শিমুল মাহমুদ
জন্ম ৩ মে ১৯৬৭, সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুর। তিনি রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। আশির দশক থেকে তিনি লেখালেখি করে আসছেন। ইতোমধ্যে তিনি মূলধারার একজন সাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থ: ইলিশখড়ি ও অন্যান্য গল্প (গল্পগ্রন্থ), সুইসাইড নোট (উপন্যাস), সাদাঘোড়ার স্রোত (কাব্যগ্রন্থ) প্রভৃতি।
শিমুল মাহমুদ

শিমুল মাহমুদের গল্প

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

দর্পণ-এর গল্পবিষয়ক বিশেষ সংখ্যা ‘শিশিরভেজা গল্প’-তে প্রকাশিত


মাতৃবিনাশ

শিমুল মাহমুদ


ক. অতঃপর নিদ্রানিকষ জন্মজীবন এবং মৃত্তিকা ঘটকি রাক্ষসিকথা

শোনা যায় রাক্ষসি মৃত্তিকা ঘটকির নাসিকা নাই, তবে শ্বাস গ্রহণের নিমিত্তে নাসিকাগহ্বর রয়েছে, চক্ষু নাই তবে দৃষ্টিপাত নিমিত্তে চক্ষুকোটর রয়েছে, ঘর্মাক্ত অন্ধকার বরণ ত্বক, কর্ণ, কর্ণলতিকা কেশসম্ভার, স্তনসম্ভার দুগ্ধভারাক্রান্ত। শোনা যায় রাক্ষসি মৃত্তিকা ঘটকির পদঅঙ্গুলি পশ্চাৎমুখো হওয়া সত্ত্বেও মৃত্তিকা দীর্ঘাঙ্গিনী কৃশকায়া লিকলিকে যেন-বা বংশদণ্ড হেঁটে যাচ্ছে বনপথে। খনখনে কর্কশকণ্ঠী মৃত্তিকা ঘটকি অতীব সন্তর্পণে ঋষি কচ্ছপমুনির পর্ণকুটিরে প্রবেশ করল। বিরামহীন ব্যাকুলতায় তাকিয়ে রইল সপ্তচন্দ্ররাত্রি বয়সি সুখচার্বাকের চকচকে অন্ধকারতুল্য দেহকান্তির দিকে। মনুষ্যশাবক ঘুমন্ত, রাক্ষসশাবক ঘুমন্ত। নিঃসার স্বপ্নঘোর ঘুমের ভিতর শিশুচার্বাকের চেতনায় ভেসে আসছে জীবনবন্দনা, প্রাণিপ্রাণ নিমিত্তে সুখ, জীবপ্রাণ নিমিত্তে মোক্ষ, অহম শান্তি, দুগ্ধরসই জীবন, ভোজ্যচোষ্যপেয়, খাদ্যরস গ্রহণেই পরম তৃপ্তি, পরম প্রাণ।

সুখচার্বাক মৃত্তিকা ঘটকির স্তন্যপানরত। জন্মলাভ অবধি এভাবেই পরম তৃপ্তি সহকারে সুখচার্বাক মৃত্তিকা ঘটকির স্তন্যপানে আসক্ত, কখনো-বা স্বপ্নঘোরে, কখনো-বা ঘুমঘোরে, কখনো জাগ্রত হাস্যোজ্জ্বল চক্ষুচঞ্চল হস্ত সঞ্চালন পূর্বক রাক্ষসি মাতা মৃত্তিকা ঘটকির কৃষ্ণকায় বাম স্তন্য খাঁমচে ধরে পরম তৃপ্তি সহযোগে ডান স্তন্যবৃন্তে পরম তৃপ্তিতে ঠোঁটসংযোগ হেতু জিহ্বায় চুকচুক আওয়াজ। অতঃপর অদ্য সপ্তচন্দ্ররাত্রি অতিবাহিত হলে দগদগে দ্বিপ্রহরের বনাঞ্চল অভিমুখে নিজবক্ষে শিশুপুত্র সুখচার্বাককে ঝাপটে ধরে ক্রমাগত হেঁটে যাচ্ছে মৃত্তিকা রাক্ষসি, হেঁটে যাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়-সন্ধানে ঋষি কচ্ছপ মুনি থেকে দূরে, পরাবত গুহা বরাবর।

ঋষি কচ্ছপ মুনি মনুষ্যশাবকের জন্মোত্তর নামপ্রদান সমাপ্তে দেশান্তরি। অদ্যাবধি কলসজাত মনুষ্যশাবক সন্নিকটে, অদ্যাবধি চার্বাকস্নেহে পর্ণকুটির অভিমুখে ঋষি কচ্ছপ মুনি মনোসংযোগী নয়। পর্ণকুটিরে সদ্যকলসজাত মনুষ্যসন্তানকে পরিত্যাগপূর্বক ঋষি কচ্ছপ মুনি জগতমাতৃকার রহস্যভেদলক্ষ্যে সদাভ্রাম্যমান।

এক্ষণে রাত্রি দ্বিপ্রহরে রাক্ষসি মৃত্তিকা ঘটক গিরিপথের নির্ঝর প্রশ্রবণ প্রান্তে শিলাবৃত প্রাকৃত গুহার নিকটবর্তী। এই সেই বিরামহীন পরাবত গুহাপ্রকষ্ঠ, রহস্যাক্রান্ত, ধ্বনিপ্রতিধ্বনি আবর্তিত। বহমান সময় রহস্যনিয়ন্ত্রিত, হাস্যোজ্জ্বল, আবর্তিত। ক্রমশ উন্মেষলগ্ন প্রত্যূষকাল, ঊষাশ্রিত মনুষ্যসন্তান।

অতীত এখন পরিত্যাক্ত। সময়চক্র ক্রমশ সুখচার্বাককে মৃত্তিকা ঘটকির দুগ্ধরস প্রাচুর্যে পরম প্রযত্নে পরিপুষ্ট নিরোগ শরীর দান করেছে। দান করেছে অপার প্রকৃতির ফল পাকুর শিকারযোগ্য জীব ভোজ্যচোষ্যপেয়। এই সেই পরাবত গুহা, এই গুহায় রাক্ষসি মৃত্তিকার প্রযত্নে সুখচার্বাক সংলগ্ন আরো এক মনুষ্যসন্তান পুষ্টিপ্রাপ্ত হয়েছে; পুষ্টিলাভকৃত মনুষ্যসন্তানের নাম পরাবত; সুখচার্বাকের আজন্ম সখা।

আখ্যান-ইশারা:

[সখা পরাবতের জন্মরহস্য অদ্যাবধি অনাবিস্কৃত; অলৌকিক হয়তো-বা অপৌরুষেয় ঐশীলীলা। সখা পরাবতের জন্মরহস্যলগ্ন হইতে দ্বিসহস্ররাধিক বৎসর অতিক্রন্ত হইলে বঙ্গ নামীয় কোন এক জনপদে চারুচার্বাক নামীয় কোনো এক পণ্ডিত অধ্যাপক এহেন সুবিদিত অপৌরুষেয় রাক্ষসজন্মের রহস্যসন্ধানে বস্তু-যুক্তি-আশ্রিত গবেষণায় মনোনিবেশ করিবেন।

এক্ষণে বিদিত আছে, ভবিষ্যত কর্মপথ অভিমুখে বর্তমান-সংলগ্ন যাবতীয় ক্রিয়াদি সদা সঞ্চরণশীল। এহেন অবস্থায় কোনো এক ভবিষ্যত লগ্নে, অধ্যাপক চারুচার্বাক সকাশে কর্মপরম্পরা সূত্রাদি নির্দেশ সাপেক্ষে মনুষ্যকুলের কিয়দংশ বস্তুযুক্তি অনুসারি হইলেও অপৌরুষেয় গ্রন্থাশ্রয়ী বিশ্বাসীগণ বিশ্বাসজাত চিরায়ত অহমিকার আশ্রয়ে আক্রান্ত থাকিবেন। আর তখন বিশ্বাসীগণ বস্তুযুক্তি পরম্পরা খণ্ডন নিমিত্তে উত্তেজনাকাল অতিবাহিত করিবেন।

