দর্পণ-এর গল্পবিষয়ক বিশেষ সংখ্যা ‘শিশিরভেজা গল্প’-তে প্রকাশিত
সন্তোষ কুমার শীল
অবশেষে শুভব্রত স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করতে বসে। এই ক’দিন দুঃশ্চিন্তায় তার খাওয়া-ঘুম বন্ধ হবার উপক্রম। জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তির তালিকায় তার নাম তুলে কী বিড়ম্বনাটাই না তাকে ফেলেছে! লাজুক, মুখচোরা, নিভৃতচারী শুভব্রত সারাটা জীবন ধরে নিরলস সাহিত্য চর্চা করে এসেছে শুধু আনন্দের জন্য, জীবনের গভীরতম রসাস্বাদনের জন্য। জীবনের এই প্রান্তে এসে রাষ্ট্র তাকে পুরস্কৃত করার জন্য মনোনীত করে যেন দুর্বিপাকে ফেলেছে। কোনোদিন বেশি মানুষের ভীড়ে, কোনো জনসভায় এমন কী ছোট মঞ্চেও উঠে দেখেনি। কখনো কখনো ডাক পেয়েছে। কিন্তু মানুষের মধ্যে যেতে কেমন বিব্রতবোধ করেছে– পাছে তার সৃষ্টিশীলতার ধারাটি প্রশংসার লোভে গতি হারিয়ে ফেলে সেই সংশয়ে। সব সময় প্রবাহমান থাকতে চেয়েছে। কিন্তু আজকের আহ্বান ফিরাতে সাহস হয় না আবার যেতেও ভরসা পায় না। তাই স্ত্রীর কাছে একটা উপায় জিজ্ঞেস করে।
শ্রাবণী অনেক ভেবেচিন্তে বলে, তোমার বাল্যের সহপাঠীকে বললে হয় না? শুভব্রত চমকে ওঠে– রতন ভূঁইয়া? ধুস্, তুমি কি যে বলো? রতন এক কালের দাপুটে মন্ত্রী। শৈশব-কৈশোরে খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল বটে। কিন্তু তা মূলতঃ সাহায্য নির্ভরতার নামান্তর। আজ কি আর তার কাছে গেলে কোনো ফল ফলবে?
রতন বরাবরই ডানপিটে। পরীক্ষার হলে সব সময় শুভব্রতর পাশে বসত, তার উত্তরপত্র কপি করত। আবার ভালোও বাসতো, শুভব্রতকে বুক দিয়ে আগলে রাখত। স্কুলের গণ্ডি পার হয়ে একই কলেজে দু’জন ভর্তি হলেও বন্ধুত্বের দাবী-দাওয়া তখন থেকেই ঘুচে যেতে শুরু করে। রতন সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। রাতারাতি সে বিখ্যাত হয়ে যায়। সহপাঠীরা তাকে লীডার বলে ডাকতে শুরু করে। তার কথা কলেজ কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত মান্য করত। আর শুভব্রত আড়ালে, সবার চোখ এড়িয়ে গিয়ে ক্লাস করে বাড়ি ফিরত। দৈবাৎ রতনের সাথে দেখা হলে ছলছূতা দেখিয়ে কোনোমতে পালিয়ে আসত। রতনও একসময় তাকে অস্বীকার করে চলতে অভ্যস্ত হয়। তারপর কত যুগ পেরিয়ে গেছে! রতন জেল খেটেছে, মার খেয়ে, মার দিয়ে প্রথমে সংসদ সদস্য, পরে মন্ত্রী হয়েছে। মফস্বলের গেঁয়ো পথে জাতীয় পতাকা টাঙ্গিয়ে গাড়ির বহর আসতো। বিশাল মঞ্চে হাত-পা ছুঁড়ে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছুটাতো। এখানে এটা প্রতিষ্ঠা, ওখানে ওটার উদ্বোধন… কী ব্যস্ততা! তার নামে বাঘে-মোষে এক ঘাটে জল খেতো। গ্রাম-শহর রতনের নামে পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুনে রঙ্গীন হয়ে সেজেগুঁজে থাকত। প্রায় এক দশক এই এলাহী কাণ্ড-কারবার চলল। নিজের নামে, স্ত্রীর নামে, বাবা-মা, শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর নামে পথ-ঘাট, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, ফাস্টফুডের দোকান, মদের আড্ডার নামকরণ করে অমরত্ব প্রায় ছিনিয়ে এনেছিল। দিনের আলো ফুটলেই গাছে, পাঁচিলে, ঘরের দেয়ালে, সরকারি ভবনে, সেতুতে, বৈদ্যুতিক খুঁটিতে এমনকি লঞ্চ-বাস স্টপেজের গণশৌচাগারে রতন ভূঁইয়ার নাম ঝকঝকিয়ে উঠত।
কিন্তু নিন্দুকের দল এই নাম-মাহাত্ম্য সহ্য করল না। কোথায় কখন যেন এক ট্রিপ এক্সপোর্টস গুডস্ ধরা পড়ল রতনের। খোঁজ নিয়ে জানা গেল তা ছিল যুবতী নারীর দল। আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারী দলের সাথে তার এতদিনের যোগাযোগ ফাঁস হয়ে যায়। মধ্যপ্রাচ্যে তার এই মালামালের নামে মানুষ পাচার (তাও আবার মায়ের জাত!) নাকি দীর্ঘদিনের। নানা খুঁটিনাটি সব তথ্য সংবাদপত্রে ছাপা হতে থাকে। অবশ্য তা এত ছোট্ট অক্ষরে যে ওই বড় বড় রঙ্গীন অক্ষরে ছেয়ে যাওয়া নামকে খুব বেশি ম্লান করতে পারে না। কিন্তু ওই নিতান্ত ছোট অক্ষরেই লোমহর্ষক, বীভৎস সব কাহিনী বের হতে থাকে। প্রত্যুত্তরে মন্ত্রী রতন ভূঁইয়া অত্যন্ত উদার নীতির আশ্রয় নেয়। সংবাদ সম্মেলন ডেকে সে উচ্চস্বরে সদম্ভে ঘোষণা দেয়– তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য বিরোধী দল চক্রান্ত করে এই নাটকীয় ঘটনার জন্ম দিয়েছে।
কিন্তু মন্ত্রীর পদে থাকা একজন ব্যক্তির অপবাদজনক অপমান গোটা জাতির অপমান– দেশের অপমান। তাই সংবাদ-সম্মেলনেই সে পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ফিরে আসে। বাসভবনে পৌঁছেই আকস্মিকভাবে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং অত্যন্ত সুকৌশলে সর্বময় কর্তৃপক্ষের অদৃশ্য কলকাঠিতে চিকিৎসার নামে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। আর ধীরে ধীরে জনমনে বিস্মৃতির পলি পড়ে একদিন রতন ভূঁইয়া আর তার দাপুটে কুকীর্তির কথা গভীর অতলে চাপা পড়ে যায়।
সেই বাল্যবন্ধুর কাছে আজ গিয়ে দাঁড়াতে তার আদর্শে বাঁধে। অবশ্য দেশে ফিরে আসার পর তার টেরই পাওয়া যায়নি।
শ্রাবণী এ পর্যন্ত বলে– তুমি এত দ্বিধা করছ কেন? তুমি তো তার কাছে কোনো সহায়তার জন্য যাচ্ছ না। শুধু তাকে নিয়ে যাবে। সে তো একসময় মন্ত্রী ছিল। আর তুমি জীবনে কোনোদিন ঘরের বাইরেই গেলে না। ব্যস্ত রাজধানীর পথে তোমাকে একলা কিছুতেই যেতে দেব না।
শুভব্রতও একা বড় অসহায় বোধ করে। বাইরের জগৎটাকে সে ভীষণ ভালোবাসে কিন্তু সে শুধু তার কল্পনায়। বাস্তবে সে পর্যুদস্ত হয়েছে বারে বারে। তাই সবকিছুতে তার ভয়। অজানা-অচেনা জায়গায় যেতে, রাষ্ট্রপতির হাতে সম্মাননা, পদক নেবার কথা মনে করতেই তার বুকের ভিতর দুরুদুরু করে ওঠে। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয়– বাল্যবন্ধুকে নিয়েই যাবে। সে সাথে থাকলে অন্ততঃ একটু ভরসা পাবে।
একবুক আশা নিয়ে সংশয়াতুর শুভব্রত বাল্যবন্ধুর বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হয়। বিশাল বাড়িটার সর্বত্র কালের জীর্ণতা গ্রাস করেছে। গেটের শ্যাওলাধরা নামফলকে এককালের মন্ত্রী থাকার ইতিহাস আজও কোনোমতে বহন করে চলছে। বাড়ির চারপাশের নোনাধরা, পলেস্তারা খসে যাওয়া দেওয়াল বেয়ে অসংখ্য গুল্মের ঝোপঝাড় উঠেছে। রতন যেদিন মন্ত্রী ছিল, শহরের এই বাড়িটা ছিল সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ! কত দাসদাসী, আমলা-কর্মচারী, ড্রাইভার-দারোয়ান, গেটে উর্দিপরা নিরাপত্তা কর্মী, রাস্তায় বিশাল লম্বা গাড়ির বহর ছিল। অথচ আজ শুভব্রত নিজের নিঃশ্বাসের শব্দও টের পায়। শহরের এদিকটা একেবারেই মরে গেছে। শুভব্রত মনে মনে বিস্মিত হয়– আশা-আকাঙ্খা, স্বপ্নের মতো শহরও কি তাহলে মরে যায়!
বৃদ্ধ রতন ভূঁইয়াকে দেখে চমকে ওঠে শুভব্রত– থলথলে দেহটা ইজিচেয়ারে ছেড়ে দিয়ে চোখ বুঝে শুয়ে আছে। মুখের কষ বেয়ে পানের পিক গড়াচ্ছে। চোখ-মুখ ঝুলে নেমে আসছে নিচের দিকে। মনে হয় প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, কোনো ভাস্কর্য। শুভব্রত একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে– এই কাষ্ঠখণ্ডে যতক্ষণ ক্ষমতা-দম্ভের অগ্নি ছিল ততক্ষণ দাউ দাউ করেছে। আজ শুধু ছাই অবশিষ্ট রয়ে গেছে। শুভব্রতের সাড়া পেয়ে ভাস্কর্য লাল টকটকে চোখ খোলে, কিন্তু কোনো ভাবান্তর হয় না। শুধুমাত্র একটু নড়ে চড়ে বসে।
শুভব্রত অনেক আমতা আমতা করে শেষ পর্যন্ত তার রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রাপ্তির কথা জানায় এবং তার সাথে প্রাক্তন মন্ত্রী বন্ধুকে যেতে বিনীত অনুরোধ করে। পুরোপুরি অবিশ্বাসের চোখে শুভব্রতের দিকে চেয়ে থাকে রতন ভূঁইয়া। বলে, সত্যি বলছ নাকি অন্য কোনো মতলব আছে ?
শুভব্রতর ভিতরটা আর্তনাদ করে ওঠে। কিন্তু আজীবনের সংযম তাকে শান্ত, সহাস্য রাখে। পকেট থেকে নিমন্ত্রণপত্রটা বের করে এগিয়ে ধরে রতন ভূঁইয়ার দিকে। কার্ডটা ছোঁ মেরে নিয়ে মনযোগ দিয়ে পড়ে আর তার মুখাবয়বে পরিবর্তনের ছাপ ফুটে ওঠে। অবস্থাটা এই রকম একটা সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পেল কিনা গোবেচারা এই বোকা বোকা চেহারার বেকুবটা! দেশটা কি রসাতলে গেছে! এর চেয়ে নতুন কোনো প্রজেক্ট চালু করলে লোকজন কিছু সুবিধা পেত, সরকারও লাভবান হত। রাজনীতি থেকে সরে আসার পর দেশের কি দুরবস্থাটাই না হয়েছে! একটা বিরক্তিকর ভঙ্গী করে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে– এসব তুচ্ছ কাজেও যদি আমাকে ডাকো তবে তো পালিয়ে বেড়াতে হবে দেখছি!
– দেখ, আমার কথা তো জানো–জীবনে ঘরের বাইরে পা দিইনি। তোমার মতো একজন দেশ-বিখ্যাত বন্ধু থাকতে আর কার কাছে যাব বল?
– ঠিক আছে। কিভাবে যেতে চাও?
– আগের দিন এখান থেকে স্টীমারে চড়ব।
– পাবলিক ভিইকলে ? সে আমি পারব না। আম-জনতার ঠাসাঠাসি ভীড়ের মধ্যে মানুষ যেতে পারে নাকি?
শুভব্রতের বলতে ইচ্ছে করে– তাদের দয়ায়ই তো তুমি মন্ত্রী হয়েছো, গাড়িতে চড়তে পেরেছো, এত ক্ষমতার মালিক হয়েছো। আজ তাদেরই অবজ্ঞা? কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারে না। ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞেস করে– তবে? কি উপায় করতে পারি তুমিই বলো!
– আসা-যাওয়া চুক্তিতে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করো। নইলে আমি যেতে পারব না।
– বল কী!
– সারা জীবন দরজা বন্ধ করে মাথা-মুণ্ড কত কি লিখলে! কর্তৃপক্ষকে পটিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা নিচ্ছ? আর যাওয়া-আসার জন্য একটা গাড়ি ভাড়া করতে পারো না? আরে ইচ্ছে করলে তো গাড়ি দু’একটা কিনে ফেলতে পারো।
তেতো ওষুধ গেলার মতো শুভব্রত একটা ঢোক গেলে। সৃষ্টিশীলতার প্রতি দেশের মন্ত্রী, রাজনীতিবিদদের এই যদি ধারণা হয় তবে তার চেয়ে দুঃখজনক এবং বিপদজনক আর কি আছে! এরা তো সবকিছুতেই নিজের চরিত্রের প্রতিচ্ছবি দেখে। চলে যাবে এখান থেকে? বন্ধুত্বকেই যখন অসম্মান করেছে তখন তার সঙ্গ কামনা করা বোধ হয় অকর্তব্য।
শুভব্রত কিছু না বলে উঠতে যায়। একটা বিশ্রী হাসি হেসে রতন ভূঁইয়া বলে– সম্মাননা আনতে যাচ্ছ অথচ পয়সা খরচ করতে চাইছো না– এটা কেমন কথা !
– সম্মাননা আমার শিল্প সাধনার স্বীকৃতি স্বরূপ সুধীজনের মূল্যায়নে রাষ্ট্র দিচ্ছে। কিন্তু আমি তো উপার্জনের ধান্ধায় জীবন কাটাইনি! তাহলে আমারও একটা গাড়ি থাকতে পারত। দেখি গাড়ি ছাড়া যেতে পারি কিনা।
খোঁচাটা গায়ে না মেখে রতন ভূঁইয়া হেসে বলে– আরে আমার গাড়ির কথাও তো বলতে পারতে। তাও তো দেখছি ভুলে গেছ।
শুভব্রত এতক্ষণে বুঝতে পারে, মৃত্যুর প্রান্তে এসেও সারা জীবনের অভ্যেস– প্রশংসা, তোষামোদ, মিথ্যাস্তুতির প্রতি সুগভীর অনুরাগ রয়েই গেছে ! এসবের পূর্তি না হলে অহংবোধ তৃপ্ত হয় না, বরং ক্ষুণ্ণ হয়। সে রাজি হয়ে বিষণ্ণ মনে বাড়ি ফিরে আসে।
গাড়িতে উঠে প্রাক্তন মন্ত্রী রতন ভূঁইয়া চক্চকে বাধাঁনো একটা দামি নোটবুক শুভব্রত-র হাতে দিয়ে বলে– তোমরা তো আকাশ-কুসুম নানা জল্পনা-কল্পনার কথা, হাবিজাবি লেখ। এই দেখ– দেশের উন্নয়ন, জনগণের সুখ-সুবিধার কথা এখানে লেখা আছে।
শুভব্রত নোটবুকটা খুলে দেখে– কবে কোথায় সেতু, কালভার্ট, টোলঘর, বিশ্রামাগার, মাছের বাজার উদ্বোধন করেছে, কোথায় দুর্গতদের খিচুড়ি বিতরণ করেছে, কোথায় জনসভা করেছে, কতবার বিদেশে গিয়েছে তার একটা হিসেব লেখা। সে সবিস্ময়ে লক্ষ্য করে– প্রায় হাজার খানেক নামফলক আছে তার নামে। তারিখ এবং স্থানের বর্ণনাসহ তার তালিকা।
রতন ভূঁইয়া হেড়ে গলাটা ঝেড়ে বলে– শুধু নামফলকের তালিকাটা দেখ। দুই যুগ পার হয়ে গেছে। আজও যদি একজনে একটা নামফলক পড়ে তবেও প্রতিদিন একহাজার মানুষ নামটা স্মরণ করে। তোমার ওই সম্মাননা, সাহিত্যচর্চা কে কয়দিন মনে রাখবে? ওতে কি হবে! নিছক পাগলামী বৈ তো নয়! চলো রাজধানীতে। দেখবে, আমার দল ক্ষমতায় না থাকলে কি হবে? এখনও আমার কত সম্মান, কত প্রতিপ্রত্তি!
সম্মেলন কক্ষের প্রবেশ পথে এসে বিপত্তিটা বাঁধল। শুভব্রত সংশয়-সঙ্কোচে একটু পিছিয়ে পড়েছিল। রতন ভূঁইয়ার গলা শুনে এগিয়ে আসে। নিরাপত্তা কর্মীরা নিমন্ত্রণপত্রবিহীন কাউকে ঢুকতে দেবে না। প্রাক্তন মন্ত্রী সাবেকী মেজাজে নিরাপত্তাকর্মীদের সাথে দুর্ব্যবহার করলে তার হাত ধরে টেনে বাইরের দিকে রেখে আসে। অবশেষে শুভব্রত এসে তাদের বিনয়ের সাথে বন্ধু পরিচয় দিলে রতন ভূঁইয়ার প্রবেশের অনুমতি মেলে।
ভিতরে গিয়ে প্রাক্তন মন্ত্রী হতচকিত হয়ে যায়– দেশের খ্যাতনামা এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত। রাষ্ট্রপতিসহ সকল মন্ত্রীবর্গ রয়েছেন মঞ্চে। একটু গল্প-গুজব লেখার পুরস্কার দিতে এত আয়োজন! এতে কি জনগণের উপকার হয়! ক্ষুধায় খাদ্য জোটে? তার দল ক্ষমতায় থাকলে অন্ততঃ এ বিষয়ে একটা বৈঠক করা যেত।
রাষ্ট্রপতি যথাযোগ্য শ্রদ্ধার সাথে শুভব্রত-র হাতে পদক তুলে দিয়ে তার সাহিত্য-কর্মের প্রশংসা করেন এবং জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে তাকে অভিহিত করেন। বিস্মিত, মুগ্ধ শুভব্রত-র কৃতজ্ঞতায় অন্তর ভরে ওঠে। সারা জীবনের দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনার কথা ভুলে যায়। এক অনির্বচনীয় সুখে তার অন্তর পূর্ণ হয়ে ওঠে।
ফেরার পথে গাড়িতে দু’জনের মনে দুই রকম চিন্তার স্রোত বইতে থাকে। তাই দু’জনই চুপ করে থাকে। শুভব্রত যেদিন সৃষ্টিশীলতার পথে প্রথম যাত্রা শুরু করে সে দিনগুলো কি ভীষণ নিঃসঙ্গ ছিল! আত্নীয়-স্বজন, প্রতিবেশীরা তাকে হেয় জ্ঞান করে দূরে রাখত। কোনোদিন কিছুতে তার ন্যূনতম একটা মতামত নিয়েও সম্মান দেখায়নি। বরং সুযোগ পেলে অসম্মান করত। ধীরে ধীরে এই একলা পথে নিজেকে কী যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে এসেছে, তা শুভব্রত ছাড়া কেউ জানে না। একদিন বিখ্যাত হবে, ভাগ্য তাকে পুরস্কৃত করবে এ স্বপ্ন দেখার দুঃসাহস তার হয়নি। কখনো যে একেবারেই বিদ্যুৎ চমকের মতো দূরাশার ঝলকানি দেখতে পায়নি তা নয়। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে প্রবোধ দিয়েছে– নিজের কাজটা নিষ্ঠাসহকারে করা তোমার কর্তব্য। কাল কি হবে তা ভেবে মিছেমিছে হতাশা ডেকে আনো কেন? মূল্যদাবী না করে তোমার শ্রম-সাধনা করে যাও।
আজ রাষ্ট্রপতির হাত থেকে জাতীয় সম্মাননা প্রাপ্তির পর কেন যেন তার মনে হয়– এ তার শ্রম সাধনার ফসল। তার ভাগ্যই যেন রাষ্ট্রপতির মূর্ত প্রতীক হয়ে তাকে জয়মাল্য পরিয়েছে। পুরস্কার হাতে পেয়ে প্রথমটায় যতখানি অভিভূত হয়েছিল তা ধীরে ধীরে কেটে যায়। মনে হয় এটুকু তার প্রাপ্য ছিল। নইলে ঠিক হতো না। সবাই যখন মুখ ফিরিয়ে নিল, তখন সরস্বতীর এই দাক্ষিণ্যটুকু তার একান্তভাবেই পাওয়া দরকার ছিল।
বন্ধুর ডাকে তার চমক ভাঙ্গে– দেখো লেখক, এইটুকুতেই আবার আত্মহারা হয়ে যেও না। এ হচ্ছে যুগের হুজুগ। দেখবে কাল এরা তোমায় চেনেও না। আর ওই বই! এই দেশের মানুষ কি কস্মিনকালেও বই পড়ে? বর্তমান দল তোমায় নিয়ে ফায়দা লুটছে। তোমরা সহজ-সরল, গেঁয়ো মানুষ! এই সব রাজনীতির জটিল মারপ্যাঁচ বুঝবে না। তোমাদের নিয়ে এরা ব্যবসা ফেঁদেছে।
শুভব্রত এবারও চুপ করে থাকে। মন্ত্রী বন্ধুর মুখাবয়ব, চোখের দৃষ্টিতে তার ভিতরের অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। এ শুধু আত্মঅহমিকা রক্ষার ব্যর্থ প্রয়াস মাত্র। অপকর্মের দায়ে দেশ ছাড়তে হয়েছে। আজ একজন নিরাপত্তারক্ষী পর্যন্ত চেনে না। অথচ কি গর্বান্ধতা বরণ করে আছে! এদের প্রতিবাদ করে কি হবে? চুপ করে থাকাই ভালো।
রতন ভূঁইয়া হঠাৎ আঙ্গুল তুলে বলে– এই যে দেখ, মার্বেল পাথরে বাঁধান আমার নামফলক। এখানে একটা হাট বসিয়েছিলাম। আজ কত বড় বাজার হয়ে গেছে! কাল শহর হবে। আমি মরে গেলেও এই নামফলক আমার অস্তিত্ব ঘোষণা করবে। এর চেয়ে বড় খ্যাতি, পরিচয়, সম্মান আর কি থাকতে পারে?
দুই পাশে বিস্তৃত মাঠের মধ্য দিয়ে পীচঢালা পথ ধরে গাড়ি ছুটছে। অস্তমিত সূর্যের একটা গাঢ় আভা জেগে আছে দিগন্তভালে। জানালায় চোখ রেখে শুভব্রত মনে মনে ভাবে– কালের কোনো সীমানা নেই, ইতিহাস নেই। অথচ অসীম কালের পটে অতি আনুবীক্ষণিক জীবন কত মোহনীয়, কত বর্ণিল! মৃত্যুর দুয়ারে তো এসেই গেছি। এই অস্তমিত সূর্যের মতো মৃত্যুর পরও কি আমার লেখনী এই সান্ধ্য-নিসর্গের মতো কিছুকাল আভা বিচ্ছুরিত করবে! কেমন একটা ব্যথা জাগানিয়া অনুভূতি আছড়ে পড়ে মনের উপকন্ঠে।
রতন ভূঁইয়া ড্রাইভারকে বলেন– “সামনে একটা বাজার আছে। ব্রীজের ওপর গাড়ি দাঁড় করিয়ে একটা মিনারেল ওয়াটার নিয়ে এসো।” শুভব্রত-র দিকে ফিরে বলে, ওই যে আলো ফুটে উঠছে, ওই সেতুটা আমিই উদ্বোধন করেছি। ওখানেও একটা নামফলক আছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি সেতুর ঢালে এসে দাঁড়ায়। শুভব্রত নেমে বলে তুমি বস, আমি প্রস্রাবখানা থেকে আসছি। সেলফোনের আলো জ্বেলে রাস্তার ঢালে একটা উঁচুমতো জায়গায় সবাই যেখানে প্রস্রাব করে সেইখানে গিয়ে দাঁড়ায়। সেলের টর্চ ফেলতেই চমকে ওঠে– উঁচু জায়গাটা একটা স্তম্ভের হেলে পড়া অংশ, বিশেষ করে যেখানে শ্বেত প্রস্তরের উপর কালো অক্ষরে রতন ভূঁইয়ার নামটা ক্ষোদিত। কিংকর্তব্যবিমূঢ় কয়েক মুহুর্ত দাঁড়িয়ে শুভব্রতর মুখখানা পাংশুটে হয়ে যায়। এ অন্যায়, এ পাপ! শুভব্রত কোনোমতেই এটা মেনে নিতে পারে না। সে নিজের ধবধবে শাদা পাঞ্জাবীটা খুলে নামফলকটা ঢেকে দেয়। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্যমনস্কের মতো ফিরে আসে।
শরীরের উপরের অংশটা অর্ধনগ্ন দেখে হেসে ওঠে রতন ভূঁইয়া– আনন্দের ঘোরে জামাটা আবার কোথায় খোয়ালে? নাকি বেশি খুশিতে ন্যাংটো হয়ে গেছ?
– আমি নগ্ন হয়ে বন্ধুর সম্মান, সম্ভ্রম রক্ষা করার চেষ্টা করছি।
মানে না বুঝতে পেরে রতন ভূঁইয়া চুপ মেরে যায়। অন্ধকার পথে তীব্র আলো জ্বেলে গাড়ি গন্তব্যে ছুটতে থাকে।