রান্না শেষ করে ল্যাপটপ চালু করেছে। একটু দারুণ গল্প লেখতে বসবে। আজ সন্ধ্যায় অফিসের পোশাকেই হাঁটতে গিয়ে পানি শুকিয়ে যাওয়া হাওরে নেমেছিলো। কোথাও কোথাও ছোপ ছোপ কচুরিপনা জমে আছে, ওরা মরতে শুরু করেছে, শুকিয়ে যাওয়ার চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই মৃত্যুর মধ্যেও কিছু কচুরিপনায় ফুল ফুটেছে। এরা আর জীবিত হবে না– নিশ্চিত জানে। যে ফুলটা ফুটছে, সেটাও ফুটতে ফুটতেই মরে যাবে। হাওরে পানি আসতে ঢের দেরি। কচুরিপানার কয়েকটি ডোবা পার হয়ে রাস্তা থেকে অনেক ভেতরে চলে এসেছে। সাথে আছে আঙ্গুর আর শোভন। ওরাও শিক্ষক। শিপন নিজেও শিক্ষক। রাস্তার ধারের দু’টি চায়ের দোকান, এখন ছোলা, পিয়াজু, পুরি আর সিঙাড়া পাওয়া যায়। ওসব দোকানে বসে ছাত্ররা আড্ডা দেয়। এদিকটায় শিক্ষকদের আসা হয় না। আজ ওরা নেই এদিকে, সে সুযোগেই আসা।
হাঁটতে হাঁটতে হাওরের অনেক ভেতরে চলে গিয়েছে। রাস্তাকে এঁকেবেঁকে যাওয়া সাপের মতো দেখাচ্ছে। রাস্তার পাশে লাগানো বড় গাছগুলোকে কচুরিপানার ফুটফুটে ফুলের মতো লাগছে, কেমন ফুলে-ফেঁপে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে ধানক্ষেত। ধানক্ষেতে অনেকগুলো কাকতাড়ুয়া। কয়েকটা কাকতাড়ুয়ার ওপর কাক বসে আছে, অন্য পাখিও বসে আছে। পাখিগুলোর নাম জানে না শিপন।
ধানক্ষেতের পূর্ব-দক্ষিণ দিকের একটা কাকতাড়ুয়ায় হলুদ রঙের একটা কামিজ পরানো আছে। ডান হাতটা নেই, সম্ভবত বাম হাতটা কেটে গরম পাতিল ধরার লুছনি বানানো হয়েছে। অবশিষ্ট জামাটুকু ঠাঁই পেয়েছে ধানের ক্ষেতে, কাকতাড়ুয়ার শরীরে।
কাকতাড়ুয়াটির ডান হাতে বাঁশের চটা বেরিয়ে আছে, সেটার ওপর কালো রঙের একটি পাখি বসে। শিপন ছবি তোলার জন্য ওদিকে যেতেই উড়ে গেলো পাখিটি। তখন শিপনের মনে হলো– আমরা সবাই কাকতাড়ুয়া, এ কাকতাড়ুয়াটি আমার আপন।
এ ঘটনাটি আরও সাজিয়ে-গুছিয়ে একটা গল্প লিখতে বসবে। এজন্যই ল্যাপটপ চালু করেছে। ল্যাপটপের দুই পাশে দুটি ফোন। বাম পাশের ফোনটি এন্ড্রয়েড, বেশ পুরনো। চার্জ দিতে বেশ কষ্ট হয়। অধিকাংশ চার্জার থেকেই চার্জ নেয় না। কিংবা নিলেও বিশেষভাবে তারটি ধরে রাখতে হয়। শিপন অনেক চেষ্টা করে ফোনের সাথে চার্জারের যে অংশটি লেগে আছে, সেটা তিন ভাজ দিয়ে তার ওপর ছোট ফোনটি চাপা দেয়াই চার্জ-সংকেত দেয়া লাল বাতিটি জ্বলে উঠলো। মোবাইলের চার্জের বন্দোবস্ত হওয়ায় লেখায় মন দেবে। তখনই ফোন বেজে উঠলো, নোকিয়া কোম্পানির ছোট ফোনটি রিনরিন করে বাঁজছে। নিশা ফোন দিয়েছে।
এখন ফোন দুটি কারণে ধরা যাবে না। ফোন ধরতে গেলে নিচের এন্ড্রয়েড ফোনটি নড়ে যাবে, চার্জ নেবে না। দ্বিতীয় কারণ হলো কথা বলা শুরু করলে গল্পটি ভুলে যাবে। দীর্ঘদিন পর একটি গল্প মাথায় এসেছে। এটা লিখতেই হবে।
শিপনের মনে হলো– এভাবে প্রতিদিন যদি হাওরের একেকদিকে ঘুরতে যাওয়া যায়, তাহলে নতুন নতুন গল্প মাথায় আসবে। নিশাকে সাথে নিয়ে যাওয়া যাবে না, ও এসবে মজা পায় না। ওর আগ্রহ নেই এসবে। আবার আঙ্গুর আর শোভন প্রতিদিন আসবে না। কিংবা নিশা বাড়ি থেকে ফিরে এলে প্রতিদিন বের হওয়াও হবে না। অর্থাৎ সবকিছু থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে, গল্প যখন-তখন মাথায় আসে না, যেহেতু চলেই এসেছে, লিখতেই হবে।
নিশা শিপনের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আছে এমন ছবিটি ল্যাপটপের স্ক্রিনে ভেসে উঠলো। শিপন না পারছে লেখা শুরু করতে, না পারছে ফোনটি ধরতে, না পারছে ফোন রিসিভ না করে বসে থাকতে, না পারছে ফোনে চার্জ দিতে। চুপচাপ বসে থাকল। যখন একসাথে অনেক কাজ আসে, তখন কোনটাই করা যায় না। চুপচাপ বসে সবগুলো ভেস্তে দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। শিপন বুদ্ধিমান ছেলে, সেও কোনটাই করল না, বসে থাকলো।
শিপন সবকিছু পারে। সবকিছু পারে মানে হলো– সে রান্না পারে, পায়ে হেঁটে দীর্ঘপথ যেতে পারে, অনায়াসে ফোন বন্ধ রাখতে পারে, অনেক মানুষের কল রিসিভ না করে নির্বিকার বসে থাকতে পারে। কিন্তু সে একটা কাজ পারে না, সেটা হলো নিশার ফোন এলে সেটা না ধরে সে থাকতে পারে না। শিপনের মনে হয়, যদি আজরাইল জান কবজ করবে এমন সময়েও নিশা ফোন করে, সে আজরাইলকে অনুরোধ করে হলেও ফোনটা রিসিভ করবে, কথা শেষ হলে আজরাইলকে বলবে– প্রিয় আজরাইল, আমার জান কবজ করুন।
ফোনটা বাজছে। এখনো। রিনরিনে একটা রিংটোন। এটা নিশা নিজেই ঠিক করে দিয়েছে। শিপনের মাথার মধ্যে ধোঁয়ার কুন্ডলী উড়ছে। একটা ধোঁয়া কাকতাড়ুয়াতে বসে থাকা পাখি হয়ে উড়ে যাচ্ছে, ধোঁয়াটা নড়ছে, মনে হচ্ছে– পাখিটা একটু বেশি জোরেই উড়তে গিয়ে বড় আঘাত লেগেছে ডান হাতটিতে। ডান হাত থেকে উড়ে যাওয়ায় বাম হাতটা আরো জোরে নড়ছে, কাপছে। পুরো শরীর কাঁপছে। ডান হাত কাটা হলুদ কামিজের পুরো কাঁপছে। ধোঁয়াটাই যেন কাকতাড়ুয়া। এ ধোঁয়ার মধ্যে আরেকটা ধোঁয়া ঢুকে গেছে, প্রথম ধোঁয়ার একটু পরেই এই ধোঁয়াটা ছেড়েছে। সে ধোঁয়াটা নিশার আকৃতি ধারণ করেছে। ধোঁয়ার মতো উড়ে উড়ে শিপনকে ঘিরে ফেলছে, শিপনের চারদিক থেকে এই ধোঁয়াটা জড়িয়ে ধরে বলছে- শিপন। এই শিপন।
শিপন শিওরে ওঠে। না লেখা হচ্ছে গল্পটি, না ধরা হচ্ছে নিশার ফোন। একটা রিংটোন কতক্ষণ বাজতে পারে? শিপনের মনে হচ্ছে– অন্য কারো কল হলে রিংটোন বড়জোড় এক মিনিট বাজতে পারে। কিন্তু কলটা যদি নিশার হয়, তাহলে সেটা না ধরা পর্যন্ত বাজবে। এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় বার নিশাকে কল করতে হয়নি, ওর প্রথম কলই শিপন রিসিভ করেছে। যখন কল ধরতে দেরি হয়েছে, তখন যেন রিংটোন দীর্ঘ হয়েছে। ধোঁয়ার মতো দীর্ঘ।
শিপনের মন থেকে কাকতাড়ুয়া যাচ্ছে না। কাকতাড়ুয়াগুলো বসানো হয়েছে যাতে করে অযাচিত পাখি বসতে না পারে। পাখিরা ধান খেয়ে যায়। তাদের হাত থেকে ধানকে রক্ষা করার জন্য বসানো হয়েছে। অথচ কাকতাড়ুয়াগুলোতেই এসে পাখি বসছে, ওদের হাতে শক্তি নেই তাড়ানোর। পাখি ঝুপ করে নেমে ধানের শিষ মুখে কেটে কাকতাড়ুয়ার ডানায় কিংবা মাথায় বসছে, কিছু বলতে পারছে না।
কাকতাড়ুয়ার মাথা মাটির ভাঙ্গা হাড়ি দিয়ে বানানো। একদিকটা ভাঙ্গা, ভেতরে বাঁশের চটা পুরে দেয়া, ভেতরটা খালি। কয়েকটা ভেতরে বাঁশের চটার ওপর ত্যানা জুড়ে দেয়া হয়েছে, যাতে মাথাটা বাতাসে না ঘুরে কিংবা না পড়ে যায়। এই মাথা কোন কাজে লাগে না।
মাথার চেহারা কেমন? কোনটাতে কালি লেপ্টে চেহারা বানানো হয়েছে। কোনটাতে তাও নেই। কতকগুলোতে হেমন্তের কুয়াশায় মুছে গেছে কালিও। এসব মাথা শুধু আছে, মাথার কোন কাজ নেই। এদের হাতের কোন কাজ নেই। তবু নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছে। নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকাই যেন ওদের চাকরি।
ফোন বাজছে। শিপন যদি এই কলটা না ধরে অনন্তকাল বাজতে থাকবে, রিনরিন করে রিংটোন নিশার কথা মনে করিয়ে দেবে, কল ধরলেই থামবে এটা।
শিপন কলটা ধরবে, মোবাইলে যেহেতু ভাইব্রেশন দেয়া, সেহেতু কল বাজার সাথে সাথে নিচের ফোনটা নড়ে গেছে। আর চার্জ হচ্ছে না। কথা শেষ করে আবার কায়দা করে চার্জার সেট করতে হবে। গল্পটি লেখার দরকার নেই। আজ যদি গল্পটি লিখতে না পারে, অন্য কোনো দিন অন্য কোনো গল্প লিখতে পারবে। কিন্তু নিশার এ কল কেটে যেতে দিবে না।
ফোনটা হাতে নিলো, রিসিভ করবে। মনে হচ্ছে– এই ফোনটা একটা কাকতাড়ুয়া। কেউ ফোন দিলে বেজে ওঠে, ওপাশ থেকে কেউ কথা বললে শোনা যায়, এ পাশ থেকে কেউ কথা বললে ওপাশ থেকে শোনা যায়। কথা আসে ফোনের কাছ থেকে তবু ফোন কথা বলে না। ফোন অন্যের কথা বলে। কাকতাড়ুয়া অন্যে বানায়, অন্যে বসায়, অন্যে কাজ করায়। কাকতাড়ুয়া বানানো হয়েছে পাখি তাড়ানোর জন্য, ডাকাত পাখি চোর পাখি তাড়ানোর জন্য। অথচ ডাকাত পাখি আর চোর পাখিরা কাকতাড়ুয়ার মাথায় বসেই খায়, হাতে বসে খায়, ওদের কথা বলার ক্ষমতা দেয়া হয়নি।
ফোন রিসিভ করে। ওপাশ থেকে শোনা যায়– এতো দেরি কেনো গো? রান্না করছিলে নাকি?
শিপন বলে– কাকতাড়ুয়া দেখছিলাম।
ওমা, কোথায়? ঘরের মধ্যে কাকতাড়ুয়া কোথায় পেলে?
আমার আছে আপন কাকতাড়ুয়া…
লাইনটিতে কোন ছন্দ নেই, শিপন তবু সুর করে বলে। ফ্যাঁশফেঁশে কণ্ঠে সুরটাকে কেমন বেসুরো লাগে। নিশা বলে, কী হয়েছে তোমার? কথা বলতে ইচ্ছে করছে না?
হ্যা, ইচ্ছে করছে তো। কী করছো? খেয়েছো?
খেয়েছি কিন্তু ভালো লাগছে না। তোমার ওখানে চলে আসবো। কবে পরীক্ষা শেষ হবে গো?
নিশাকে বাড়িতে রেখে এসেছে শিপন, নিশার পরীক্ষা। শিপনের খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট হচ্ছে, তবু তার কোনো কষ্ট নেই। অনার্স-পড়ুয়া নিশাকে বিয়ে করেছে মাত্র ক’দিন হলো। ফাইনাল পরীক্ষার জন্য রেখে এসেছে। সারাদিন তার জন্য মনটা খারাপ থাকে শিপনের। এটা-ওটা ভেবে দিন পার করে। প্রতি ঘন্টায় নিজেই কল দিয়ে কথা বলে। এর মাঝে নিশা কল দেয়। মেসেজে কথা হয়। তবু মনে হয়– ওরা দুজনে অনেক দূরে আছে। শিপন নিজেকে শান্তনা দেয়– পরীক্ষার মাত্র ক’টা দিন, শেষ হলেই নিশাকে নিয়ে আসবে।
নিশা বলে, তোমার শরীর খারাপ করছে নাকি?
কই, না তো।
দুজনেই চুপ করে থাকে। শিপন বলে, আচ্ছা একটু রাখো। পরে কল দিচ্ছি। তুমি পড়তে বসো।
কেনো? কথা বলতে ইচ্ছে করছে না?
শিপনের কথা বলতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। ফোন কাটতেও যেমন ইচ্ছে করছে না, কাকতাড়ুয়ার যে গল্পটি মাথায় মধ্যে ধোঁয়ার মতো উড়ে বেড়াচ্ছে, সে গল্পটিকেও হারিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে না।
নিশাকে বলে, মানুষ সবাই কাকতাড়ুয়া, তাই না?
নিশা হাসে, কিন্তু এ হাসিতে কোন উচ্ছ্বাস নেই। বুকে পাথর চাপা দেওয়া মনে হচ্ছে। নিশা শিপনকে বুঝতে পারছে না যেনো। এ যেনো অন্য কোন শিপন, এ শিপন নিশার না। নিশার শিপন এমন আনমনা না, সে চটপটে, পাগলের মতো। নিশা চুপ থাকে। শিপন বলে, কাকতাড়ুয়ার মতো আমরা সবাই ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকি, কথা বলার ক্ষমতা নেই, ধান খেয়ে যাওয়া পাখি তাড়ানোর সাধ্য নেই, তবু দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
নিশার অভিমান হয়। রাগ করে বলে, ফোন রাখো তো। আমার সাথে কথা বলতে তোমার যেন কোন ইচ্ছাই করছে না।
ফোন কাটার শব্দ শুনতে পায়। চোখ পিটপিট করে। ফোন থেকে কোন শব্দ আসে না, চোখে কোন কাকতাড়ুয়ার ছবি ভাসে না। শুধু ধোঁয়া, এ ধোঁয়ায় কাকতাড়ুয়া নেই, এ ধোঁয়ায় নিশা নেই, এ ধোঁয়ায় শিপন নেই।
আর কাকতাড়ুয়াকে খোঁজে না। নিশাকে ফোন দেয়। তিনবার ফোন দেয়ার পর ধরে। ধরেই বলে, কী, ফোন দিলে কেনো?
আমার কাকতাড়ুয়ার দরকার নেই, তোমার দরকার। তুমি আমার কাকতাড়ুয়া, হলুদ কামিজ পরা, ধান খুটে এনে তোমার ডানায় বসে খাবো। তুমিও খাবে। আচ্ছা শোনো, কাকতাড়ুয়া খেতে পারে?
নিশাকে উত্তর দেয়ার সুযোগ দেয় না। নিজেই বলে, সত্যিকারের কাকতাড়ুয়া খেতে পারলে পারবে, না পারলে না। আমার কাকতাড়ুয়া পারবে।
নিশা বলে, শিপন, তোমার মাথায় বোধহয় কোনো গল্প ঘুরছে, যাও লিখতে বসো, নাইলে ভুলে যাবে।
আমার কোনো গল্পের দরকার নেই। আমি গল্প লিখবো না, তোমাকে লিখব।
নিশা শুনতে পায়। শিপন ফোনের ও-প্রান্ত থেকে বলে,
আমার আছে আপন কাকতাড়ুয়া
দূর থেকে ডাকছে শেয়াল, ডাকছে হুক্কা-হুয়া।
শিপন শেয়ালের হুক্কাহুয়া ডাক শুনতে পায়। জয়নগরের এ বাসা থেকে শেয়ালের ডাক শোনা যায়। ফোনের ওপাশ থেকে নিশাও শেয়ালের ডাক শোনে। দুজন একসাথে শেয়ালে ডাক শোনে, ডাক খুব সুন্দর লাগে। মুগ্ধ হয়ে দুজনেই শুনছে। মুগ্ধতা কোথায় যে থাকে, তা কেবল হৃদয় জানে, হৃদয় খুঁজে নেয় শুধু।