রুমান হাফিজ

স্মৃতিময়

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

বয়স আর কতোই বা হবে! এই এক দুই ক্লাসে পড়লে যেটুকু হয় আর কি! পড়ালেখায় এখনকার মতো এতো ধরা বাঁধা ছিলো না। তা আবার ছোট ক্লাস পড়ুয়াদের জন্য তো নয়ই। আম্মুর পড়ালেখার সীমানা খুবই সীমিত। ঐ শখের বশে দুই তিন ক্লাস পর্যন্ত হয়তো গিয়েছিলেন। তবে এসব নিয়ে ওই আমলে কারো মাথা ব্যথা ছিলো না।

যাই হোক, আমাকে নিয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর পড়াতে বসতেন। কেরোসিনের বাতি আর কুপিই ছিলো ভরসা। বিদুৎ আমাদের গ্রামে এসেছে আজ আর কাল হবে। মাঝে মাঝে কুপির ধুয়া এসে নাকে মুখে লাগতো। আমি বায়না ধরতাম, আর পড়বো না। আম্মু তখন বাতি একটু সরিয়ে দিয়ে বলতেন, “বও(বস), আর লাগতো নায়।”

মুখে মুখে ছড়া, কবিতা বলতেন। আম্মুর সাথে আমি বলতাম। আবার কখনো বই থেকে গণনা, বর্ণমালা ইংরেজি অক্ষর এসবও পড়াতেন। লেখাতেন।

২.

আব্বু বিদেশে থাকতেন। কথা বলার সুযোগ ছিলো না একদমই। মাসে এক দুই বার হয়তো সদরে গিয়ে কল করা হতো। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে আব্বুর সাথে সংযোগ পাওয়া যেতো। দাদু, আম্মু আর ভাইয়া সবাই এক এক করে কথা বলতেন। শুধু আমি ছাড়া। লজ্জা, সংকোচ খুব কাজ করতো। মনে হয় আব্বুর সাথে ফোনে আমার কখনো কথা হয় নি। সবাই কথা বলতো। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে নেটওয়ার্ক-এর উঁচু উঁচু টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে ভাবতাম, আব্বু মনে হয় ওখান থেকে কথা বলছেন!

মাঝে মাঝে দাদু ক্যাসেট রেকর্ড করে পাঠাতেন আব্বুর কাছে। চিঠি লিখে পাঠানোর কথা ঠিক স্মরণে নেই। ঘরের সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়ে যার যার কথা বলতেন। কারো এটা লাগবে, ওটা লাগবো। সুখ-দুঃখ সবকিছুই। একবার মনে আছে দাদু রেকর্ডিং এ বলছিলেন, “বাবা,আগামী মাস তাকি দুই আজার(হাজার) টেখা(টাকা) খরচের লাগি বাড়াইয়া দিও। আর তোমার ফোয়া(ছেলে) নয়া কেলাশে ভর্তি অইতো তার লাগিও কিছু দিও।”

রেকর্ডিং এর সময় আমাকে ডেকে আনা হতো। আমি প্রথমে সালাম দিয়ে আর কিছু না বলেই দৌড় দিতাম!

৩.

একবার বিকেলবেলা বাড়ির সামনের মাঠে খেলছিলাম। গ্রামের ছোট বড় সবাই এই সময়টাতে মাঠের মধ্যেই থাকে। কেউ কানামাছি, ডাংগুলি, গোল্লাছুট, ফুটবল এসব খেলায় মেতে ওঠে। আবার কেউ কেউ দর্শক হয়েই তৃপ্ত থাকতেন। খেলার সময় গোল দেওয়া নিয়ে আমার সাথে আরেকটা ছেলের ছেলের ঝগড়া বাঁধে। কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলতে নারাজ। থামার কোনো লক্ষণই নেই। এক পর্যায়ে ছেলেটা আমার গায়ে হাত দিতে শুরু করলে আগপাছ না ভেবে নিজের সবটুকু জোর দিয়ে একটা ঘুষি দিলাম ওর মুখ বরাবর। তৎক্ষাণৎ নাক দিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করলো। সবাই তখন ছেলেটাকে নিয়ে ব্যস্ত। আমি দৌড়াতে লাগলাম। কোথায়, কার কাছে যাচ্ছি এসবের দিকে খেয়াল নেই। দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত। রাস্তার এক পাশে বসলাম। জানি এই মুহূর্তে বাড়ি যাওয়া একদমই ঠিক হবে না। আম্মুকে প্রচন্ড ভয় পাই৷ আম্মু আমাকে পেলে কি যে শাস্তি দেবে এই ভেবেই চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো।

পাশের এক গ্রাম পর ফুফুর বাড়ি। সেদিকে ছুটলাম। অসময়ে আমাকে দেখে ফুফুতো অবাক। আমাকে বেশ ভালো করেই পর্যবেক্ষণ করে নিলেন। কোথাও কোনো সমস্যা হলো কি না! ভয়ে ফুফু কাঁপতে লাগলেন। কিছু একটা বানিয়ে বলাতে ফুফু শান্ত হলেন। আমার হাত-মুখ ধুইয়ে ঘরে নিলেন। সমবয়সী ফুফাতো বোনের সাথে পড়তে বসে গেলাম। ততক্ষণে করে আসা সব কান্ডকারখানা ভুলে গেছি।

এদিকে বাড়িতে খবর পৌঁছে গেছে। আম্মুর অবস্থা তো বেগতিক। এখনকার মতো এতো সহজলভ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় ভাইয়াকে সাথে নিয়ে কাছাকাছি সব আত্মীয়দের বাড়িতে খুঁজতে লাগলেন। কোথাও পেলেন না। তারপর ফুফুর বাড়িতে এসে হাজির। আম্মুকে দেখা মাত্রই আমি লাফ দিয়ে ফুফুকে জড়িয়ে ধরলাম। অনেক বুঝিয়ে আমাকে ফুফুর কোল থেকে নামানো হলো। আম্মু আমাকে কোলে করে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলেন। সারাটা পথ কোলেই ছিলাম। আর আম্মু সারাক্ষণ কান্নাই করছিলেন।

হঠাৎ গরম ছোয়া অনুভূত হলো। সম্বিত ফিরে ফেলাম। চোখ থেকে দুফোঁটা অশ্রু হাতের উপর পড়লো। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে পেলাম না। পুরো রেস্টুরেন্ট ফাঁকা। ওয়েটারগুলো দাঁড়িয়ে কী যেনো আলাপ করছিলো। ততক্ষণে আমার অর্ডার করা কফি হিম শীতল হয়ে গেছে!

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu