বাপ সনাই বাগদি বলতো, “বুঝলি বাপ,আমরা হলাম গে জলের মানুষ। জলের সাথেই আমাগের সম্পক্ক। জল রে যত ভালোবাসপি জল তোরে ততই দেবে। আর এট্টা কথা। জাল-নৌকো নে’ জলে নামলিই খালি হয় না। জাল ফেলার ধরন ধারন শিখতি হয়। মাছের গোন-অ গোন জানতি হয়। তাহলিই না একজন ভালো মাছমারা হতি পারে মানুষ। সেইজন্যি আমি কই কি আমার কাছ থে ‘ এগুলোন ভালো কইরে শিখ্যে নে। তাহলি দেকপি কুনোদিন মাছের অভাব হবে না তোর।”
বাপ চাইলেও মা কিন্তু চায়নি এমনটা। ছেলে কে কোথায় পড়ালেখার কথা বলবে তা না করে মাছধরার কথা। এমন কথা শুনে বেজায় রেগে যেত মা। বাপের দিকে ঘুরে বলতো, “কেমুন মানুষ তুমি কও দেহি?”
বাপ বলতো, “ক্যান? আমি আবার কী করলাম?”
“কী করো নাই তাই কও। ছেল্যেরে কুথায় ইসকুলি ভত্তি করাবা তা না কইরে – ”
“এ তুমি কেমুন কথা কও? মাছমারার ছেল্যে ভত্তি হবে ইসকুলি? ”
“ক্যান? হলি অসুবিধে কী?”
“অসুবিধে নাই। কিন্তুক মাছমারার ছেল্যে পড়ালেহা কইরে লাভ কী? শ্যাষে তো মাছই ধত্তি হবে। তার চেইয়ে ছোট থ্যিকেই মাছমারা শেকা ভালো না?এই যে দিন নাই রাত নাই একা একা মাছ ধরি। ছেল্যে ডা সঙে গেলি কত ভালো হয় জানো?”
বাপ কে অনেকদিনই বোঝানোর চেষ্টা করেছে মা। কিন্তু বাপ সনাই বাগদি সে কথায় কান দেয়নি। কারন ছেলেকে নিয়ে সে স্বপ্ন দেখতো ছেলে বড়ো মাছমারা হবে। বাড়ির সামনে খাল। বছরভর মাছ ধরবে খালে। সেই মাছ বেচা টাকায় নতুন করে সাজাবে বাড়িখান। নতুন একখানি ঘর দেবে। বিয়ে করে সুন্দর বৌ আনবে। নাতি-নাতনিতে ভরন্ত সংসার হবে সনাইয়ের। আর সেজন্যেই সারাক্ষণ ছেলেকে কেবল বোঝাতো যাতে মন টা অন্য দিকে না দিয়ে কেবল মাছমারার দিকেই দেয় সে।
তখন নিতান্তই অল্প বয়স শীতলের। সারাদিন খায় দায় আর খেলে বেড়ায়। ইচ্ছে হলে আকাশ দ্যাখে। দূরের বিল দ্যাখে। উড়ে যাওয়া পাখি দ্যাখে। বক, পানকৌড়ি, মাছরাঙার মাছ ধরা দ্যাখে। আবার চেয়ে দ্যাখে বাপের জাল ফেলা। জালের সাথে উঠে আসা মাছের গায়ে ঝলকে ওঠা রোদ কখনও কখনও খুশি হয়ে ছুঁয়ে যায় তার জোড়া চোখ।
পড়াশোনার ব্যাপারটা এমনিতেই ভালো লাগতো না শীতলের। পাড়ার সীমনা ছাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে বিশ্বাস পাড়ার ওদিকে গেলে দেখতে পেতো বিশ্বাসদের ছেলেমেয়েরা কাঁধে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। বইয়ের ভারে বেঁকে যাওয়া পিঠ দেখে ভয় লাগতো তার। কেবলই মনে হত মায়ের কথা শুনে বাপ যদি সত্যি সত্যিই তাকে ভর্তি করে দেয় স্কুলে?দিলে দিক। শীতল তাতেও স্কুলে যাবে না। কেন যাবে?অত অত বই। অত পড়াশোনা। সারাদিন স্কুল ঘরে আটকে থাকা। তার চেয়ে মাছ ধরা ঢের ভালো। মাথার ওপর খোলা আকাশ। নিচে খাল, বিল। চারপাশে খোলা হাওয়া। কত স্বাধীন জীবন। না আছে পড়াশোনার চাপ। আর না আছে সারাদিন চার দেয়ালের মাঝে আটকে থাকা।
অগত্যা সেই বয়সেই বাপের কাছ থেকে সবকিছু শিখে নিয়েছিল শীতল। হাতে ধরে সবকিছু শেখাতে শেখাতে বাপ বলতো, “আমি যহন থাকপো না, তহন এই শিক্ষে ডা তোর থাকপে।”
ততদিনে অবশ্য শীতল মাছ ধরায় অনেকটাই পারদর্শী হয়ে উঠেছে। বাপ নৌকোর হালে বসে থাকলে সে জাল ফেলতে পারে। ঘুনি,আটল,চেড়ো পাততে পারে। আবার হালও ধরতে পারে অল্প স্বল্প। মাছের গায়ের আঁশটে গন্ধ ততদিনে বেশ ভালো লেগে গেছে তার। বুক ভরে শ্বাস টেনে সে মাছের গন্ধ নেয়। বাপ যেটা বলে তা মন দিয়ে শোনে। বাপ যা শেখাতে চায় তা মন দিয়ে শেখে। ছেলের শেখার প্রতি এত মন দেখে বাপ বেজায় খুশি। শেখাতে শেখাতে তাই বলতো, “বুঝলি বাপ শিক্ষে কহনও কেউ ভুল্যে যায় না। মানষে একবার যা শেকে তা সারাজেবন তার কাজে লাগে।”
হ্যাঁ, ঠিকই বলতো বাপ । আজ সেই মানুষটা বেঁচে নেই। কিন্তু তার দেওয়া শিক্ষাটা রয়ে গেছে। সেই শিক্ষাকে সঙ্গে নিয়েই রোজ জলে নামে শীতল। জাল ফ্যালে। মাছ ধরে। সেই মাছ দু’মাইল পথ ভেঙে এসে রোজ নিয়ে যায় সাতাশীর মুকুন্দ ব্যাপারি। তাতে যা পায় তাই দিয়েই সংসারের চাল, ডাল, নুন, তেল–টা হয়ে যায়। হয়ে যায় সাজা পরার জিনিসও। এমনকি গেল বছর যে দশ কাঠা জমি কিনলো তাও এই মাছ বেচা টাকাতেই।
জমিখান কেনা অবশ্য বাপের কথা ভেবেই। একফালি জমির বড়ো সখ ছিল বাপ সনাই বাগদির। সাকুল্যে তিন কাঠা বাড়ির জমি ছিল মানুষটার। শুকনো মরশুমে খালে বিলে যখন জল থাকতো না, চাদ্দিকে শুরু হত মাছের আকাল, তখন সংসার চালাতে অন্যের জমিতে জন খাটতে যেতে হত তার। অন্যের জমিতে ফসল ফলাতে ফলাতে স্বপ্ন দেখতো নিজের একফালি জমির। নিজের হাতে বোনা ফসলের।
এক একদিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে মা কে বলতোও সে কথা। শুনে মা বলতো, “আমাগের কী আর সেই সামত্থ আছে?কী লাভ অমন স্বপন দেহে?”
বাপ বলতো, “স্বপন নে’ ইতো মানষে বাঁচে। যার কুনো স্বপন নাই তার বেঁচ্যে থ্যিকেও লাভ নাই।”
“কিন্তুক আমরা হলাম গে দিন আনি দিন খাই মানুষ। অত ট্যাকো পাবো ক্যামনে?”
“পাবো গো পাবো। আমি না পাই আমার ছেল্যে পাবে। ঠিকই দ্যাকপা একদিন আমাগেরও একফালি জমি হবে। জমিতি ফসল হবে। ঘরের ধানের ভাত খাবো। নিত্যিদিন ভজন মুদির দোকানে গে চাল কিনতি হবে না।”
বিছানায় শুয়ে শুয়ে বাপের এ সব কথা শুনতে শুনতে শীতলও স্বপ্ন দেখতো নিজেদের একখানি জমির। নিজেদের ফসলের। আর মনে মনে ভাবতো বাপ যদি না পারে তাহলে সে ই কিনবে খানিক জমি। তারপর সেই জমিতে চাষ দেবে। ফসল ফলাবে। বাপের স্বপ্ন সফল হয়নি। দিন আনি দিন খাই মানুষটা হাজার চেষ্টা করেও টুকুন জমি কিনতে পারেনি। মাছ বেচে যা পেয়েছে খেতে পরতেই শেষ হয়ে গেছে তা। কিন্তু বাপ না পারলে কি হবে। ছেলে ঠিক পেরেছে। মাছ বেচা টাকাতেই কিনেছে জমিখান।
জমিখানের মালিক ছিল সনাতন। মেয়ের বিয়ের কারণে ঠেকায় পড়ে বেচে দিয়েছিল জমি খান। খদ্দেরের অভাব ছিল না। কিন্তু এক রাতে বাড়ি বয়ে গিয়ে শীতল যখন বলেছিল, “এক ফালি নিজির জমির বড়ো সখ সনাতন দা। জমিখেন তুমি আমারেই দেও।” তখন কথাগুলো কোথায় যেন ছুঁয়ে গিয়েছিল সনাতনের। সে জিজ্ঞেস করেছিল, “সারা বছর তুই খালে বিলে মাছ ধরিস। জমি দিয়ে করবি কী?”
শীতল বলেছিল, “জমি যে আমার স্বপন সনাতন দা।”
“কিন্তু অত টাকা –”
“ট্যাকা আছে দাদা।”
“ঠিক আছে,তাহলে জমিখান আমি তোকেই দিলাম। কিন্তু একটা কথা। যদি কোনওদিন জমিখান বিক্রি করিস আর আমার সামর্থ্য থাকে তাহলে আমার জমি আমাকেই ফিরিয়ে দিস।”
খালে বিলে মাছ ধরা বাগদি হয়েও এভাবেই জমিটুকু কেনা শীতলের। আর তা ওই মাছ বেচা টাকাতেই।
খালপাড়ে বাড়ি শীতলদের। তারা ছাড়াও আরও বাইশ ঘর বাগদির বাস এ পাড়ায়। এত মানুষ থাকতেও সেই কবে নিতাই সাহা সনাই বাগদিকেই বেছে নিয়েছিলেন তার খালে বাঁধ দেওয়ার জন্য। বলেছিলেন, “শোন সনাই, এক তোকে ছাড়া এ পাড়ার আর কাউরে বিশ্বেস পাইনে আমি। মাছের ভাগ আমার চাই নে। কেবল দু’বেলার খাওয়ার মাছ। তা দিতেও যদি ওদের মুখ শুকোয় তাহলে কেনই বা ওদের ভরসায় থাকবো। তার চেয়ে তুই ই–”
“কিন্তু বাবু ওরা যদি–”
“ওরা? ওরা কী করবে? আমার খাল আমি যাকে খুশি মাছ ধরতে দেবো। ওরা বলার কে?”
“আপনেরে কিছু বলতি পারবে না। কিন্তু আমারে–”
“অত ভাবিস নে তো। এই আমি আছি। আমিই ওই ব্যাপারটা দেখে নেবো। তুই আর দেরি না করে কাল থেকেই লেগে যা দেখি। আর শোন বাঁশ টাশ যা লাগে আমার ঝাড় থেকেই কেটে নিস। একটা বাঁধ দিতে অনেক খরচ। অত তুই পারবি নে। ”
“আপনে বড়ো দয়ালু মানুষ বাবু। ”
হেসেছিলেন নিতাই সাহা, “তোর বুঝি তাই মনে হল?কী জানি। হবে হয় তো।”
সেই থেকে খালে বাঁধ দেওয়া শুরু সনাই বাগদির। বাঁধ মানে বাঁশের চটায় বানানো ‘বানা’ খালের এপার থেকে ওপার পর্যন্ত এমন ভাবে টাঙানো যাতে কোনও মাছই তা টপকে পেরিয়ে যেতে পারে না। জল পর্যন্ত আটকে থাকে বলতে গেলে। মাঝখানে কেবল খানিক ফাঁকা জায়গা। সেই ফাঁকার মুখেই ভেসাল। তে কোনা আকৃতির আস্ত বাঁশের কাঠামোয় লাগানো বড়ো জাল। ছোট বড়ো সব মাছ উঠে আসে তাতে। এছাড়াও কত রকমের জাল, কত রকমের বাঁশের খাঁচা ‘বানা’-র গায়ে গায়ে বসানো। এমন করে বাঁধ দিয়েই মাছ ধরতো সনাই বাগদি। সকাল, বিকেল, সন্ধে খালেই পড়ে থাকতো সে। ভালো ভালো মাছ বেছে নিয়ে রেখে দিত নিতাই সাহার জন্যে। সময় করে ব্যাগ হাতে সাহা মশাই এসে দাঁড়াতেন খালপাড়ে। বলতেন, “দে দেখি কী দিবি।”
আলাদা করে রাখা মাছগুলো এনে সাহা মশাইয়ের ব্যাগে দিতে দিতে সনাই বাগদি বলতো, “যদি লাগে আরও চাড্ডি এন্যে দিই বাবু।”
নিতাই সাহা বলতেন, “না রে লাগবে না। যা দিয়েছিস এই কী কম?”
আজ বাপ সনাই বাগদি বেঁচে নেই। এখন বাপের জায়গায় এসেছে ছেলে। এখন শীতলই বাঁধ দেয়। মাছ ধরে। বড়ো মাছটা যত্ন করে রেখে দেয় নিতাই সাহার জন্যে। সাহা মশাই বুড়ো হয়েছেন। খুব বেশি হাঁটা চলা করতে পারেন না। বাড়ির কাজের লোক নিবারন। সময় করে এসে সে-ই নিয়ে যায় মাছ। খালপাড়ে এসে সে হাঁক ছাড়ে, “কই গো শীতল দা, কি পেলে নিয়ে এসো দেখি।”
শীতল হয়তো তখন মুখ খোলা কুঁড়ের মাচালে বসে জলে ফেলা ভেসাল জালের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। চেয়ে চেয়ে দেখছে ঝাঁকবাঁধা পুটি, খলসে মাছের ‘ফুট’ কাটতে কাটতে জালের মধ্যে ঢুকে আসা। কিংবা হয়তো সেসবের কিছুই দেখছে না সে। একটা ঘোর নিয়ে জলের দিকেই কেবল চেয়ে আছে। আর চেয়ে চেয়ে ভাবছে তার অতীত। তার ছোটবেলা। বাপের মুখ। কতদিন খালপাড়ে দাঁড়িয়ে এমনি করে জাল ফেলতে দেখতো বাপকে। জাল ফেলে একদৃষ্টিতে জলের দিকে চেয়ে থাকতো বাপ। থাকতে থাকতে কোথায় যেন হারিয়ে যেত মানুষটা। কখন দিনের সব আলো মুছে গিয়ে সন্ধে নামতো তাও বুঝি খেয়াল থাকতো না তার।
নিবারনের হাঁকে ঘোরটা কেটে যায় শীতলের। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় পাড়ের দিকে। সেখানে তখন রোদ ছায়াদের লুকোচুরি। খানিক দূরে জলকিনারে মাছের আশায় জলের দিকে চেয়ে থাকা কোনও বক। নিবারনকে দেখে গলা ছাড়ে সেও, “এট্টুস দাঁড়া নিবে জালে টান ডা দে নেই।”
বলতে বলতে ভেসালের উঁচু হয়ে থাকা প্রান্তে উঠে দাঁড়িয়ে চাপ দেয় সে। ধীরে ধীরে জলের নিচ থেকে উঠে আসে অতোবড়ো জালটা। সঙ্গে উঠে আসে কিছু বিলেন মাছ। হয়তে দু’চারটে ছোট বাটা, মৃগেল, কিংবা বাচ্চা রুই। জল থেকে উপরে উঠতেই জালের ওপর শরীর ঝাপটাতে থাকে তারা। দক্ষ হাতে মাছগুলো নির্দিষ্ট পাত্রে রেখে অন্য পাত্রে জিইয়ে রাখা সেবেলার সবচেয়ে বড়ো মাছটা আর সঙ্গে কিছু ছোট মাছ খালুইতে করে এনে তার ছোট্ট ডিঙিনৌকোটা চড়ে খালপাড়ে উঠে আসে শীতল। তারপর খালুইটা নিবারনের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলে, “আজ যে আসতি দেরি কইরে ফেললি রে নিবে?”
মাছগুলো খালুই থেকে ব্যাগে নামাতে নামাতে নিবারন একবার শীতলের দিকে তাকায়। একবার আকাশের দিকে। বলে, “কাজ কি আমার কিছু কম শীতল দা। বাবু তো কিছুই করতে পারে না। আর তাঁর ছেলে,মানে আমাদের অনন্ত দা– সে তো তার দোকান নিয়েই ব্যস্ত। এসব দিকে মন দেওয়ার তার সময় কোথা? সবকিছু এই আমাকেই তো দেখতে হয়।”
“তা তো দেকতিই হবে। বাবু তোর ওপর কত ভরসা করে বল দেহি।”
“তা করে।”
“বাবু বড়ো ভালো মানুষ রে। ভালো বাড়িত্ আছিস তুই।”
“তা তুমি ঠিকই বলছো শীতল দা।”
“কতদিন ভাবছি বাবু রে এট্টু দেকতি যাবো। কিন্তুক সমায়ই পাই নে।”
“বাবু অবশ্য মাঝে মাঝেই তোমার কথা বলে। বলে তুমি নাকি তোমার বাবার মতই হয়েছো। জানো তো বাবু খুব বিশ্বাস করে তোমায়।”
“বাবু রে কস সমায় পালি যাবানে একদিন। আচ্ছা নিবে?”
“উঁ।”
“বাবু অহন কোন মাছ ভালো খায় রে?”
“শিঙ মাছ।”
“কী করি ক’ দেহি। শিঙ মাছ তো তেমন পাইনে।”
“না পালি আর কী করবা।”
“তাই তো।”
লুঙ্গির ভাজে গুঁজে রাখা প্যাকেট থেকে বিড়ি বের করে একটা নিজের ঠোঁটে গুঁজে আর একটা শীতলের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে নিবারন বলে, “নাও শীতল দা, বিড়ি খাও।”
হঠাৎই যেন নেশাটা বেশ করে পেয়ে বসে শীতলকে। আসলে জাল ফেলতে ফেলতে একটা ঘোর চলে এসেছিল তার। সেই ঘোর তাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল বিড়ির কথা। এখন নিবারন মনে করিয়ে দিতেই মাথাটা কেমন ঝিন ঝিন করে ওঠে। গলার কাছটায় ঠেলা মারে আঠালো একটা অনুভূতি।
তখন হয়তো বিকেল। দিন শেষের ইশারা নিয়ে সূর্য টা দিগন্তের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশের গায়ে রঙ পাল্টানোর খেলা। বকের ডানায় ঝলকে উঠছে রোদ।
বিড়িতে বড়োসড়ো এক টান দিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে একরাশ ধোঁয়া উগরে দেয় শীতল। ফের একবার মনে পড়ে যায় বাপের কথা। এমনি করেই বাপ সনাই বাগদিও বিড়ির ধোঁয়া ছাড়তো। আর কোনও নেশা ছিল না বাপের। তবে বিড়ির নেশাটা ছিল একটু বেশিই। দিন-রাত মিলিয়ে কত বিড়ি যে খেত। তার এত বিড়ির নেশা দেখে এক একসময় খুব রাগারাগি করতো মা। বাপ বলতো, “রাগো ক্যান?এট্টু বিড়িই খালি খাই। আর কুনো নেশা তো করি নে।”
মা বলতো, “তাই কয়ে এত?”
“হঃ,এট্টু বেশিই খাই। কিন্তু কী করবো কও? সারাদিন রোদ জলে থায়ি। তয় ভাবছি খাওয়াডা আস্তে আস্তে কমায়ে আনবো।”
“খালি ভাবো। কমাতি আর হবে না।”
“না গো শীতলের মা,সত্যিই কমায়ে আনবো।”
কমানোর আর সময় পেল না বাপ। এক ঘোর বর্ষার রাতে জ্বরের ঘোরে চলে গেল আচমকাই। অথচ আরও কতদিনই না থাকার ইচ্ছে ছিল মানুষটার। কত স্বপ্ন ছিল। শীতল বড়ো হবে। বাপ-বেটায় একসাথে মাছ ধরবে। অতবড়ো বাঁধটায় একা মাছ ধরতে খুবই কষ্ট হত তার। ভেসাল ছাড়াও কত কত জাল। কত মাছ ধরার খাঁচা। নাওয়া খাওয়ার যেন সময়ই হত না তার। এক এক সময় তাই শীতল কে কোলের কাছে টেনে নিয়ে বলতো, “এট্টু তাড়াতাড়ি বড়ো হ দেহি বাপ। একা একা মাছ ধত্তি ভারী কষ্ট হয়। তুই বড়ো হলি এই কষ্ট আর আমার থাকপে না। বাপ-বেডা একসাথে মাছ ধরবো। আজ যদি বাপ টা থাকতো।”
“কী হল শীতল দা? কী ভাবছো?”
নিবারনের ডাকে ফের একবার ঘোরটা কেটে যায় শীতলের। বলে, “বাপের কথাডা মনে পড়্যে গেল রে নিবে। কত স্বপন ছেল তার।”
“আহা, বড়ো ভালো মানুষ ছিল গো।”
“আচ্ছা নিবে।”
“উঁ?”
“ভালো মানষে বেশিদিন বাঁচে না, না রে?”
“কি জানি। তবে খুড়োর কিন্তু এখনও অনেকদিন বাঁচার কথা ছিল। কেন যে চলে গেল।”
“বাপের কথা মনে পড়লি বড়ো কষ্ট হয় রে।”
“আর কষ্ট পেয়ে কী করবে। চলেই যখন গেছে।”
এভাবেই কথা হয়। কথায় কথা বাড়ে। কথায় কথায় বেলা যায়। আকাশের গায়ে গড়িয়ে গড়িয়ে এগোতে থাকে সূর্য। এক সময় বাড়িমুখো হাঁটা দেয় নিবারন। বলে, “অনেক কাজ পড়ে আছে শীতল দা। আমি আসি।”
নিবারন চলে যেতেই ফের আবার ভেসালে গিয়ে ওঠে শীতল। সূর্যটা ততক্ষণে দিগন্ত ছুঁই ছুঁই। একটু পরেই টুপ করে খসে পড়বে। একটা লাল আভায় রাঙিয়ে উঠছে আকাশ। বক, পানকৌড়ি, শালিক– সকলেই দিনান্তের উড়াল দিতে ব্যস্ত। শরতের ফালি মেঘ যেতে যেতে যেন থমকে দাঁড়িয়েছে মাথার ওপর। দিনান্তের শেষ আলোয় খানিক দূরের বিলটা বড় মনোরম।
বাড়ির পাশেই খাল। খালে সারাবছর জল থাকে না। কিন্তু যতদিন থাকে ততদিন এই খালই যেন শীতলের বাড়িঘর। জলের ভেতর বাঁশের খুঁটি পুঁতে তার ওপর বানানো কুঁড়ে। শক্ত পোক্ত একখানি বাঁশের মাচাল। মাচালের ওপর নৌকোর ছইয়ের আকারে বাঁশের কাঠামো। তার ওপর ত্রিপলের ছাউনি। এই কুঁড়েঘরটাই যেন তার একফালি সংসার। অবশ্য সত্যিকার একটা সংসার তার আছে। সেখানে চার চালা একখানি টিনের ঘর। ঘরের সামনে ফালি উঠোন। তুলসির চারা। বুড়ি মা। আর তার বৌ মালতী। হ্যাঁ, আজ বছর তিনেক হয়ে গেল মালতী কে ঘরে এনেছে শীতল। কাকডাঙার হরেন বাগদির মেয়ে। যেমন রূপ তার, তেমনি শরীরের গড়ন। কে বলবে বাগদি ঘরের মেয়ে। একপলক দেখেই মনে ধরে গিয়েছিল শীতলের। জগবন্ধু ঘটক কে একপাশে ডেকে নিয়ে বলেছিল, “বে করলি এই মেইয়েরে ই করবো।”
ঘটক বলেছিল, “সে না হয় করলি। কিন্তু তোকেও তো তাদের পছন্দ হওয়া দরকার।”
“পছন্দ হবে না ক্যান? কিসি কম আছে আমার? আমি খালে বাঁধ দেই। মাছ ধরি। হাত, পা, নাক, কান সবই আছে। শরীলি সামত্থ আছে।”
“তা আছে। তবু–”
শীতল কে দেখেও পছন্দ হয়েছিল হরেনের। বলেছিল, “ছেল্য তো দেকতি শুনতি মন্দ না। কিন্তুক বাড়িঘরের অবস্থা–”
“বাড়িঘর সে আজ খারাপ। কিন্তু ভালো হতে কতক্ষণ? তাছাড়া যে সংসারে মেয়ে মানুষ নাই সে সংসার সাজাবে কে?” বলেছিল ঘটক।
“তা অবশ্য ঠিকই কইছো। ঠিক আছে। আমার অ মত নাই। কিন্তুক এট্টা কথা। কিছু দেওয়া থোওয়ার সামত্থ কিন্তুক আমার নাই। নিতি হলি খালি আমার মেইয়েরেই নিতি হবে।”
একপাশে শীতলকে ডেকে নিয়ে কথাটা বলেছিল ঘটক।
শীতল বলেছিল, “দিতি থুতি কেডা কইছে। আমি বে করবো তার মেইয়ে রে। জিনিস তো আমি চাই নে।”
অগত্যা চার হাত এক হতে দেরি হয়নি।
মালতী যখন বৌ হয়ে এলো সংসারে তখন বাড়িঘরের একেবারেই যা তা অবস্থা। ঘরের মেঝেয় চোকলা ওঠা মাটি। উঠোনের চারপাশ ঘিরে এগিয়ে আসা ঘাস-আগাছার জঙ্গল। গোবর জলের লেপা পড়ে না কতদিন। তা দেখে মালতী চোখ জোড়া কপালে তুলে বলেছিল, “এ মা,এ কী অবস্থা করিছো বাড়িখানের?”
শীতল বলেছিল, “ইবার থে বাড়িখান তুমার। তুমার বাড়ি তুমি সাজায়ে নেও।”
“সে কী আর তুমার কতি হবে?এই ঘরে থাকা যায়?”
“কী করবো কও। মা’র বয়াস বাড়ছে। শরীলি কুলোয় না। আমিও সমায় পাইনে। মেইয়ে মানুষ না থাকলি বাড়িঘরের কী ছিরি থায়ে?”
“আর না। আমি যহন আইছি তহন নিজির হাতেই–”
নিজের হাতেই নতুন করে ঘর-উঠোনকে সাজিয়েছে মালতী। যা দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় শীতলের। ইচ্ছে হয় কেবল চেয়েই থাকে। কিন্তু অত সময়ই বা তার কোথায়। মাছধরা মরশুম একবার শুরু হলে সারাটা দিন তার খালেই কাটে। দুপুরে স্নান খাওয়ার জন্য একবার বাড়ি যায় কেবল। দুপুরের সূর্য টা পশ্চিমে হেলতে যতক্ষণ। আবার বেরিয়ে পড়তে হয় তার। জল কে ভালোবাসার সাথে সাথে বৌ মালতীকেও খুব ভালোবাসে শীতল। তাকে ছেড়ে সারাটা দিন এমন করে খালে পড়ে থাকতে একদমই ইচ্ছে হয় না তার। খাল,জল,মাছ,আকাশ – এতসবের মাঝেও নিজেকে কেমন নিঃসঙ্গ লাগে। হ্যাঁ,রাতে অবশ্য সে বাড়িতেই ঘুমোয়। কিন্তু সে আর কতক্ষণ। এমনিতেই যখন সে বাড়ি ফেরে চারপাশে তখন সন্ধে উতরে অনেকখানি রাত। নৈঃশব্দ্য রা জেগে ওঠে নির্জন আঁধারে। জোনাকির ডানায় নামে ক্লান্তির জড়তা। ঝিঁঝিঁ রাও ডাক থামিয়ে শুতে যায়। গভীর একটা ঘুমে তলিয়ে যেতে থাকে গ্রাম। একরাশ ঘুম জড়ানো চোখে ঘরের দাওয়ায় বাঁশের খুঁটিতে পিঠ টাকে হেলান দিয়ে বসে থাকে মালতী। শীতল ফিরলে তাড়াতাড়ি করে উঠে গিয়ে ভাত বেড়ে দেয়। সেইসাথে নিজেও বেড়ে নেয় এক থালা। একরাশ খিদে পেটে নিয়ে ভাত মাখতে মাখতে শীতল বলে, “অহনও তুমি না খাইয়ে আছো?”
ব্যস্ত হাতে ভাত মাখতে শুরু করে মালতীও। বলে, “কি করবো কও? তুমি না খালি–”
“উঁহু,তুমি কাল থ্যিকে আর না খাইয়ে থাকপা না।”
“নাগো, তাতে মানষে মন্দ কয়। তুমারে ছাড়া আমি আগে আগে খাতি পারবো না।”
“তুমি তুমার কথা না ভাবো কিন্তুক যে আসতিছে তার কথা ডা ভাবো। তারও তো খিদে পায়। আমি যতই তাড়াতাড়ি ফিরতি চাই বেরোতি গে সেই দেরিই হইয়ে যায়। নাগো,কাল থ্যিকে তুমি খাইয়েই নিও।”
মালতী কিছু বলে না। কিন্তু পরদিনও সে এমনি করেই না খেয়ে বসে থাকে। যত রাতই হোক শীতল ফিরলে তবেই খেতে বসে সে। খেতে খেতেই যেন চোখ দু’টো আরও বেশি করে জড়িয়ে আসে তার। ক্লান্ত শরীরে ঘুম নামে শীতলেরও। শুয়ে শুয়ে খুব বেশি কথা আর হয় না তাদের। অথচ কত কথাই না বলতে ইচ্ছে করে। জেগে জেগে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে আগামীর। যে আসছে বলতে ইচ্ছে করে তার কথা। কিন্তু সেই সময় তার কোথা?যখনই ঘুমটা একটু গাঢ় হয়ে আসতে শুরু করবে তখনই মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙবে শীতলের। আর বেরিয়ে পড়তে হবে তখনই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘুমোতেই হয় তাই।
ক’দিন কী যে হয়েছে। একবার বাড়ি এলে আর বেরোতে ইচ্ছে হয় না শীতলের। তবুও তাকে বেরোতে হয়। নিজেদের জন্যে যেমন বেরোতে হয় তেমনি বেরোতে হয় তার সন্তানের জন্য। যে একটু একটু করে বড়ো হচ্ছে মালতীর পেটে। তার সুন্দর একটা ভবিষ্যতের জন্যেই বেশি করে বেরোয় শীতল। বেরোনোর সময় কেবল আলতো স্পর্শে ছুঁয়ে দ্যাখে মালতীর ফুলে ওঠা পেট। এক তীব্র ভালো লাগায় মুহূর্তে হারিয়ে যায় কোথায় যেন। ভুলে যায় বেরোনোর কথা।
মালতী আলতো করে ঠেলা মারে শীতল কে, “কী হল, দাঁড়ায়ে র’লে যে? যাও। দেরি হইয়ে যাচ্ছে তো।”
একটু যেন লজ্জা পায় শীতল। আবার বৌ কে ছেড়ে যাওয়ার মনখারাপি তাকে বিমর্ষও করে তোলে। চেতনার পরতে পরতে ছড়িয়ে পড়ে সেই বিমর্ষতা। একবার মালতীর দিকে তাকায়। একবার আকাশের দিকে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বেরিয়ে পড়ে।
আজও ঠিক তেমনি করেই বেরিয়েছিল। দুপুরটা তখন আলতো করে বিকেলের দিকে হেলতে শুরু করেছে। গাছেদের গা ছুঁয়ে নেমে আসছে আশ্বিনের রোদ। চারপাশে বেশ একটা রোদ-ছায়ার লুকোচুরি। বাতাসে কি সব ফুলের ঘ্রাণ। পুজো আসছে। চারদিকে যেন তারই ইশারা। বেরোনোর মুখে আজও একবার আলতো করে আঙুল রেখেছিল মালতীর পেটে। দিনে দিনে ভেতরে যে একজন বাড়ছে বাইরে থেকেই তা এখন বেশ স্পষ্ট। সেদিকে চেয়ে থেকে আর চোখ ফেরাতে পারছিল না শীতল। মালতী জিজ্ঞেস করেছিল, “কী দ্যাহো অমন কইরে?”
পেট থেকে হাত না সরিয়েই শীতল বলেছিল, “আমার ছেল্যে রে।”
“ছেল্যে? কী কইরে জানল্যে তুমার ছেল্যেই হবে? যদি মেইয়ে হয়?”
“না গো, আমি বেশ বুঝতি পারছি আমার ছেল্যেই হবে।”
“তাই বুঝি?”
“হঃ। ছেল্যে হবে। আর কয়ডা দিন। তারপরে বাপ-বেডায় একসাথে মাছ ধত্তি যাবো। আমার বাপেরে যেমুন মাছ ধরা শেকাইছে তার বাপ। আবার আমার বাপ যেমুন নিজির হাতে মাছ ধরা শেখাইছে আমারে, আমিও তেমুন কইরে নিজির হাতে আমার ছেল্যেরে শেখাবো। দুইজনে মাছ ধরবো। বেশি বেশি মাছ। বেশি বেশি ট্যাকা।”
পেটের ওপর থেকে শীতলের হাত টা সরিয়ে দিতে দিতে মালতী বলেছিল, “হইচে, আর স্বপন দেকতি হবে না। তার চেইয়ে খালে যাও। দেরি হইয়ে যাচ্ছে। আর শোনো, এট্টু সকাল সকাল আইসো। যত দিন যাচ্ছে শরীরলডা কেমুন ভারায়ে যাচ্ছে। এই ভারী শরীল নে’ আমি বেশি রাত জাগতি পারি নে। ঘুমে চোক্ষু ভাইঙ্যে যায়। বড্ডো কষ্ট হয় গো।”
“ঠিকাছে। তুমি এক কাম কইরো। আমার জন্যি বস্যে না থ্যিকে খাইয়ে নিও।”
“আচ্ছা।”
দুপুর উতরে এখন পুরোপুরি বিকেল। গাছেদের ছায়া দীর্ঘ হতে হতে ছাড়িয়ে গিয়েছে নিজের আকৃতিকেও। দিগন্তের অনেকটা কাছাকাছি নেমে এসে ঝুলে আছে সূর্যটা। নীল আকাশের গায়ে এখন বাদামি রঙের ছোঁয়া। মাথার ওপর দিয়ে একঝাঁক সরাল রাজারমাঠ বিলের দিকে উড়ে গেল। তাদের ডানার বুনো গন্ধ এসে বুঝি ঝাপটা মারলো নাকে। ঘাড় কাত করে একবার আড়চোখে তাদের দিকে তাকালো শীতল। তারপর ফের জলের দিকে। শরতের খাল। বর্ষার উদ্দামতা ভুলে সে এখন বড়োই কোমল স্বভাবের। বুক ভরা জল থাকলেও গতি তার ধীর। ধীর গতিতে আপন খেয়ালে বয়ে চলেছে সে। তার গায়ে ভেসে ওঠা আকাশের ছবি বড়োই মনোরম। হালকা একটা হাওয়া বইছে। সেই হাওয়ায় খালের বুকে ছোট ছোট ঢেউ। ঢেউয়ের গায়ে রোদের ঝিলিক। জাল ফেলে জলের দিকে চেয়ে আছে শীতল। চেয়ে চেয়ে ভাবছে বাড়ির কথা। ঘর,উঠোনের কথা। মালতীর কথা। আর যে আসছে তার কথা। হ্যাঁ, তার কথাই বেশি করে ভাবছে শীতল। কিন্তু সে কে? ছেলে? নাকি মেয়ে? যদি মেয়ে হয় তাকে নিয়ে ভাবনাটা একটু অন্যরকম। তাকে বড়ো করতে হবে। ভালো ঘর, ভালো বর দেখে বিয়ে দিতে হবে। আর যদি ছেলে হয়? ছোট থাকতেই ছেলেকে নিয়ে জলে নামবে। নিজের হাতে ধরে শেখাবে মাছ মারার কলাকৌশল। ঠিকমতো নৌকোর হাল ধরা। জাল ফেলা। মাছেদের গায়ের আঁশটে গন্ধ কে ভালোবাসতে শেখাবে। মাছের গুন-অগুন সম্পর্কে ধারনা দেবে।
তবে যে ই হোক তাকে খুব ভালোবাসবে শীতল। মালতীর থেকেও বেশি। আচ্ছা, মালতী কী তা দেখে হিংসে করবে তাকে? না, সে কেন হিংসে করবে? সে তো মা। সেও ঠিক ভালোবাসবে অমন করেই। সন্তান হবে শীতলের। বাড়িতে প্রাণ ফিরবে নতুন করে। সারাদিন হৈ চৈ, কোলাহলে ভরে উঠবে তার বাড়ি। সেই সন্তানের টানেই প্রতিদিন আরও একটু আগে আগে বাড়ি ফিরবে শীতল। তাকে হাতে তুলে খাইয়ে দেবে। কোলের মধ্যে নিয়ে ঘুম পাড়াবে। কাঁধে চড়িয়ে ঘুরিয়ে আনবে সারা পাড়া।
ভাবতে ভাবতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল সে। আচমকা জলের মধ্যে বড়ো এক ‘উসক’ দেখে তাড়াতাড়ি করে ভেসালে টান দিল শীতল। অতবড়ো তে কোনা জাল টা একটু দ্রুতই যেন উঠে এলো জল থেকে। মুহূর্তে একটা খুশি ঝলসে উঠলো শীতলের চোখে। এত বড়ো শোল মাছ এবছর প্রথম উঠলো জালে। পিঠ জুড়ে ঘন শ্যাওলার রঙ। পেটের সাদা অংশে হলদেটে ছাপ। ভাসা ভাসা চোখ। গা থেকে বেরোনো দারুণ এক আঁশটে গন্ধ।
মাছটাকে হাতে নিয়ে একবার ভালো করে দেখলো শীতল। আর ঠিক তখনই চোখ গেল তার পেটটার দিকে। চমকে উঠলো শীতল। মাছের পেটটা যেন ঈষৎ ফোলা ফোলা। মাছমারার চোখ শীতলের। এতটুকু ভুল হওয়ার কথা নয় মোটেই। এমন গর্ভবতী মাছ জীবনে কম তো আর দ্যাখেনি সে।
আলতো করে মাছটার পেটে হাত রাখলো শীতল। আর অমনি সেই চেনা একটা ভালোলাগা এসে ছুঁয়ে গেল তাকে। চোখের সামনে ভেসে উঠলো মালতীর মুখ। উঁচু হয়ে ফুলে ওঠা পেট। আর তার স্বপ্ন ঘেরা চোখ দু’টো।
একবার আকাশের দিকে তাকালো শীতল। সেখানে তখন আশ্বিনের বিকেল শেষ হয়ে আসার ইশারা। একটা ঘোলাটে পর্দা বুঝি নামতে শুরু করেছে তার গা থেকে। দুধেল ডানার বকেরা দিনান্তের শেষ রোদ গায়ে মেখে উড়ে যেতে যেতে ফেলে রেখে যাচ্ছে কিছু স্মৃতি।
চোখ দু’টো নামিয়ে নিল শীতল। তারপর ফের একবার পেটে আলতো হাত বুলিয়ে বাঁধের পেছনে মাছটাকে ছুঁড়ে দিল তেমনি আলতো করেই। ফের একবার জল পেয়ে ভাঙতে ভাঙতে না ভাঙা স্বপ্নটা বুকে নিয়ে পিঠ ভাসিয়ে ছুটতে লাগলো মাছটা। শীতলের মনে হল মাছ নয়, মালতীই যেন সাঁতরে যাচ্ছে।