দর্পণ ডেস্ক
একটি পূর্ণাঙ্গ ম্যাগাজিন। শিক্ষা, সাহিত্য ও গবেষণামূলক ম্যাগাজিন দর্পণ। ২০১৯ সালে ব্যতিক্রমধর্মী ম্যাগাজিন দর্পণ তার যাত্রা শুরু করে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে দর্পণ "গল্পবাজ" ম্যাগাজিন আত্তীকরণ করে।
দর্পণ ডেস্ক

রিভিউ – রহিমা আক্তার মৌ

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

জানি না কয়জন এমন নিয়ম মেনে আইডিতে ফ্রেন্ডের সংখ্যা বাড়ায়। যে যাই করুক আমি নিয়ম মেনেই এড করি। সেই প্রথম থেকেই রিকুয়েস্ট এলে আগে চেনার চেষ্টা করি, এটাও জানি যে হাতে গোনা কয়জন ছাড়া অন্য কাউকে চেনার কথাই নয় আমার। যতবার আইডি খুলেছি সবার আগে সুফিয়াকে কল করে বলেছি– সুফিয়া এই নামে আইডি খুলেছি, তোকে রিকুয়েস্ট দিলাম, গ্রহণ করে নে। তুই গ্রহণ করলেই আমি অন্যদের খুঁজে পাবো।

সুফিয়া কথাটা শুনেই তাই করতো। আর পরিচিত যাদেরকে রিকুয়েস্ট দিতাম ইনবক্সে জানিয়ে দিতাম নিজের সেটুকু পরিচয় যেটুকু দিলে উনারা আমায় চিনতে পারবে। কেন জানি আইডিগুলো আপন করে নিতে চায় না আমাকে। তিন চারটা আইডি ফেল করার পরে এই আইডিতে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি।

অনেকের মতো সেদিন হায়দার রাসেল নামে একজন রিকুয়েস্ট পাঠায়। তেমন চিনতে না পেরে ঊনাকে ইনবক্স করি– কোথায় থাকেন?  কি করেন? রিকুয়েস্ট এর সাথে পরিচয় জানালে লিস্টে নিতে সুবিধে হয়।

ইনবক্স করার সাথে সাথেই হায়দার রাসেল ইনবক্সে পাঠান– রিকুয়েস্ট তুলে নিলাম।

ইনবক্স পেয়ে আমি তো হা! ভাবি ইনি হয়তো বিশেষ সম্মানিত কেউ। ইনবক্সটা মনে হয় ইগোতে খুব লেগেছে। আমার মতো ছাপোষা কেউ ঊনাকে এমন করে প্রশ্ন করবে তিনি তা আশা করেননি।

সেদিকে আর মাথা না ঘামিয়ে নিজের কাজে  মন দিই। এর মাঝে আইডিতে সদস্য বেড়ে যাচ্ছে। যতই বাড়ুক সেই নিয়মের বাইরে গিয়ে কাউকে এড করিনি। ফেসবুক কিছুটা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে আমার। অবশ্য এমনি এমনিই হয়নি। সম্মান আর জনপ্রিয়তা এমন বিষয় এমনি এমনি আসে না। সম্মান করতে জানলে সম্মান আসে। সম্মান দিলে নিজের জন্যেও সম্মান আসে। সবার সাথে সে ভাবেই নিয়ম মেনে চলছি কথা বলছি আর যোগাযোগ রাখছি।

এরপর একদিন একটা আড্ডায় গিয়ে অনেকের সাথে পরিচয় হয়। পাশ থেকে একজন বলে উঠে– আপনি নিশ্চই নীলিমা নায়লা?

– জ্বী, আপনি।

– আমি? তেমন কেউ না।

পাশ থেকে অন্য একজন বলে উঠে– আরে নীলিমা আপু, ঊনাকে চিনতে পারোনি। উনি তো বিশিষ্ট হায়দার রাসেল।

– আচ্ছা, আচ্ছা। তাহলে আপনিই হায়দার রাসেল। ফেসবুকে রিকুয়েস্ট দিয়েছিলেন। আমি পরিচয় জানতে চেয়ে ইনবক্স করেছি বলে রিকুয়েস্ট তুলে নিয়েছেন।

কথাটা শেষ হতে না হতেই কথা চলে যায় অন্য দিকে। হায়দার সাহেব কথাগুলো ঠিকই শুনেছেন, তবে জবাব দেয়নি। সেদিন বুঝিনি হায়দার সাহেব ইচ্ছে করে জবাব দেননি নাকি জবাব এড়িয়ে গেলেন। অনেকের সাথেই পরিচয় হয়েছিল সেদিন। এমন আড্ডায় খুব একটা যাওয়া হয় না, আসলে সময় সুযোগ হয় না বলেই যাওয়া হয় না।

আড্ডার ভিআইপি না হলেও সবার দারুণ গল্প হয়, আড্ডাগুলোর বিশেষ একটা আকর্ষণ হলো ছবি তোলা। সে দিকেও কিছুটা কিপটে স্বভাবের আমি, বেছে বেছে দু-চারটা ছবি তুলবো, তাও আবার যার তার ক্যামেরায় নয়। কারণ ছবি তুলেই সাথে সাথে অনেকে ফেসবুকে দিয়ে দেয়।

সেদিন আড্ডা শেষ করে বাসায় চলে আসি। অনেক জায়গায় আড্ডার দাওয়াত পড়ে, কিন্তু যাওয়া হয় না। এটা অনেকেই বুঝে যায়। এর মাঝে প্রায় অনেকদিন পার হয়। অনেকের সাথে এখানে ওখানে দেখা হলেও হায়দার সাহেবের সাথে দেখা হয়নি।

বিভিন্ন কাজের সাথে জড়িত আমি, তবে যখন যে কাজ করতে ইচ্ছে করে তাই করি। নিজের কিছু নিয়ম নীতি মেনেই সামনে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করি। একটা বিশেষ কাজ হলো লেখালেখি, লেখা জমা দেবার জন্যে কখনোই কারো অফিসে যাইনি, যাওয়ার প্রয়োজনও হয়নি।  ইমেইলেই দিতাম, আর তা না হলে কুরিয়ার বা পোস্টে পাঠিয়ে দিতাম। সময় মতো সেগুলো সংগ্রহও করতাম। প্রায় সময় কুরিয়ারেই আসে কপিগুলো।

পারিবারিক কাজেই সেদিন বের হই শাহবাগে। জাদুঘরের সামনের রাস্তায় দেখা হায়দার সাহেবের সাথে। দুজন দুজনকে চিনতেও পারি। হায়দার সাহেব বলেন– আসুন, পাশেই আমাদের অফিস। চা খেয়ে যান।

– অন্য একদিন আসবো। আজ তো জেনে গেলাম। এদিকে আশা হয় মাঝে মাঝেই।

সেই দেখার কিছুদিন পর আবারো সেই পথে। ওই একই ভবনে আমার কিছু কাজ ছিলো। তাই উপরে উঠা। একা নয়, সাথে আছে ম্যানেজার সাহিদা। পাশাপাশি  হায়দার রাসেলের অফিস হওয়াতে যাই ঊনার অফিসে, ঊনিও উপস্থিত ছিলেন। অফিসে আরো দু-তিনজন ছিলেন। কথা প্রসঙ্গে উঠে সেই ফেসবুকের কথা। হায়দার সাহেব স্বীকার করে সে কথা। আমার ইনবক্স পেয়ে তিনি রিকুয়েস্ট তুলে নেন। অবশ্য পরে আমি নিজেই রিকুয়েস্ট পাঠাই, আর হায়দার সাহেব রিকুয়েস্ট গ্রহণ করেন।

কিছুক্ষণ কথা হবার পর ফেরার জন্যে উঠি, হায়দার সাহেব নিজের কয়েকটা বই তুলে দেন আমার হাতে। দিয়ে বলেন– আপনিতো অনেক কাজ করেন, এবার আমার বইগুলোর রিভিউ লিখে দিন। আমার খুব ইচ্ছে আপনি আমার বইগুলোর রিভিউ লিখেন। লিখে আমায় দিবেন, আমিই পত্রিকায় প্রকাশের ব্যবস্থা করবো। বইগুলো  হাতে নেয়ার আগেই বলি– আমি পড়তে পারি। তবে রিভিউ লেখা সম্ভব নয়, আমি কখনো লিখিনি।

– আরে রিভিউ লেখা খুব একটা কঠিন নয়। প্রথম দিকের কয়েকটা লেখা আর শেষ দিকের কয়েকটা লেখা পড়লেই পারবেন।

ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও বইগুলো নিয়ে আসি। কয়েকটা লেখা পড়ি, কিন্তু রিভিউ!  তা সম্ভব নয় আমাকে দিয়ে। বইগুলো রেখে দিই নিজের ছোট লাইব্রেরিতে।

মাস ছয়ের মাঝে হায়দার সাহেবের সাথে আর দেখা নেই। একটা প্রোগ্রাম থেকে ফেরার পথে দেখা হায়দার রাসেলের সাথে। সেদিনও তিনি একটা বই দেন হাতে, দিয়ে বলেন– যেভাবেই হোক আপনি এই বইয়ের রিভিউ লিখে দিন।

চেষ্টা করবো বলে সেখান থেকে বিদায় নিই।

কয়েকবার পড়েছি বইটি, কিন্তু রিভিউ লেখা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। বেশ কিছুদিন পরের কথা। মোবাইলটা সাইলেন্ট করা ছিলো, হাতে নিয়ে দেখে ছয়টা মিস কল উঠে আছে, নাম বের করে দেখি সাহেদ রাজিবের। সাহেদ নায়লার ফেইসবুক বন্ধু। থাকে দেশের একেরাবেই অন্যপ্রান্তে। সাহেদের নাম্বারে কল ব্যাক করে। কুশল বিনিময় করার পর সাহেদ বলে– যে কারণে কল করেছি। কাল আপনার ঠিকনায় একটা বই পাঠাবো, যেভাবেই হোক তিন-চার দিনের মাঝে বইটির রিভিউ লিখে দিতে হবে। আমাদের আঞ্চলিক পত্রিকা আর একটা জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশ করার কথা পাকা হয়েছে।

– সরি ভাই, আমার দ্বারা সম্ভব নয়। আমি কখনো রিভিউ লিখিনি। তবে আমি কয়েকমাস সময় নিয়ে রিভিউ লেখার জন্যে প্রস্তুতি নিবো। কিন্তু এই মুহূর্তে নয়।

– আপনি সরি বলছেন। এ আমি কি শুনছি, এত কাজ করেন আর আজ বলছেন পারবেন না।

– আসলে পারবো না তা বলিনি। বললাম প্রস্তুতি নেই।

কথা শুনে একটু মন খারাপ হয়েছে সাহেদের। কিন্তু করার কিচ্ছুই নেই আমার।

– আমি খুব আশা নিয়েই কল করেছি নায়লা আপু।

– আসলে সাহেদ ভাই, আমি রিভিউ লেখার জন্যে নিজেকে তৈরি করতে চাই। ইদানীং হাতে অনেক কাজ, এই কাজগুলো সামলে নিয়েই দু-তিন মাস সময় নিব। এরপর থেকেই রিভিউ লেখা শুরু করবো। কথা দিচ্ছি তখন লিখে দিব। আপাতত অন্য কাউকে দিয়ে করিয়ে নিন।

খুব একটা অবসর সময় পাই না, তবে যেটুকু পাই চেষ্টা করি সেই সময়টুকু নিজের কাজের জন্যে ব্যয় করতে। যদিও সাহেদকে বলেছে প্রস্তুতি নিয়ে রিভিউ লিখবে, আর তার জন্যে সময়ও দরকার। কিন্তু মাঝে মাঝে বিভিন্ন পত্রিকার রিভিউগুলো মন দিয়ে পড়ি। রিভিউ মানে বই আলোচনা। শুধু বই নয়, বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন বা ছোট কাগজগুলোর ও রিভিউ বা আলোচনা লেখা হয়। একটি বইয়ে বা ম্যাগাজিনে কি আছে, কোন বিষয়কে মাথায় রেখে লেখক বা সম্পাদক বইটি বা ম্যাগাজিনটি করেছে, তা বুঝতে হবে, সহজ ভাষায় নিজের মতো করে বইটা নিয়ে কয়েক লাইন লিখতে হবে।

সামনেই বই মেলা, মেলা নিয়ে অনেকের অনেক আয়োজন থাকে। আমারও কিছু কিছু আয়োজন আছে। তবে তা সীমিত। এই সীমিত আয়োজনেই সেরে ফেলতে হবে নিজের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো। মেলায় যাওয়ার আগেই কিছু লিস্ট করি, সেভাবেই যাওয়া আর আসা। এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি না করে সোজা লিস্ট করা স্টলগুলোতে। সেভাবে যাওয়া হয় ‘গল্পকার’ এর স্টলে। গল্পকারের সম্পাদক মুহাম্মদ মুহিউদ্দিন ভাইকে আগে থেকেই চিনি। ভাই একটা বই দেখান। বইটার উপরে শুধু গল্প দেখেই বইটা নিয়ে আসি। বাসায় এসে দেখি বইটির নাম “বরেণ্য লেখকদের প্রথম বই প্রকাশের গল্প”। নামটা দেখলেই বুঝা যায় ভিতরে কি থাকতে পারে। কিন্তু কেনার সময় এতকিছু ভেবে কেনা হয়নি। শুরু করি বইটা পড়া। লেখালেখি করলেও আমি খুব একটা দ্রুত পড়তে পারি না। দ্রুত পড়লে ভুলে যায় আগে কী পড়েছি। তাই মন দিয়ে একটু সময় নিয়েই পড়তে থাকি। প্রথম দিনেই অর্ধেক পড়ে ফেলি। মনে এতটাই আনন্দ লাগছে পুরোটা পড়তে তেমন সময় লাগেনি। কেন জানি পড়তে পড়তেই বইটাতে কিছু আঁকিবুকি করি। পড়া শেষ করেই ভাবি– এই বইয়ের রিভিউ দিয়েই শুরু করি লেখার জগতের আরেকটা দিক। বরেণ্য লেখকদের কিছু কথা আর নিজের মনের সহজ কথাগুলো দিয়েই লিখে ফেলি প্রথম রিভিউ।

অসাধারণ কিছু বিষয় জানতে পারি বইটা পড়ে। এই আমি বা আমরা কত ব্যস্ত নিজেদের লেখা নিয়ে, পত্রিকায় প্রকাশ করা আর বই প্রকাশ নিয়ে। শুধু কি তাই? নিজের বইয়ের রিভিউ লিখে দেয়ার জন্যে কতজনের কাছে যাই, কত তোষামোদি করি। কিন্তু বুঝতে চেষ্টা করিনা যে লিখলেই কিন্তু লেখা হয়না, লেখা হতে হবে পাঠকের পড়ার মতো। লেখা হতে হবে সমাজ সংস্কৃতি আর যুগোপযোগী। পত্রিকায় পাঠালেই শুধু হয়না, লেখাটির প্রকাশের যোগ্যতা থাকতে হবে। লেখার বিষয় বুঝাতে হবে, পাঠক যেনো বুঝতে পারে কি লিখতে চেয়েছে লেখক। আর কি লিখে ভাব প্রকাশ করেছে। কেউ কিছু বললেই লেখা যায় না। লেখার জন্যে নিজেকে তৈরি হতে হয়। বর্ণমালা গুলোকে সাজিয়ে লিখে দিলে শব্দ হবে, শব্দ সাজালেই বাক্য হবে, আর বাক্যকে সাজালেই লেখা ঠিক হবে। তবে সব লেখা পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। আর লিখলেই যে বই প্রকাশ হবে তাও নয়। বই করে কাউকে ধরিয়ে দিলেই কিন্তু বইয়ের রিভিউ বা আলোচনা করা যায় না। যে বিষয়ের বই সে বিষয় সম্পর্কে রিভিউ লেখার যোগ্যতা তার থাকতে হবে।

কিছু রিভিউতে দেখছি লেখকের অনেক কথাকেই তুলে ধরেছে অনেকে হুবুহুভাবে। এটাও আমার কাছে ভালো লাগেনি বলে বইয়ের প্রথম আর শেষ পড়ে রিভিউ লিখতে চাইনি। রোদ্র আর অভ্র খুব এক্সাইটেড, আমি বই পড়ে আবার রিভিউ লেখার কথা ভাবছি। কিছু কিছু বই ওরাই বেছে দেয়। পড়তে বলে। অভ্র এনে দেয় জয়নাল আবেদীন এর লেখা “আরাকান থেকে বাংলাদেশ” মূলত আরাকান শব্দটা না বুঝার কারনেই এটা পড়তে দেয়া। পড়ার আগেই ওকে বলেছি, এটা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর নির্যাতন নিপীড়ন নিয়েই লেখা।

শুরু করেছি পড়া। একটু পড়তেই অভ্র জানতে চায় কী হয়েছে। আবার পড়ি, আবার ওকে বলি। কিন্তু বইটির কোথাও দাগ টানা হয়নি। পড়ার পর অভ্রই বলে বইটি নিয়ে দুটো কথা লিখতে। চেষ্টা করি লেখার। লিখলাম। রৌদ্র পড়ে বলেছে– দারুণ হয়েছে মা। তবে একটা কথা বলি, তুমি গদ্য নিয়েই কাজ করো। ইচ্ছে হলে পদ্য লিখো, তবে তা নিয়ে কাজ করো না।

আমি ওর কথাটা বুঝতে পারি। কিন্তু ভাবনায়ও পড়ি, হায়দার আকবরের বইয়ের রিভিউ কখনো আমার লেখা হবে কিনা। জানি চলতে পথে দেখা হবে, কথা হবে।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu