দর্পণ ডেস্ক
একটি পূর্ণাঙ্গ ম্যাগাজিন। শিক্ষা, সাহিত্য ও গবেষণামূলক ম্যাগাজিন দর্পণ। ২০১৯ সালে ব্যতিক্রমধর্মী ম্যাগাজিন দর্পণ তার যাত্রা শুরু করে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে দর্পণ "গল্পবাজ" ম্যাগাজিন আত্তীকরণ করে।
দর্পণ ডেস্ক

শূন্যতা – রুমান হাফিজ

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে খোরশেদের কন্ঠ।

– কিরে কই তুই?

– এইতো বাসায়, আর তুই?

– আমি তো পুরবী গেইটে দাঁড়িয়ে আছি। তুই আসতে পারবি, চা খাবো।

– না রে এখন আসতে পারবো না।

– অ! বুঝতে পেরেছি, তোর রুনা আপু বাসায়?

– হুম।

ডিসেম্বর মাস তো তাই আপুর অফিস বন্ধ। আর আপুর অফিস বন্ধ মানে আমার কাজ ছাড়া বাইরে বের হওয়া বন্ধ। কোথাও বের হতে চাইলে কত কি যে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়! কই যাবি? কী কাজ? খুব দরকার? ফিরবি কখন? ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর ঠিকমতো দিতে দিতে ছোটখাটো কোনো একটা কাজ হয়তো করা হয়ে যেতো। কি আর করা! সেই ছোটবেলা থেকেই আপুর কাছে থেকে আমি বড় হচ্ছি। আপুর কোনো সন্তান নেই, আর দুলাভাই প্রবাসী। বাসায় আমি আর আপু। একটা প্রাইভেট স্কুলে শিক্ষকতা করছেন অনেকদিন ধরে। সেখানে চার-পাচ ক্লাস আমিও পড়েছি। তারপর স্কুল শেষ করে কলেজে। সেখান থেকেই বন্ধুত্ব হয় খোরশেদের সাথে। আমাদের বাসার পাশেই ওর বাসা। একসাথে কলেজে যাওয়া-আসা, বিকেলবেলা খেলতে যাওয়া, কিংবা পাশের রতন মামুর টঙ-এ চায়ের চমুকে আড্ডা দেওয়া, এসবই ছিলো আমাদের দৈনন্দিন রুটিন।

আপু আমাকে ভীষণ ভালবাসে কিন্তু মাঝেমধ্যে তার অতিরিক্ত শাসন আমার কাছে খুব খারাপ লাগে। আপুর এই শাসন যে আমার ভালোর জন্য, তা আগে না বুঝলেও এখন বুঝতে পারি। তাই আপুর কথামতো চলতে চেষ্টা করি। আমি আম্মুকে পাইনি, মায়ের আদর কি তা বুঝতেও পারিনি। কিন্তু আপু আমাকে যেভাবে আদর যত্ন করে তিলে তিলে বড় করে তুলেছে, এতে কখনো বুঝতেই পারিনি যে আমার আম্মু নেই। আম্মু না থাকার অভাব সবটুকু আপু পূরণ করেছে। আপু আমাকে নিয়ে মাঝেমধ্যে ঘুরতে বের হতো, তখন কত কিছুই না কিনে দিতো! অনেকসময় আমি নিতে চাইতাম না। তখন আপু রাগ করতো।

– আচ্ছা আপু এতো কিছু না কিনলে হয় না? আমি ছোট নাকি সব কিনে দিতে হবে? আর টাকা খরচ তো হচ্ছেই।

– থাক তোমাকে আর পণ্ডিতি করতে হবে না।

প্রতিদিন স্কুল থেকে আসার সময় কিছু না কিছু নিয়ে আসতো আপু আমার জন্য। আমার জন্মের কিছুদিন পর আম্মু মারা যান, তাই আম্মুকে দেখিনি। আম্মু মারা যাওয়ার পর আব্বু নাকি আরেকটা বিয়ে করেন। আব্বুর নতুন স্ত্রী আপুকে বেশ জ্বালাতন করতো, আপুকে একদম সহ্য করতে পারতো না। আপু শহরে পড়ালেখা করেন। স্কুলে চাকুরী নেন। তারপর আমাকেও সেখানে নিয়ে আসেন। আর ফিরে যাননি আব্বুর কাছে।যাই হোক, আপু চাকুরী নেয়ার কিছুদিন পর বিবাহ করেন। আমার দুলাভাইটাও অনেক ভালো মানুষ। আপুকে ভীষণ ভালবাসেন।

সেদিন বিকেলবেলা একটা জরুরী কাজের কথা বলে আপুর থেকে ফাঁকি দিয়ে চলে আসি। বেশ কদিন পর বের হলাম, খানিকটা ভিন্নরূপ লাগছে।

– কিরে দোস্ত কি অবস্থা?

– আর বলিস না, একদম ভালো নেই!

– কি হইছে রে?

– এই যে বললাম না, আপুর স্কুল বন্ধ তো আমারও বের হওয়া বন্ধ। কোথাও বের হওয়া মানে তো মহাভারত জয় করা!

– আচ্ছা থাক, বড় বোন ত! চল রতন মামুর টঙ-এ।

– হ্যাঁ, চলতো।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আড্ডা দেয়া আমাদের রোজকার কাজ!

– নাহ, একদম ভাল্লাগেনা সারাদিন শুধু শুধু বাসায় পড়ে থাকা। তাও আবার এই সময়টাতে কলেজও বন্ধ!

– আচ্ছা বাদ দে ওসব। কোথাও ঘুরতে গেলে কেমন হয়?

– হুম, গেলে তো ভালোই হয়। কিন্তু..

– কিন্তু কি?

– না বলছিলাম কী এখন না গেলে হয় না?

– তাইলে কি পরে যাওয়ার কথা বলছিস?

– হ্যাঁ, যখন কলেজ খুলবে।

– যাওয়া যায়,তবে তখন তো ক্লাস, কোচিং থাকবে। সব মিলিয়ে কীভাবে?

– আচ্ছা,চিন্তা করিস না, সময় আসুক ব্যবস্থা হবেই।

সেদিনের মতো বিদায় নিয়ে আসি খোরশেদের কাছ থেকে।

প্রতিদিনের মতো আজও রাতে একসাথে খাবার টেবিলে বসি আমি আর আপু। কিন্তু আপুকে কেমন যেন অন্যরকম লাগছে।

– আপু তোমার কি শরীর খারাপ?

– নাহ।

– তাইলে এমন দেখাচ্ছে কেন?

– কেমন আবার দেখাচ্ছে, আমি তো ঠিকই আছি।আচ্ছা যাকগে, আমি আগামীকাল মেডিকেল যাবো ডাক্তারের সাথে দেখা করতে, তুই আমার সাথে চলবি।

– আচ্ছা ঠিক আছে যাবো।

সকালবেলা রেডি হয়ে আপুর সাথে গেলাম মেডিকেল। ডাক্তারের রুমে আপু প্রবেশ করলে আমি বাইরে বসে থাকি। অনেকক্ষণ হয়ে গেলো আপু তো বেরিয়ে আসতেছে না। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম, ডাক্তারের রুমের সামনে গিয়ে একবার দেখেও এলাম। আপু কী যেন আলাপ করতেছেন। তারপর আপু বের হয়ে এলে আমরা ফের বাসার দিকে রওয়ানা হই। একটা বিষয় আমি লক্ষ করলাম, আপু কোনো কথা বলতেছে না। যে আপু সবসময় হাসিমুখে কতো কথাই না বলতো।আর বাইরে কোথাও বের হলে তো কথাই নেই!

– আচ্ছা আপু, হঠাৎ করে আজ ডাক্তারের কাছে কি জন্য? কোনো অসুখ হয়েছে নাকি?

আপু এবার মুখ খোলে।

– না রে তেমন কিছু না, কয়েকদিন চিকিৎসা নিলে ঠিক হয়ে যাবে।

– আচ্ছা তুই কাল আবার আমার সাথে আসবি?

ডাক্তার বলেছেন দেরী না করে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসাটা করিয়ে নিতে।

আপুর এসব কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। কী এমন হলো আপুর?

পরদিন আবার আপুকে নিয়ে মেডিকেলে গেলাম।ডাক্তারের রুমে আপুর সাথে আমিও গেলাম, ডাক্তারের সাথে আপুর কথোপকথন শুনে তখন আমার আর বুঝতে বাকী রইলো না যে আপুর অসুখটা কী। আর এজন্যই তো আপু আমাকে বলতেছেনও না। সেখান থেকে আপুকে নিয়ে যাওয়া হলো কেবিনে। বাসা থেকে আসার সময় তেমন কিছুই নিয়ে আসা হয়নি। আপুকে রেখে আমি বাসায় গিয়ে দরকারি সব জিনিসপত্র নিয়ে আসি।

এর কয়েকদিন পর ডাক্তার জানালেন অপারেশন করতে হবে, আপু তখন কাঁদতে কাঁদতে একদম হয়রান হয়ে যাচ্ছেন। আমি নিজেকে ঠিক করে আপুকে সান্তনা দিতে লাগলাম।

– ভাই রে আমি মনে হয় আর বেশিদিন বাঁঁচবো না, আমার জন্য তুই দোআ করিস, নিজের যত্ন নিস, সব সময় ভালো হয়ে চলিস।

আপুর কথাগুলো আমার শরীরে চাবুকের মতো আঘাত করতে শুরু করলো। তাহলে কি আম্মুর মতো আপুও?

শুধু হ্যাঁ সূচক উত্তর দিয়ে আপুকে সান্তনা দিতে লাগলাম।

সব প্রস্তুতি শেষ করে আপুকে নিয়ে যাওয়া হলো অপারেশন থিয়েটারে। দুলাভাইকে খবর দেওয়া হয়েছে আগেই। তিনিও ছুটি নিয়ে দুএকদিনের মধ্যে চলে আসবেন। রাত দশটায় অপারেশন হবে, আমি বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছি। নানা রকম চিন্তা এসে মাথার মধ্যে ভিড় করতে থাকে।ঘড়ির কাটায় তখন রাত এগারোটা, অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে আসেন একজন ডাক্তার, আচ্ছা এখানে রুনা তাসমিনা নামের রোগীর সাথে কেউ আছেন? সাথে সাথে আমি এগিয়ে আসি। হ্যাঁ হ্যাঁ আমি আছি, কি অবস্থা ডাক্তার সাহেব?

– আপনাদের একটা ছেলে সন্তান জন্ম হয়েছে।

কিন্তু!

সুসংবাদটা শুনে আলহামদুলিল্লাহ্‌ বলতে যাবো, আর তখনি ডাক্তারের কন্ঠে ‘কিন্তু’ শুনে আমি আটকে গেলাম।

– কিন্তু কি ডাক্তার সাহেব?

– বাচ্চাটার মাকে আর বাঁচানো যায়নি!

খবরটা শুনার সাথে সাথে সজোরে চিৎকার করে দাঁড়ানো থাকা অবস্থায় আমি মাটিতে পড়ে গেলাম। তারপর কী হলো আর কিছুই বুঝতে পারিনি। আমাকে তখন ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয়। জ্ঞান ফিরলে পাশ দিয়ে থাকিয়ে দেখি দুলাভাই বসে কাঁদতেছেন। আস্তে আস্তে আমি নিজেকে খুঁজে পাই।

আপুকে কাফন দাফন, জানাজাসহ সব কাজ সম্পন্ন করা হলো। মাটির মধ্যে রেখে আপুকে চিরবিদায় দিয়ে এলাম। কীভাবে যে এই কাজগুলো করেছি তা নিজেও বুঝতে পারিনি। এসব কাজে সবসময় পাশে থেকে সাহায্য করেছে আমার বন্ধু খোরশেদসহ আরো দুচার জন। তাদের সেই সাহায্যের কথা আমি কখনোই ভুলতে পারবো না। আপু চলে গেলেন আমাকে এতিম করে দিয়ে।আর উপহার দিলেন আমাকে একটা ভাগনা।কিভাবে ছোট বাচ্চাটাকে লালনপালন করবো? এ নিয়ে বেশ চিন্তার মধ্যে ছিলাম। হাসপাতাল সূত্রে যখন জানতে পারলাম যে, হাসপাতালেও বাচ্চাদের লালনপালনের জন্য (চাইল্ড কেয়ার) বিশেষ সুযোগ-সুবিধা আছে। তাই সেখানেই আমারা আপুর ছেলেটাকে রেখে দিলাম। সাথে ছিলাম দুলাভাই আর আমি। দিনগুলো তখন আমাদের কিভাবে যে কাটছে তা হয়তো কাউকে বলে বুঝানো সম্ভব হবে না।

এরই মধ্যে ছয়টি মাস কেটে গেল। হাসপাতাল জীবনে নাওয়া-খাওয়া, পড়ালেখা বলতে গেলে সব কিছুই ছিলো ছন্নছাড়া। ভাগনা কে নিয়ে চলে আসি বাসায়, লালনপালন করতে থাকি আমি। যেভাবে আপু আমাকে করেছিলো। দুলাভাই এর কিছুদিন পর ফের বিদেশে চলে যান।

আস্তে আস্তে ভাগনাটাও বড় হচ্ছে, কোলের ভাগনাটাকে লালনপালন করতে গিয়ে কলেজে ক্লাস করাটা আর সম্ভব হয়নি। কলেজে না গেলেও প্রতিদিন ক্লাসের সব পড়া খোরশেদ এসে আমাকে দিয়ে যেতো। কোথাও আটকে গেলে দেখিয়ে দিতো। দুলাভাই প্রতি মাসের শুরুতেই টাকা পাঠিয়ে দেন। আমি দেখভাল করতে থাকি আমার মতো মা হারা ভাগনাটাকে। আপু ছাড়া পৃথিবীটা আমার কাছে কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেলো।

ছোট ভাগনাটাকে নিয়েই আমার জীবনের বাকি পথ চলতে শুরু করি। কিন্তু কোথায় যেন একরকম শূন্যতা।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu