাইট।
হুট করে আলো নিভে গেল। ঘরময় ভীষণ অন্ধকার। আমার চোখ দুটোও জড়িয়ে যেতে লাগল গভীর ঘুমে। কোন কিছুই বলা হল না।”
পরদিন কুয়াশা কমতে কমতে দশটা বেজে গেল। ওদের নৌকায় তুলে দিতে সাত-আট জনের একটা দল ঘাটে এসেছে। দলের নেতা মাতব্বর গোছের মানুষটি। তাঁর মুখ মলিন। এই অল্প সময়ের মধ্যেই শান্তা-সোহেলের উপর মায়া পড়ে গেছে।
সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়া হয়ে গেলে নৌকা ছাড়ল কোরবান।
সাবগ্রাম পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে গেল। শোভাদের বাড়ি খুঁজে পেতে কষ্ট হল না। সোহেল বাজারের মধ্যে একজন মাঝবয়সী লোককে জিজ্ঞেস করতেই রাস্তা দেখিয়ে বাড়ির বর্ণনা বলে দিল লোকটা। সেই রাস্তা ধরে মিনিট তিনেক হাঁটতেই ওরা বাড়িটা পেয়ে গেল। বিয়ে বাড়ি, তাই বেশ লোকজন আর কিছুটা সাজানো গোছানো। তিনটা ছেলেমেয়ে ওদের দেখে ছুটে এল। সোহেল শোভার কথা বলতেই ওরা তেমনি ছুটে বাড়ির ভেতরে চলে গেল।
বাড়ির ভেতরে ঢোকার মুখে কয়েকজন মুরুব্বি নিজেদের আলোচনা থামিয়ে সোহেল আর শান্তাকে দেখলেন। সোহেল কাছে গিয়ে সালাম দিল। একজন ওদের দু’জনকেই চিনতে পারলেন। শোভার বাবা। সরকারি চাকরির সুবাদে সপরিবারে ময়মনসিংহ ছিলেন অনেকদিন। তখন থেকেই শোভার বন্ধু হিসেবে চেনেন।
কুশলাদি বিনিময়ের পর তিনি ওদের বাড়ির ভেতরে যেতে বললেন। ওরা পা বাড়াল। তখনি ছুটে এসে শোভা ওদের সামনে দাঁড়াল। খুশি হয়ে বলল, ইস্ তোরা! আয়, আয়। শান্তার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল শোভা। সোহেলও এগোল পেছনে। শোভা বলেই চলেছে,আমার মনে হচ্ছিল তোরা আসবিই। জানিস, কাল বিকালে আব্বু জিজ্ঞেস করছিল তোরা আসবি কিনা। কি ভেবে বলে ফেললাম ‘আসবে’। তারপর থেকেই ট্রাই করছি, কিন্তু তোদের মোবাইল বন্ধ। কেন রে?
আমরা যেখানে ছিলাম সেখানে নেটওয়ার্ক ছিল না। একটা রুমে ঢুকে শান্তা বলল।
নেটওয়ার্ক ছিল না মানে?
এবার সোহেল কথা বলল, এখানে আসার জন্য আমরা বেরিয়েছি গতকাল সকালে। পথে বৈরী প্রকৃতি আটকে দিয়েছিল আমাদের যাত্রা।
কি বলিস তোরা? আসলে কাহিনিটা কি?
শান্তা বলল, তোকে দেখে কাহিনিটা কোকিল হয়ে উড়ে চলে গেল। যখন ফিরবে তখন বলা যাবে। ঠিক আছে শোভাময়ী? শীতকালে কোকিল! তোরা….
শোভাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে সোহেল বলল, শীতকালেও কোকিল থাকে। কেবল ‘ক্যোই ক্যোই’ বলে প্রিয়াকে ডেকে মরে না। সোহেলের কথা শুনে তিনজনই হেসে উঠল একসাথে।
রাতে নিতুর বিয়ে, পরদিন বগুড়া শহর ঘুরে এটা সেটা কেনাকাটা।
তার পরদিন মহাস্থানগড় ঘুরে আসা।
তারও পরদিন বাসে চেপে তিনজন মানে ট্রিপল এস অর্থাৎ শান্তা, সোহেল, শোভা ময়মনসিংহ ফিরে এল।
৩.
পরিশিষ্ট
শান্তা হুট করে আমার রুমে ঢুকে প্রশ্ন করল, “আপনার সাথে একটু কথোপকথন করি?”
আমি কিছু বললাম না। সামান্য একটু হাসলাম।
শান্তা: ভ্রমণ কেমন হল?
আমি: ভালো।
শান্তা: গল্পটা কেমন হয়েছে?
আমি: ঠিক বুঝতে পারছি না।
শান্তা: ও, আচ্ছা। আপনি তাহলে না বুঝে গল্পের নাম দিয়েছেন ‘শান্তার উড়ালযান’! আমারই ভুল হয়েছে। আমি বুঝতে পারিনি আপনি কচি খোকা। কেন জানিনা আমি আপনাকে বন্ধু ভাবি! ভালোবাসি। অথচ আপনি আমার ক্ষতি করতে চাইছেন। আপনি চাইছেন গল্পটা পড়ে সবাই আমাকে সন্দেহ করুক। তা হবে না। আপনি গল্পের নাম চেঞ্জ করে লিখুন ‘আমার’। তাহলে গল্পটা যে পড়বে তারই হবে। আপনি গল্প কথক মাত্র! লিখুন ‘আমার’।
আমি একান্ত বাধ্যগত ছাত্রের মত তা-ই লিখলাম।