এমতাবস্থায় বিশ্বাসীগণের নিকট বিরামহীন রক্তপাত ব্যাতিত দ্বিতীয় কোন প্রতিকার দৃষ্টিগ্রাহ্য হইবে না। ইতিহাস ধারাক্রমে তাহারা নিশ্চিত হইবেন একমাত্র তলোয়ারই হইতে পারে ধর্মরক্ষা তথা ধর্মবিস্তারের পথ; আর তখন ভূভারত খণ্ড হইতে খণ্ডিত হইবে। যদিও তখনো শতাব্দীকাল অন্তর রাক্ষসসময় অব্যাহত থাকিবে। মনুষ্যসমাজে রক্তপাতে বিশ্বাসী ধর্মবিশ্বাসীদের বিপরীতে উদ্ভাবিত হইবে মিউটেশন বিজ্ঞান। মারণাস্ত্র হিশাবে ব্যবহৃত হইবে নিত্যনতুন উদ্ভাবিত জীবাণুভাণ্ডার, ভাইরাস-অস্ত্র, অব্যাহত থাকিবে মহামারিযুগ। তখন মনুষ্য জাতি দ্বিদলে বিভক্ত হইবে : একদল বিশ্বাসী; অপরদল অবিশ্বাসী। যেরূপ এক্ষণে খ্রিষ্টপূর্ব সোয়াতিনশত বৎসরকালে একদল রাক্ষসজাত, অনার্য; শাস্ত্রে বিশ্বাস নাই, অবিশ্বাসী। অপরদল আর্য, বিশ্বাসী; শাস্ত্র-আশ্রয়ী। এক্ষণে আখ্যান-ইশারা হইতে জানা যাইতেছে ব্রহ্মাণ্ডের অন্তিম লগ্নে অপৌরুষেয় শাস্ত্রে অবিশ্বাসীগণ জয়যুক্ত হইবেন। তথাপি তখনো রাক্ষসকাল অব্যহত থাকিবে।]

খ. মাতৃহত্যাজনিত প্রার্থনা সমাচার

বালক সুখচার্বাক এবং সখা পরাবাত সদাচঞ্চল। ক্লান্তিহীন। ঝরনাপ্রান্ত নিসর্গে ক্রিড়ারত। কখনো-বা মৎসাদি শিকারে জলস্রোত বরাবর কৌতূহলি। কখনো-বা বায়ুপ্রাণ রঙিন প্রজাপতি অভিমুখে ব্যাকুল। আর তখন কোনো একদিন পড়ন্ত দুপুরলগ্নে টিলাপ্রান্ত থেকে শোনা গেল রাক্ষসি মৃত্তিকা ঘটকির একটানা কর্কশ চিৎকার। অন্তরীক্ষব্যাপি, ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত। সহসা সচকিত উভয়েই। সুখ এবং পরাবত।

এক্ষণে উভয়েই ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখি, টিলাগাত্র আরোহণে চেষ্টারত। সুখচার্বাকের কৃষ্ণবর্ণের খসখসে পদযুগল ক্লান্ত অথচ অগ্রসর স্পৃহায় উত্তেজিত। পরাবতের চোখে আতঙ্ক অথচ ধীরপ্রশান্ত আস্থাশীল ওর চক্ষুযুগল। অবশেষে সেই সন্ধ্যায় তারা উভয়েই খুঁজে পেয়েছিল এক ভয়ানক রহস্যঘন এলোমেলো অগ্নিবিষাদ দৃশ্যপট। টিলাশীর্ষে নয় বরং টিলাগাত্র অতিক্রমপূর্বক, আরো পশ্চিমে টিলা থেকে অবতরণপূর্বক, চিচিঙ্গা লতাবন অতিক্রমপূর্বক, দানাদার শস্যক্ষেত অতিক্রমপূর্বক, মোহনীয় পিপ্পল ক্ষেত অতিক্রমপূর্বক প্রগাঢ় সবুজের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ঝাঁকবাঁধা মনুষ্যগ্রাম, সেই গাঁয়ের সার্ধশত বৎসরের সার্ধসহস্র শেকড়বাকল পরিবাহী ঝুলন্তকাণ্ডের নিকটে বৃহদাকার ঊর্ধ্বমুখি তীব্র স্বর্ণরঙিন বৃহৎ বৃত্ত অনুসারি বর্তুলাকার অগ্নিকুণ্ড, ভয়ানক মায়াজাগানিয়া, জীবন উত্তেজক, ক্রোধ উত্তেজক, সংগীত উত্তেজক, প্রার্থনা উত্তেজক সেই স্বর্ণরঙ-আশ্রিত সর্গমুখি অগ্নি-উৎসব ঘিরে গ্রামবাসী নৃত্যরত। ঢোলকের অন্ধতালশব্দ বিরামহীন, বংশদণ্ডের চোঙ থেকে সোমরস ঢেলে নিচ্ছে একেকজন পুরুষ নিজ নিজ চওড়া ঠোঁটের গিরিপথ বরাবর গলপথে, গলনালি অনুসরণে বুকের ভিতর সেই সোমরস অমৃতের সন্ধানে যেন-বা সপ্তর্ষি মণ্ডলের সন্ধানে, স্বর্গোদ্যান সন্ধানে ক্রমশ বহুবর্ণিল কোরাসচিৎকার, উত্তেজিত সুখভরাট আনন্দচিৎকার।

সুখ এবং পরাবত যখন রাত্রিসূচনা লগ্নে সর্গমুখি অগ্নি-উৎসবের বৃত্তাবদ্ধ কেন্দ্র থেকে মৃত্তিকা ঘটকির মর্মভেদী তীক্ষ্ণ কর্কশ ভয়জাগানিয়া বেঁচে থাকার ব্যাকুলতা মিশ্রিত বিরামহীন আর্তনাদ শ্রবণপূর্বক নৃত্যরত কোরাসকণ্ঠী গ্রামবাসীর ভিড়ে মিশে যেতে থাকল তখন উভয়ে বিভ্রান্ত যেন-বা দিগভ্রম হতবাক হরিণশাবক। অবশেষে ভয়ার্ত কৌতূহলসমেত ওদের চক্ষুসমূহ যখন ক্রমশ ভয়ানক হৈহট্টগোলমুখর গ্রামবাসীর নিরবিচ্ছিন্ন নৃত্যরত দেহরাশি অতিক্রম পূর্বক অগ্নিবলয়ের নিকটবর্তী তখন সুখচার্বাক এবং সখা পরাবতের কণ্ঠদ্বয় চিৎকারের পরিবর্তে বাকহারা।

বিচিত্র শরীরসমূহ। যে শরীরসমূহে ছাইভস্মকালির পাশাপাশি মনুষ্যরক্তের লেপনে আঁকা রয়েছে সাপ-লতা-পাতাসমেত নরমুণ্ড। কারো-বা বাহুতে অথবা গলায় বাঁধা রয়েছে মানব-কশেরুকার গুটিগুটি হাড়হাড্ডি গ্রন্থিত তাগা। এক্ষণে এহেন উৎসব-বিহ্বল, মস্তিষ্ক-উত্তেজক অমৃতরস-বিহ্বল আপাত বিশৃঙ্খল সদৃশ এলোমেলো গ্রামবাসীর মধ্য থেকে সহসা গুটিকয়েক মশালধারী পুরুষ অগ্নিবলয়ের নিকটে চিৎকাররত বালকদ্বয় চার্বাক এবং পারাবতকে চ্যাঙদোলাপূর্বক অনতিদূরে শাম্বলি বৃক্ষতলে অতিকর্কশ কণ্টকাকীর্ণ গুল্মঝোপের ওপর ছুঁড়ে ফেললো।

অতঃপর যখন সেই ক্লান্তিঘন কষ্ট-আক্রান্ত, অন্তরীক্ষ-আক্রান্ত রাক্ষসির চিৎকার কালো ধোয়ায় পালটে যেতে শুরু করেছে তখন রাত্রির প্রথম প্রহর অতিবাহিত। সুখ এবং পরাবতের চিৎকার মিশে যাচ্ছে অগ্নিউৎসবের হৈহট্টগোলে ঢোলক-বাদ্যের ভিড়ে। জান্তব মানুষপোড়ার গন্ধে যেন-বা মনুষ্যকুলের ক্ষুধার উদ্রেক হলে কৃষ্ণঘন অন্তরীক্ষ আরো দূর দূরান্ত থেকে রাত্রিজীবী জীবজগতের হুহুঙ্কার। যেন-বা বাতাসের বেগ বাঁশবনে ঘর্ষণরত। ঘষর্ণরত আওয়াজ যেন-বা উদ্বেগ-আকুল ছেঁড়াছেঁড়া মনুষ্যকণ্ঠের চিক্কন নাকিকণ্ঠের কান্না। আর তখন শোনা যাচ্ছিল উৎসবমুখর মনুষ্য সন্তানদের ভিতর এক ধরনের ভূতজাগানিয়া নেশা-আক্রান্ত প্রলাপ।

তখন রাত্রি দ্বিপ্রহর। তখনও গ্রামবাসী উৎসব-বিহ্বল, মস্তিষ্ক-উত্তেজক অমৃতরস-বিহ্বল। পরিশ্রান্ত, ঘুমাশ্রিত, কেউ-বা অর্ধ্বজাগ্রত এলোমেলো শুয়ে বসে প্রলাপরত। সংগীতবিচলিত জীবনের দিকে প্রলাপরত ওরা। আনন্দের দিকে প্রলাপরত, মৃত্যুর দিকে প্রলাপরত, প্রার্থনার দিকে প্রলাপরত, বিনাশের দিকে প্রলাপরত দলবাঁধা মনুষ্যপ্রবর। আর তখন বৃত্তাবদ্ধ অগ্নিকুণ্ডের কেন্দ্রে বটবৃক্ষের দীর্ঘ চিরভাস্বর একজোড়া ঝুলন্ত চওড়া শেকড়ের সঙ্গে বেঁধে রাখা রাক্ষসির দীর্ঘ কৃষ্ণকর্কশ দেহ পুড়ছিল। যদিও তখন তা রাক্ষসির দেহ-অবয়ব পরিত্যাগপূর্বক পিচাশাকৃতিপ্রাপ্ত; যার দেহমুখহস্তপদ কিছুই নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে স্থির নয়; বরং রাক্ষসির হাড়হাড্ডি প্রকটিত বক্ষপিঞ্জর শ্বেতকৃষ্ণ কঙ্কাল থেকে ভরাট-ভ্যাপসা গন্ধ উত্তেজক তথা প্রগাঢ় দুর্বোধ্য নেশা জাগানো আবহ ক্রমশ জমাট।

ওই জমাটবাঁধা আমিষগন্ধে কোনো যন্ত্রণা ছিল না। ওই ভস্মীভূত তেলকঙ্কালদেহে কোন বিষণ্ণতা ছিল না। ওই পুড়ে যাওয়া মনুষ্যমাংসের প্রাণে কোন আকাঙ্ক্ষা ছিল না। সেই পোড়াদেহের কঙ্কালগ্রন্থিতে ছিল না কোনো দুগ্ধপোষক স্তন্যের আভাস। শুধু তখন দেখা যাচ্ছে এক জোড়া পদ-দণ্ডের দীর্ঘাকৃতি মাংসবিহীন কালো পোড়া হাড়। দীর্ঘাকৃতি হাড়হাড্ডি আশ্রিত ভূতগ্রস্ত ধুম্রজালআক্রান্ত কঙ্কাল থেকে তখন ভেসে আসতে শুরু করেছে অবজ্ঞা; মনুষ্যজীবনের প্রতি ভীষণ রকম বিতৃষ্ণা। আর হয়তো-বা সেই রাত্রির অন্ধকারের ভিতর তখন রাক্ষসপ্রাণ হাহাকার দুলছিল; হয়তো-বা রাক্ষসপ্রাণ হাহাকার লুকাচ্ছিল। সেই হাহাকার রাশির ভিতরে প্রকৃত প্রস্তাবে তখন লুকিয়ে ছিল রাক্ষস-জীবনের আফসোস, মাতা মৃত্তিকা ঘটকির চিরায়ত আকাঙ্ক্ষা।

নিভু নিভু অগ্নি-উৎসবের মাঝে বটবৃক্ষের দীর্ঘভাস্বর একজোড়া ঝুলকাণ্ডের সঙ্গে লেপটে থাকা প্রায় নির্চিহ্ন রাক্ষসির কৃষ্ণ-কর্কশ মার্তৃদেহ তখনো পুড়ছে। মার্তৃমাংস পোড়ার গন্ধ ওই রাত্রিতে পৃথক মাত্রায় ভয়ানক জীবনমুখো, বিচলিত। অগ্নিজিহ্বা ফোসফোসিয়ে উচ্চারণ করছে, বিনাশ করো রাক্ষসজীবন, সম্মুখেই অনন্ত জীবন, সম্মুখেই মনুষ্য জীবন। আর তখন ভীতবিহ্বল গ্রামবাসী রাক্ষসি বিনাশপূর্বক উদ্দেশ্যহীন শেষরাত্রির শিশিরে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠতে থাকলে ঋষি কচ্ছপ মুনি সেই অগ্নিভস্ম গ্রামগোষ্ঠীর মধ্য থেকে উঠে দাঁড়ালো, তার কণ্ঠে শোনা গেল প্রার্থনা, ফসলের দেবতা উষ্ণতার দেবতা আগুনের দেবতা হিমবাহের দেবতা অন্তরীক্ষের দেবতাসকল গ্রহণ কর নৈবেদ্য, মনুষ্যসন্তানদিগকে ধনে পুত্রে ঐশ্বর্যে দীর্ঘজীবী করো, বিনাশ করো রাক্ষসকুল, বিনাশ করো চিরায়ত অন্ধকারতুল্য রাক্ষসরমণী।

সেই প্রভাত-নিকটবর্তী কুয়াশামাখা অন্ধকারের ভিতর দাঁড়িয়ে গ্রামবাসীর অতীব নিকটবর্তী বালকদ্বয় সুখ এবং পরাবত অবলোকন করলো দৃশ্য, রাক্ষসদৃশ্য, অগ্নিদৃশ্য। এক্ষণে এইভাবে একঝাঁক রাক্ষসকুলের মধ্য থেকে বিগত রাত্রিকালিন উৎসবে দুগ্ধপ্রদায়ক রাক্ষসিশরীর দগ্ধ করা হলো।

ঘুমক্লান্ত গ্রামবাসীর নিকট ঘেঁষে রাত্রিজাগরিত বালকদ্বয় ঋষি কচ্ছপ মুনির শরীর থেকে ভেসে আসা উগ্র-প্রাচীন গন্ধ অনুভব করল। ওই উগ্রতার ভিতর, ওই মনুষ্যজাত প্রাচীন গন্ধের নিকটে বসে রইল সুখচার্বাক এবং সখা পরাবত, বিরামহীন ক্লান্তিহীন। আর তখন উভয় বালকের চক্ষু ক্রমশ সজল, ক্রমশ রাক্ষসমাতার কোলে রাত্রিকালিন গুহাঘুমের স্বপ্নদৃশ্য ক্রমাগত সঞ্চরণশীল। বালকদ্বয়ের চেতনায় ভেসে উঠল মাতা মৃত্তিকা ঘটকির প্রাণপ্রিয় হরিণশাবক তৃণমুখির মায়াকাতর চোখ।

মৃত্তিকা ঘটকি হেঁটে যাচ্ছে গিরিপথ ধরে। পদদ্বয়ের সঙ্গে হাঁটছে হরিণশিশু তৃণমুখি। অতঃপর মৃত্তিকা তৃণমুখিকে কোলে তুলে নেয়। সুখচার্বাকের সন্ধানে রাক্ষসির চোখ ব্যাকুল। তৃণমুখির চোখে জলচিকচিক; আর তখনো বালক সুখচার্বাকের সন্ধান পাওয়া না গেলে রাক্ষসির স্কন্ধে ঝোলানো পক্ক কদলির কাধি ঘিরে কয়েকটি মৌপোকা এলোমেলো ছুটাছুটি শুরু করলে দুখানা ঘাসফরিঙ রাক্ষসির কেশদামে নির্বাক নিশ্চুপ শুধু বসেই থাকে আর তখন মৃত্তিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ কণ্ঠে একটানা কী এক মোহনীয় মায়া জাগানিয়া জাদুকণ্ঠে ক্রমশ সু-খ- ধ্বনি উচ্চারণে বনাঞ্চল শিহরিত মায়ামগ্ন, এবং আবারো একটানা ব্যাকুল সু-খ ধ্বনিতে যখন মৃত্তিকা রাক্ষসির বক্ষ উত্তেজিত, ভীতবিহ্বল, তখন শোনা যায় সখা পরাবতের স্বরধ্বনি আ-আ-আ, পরক্ষণেই অতি দূরান্ত থেকে যেন-বা ভেসে এলো সুখচার্বাকের কণ্ঠ, মা-আ-আ-আ।

সেই রাক্ষসরাত্রিতে, অগ্নি-উৎসবের পর সুখচার্বাক অতি প্রত্যূষলগ্নে সখা পরাবতকে পিছে রেখে ক্রমশ সঞ্চরণশীল। হাঁটতেই থাকে। পশ্চিম থেকে পূর্বে, পূর্ব থেকে উত্তরে, উত্তর থেকে দক্ষিণে ক্রমশ বনাঞ্চল, শিলাখণ্ড, পাহাড়প্রপাত, ক্রমশ সমতল, আবারো সমতল থেকে কাকরপথ, বনাঞ্চল। অবশেষে একদা একদিন তক্ষশীলায় আগমন। মঠবাসী বৌদ্ধশ্রমণবৃন্দ প্রার্থনারত। তক্ষশীলার সঞ্চরণশীল বায়ুপ্রবাহ থেকে ভেসে আসছে, এ জগত দুঃখময়, এ জগত মায়ামরিচিকা, সখা পরাবত সেও নিশ্চিত মায়া, মাতা মৃত্তিকা রাক্ষসি সেও মায়াবিভ্রম, বেঁচে থাকার সবটুকুই মায়া, একমাত্র জীবনই সত্য, প্রাণই পরম।

অমোচনীয় অনেপনীয় সনাক্তবিহীন কী এক বিরামহীন বিষণ্ণ যাতনা, ব্যাখ্যাতীত জীবনপিপাসা সুখচার্বাককে কেবল তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ালো। পর্বত থেকে সমতলে, সমতল থেকে পর্বতে, বনাঞ্চাল থেকে মনুষ্যগাঁয়ে, মনুষ্য থেকে বনজ প্রাণিকুল বরাবর তাড়াতেই থাকে ওকে। অবশেষে দ্বাদশ বৎসরের বালক সুখচার্বাক অধ্যক্ষ চার্ণবের মুখোমুখি হলে সুখচার্বাক চার্ণববাক্য শ্রবণে হতবিহ্বল কৌতূহল-দীপ্ত, ম্রিয়মান ও শঙ্কা-ব্যাকুল, ওহে হতদরিদ্র অসহায় নিঃস বালক শ্রবণ করো, পৃথিবী দুঃখময়, জন্মমাত্রই কষ্ট-আশ্রিত, মৃত্যু নামক ব্যাধি থেকেই জীবজগতের উত্থান, তদুপোরি দুঃখসরোবরে মনুষ্যসন্তানের জন্মলাভ দুঃখভোগ সমীপে ন্যাস্ত, তথাপি এহেন হতাশাক্রান্ত মনুষ্য জীবনের জন্য রয়েছে আশার বিদ্যুৎ, রহস্যভরাট আকাঙ্ক্ষা-দীপ্তি, সেই রহস্যের দীপ্তি তোমাকে নিরন্তর ডাকছে…।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu