দর্পণ ডেস্ক
একটি পূর্ণাঙ্গ ম্যাগাজিন। শিক্ষা, সাহিত্য ও গবেষণামূলক ম্যাগাজিন দর্পণ। ২০১৯ সালে ব্যতিক্রমধর্মী ম্যাগাজিন দর্পণ তার যাত্রা শুরু করে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে দর্পণ "গল্পবাজ" ম্যাগাজিন আত্তীকরণ করে।
দর্পণ ডেস্ক

স্বরবর্ণের নীরব প্রস্থান – সুজিত সজীব

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আজ অনেক কথাই মনে পড়ছে হাসমত আলীর। শীতের কুয়াশা ভেদ করে রোদ উঠার মতো মনের ভেতরেও উঁকি দিচ্ছে ফেলে আসা জীবনের নানান ঘটনা।

দীর্ঘ বয়সের পথ পাড়ি দেয়া মানুষটির মনে বাজছে অতীতের সুর…

শৈশবের ফড়িং শিকারে তার জীবন ছিল বুনো ঘোড়ার মতো। দৌড়াতে দৌড়াতে বিশাল ধানক্ষেতে ছাড়িয়ে তা গিয়ে থামতো মধুমতির তীরে।

আহ্‌ মধুমতি! এখনো বুকের ভেতর কান পাতলে শোনা যায় তার ছলাৎ ছলাৎ জলের শব্দ।

আজ কতদূরে বসেও সেই শব্দ হাসমত আলীর কানকে সচিকত করে তোলে! সুপ্ত স্মৃতিরা ধুলো ঝেড়ে লতানো কুমড়োর ডগার মতো লিকলিকিয়ে তার জীর্ণ শরীর জড়িয়ে বাড়তে শুরু করে।

জীবন কত অদ্ভুত, কত বৈচিত্র্যময়।

সেই স্বপ্নময় জীবন আজ আলো-বাতাসের স্বল্পতায় ঘেরা স্যাঁতস্যাঁতে পুরানো দালানের বিচারালয়ে এসে দাঁড়িয়েছে।

কস্মিনকালেও কি কখনো এই দিনটি, এই ক্ষণটির কথা, ভেবেছিলেন তিনি! ভেবেছিলেন কি কোনো কালে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে তাকে! তারপরও জীবনের এমন চিত্রনাট্যে তিনি মূখ্য অভিনেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।

মাঝে মধ্যেই তিনি অদৃষ্টবাদী হয়ে ওঠেন। মানিকের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসটির পাতায় চলে যায় মন। নিজেকে আবিষ্কার করেন সেখানে। যেখানে মানুষের জীবন চলে কারো অমোঘ ইশারায়। আজও তাঁর এমনই অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে, তার সারা জীবনের সকল কিছু ব্যর্থ করে দিতে কেউ একজন আড়াল থেকে তার সঙ্গে খেলছেন, সর্বনাশী কোনো খেলা। সেই খেলার পরিনাম ঠিক হয়েই আছে। সারা জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়েও তিনি তা রোধ করতে পারবেন না।

নিজেকে বড় অসহায় লাগছে তার। আজ বহুদিন পর তার বাবার কথা মনে পড়ছে। মানুষটিকে নিয়ে এখনো তাঁর বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। মানুষের প্রতি কতটা ভালবাসা থাকলে, অমন একজন মানুষ হওয়া যায়! আজও জানা হয়ে ওঠেনি তার। তিনি শুধু জানেন সারা জীবন তপস্যা করেও তিনি অমন জীবনের অধিকারী হতে পারবেন না।

হাসমত আলীর বাবা ছিলেন জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তুমুল জনপ্রিয় মানুষটির মুখে সবসময় থাকত স্মিত হাসির রেখা। এমন হাস্যময় মুখের কারণেই হয়তো মানুষ তাঁকে সহজে আপন করে নিত। মানুষের বিপদে আপদে পাশে দাঁড়াতেন, সৎ জীবন যাপন করতেন। নিজ সন্তানদেরও তিনি সেই শিক্ষা দিয়ে গেছেন। সন্তানরাও তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে সৎ ও ভালো মানুষের উদাহরণ।

ছোট্ট মফস্বল শহরের প্রতিটি মানুষই হাসমত আলীকে চেনে, জানে। তাঁকে শ্রদ্ধা করে, ভালবাসে। দুএকজন যারা তাঁকে পছন্দ করে না, তারাও তাঁর জনপ্রিয়তার ভয়ে; তা কখনও প্রকাশ করতে সাহস পায় না। হাসমত আলী জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক হয়ে তাঁর বাবার সুনাম আরো বহুগুণে বাড়িয়েছেন। বিপদে আপদে সকল সময় তিনি এলাকার মানুষের জন্য নিবেদিত এক প্রাণ। এমন মানুষটিকেই কিনা আজ তুচ্ছ একটা অভিযোগে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হলো।

স্কুলের অনুদানের দুই বস্তা চাল চুরি হয়েছে।

কেউ বিশ্বাস করছে না এই কাজ হাসমত আলী করেছে। কিন্তু মানুষের বিশ্বাস অবিশ্বাসে আদালত চলে না। যেহেতু মামলা হয়েছে, তাই বিচার হবে, সাক্ষী সবুদ হাজির হবে, জেরা হবে, চুলচেরা বিশ্লেষণের পর বিচারক তার রায় পড়ে শোনাবেন।

সবাই আশায় রয়েছে, এই মিথ্যা মামলা থেকে তিনি নিশ্চয়ই মুক্তি পাবেন। ষড়যন্ত্রকারীদের সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে তিনি আবারো তাঁর সুনাম নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন, মানুষের মাঝে বিলাবেন ভালবাসা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মাথায় হাত বুলিয়ে মানুষ হওয়ার দোয়া করবেন।

কখনও মানুষের ভাল বৈ খারাপ চিন্তা করেননি তিনি। সহজ সরল জীবন যাপনেও তিনি এলাকায় অনন্য ব্যক্তিত্ব। তাকে এমন অবস্থায় দেখে সকলেই বিস্মিত হয়েছেন। আফসোস করেছেন। বিধাতাকে দোষারোপ করেছেন। ‘আজ যখন সমাজে মানুষ বানানোর দক্ষ কারিগরের বড় প্রয়োজন তখন কিনা…’

সকাল ১১টা ২১ মিনিট। জজ সাহেব এজলাসে এসে বসলেন। হাসমত আলীর মতো মানুষকে কাঠগড়ায় দেখে বেশ বিব্রত বোধ করছেন। আসামীর দিকে না তাকিয়েই তিনি তার প্রাথমিক কাজকর্ম সারছেন। লজ্জায় তার চোখ নিম্নে অবনত। নানা জনদরদী কীর্তির জন্য মানুষটির সুনাম আকাশচুম্বি। তার সঙ্গেও বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। তিনি বেশ বিব্রত বোধ করছেন।

বিব্রত হলেও তিনি নিজেকে সামলান। নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দেন। একটি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে তিনি চোখ তুলে তাকান আসামীর দিকে। বিস্মিত হন, মানুষটি এমন পরিস্থিতিতেও হাসছেন। নিজেতে শক্ত করেন বিচারক সুনীল মজুমদার। দায়িত্ব পালনে দৃঢ় মনোভাব গড়ে ওঠে তার ভেতরে।

মামলার প্রথম সাক্ষী স্কুলের দারোয়ান দয়াল সিংহ। সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েই সে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন।

‘আমি কিচ্ছু জানি না, হুজুর। আমি কিচ্ছু জানি না। আমি খালি জানি এই মানুষটা কোনো দোষ করতে পারে না। ভগবান আইসা কইলেও আমি বিশ্বাস করুম না, স্যার চুরি করছে।’

সরকারী উকিলও হাসমত আলীর সুজন। কতর্ব্যের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই হয়তো দয়াল সিংহকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেন, ‘থামো, তুমি কী বিশ্বাস করো, তা তোমার কাছে রাখো, তুমি শুধু প্রশ্নের উত্তর দাও…’

মামলার তিনজন সাক্ষী। স্কুলের দারোয়ান, স্কুল গোডাউনের স্টোর কিপার এবং থানা শিক্ষা অফিসার। এরাও হাসমত আলীর শুভাকাঙ্ক্ষী, স্বজ্জন। তারাও নিরুপায়, তাই বাধ্য হয়ে সাক্ষী হয়েছেন। তবে কেউই হাসমত আলীর বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করল না, তাঁর বিরুদ্ধে একটি কথাও বলল না। তারপরও সরকারী উকিলের জেরাতে প্রমাণিত হতে শুরু করলো, স্কুলের চাল হাসমত আলীই সরিয়েছেন।

আদালত কক্ষে কানাঘুষা শুরু হলো। তাইলে শেষমেশ হাসমত স্যার স্কুলের চাল চুরি করল! কিন্তু এটা কী করে সম্ভব! বিষয়টা কোনোভাবেই কারো বোধগম্য হচ্ছে না।

মামলা পরিচালনায় নিজের পক্ষে হাসমত আলী কোনো উকিল নেননি। তাঁকে উকিলের কথা জিজ্ঞাস করা হলে, তিনি জানিয়েছেন, উকিলের প্রয়োজন নেই। নিজেই আত্মপক্ষ সমর্থন করবেন।

যে যা বলছে সবই শুনছেন আর হাসিমুখে মাথা ঝাঁকিয়ে মেনে নিচ্ছেন। জজ সাহেবের বারবার অনুরোধের পরও তিনি একজন সাক্ষীকে জেরা করলেন না। তাদের কোনো কথার প্রতিবাদ করে একটি টু শব্দ উচ্চারণ করলেন না। মৌনতা নাকি সম্মতির লক্ষণ! তাহলে কি…

চারদিকে কানাঘুষা বাড়তে থাকে।

জোহরের নামাজ ও দুপুরের খাবারের বিরতির জন্য কোর্টের কার্যক্রম এক ঘন্টার জন্য মুলতবি করা হলো।

আদালত চত্বরে এখন হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হয়েছেন। সবাই হাসমত স্যারের বিচার দেখতে এসেছে। জানতে এসেছে স্কুলের চাল চুরির রহস্য। তবে পরিস্থিতি আমলে নিয়ে কেউ কেউ একটু ভিন্ন সুরে বাঁশি বাজাতে চাইলেও সাধারণ মানুষের প্রতিবাদে তা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।

নির্ধারিত সময়ে আবার শুরু হলো বিচার কার্যক্রম।

বিচারক সুনীল মজুমদার আত্মপক্ষ সমর্থন করে আসামী হাসমত আলীকে তার বক্তব্য দিতে বললেন।

হাসমত আলী মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন, কিছুই বলছেন না। নীরব। বয়েসের বলীরেখার মুখে শুধু একটু হাসির প্রলেপ ছড়িয়ে আছে।

তাঁর এমন মৌনতাকে কেউই মানতে পারছেন না। ইতিমধ্যে সবকিছু তাঁর বিরুদ্ধে চলে গেছে। এখন যদি তিনি মুখ না খুলেন তাহলে চুরির দায়ে তাঁকে শাস্তি পেতে হবে।

এক সময় মাথা তুললেন হাসমত আলী। চারপাশে তাকালেন। প্রায় সবই তার পরিচিত মুখ। অনেকের চোখে জলের রেখা। তিনি মৃদু হাসলেন। তারপর নীরবতা ভেঙ্গে বললেন, ‘আমার কিছু বলা নেই।’

আদালত কক্ষ হায় হায় রবে কম্পিত হয়ে উঠল। আরে মানুষটা কেন এমন আচরণ করছেন! কেন কিছু বলছেন না! একটু যদি বলেন, কোনো কারেণে খুব প্রয়োজন ছিল, তাই বাধ্য হয়ে নিয়েছিলাম, আমি চুরি করিনি। তিনি এমন একটি বাক্য উচ্চারণ করলেই তো সব ঠিক হয়ে যায়! কেউ এই নিয়ে একটুও আপত্তি তুলবে না! কেন তিনি নীরব থেকে চুরির দায় মাথা পেতে নিচ্ছেন! তাহলে কি হাসমত স্যার সত্যি সত্যি স্কুলের চাল চুরি করেছেন!

এবার বিচারক সুনীল মজুমদার ভেঙ্গে পড়লেন। তিনি কাতর অনুরোধ করলেন, আপনি কিছু একটা বলুন। নইলে তো…

সরকারি উকিলও ভিন্ন পন্থায় তাঁকে কিছু বলার জন্য বারবার  অনুরোধ করলেন।

কিন্তু হাসমত আলী অনড়। একটি শব্দও মুখ দিয়ে বের করলেন না।

মামলার বাদী টিএনও একবার মামলা উঠিয়ে নেয়ার কথা ভাবলেন। কিন্তু সরকারী জিনিস খোয়া গেলে মামলা তো হবেই! কারো কিছু করার নেই! তাই চুপ রইলেন। ভেতরে রক্তক্ষরণের প্রবল স্রোতে তার মন রক্তাত্ত হয়ে উঠল।

আদালত কক্ষ ও বাহিরে শত শত মানুষ নিস্তব্ধ হয়ে গেছেন। অনেকে চোখের জল ফেলছেন…

উপস্থিত জনতার বেশিরভাগই চুরির ঘটনা বিশ্বাস করল না। তবে কিছু মানুষ বলল, স্কুলের চাল চুরি করে মুখ না খুলে নাটক করছেন হাসমত স্যার।

সময় বয়ে চলছে, কিন্তু অনন্তকাল ধরে সময়কে এই আদালতের স্যাঁসস্যাঁতে ঘরে আটকে রাখা যায় না। তাই হয়তো যবনিতাপাতের ক্ষণ এলো। রায় লিখতে গিয়ে বিচারক সুনীল মজুমদারে বুক-হাত কাঁপছে। মন বিষণ্ণ।

আদালতে উপস্থিত হাসমত আলীর শুভাকাঙ্ক্ষিদের বুক ঢিপ ঢিপ করছে, কী রায় পড়ে শোনাবেন বিচারক? অনেকে আকুল প্রার্থনায় দুহাত তুলেছেন সৃষ্টিকর্তার দরবারে।

আদালত দুই বস্তা চাল চুরির জন্য হাসমত আলীকে এক বছরের কারাদন্ড আর পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করলো। অনাদায়ে আরো তিনমাসের জেল।

রায় শুনে সকলের মন খারাপ হয়ে গেলো। শুধু হাসমত আলী মিটমিট করে হেসে চলেছেন।

হাসমত আলী রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলেন না। নীরবে জেল খেটে দুই বস্তা চাল চুরির শাস্তি ভোগ করলেন।

রায় ঘোষণার কয়েকমাস পরেই বাড়িঘর বিক্রি করে তার পরিবার অন্যত্র চলে গেল। কেউ জানতে পারল না তারা কোথায় গেল। সাজা শেষে হাসমত আলীও আর কোনো দিন এই ছোট্ট মফস্বল শহরে ফিরে আসল না। ধীরে ধীরে হাসমত আলীকে সবাই ভুলে গেল।

আসলেই কী মানুষটা চাল চুরি করেছিল? নাকি অন্য কিছু? মাত্র দুই বস্তা চালের জন্য কি তিনি তার সারা জীবনের নীতি আদর্শ জলাঞ্জলি দিলেন? আসলে কী হয়েছিল হাসমত আলী ছাড়া তা কেউ জানে না…

সবাই তাঁর কথা ভুলে গেলেও শুধু একজন মানুষ তার কথা মনে রেখেছে!

মালা পাগলী। সে মাঝে মাঝেই চিৎকার করে বলে, ‘ওই হাসমত মাস্টার, তুই একবার আয়। আয় না। আমার সংসারটা একবার দেইখ্যা যা…’

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu