– এ্যা!
– এইযে ওটোতো, ওটো, চউক খুলি দেকো…
আরো কিছুক্ষণ ডাকাডাকি ঝাঁকাঝাঁকির পর সে ধড়ফড় করে উঠে বসে।
– কি? কি কলু? বিষ উটচে? কাইত্যা! অ কাইত্যা!
এ অবস্থাতেও বউ ঝামরে ওঠে– ছাওয়াটা নিন পারোচে পারুক, অক ফির ডাকায়চেন ক্যানে? ওহ্ ভগমান! এই মানুষটা!
– তা নুরীর মাক খবর দেইম? আইচ্চা, যাও এলা…এই দৌড়ি যাওচো…
– বিয়ান হউক যান এলা। এখন মোক এনা জল দ্যান।
জল খাওয়া শেষে দুগির বাপের হাত ধরে কাকুতি মিনতি করে, চিঁ চিঁ করে বলে- শোন দুগির বাপ! এবার বুজি মুই আর না বাঁচিম। মন কুডাক দেওচে। খারাপ স্বপন দেকচু…
– স্বপন কিচু না। দাইয়ানি আসপে, কিচ্চু হবার ন্যায়। চিন্তা না করিস। মাতার উপর ভগমান আচে।
– তোমরা মোক মাপ করি দ্যান, আগ করি মেলা সময় মেলা গাইলাগাইলি কচ্চু, তোমরা মাপ না করলে নরকবাসি হবার নাগবে। ছাওয়া দুইটা থাকিল ওমাক দ্যাকেন।
– আরে, ওগলা কতা না কইস তো। মুইও তোক মেলা মন্দ কতা কচু। সংসার করবার গেইলে উলা মেলা কিচু হয়, অগুলা ধরি থাকলে হয়! আর এলা কি অগুলা কতা কওয়ার সময়! মন ভালো কর, মনত জোর আন, মুই যাও নুরীর মাও চাচিক ডাকে আনো, সে হইল এই এলাকার নামকরা দাইয়ানী…
বউয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে স্বামী নানা রকম দরদী কথা বলতে থাকে। অন্ধকার সরিয়ে চারপাশ আলোকিত হতে শুরু করলে দুগির বাপ বেড়ার গা থেকে ছাতা আর ফতুয়াটা নিয়ে হনহন করে হাঁটা দেয়।
আষাঢ় মাস চলছে। তিন দিন ধরে লাগাতার বৃষ্টিতে চারপাশে থিকথিকে কাদা। লোকজন পারতপক্ষে ঘরের বাইরে যাচ্ছে না। মানুষের দুর্ভোগের একশেষ। বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষদের। গরু-ছাগল নিয়ে সকলে বড় বিপাকে পড়েছে। এসময় কাজ থাকে না, অভাবেরও শেষ থাকে না।
সেই ভোরবেলা দুগির মায়ের ব্যথা উঠেছে দীর্ঘ সময় পার হতে চলল… কোনো ডাক্তার নেই, দাই চেষ্টা করে করে এখন প্রায় হাল ছেড়ে দিতে চলেছে। দাই একসময় ঘরের বাইরে এসে দুগির বাপকে বলে- এই যে ক্ষিতিশ শুন, অবস্থা তো ভালো না, এলা এটা মোর হাতের বাইরা, মোর কাম এটা নোয়ায় বাবা। তুই অন্য চেষ্টা নে, তুই ডাক্তার এর ব্যবস্থা কর।
একথা শুনে বেসামাল ক্ষিতিশের মাথায় একেবারে আসমান ভেঙে পড়ে। সে দিশেহারা হয়ে পড়ে। কী করবে সে এখন! কোথায় যাবে! কোন ডাক্তার এই ঝুম বর্ষণের সময় দুগির মায়ের ঝুপড়ি ঘরে আসবে! মনে মনে সে ভগবানকে ডাকে… ভগবান ছাড়া ওদের আছে কে! এভাবেই সন্ধ্যা পার হয়ে রাত বাড়তে থাকে। অবস্থার কোনো হেরফের হয় না। এক সময় হাতের বিড়ি ছুঁড়ে দিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়…
নুরীর মা চাচীকে বলে কয়ে সে দুগির মায়ের কাছে যায়। যদিও এসময় স্ত্রীর কাছে যাওয়া এদের নিষেধ। কিন্তু সেসব ক্ষিতিশের মনে থাকে না, ওর মাথার ঠিক নাই। সে বউয়ের কপালে হাত দিয়ে অনেকটা সময় চুপচাপ অসহায় দাঁড়িয়ে থাকে। তার চোখে অবিরল জলের ধারা…
দুগির মায়ের কথা বলার শক্তিও আর অবশিষ্ট নাই। সে ক্লান্ত, ক্লিষ্ট, অমানুষিক ব্যথায় অবসন্ন। আধবোজা চোখে স্বামীর দিকে তাকায়, তার চোখও শুকনা থাকে না। সে কেবল গোঙাতে থাকে। ক্ষিতিশ বাইরে এসে কন্যা দুগি আর পুত্র কার্তিকের হাত ধরে মায়ের কাছে নিয়ে যায়। ওদের পিছ পিছ নুরীর মাও ঘরে ঢোকে, সে আর কী করবে! ভাবে, মা তার সন্তানদের দেকি নেউক, শ্যাষ দেকা দেকুক। সন্তানদের দেখে দুগির মা অসহায় গোঙানিতে আরো কুঁকড়ে যায়, ফ্যাসফ্যাসে নিস্তেজ গলায় হিক্কা দিয়ে ওঠে। দুগির বাপ, মরা কান্না জুড়ে দেয় সাথে নুরীর মাও আর চুপ থাকতে পারে না… ক্ষুধায় কাতর ছোট ভাইটি দিদির হাত আঁকড়ে ধরে, তারাও ভয়ে, সারাদিনের না খাওয়ায় আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে। পাড়ায় পাড়ায় রটি যায়– পোয়াতি দুগির মাও ছাওয়াল হইতে যায়া মরি গেইচে…
কাজী মেটার্নিটি ক্লিনিক। এখানে একজন নামকরা গাইনী বিশেষজ্ঞ এই ক্লিনিক গড়ে তুলেছে যার মূল উদ্দেশ্য ‘অপরিহার্য না হলে সিজার নয়’। সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের হার বাংলাদেশে ক্রমাগত ভয়াবহ আকার ধারন করেছে। সন্দেহ নেই এই উচ্চহার পৃথিবীর অন্যান্য দেশের চাইতে বেশি, অনেক বেশি। নামকরা গাইনোকোলজিষ্ট কাজী ফিদা তাজকিয়া প্রভা ভয়াবহতার বিপরীতে, এই মহান ব্রত নিয়ে এই ক্লিনিক গড়ে তুলেছেন। সচেতন দম্পতিরা এখানে নিশ্চিন্তে সন্তান প্রসবের জন্য ভিড় করেন।
ডাঃ ফিদা তাজকিয়া প্রভা মাত্রই একজন শিশুকে মায়ের গর্ভের হিরন্ময় অন্ধকার থেকে পৃথিবীর আলো বাতাসে এনে দিয়ে নিজ চেম্বারে আসেন। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে ফোন হাতে নিয়ে দেখেন বেশ কিছু মিসড কল। একটি নাম দেখে ডাক্তারের মাঝে একটু চঞ্চলতা দেখা দেয়। তিনি তাড়াতাড়ি কল ব্যাক করেন, কিছুক্ষণ নরম স্বরে কথা বলেন। এরপরে অতি দ্রুত তিনি কিছু সরজ্ঞামাদি সঙ্গে নিয়ে, সবাইকে বলে কয়ে, বাসায় একটি কল করে ছেলেমেয়েদেরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে, স্বামীর সাথে কথা সেরে গাড়িতে উঠে বসেন। আবার কী মনে করে গাড়ি থেকে নেমে আরেকজন ডাক্তারের সাথে কথা বলে একজন অভিজ্ঞ নার্স সাথে নিয়ে গাড়িতে বসলে নির্দেশ মতো গাড়ি ছুটতে থাকে।
কিছুক্ষণ পরে তার ফোনে আবার কল আসে, ফোন রিসিভ করে– হ্যা, দাদীমণি আমি রওনা হয়ে গেছি, এইত আমি এসে গেছি, আর অল্প কিছুক্ষণ পরেই তোমার কাছে আসছি।
অপর প্রান্ত থেকে– আমার কাছে পরে এসো। আগে তুমি সোজা বাগদী পাড়ায় যাও, ওখানে ছাতা, টর্চলাইট এবং দরকারী আরো জিনিস নিয়ে তোমার হালিম চাচা, এবং আরো কয়েকজন, তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। কিছু লাগলে ওদেরকে বলবা।
– আচ্ছা দাদীমণি। আমি সব শেষ করে তোমার কাছে আসব, তুমি চিন্তা কর না।
– এসো সোনামণি, আমি অপেক্ষায় থাকলাম, তুমি এলে একসাথে খাবার খাব।
সত্যি সত্যি যমের হাত থেকে দুগির মাকে ছিনিয়ে এনে সদ্য জন্মানো শিশুদুটির একটিকে নার্সের হাতে আর একটিকে নুরীর মা দাইয়ের হাতে দিয়ে স্বস্তির একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলেন গাইনী বিশেষজ্ঞ। হ্যাঁ দুগির মায়ের পেটে ফুটফুটে যমজ সন্তান ছিল। তারা এখন ভালো আছে। কোত্থেকে দুগির বাপ হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে এসে ডাক্তারের পায়ের উপর গড় হয়ে পড়ে। ডাক্তার অসম্ভব বিব্রত হয়ে ছিটকে দু’পা পিছিয়ে যায়– আরে! আরে! করছেন কি!
একটা জটিল যুদ্ধ শেষ হয়। তার মনে হয় যেন এটা একটা মিরাকল। খুব ভয়াবহ না হলেও কিছু জটিলতা তো ছিল, আবার লম্বা সময়ে পেসেন্টের অবস্থা এত খারাপের দিকে গিয়েছিল যে ক্লিনিক বা হসপিটাল ছাড়া এটা সামাল দেয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। তারপরও আবার অনেককিছুই সম্ভব হয়, কী করে হয়! কার সদয় ইচ্ছায় হয়! কে এমন মহাদুর্যোগে পাশে থাকে! অবশ্যই এই অসহায় মানুষদের জন্য অদৃশ্য কারো করুণাধারা বর্ষিত হয়। সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ মনোভাব নিয়ে, ডাক্তার দাদীকে ধন্যবাদ দেন। আবার ভাবেন, এই দাদীমণি তাকে প্রায়শই এমন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন। সবগুলোই যে সফলতার মুখ দেখে তা নয়। বাগানের সব ফুল কি আর পুজোর থালায় যায়! কিছু যায় কবরস্থানে বা শ্মশানে। সফল না হলে দাদীমণির যেমন খুব মন খারাপ হয়, আবার তার নিজের মনও অসম্ভব খারাপ হয়। তবে সফল হলে তারা দাদী নাতনি আনন্দ খুশিতে বাগবাগ করে। এবং এই আনন্দের খেসারত অবশ্য দাদীকে দিতে হয়। নাতনির সাথে গিয়ে শহরের বাসায় থাকতে হয়, দাদী নাতনির মাঝে এমনই এক মধুর চুক্তি আগে থেকেই হয়ে আছে। ঘরের বাইরে এসে তিনি ক্লান্ত শরীরে দাঁড়ান– পূবাকাশ আলোর রক্তিম আভায় লাল হয়ে উঠছে। ক’দিন পরে আজ দীপ্যমান সূর্য মেঘ হঠিয়ে তেজস্বী হয়ে উঠতে চাচ্ছে। অদূরেই একটি কদম গাছে অদ্ভুত সুন্দর গোল গোল কদমফুল ফুটে এক বিস্ময়কর মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে।
ডাক্তারের দাদী গ্রামের বিশাল বাড়িতে লোকজন সাথে নিয়ে একা একা থাকেন। তার সন্তানেরা সকলেই দেশে বিদেশে থাকে। তারা মাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চায় কিন্তু তিনি কারো কথা শুনলেতো! ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনি সবাই তাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা ভক্তি করে, ভালোবাসে। কিন্তু তিনি কারো কাছে গিয়ে থাকেন না এমনকি তার প্রিয় নাতনি কাছের শহরে থাকে সেও চায় দাদী এসে তার কাছে থাকুক, কিন্তু না, তিনি তাঁর স্বামী শ্বশুরের এই ভিটে ছাড়া কোথাও যাবেন না। গ্রামের, গ্রামের আশপাশের বিপর্যস্ত মানুষের পাশে তিনি সব সময় থাকেন। সকলের ভালোমন্দকে তিনি নিজের ভালোমন্দ বলে ভাবেন। এলাকায় তিনি ‘বড় আম্মা’ হিসেবে বহুল পরিচিত। উনার গ্রামের পাশেই এই ছোট্ট বাগদীপাড়া, কয়েক ঘর হতদরিদ্র মানুষের বাস। সন্ধ্যার দিকে আম্মার কানে দুগির মায়ের মরার খবর পৌঁছুলে, তিনি বিস্তারিত খোঁজ খবর নিয়ে, প্রিয় নাতনিকে ফোন করেন। এমন তিনি প্রায়ই করে থাকেন, নাতনিও এসবে অভ্যস্ত।
ঝুম বর্ষণ শেষে আজ চনমনে দিনের শুরু। নাতনি যতক্ষণ যম আর রোগীকে নিয়ে যুদ্ধরত থাকেন দাদী ততক্ষণ জায়নামাজে বসে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে নাতনির সফলতা প্রার্থনা করেন, নাতনির সফলতার জন্য মাঝে মাঝেই রোজা রাখেন, মিসকিনদের খাওয়ান। আর এটাতো সত্যি নাতনির সফলতা মানেই রোগীর সুস্থ্যতা। এখন তোড়জোড় করে নাতনির পছন্দের খাবারের আয়োজন চলছে। খাবার ঘরের বারান্দায় হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে দাদী নানাজনকে নানাবিধ নির্দেশ দিচ্ছেন, নাতনি এসে পেছন থেকে দাদীমণির গলা জড়িয়ে ধরেন। দাদীর বুক আনন্দ, খুশি এবং গর্বে একশ হাত ফুলে ওঠে। তিনি তার রক্তধারার এই বংশলতিকাকে কল্পনার অতীত ভালোবাসেন জন্মের পর থেকে যাকে তিনি পরম যত্নে, নরম ভালোবাসায় মানুষ করেছেন।
দুগির মা এবং সন্তান ভালো আছে তিনি আগেই সংবাদ পেয়েছেন এবং মা সন্তানের জন্য সকল রকম ব্যবস্থাদি করে পাঠিয়ে দিয়েছেন।