আচমকা ঘুম ভাঙতেই ঝটকা মেরে উঠে বসলো নিশে, ‘ক্কে- কে—ডা?’
‘ইজ্ঞে আমি গো ভ্যানঅলা। ভয় পালা নেকি?’
‘ভয়? কে– ক্কেনে?’
নিশেকে ওভাবে তড়াক করে লাফিয়ে উঠতে দেখে হেসেই উঠতে যাচ্ছিলো বোধকরি লোকটা। কিন্তু হাসলো না। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা হাসি সামলে নিল বহু কষ্টে। বললো, ‘ইজ্ঞে তোমার ভাব সাব দেহে তো ত্যামন-ই মনে হচ্ছে গো।’
প্রথমটা নিশের মনে হয়েছিল ঘরের ভেতর নিজের বিছানাতেই শুয়ে আছে বুঝি। লোকটার ডাকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে আশে-পাশে হাতড়ে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করলো। নিদেনপক্ষে কোনও লাঠি বা আলো জ্বেলে দেখা যায়— এমন কিছু। কিছু তো পেলো না, উল্টে ভেতরের চমকানিটা তার দুই চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সেখানে রাজ্যের বিস্ময়। কে হবে লোকটা? তার চাই-ইবা কী? চোর টোর নয় তো! কি যে করে এখন! হাতের কাছে নেইও কিছু এমন সময়। আচ্ছা, দরজা তো সারারাত বন্ধ থাকে। তাহলে লোকটা ঢুকলো কী করে?
নিজেকেই প্রশ্নটা করে ফেললো নিশে। আর অমনি তার খেয়াল হল— নাহ্, বিছানা কই? সে তো দেখি তার ভ্যানরিকশাটার মাচালেই বসে আছে। মাথার ওপর বড়ো তেঁতুল গাছটার ঝাকড়া মাথায় একরাশ জমাটি আঁধার ফুঁড়ে নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে একঝাঁক জোনাকি। খানিক দূরে রাখোহরির চায়ের দোকানে জনা পাঁচ-ছয় লোক বসে জটলা করছে এখনও। পাশের দোকানগুলোয় দুপুরবেলার মতো ভিড় না থাকলেও এক আধজনার গলা যে সেখান থেকে ভেসে আসছে তা বুঝতে পারলো নিশে। আর তাতে এটাও বুঝতে পারলো বাজার এখনও খোলা। তবে গো হাটায় আসা মানুষগুলো যে ফিরে গেছে অনেক আগেই, তা এই হাটের ঝুলকালি মাখা আঁধার আর নির্জনতাই বলে দিচ্ছে।
মাঝপথে ঘুম ভেঙে যাওয়াতে চোখ দুটো বিদ্রোহ করে উঠতে চাইছিলো বারবার। দুই হাতের তালুতে বেশ করে ঘঁষে নিয়ে সেই বিদ্রোহকে সামাল দিতে দিতে পেছনের কথাগুলো স্মরণ করার চেষ্টা করলো নিশে। আর অমনি বর্ষাকালে ছেঁড়া-ফোড়া মেঘের ফোঁকর দিয়ে রোদ বেরনোর মতোই উঁকি দিতে শুরু করলো ঘটনাগুলো। না, দিনটা তো বেশ ভালোই শুরু হয়েছিলো তার। সেই কোন ভোর ভোর নিজে হাতে চাট্টি ফুটিয়ে খেয়ে তার পক্ষীরাজ ভ্যানরিকশাটা নিয়ে বেরিয়েছিল সে। ফি বিষ্যুদবার মেদের হাটের একপাশে গো হাটা বসে। রাজ্যের ভীড় হয় এখানে। কত লোকের আনাগোনা। ভ্যানরিকশা চেপে কত লোক আসে। কত লোক যায়। সেসব লোক ধরার তাগিদে আজও একটু সকাল সকাল বেরিয়েছিল সে। সারাদিন লোক টেনে রোজগারও হয়েছিল বেশ। শেষে বিকেলের মুখে শরীরটা ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়ে এলে তেঁতুল গাছটার গোড়ায় ভ্যানটাকে লাগিয়ে খানিক জিরেন দিতে গড়িয়ে দিয়েছিল গা-টা। সে কিনা সেই কোন বিকেলের কথা। আর এখন—
কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল কে জানে। এতসব চেনাজানা মানুষজনও ছিল অথচ একটিবার কেউ যাওয়ার সময় ডেকেও তুললো না তাকে?
‘সব শালা হারামী।’
মনে মনেই গালটা দিল নিশে। কিন্তু ঠিক কাকে যে দিল তা বুঝলো না নিজেও। আসলে ঘুমের ঘোরটা এখনও তার দু’চোখে লেগে আছে যে—
‘ব্যাপার কী কও দেহি? এই অ সমায় এমন পড়ে পড়ে ঘুমাতিছো। নেশা টেশা করো নাই তো?’
‘নেশা? কেডা?’
‘কেডা আবার, তুমি।’
বড়োসড়ো একটা হাই এসে ভেতরের জড়তা অনেকখানি সরিয়ে দিল নিশের। মাথাটাকে বার দুই ঝাঁকিয়ে নিয়ে বড়ো বড়ো চোখে সামনের দিকে তাকালো সে। না, জায়গাটা একটু আবডালে হওয়ার জন্য আলো টালো এখানে বেশ কম। আর কম আলোয় মানুষটার মুখটা দেখাও যাচ্ছে না স্পষ্টভাবে। গলার স্বর শুনে অবশ্য অচেনা মনে হচ্ছে। কোমরে দেশলাই আছে নিশের। একটা কাঠি বের করে জ্বালবে নাকি?
‘ঘুম ডা ভাঙলো তোমার?’
লোকটা-ই আগ বাড়িয়ে শুরু করলো ফের। নিশের মাথার ভেতর একটা চরকি বার কয় ঘুরে থেমে গেছে। এখন সে অনেকটা স্বাভাবিক। ঘুমের ঘোরটা কাটছে একটু একটু করে। দু চোখের পাতা স্বাভাবিক হয়ে আসছে। একটু আগেও দুই কানে ঝিঁঝিঁর ‘ভোঁ’ লেগে ছিল। এখন তা অতটা নেই।
ভ্যানের ওপর বিছিয়ে রাখা গামছাটা তুলে মুখ চোখ মুছে নিল নিশে। তারপর জিজ্ঞেস করলো, ‘কি কবা কও।’
রাত বাড়ছে। এখন আর ভনিতা করার সময় নেই লোকটার। তার পৌঁছোতে হবে চার ক্রোশ দূর। একে অমাবশ্যার রাত। তার ওপর গ্রাম্য কাঁচা রাস্তা। পা এদিক পড়তে গিয়ে ওদিক পড়ে। হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেতে হয়। ভরসা বলতে এখন অগতির গতি এই ভ্যানঅলা।
লোকটা জিজ্ঞেস করলো, ‘যাবা নেকি?’
নিশে প্রশ্ন করলো, ‘কোথা?’
‘বেশি দূর নাগো। ভবানীপুর।’
‘ভ-বা-নী-পু-র? বাপ রে। সে যে অনেকখানি পথ। এই আন্ধার রাইতে— না গো, যাবো না।”
‘কিন্তুক আমার যে যেতি হবে গো।’
‘তা যাও না। মানা করছে কেডা?’
‘না, মানা আর কেডা করবে। তয় কইছিলাম যে তুমি যদি—’
‘না, আমি যেতি পারবো না। এমনিতে অনেক রাত হইয়ে গেছে। অন্যরা কহন ফিরে গেছে বাড়ি। কেবল আমিই—’
‘নেশা করছিলে নেকি?’
‘নেশা? তা বিড়ি টিড়ি খাই বটে। তয় আর কিছুর নেশা আমি করি নে।’
‘তালে তো মানুষ তুমি মন্দ না।’
‘কি জানি।’
‘কি জানি মানে? মানুষ তো নিজিরিই বেশি জানে।’
‘হবে হয় তো। আমি কিন্তুক ওইভাবে ভাবি নেই কোনো দিন। আচ্ছা রাত কত হল কও দেহি?’
‘তা মন্দ হয় নাই বটে।’
‘তা এই রেতের বেলা তোমারইবা অতখানি পথ যাবার কিবা এমন দরকার শুনি?’
‘মেইয়ের বাড়ি যাবো না?’
‘মেইয়ের বাড়ি? তা দিন থাকতি থাকতি গেলি কী এমন অসুবিধে হত?’
‘আমার বাড়ি কি আর এখেনে? সে যে বহুদূর গো ভ্যানঅলা।’
‘খালি ভ্যানঅলা ভ্যানঅলা না ক’য়ে নাম ধইরে তো ডাকতি পারো।’
‘নাম?’
‘হ, নাম। আমার নাম নিশে।’
‘নিশে?’
‘নিশেপতি রায়।’
‘বাহ, বেশ নাম তো তোমার।’
‘মানষে তাই কয় বটে।’
কথায় কথায় ঘুমের ঘোরটা কখন কেটে গেছে নিশের। আর এতক্ষণ ঘুমোনোর কারণে শরীরের সে ক্লান্তির ভাবটাও আর নেই। চোত মাসের রাত। দক্ষিণের দিক থেকে বেশ একটা নরম শরম হাওয়া বইছে। সে হাওয়ার ছোঁয়াতেই কিনা কে জানে তার মাথার ভেতর বেশ একটা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়েছে। কেবল এতক্ষণ ধরে গো হাটার মশাগুলোর কামড়ের জায়গায় হালকা যা খানিক জ্বলুনি। এটুকু অবশ্য গা সওয়া নিশের। প্রতিদিন এমন কত কামড়ই না খায় সে। খাটাখাটনির শরীরে ওটুকু তার মালুম হয় না।
রাত্রি বাড়তে থাকার কারণে লোকটার ভেতরেও বাড়তি একটা তাড়া। বলল, ‘পঞ্চাশ ডা ট্যাকা না হয় ধরেই নিও।’
‘কিন্তুক এত রাতে অতখানিক পথ—’
‘আমি যে বড়ো বেপদে পড়িছি বাপ। বিদেশ বিভুঁইয়ে এত রাতে পথ চলা। অচেনা অজানা পথঘাট। কহন যে কি বেপদে পড়ি। চোর ডাকাইত—’
লোকটা এমন করে ‘বাপ’ বলে ডাকলো যে ভেতরটা বুঝি ঈষৎ ভিজে উঠলো নিশের। তার ওপর ভেবে দেখলো সত্যিই বড়ো বিপদে পড়েছে মানুষটা। সেই কতদূর কোন এক গাঁ থেকে এসেছে। মেয়ের বাড়ি এখনও কতখানি দূর। বুড়ো মানুষ একা হেঁটে এতখানি পথ—
ভ্যান থেকে নেমে পড়লো নিশে। হ্যান্ডেলে হাত রেখে বললো, ‘ঠিক আছে, ওঠো। তয় ভাড়া কিন্তুক পুরোপুরিই দিবা।’
‘মানে?’
‘ওই যা ক’লে— পঞ্চাশ ট্যাকা বাড়তি। সাথে ভাড়া আর পঞ্চাশ। মানে হল গে একশো।’
‘ঠিক আছে, দেবানে।’
লোকটা ভ্যানে উঠে বসার উপক্রম করতেই নিশে দেখতে পেল লোকটার দু হাতে বেশ ভারী ভারী দুটো ব্যাগ। অনেকদিন পর মেয়ের বাড়িতে যাচ্ছে বোধকরি। মেয়ের মা নির্ঘাত সঙ্গে করে দিয়ে পাঠিয়েছে অনেককিছু। গাঁ গেরামের এই এক অদ্ভুত নিয়ম। বাপ মা মেয়ের বাড়িতে খালি হাতে আসে না। গাছের আম, তাল, খেতের কলা, মুলো, ঘরে ভাঁজা মুড়ি, নারকোল নাড়ু— যার যেটুকু আছে মেয়ের বাড়িতে না পাঠালে মনে সুখ পায় না। কত আদরের মেয়ে। পরের ঘরে কতটুকু কি খেতে পায় না পায়— বাপ মায়েরা সঙ্গে করে যেটুকু পারে নিয়ে যায়। বাপের বাড়ির জিনিস পেয়ে মেয়ে খুশি। মেয়ের খুশিতে মা-বাপ খুশি।
হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ভ্যানটা পথ মুখো করতে করতে নিশে জিজ্ঞেস করলো, ‘তা এতখানি রাইতে কিরাম ভাবে আলে?’
এতক্ষণ লোকটার মনে সংশয় ছিল মেয়ের বাড়ি পর্যন্ত কিভাবে যাবে। একে দুই পায়ে বয়সের ভার, তার ওপর হাত জোড়া অমন দু খানা ব্যাগ। এখন নিশে ভ্যান নিয়ে যেতে রাজি হওয়ায় ভেতরের সে সংশয় কেটে গিয়ে বেশ একটা ফুরফুরে অনুভূতি টের পেল লোকটা। তার বেশ ভালোও লাগলো নিশেকে। ভ্যানের ওপরে নড়েচড়ে বসলো সে। তারপর বললো, ‘অনেকখানি আগেই পৌঁছানোর কথা ছেল, বুঝলে। তা বাসটা মাঝপথে সেই যে দাঁড়ায়ে গেল আর নড়ার নাম ডা নাই। কি হইছিল কেডা জানে। যহন ছাড়লো তহন রাইত হইয়ে গেছে। তারপরেও তো আবার এই এ্যাত্তোখানি পথ।’
গো হাটার আঁধার থেকে ভ্যান নিয়ে বাজারের আলোয় এসে পড়লো নিশে। সে আলোয় চোখটা সয়ে নিয়ে বললো, ‘যদি ঘুমায়ে না পড়তাম তালে তো আর আমারে পাতে না। কী হত তহন কও দেহি?’
লোকটার যেন এতক্ষণ কোনও দুশ্চিন্তা-ই ছিল না মনে ভাবখানা এমন করে বললো, ‘বাদ দেও দেহি ও কথা। তার চে কও যেতি কতক্ষণ লাগবে।’
‘আন্ধার রাইত। এতখানি পথ। তা ধরো ঘন্টা খানিক।’
‘এক ঘন্টা? তোমার তো খুব কষ্ট হইয়ে যাবেনে।’
না হেসে পারলো না নিশে। জীবনে এই প্রথম কাউকে দেখলো ভ্যানঅলার কষ্টের কথা ভাবতে। এতদিন যাদেরকে সে তার ভ্যানে তুলেছে তারা সকলেই এক— দু টাকার জন্য কতই না দরাদরি করেছে। আর এই মানুষটা—
‘কি হল? ভাবো কী?’
উত্তর দিল নিশে, ‘আমি হলাম গে ভ্যানঅলা। কষ্টের কথা আমাগের ভাবলি চলে?’
‘ভ্যানঅলা কি মানুষ হয় না?’
‘তা অবশ্যি হয়।’
‘তালে?’
‘না, মানে—’
কথা বলতে বলতেই ভ্যান নিয়ে রাস্তায় এসে পড়লো নিশে। এবড়ো থেবড়ো অসমান ইটের রাস্তা। এখানে ওখানে আবার ছোটোখাটো গর্ত। ইট উঠে গিয়ে নিচের মাটি বেরিয়ে পড়েছে। চাকাটা তেমন একটা গর্তে পড়ে যেন কঁকিয়ে উঠলো। ভ্যানের ওপরে বসা লোকটা দু’হাতে ব্যাগ দুটো চেপে ধরে বললো, ‘এ কিরাম রাস্তা? গাঁয়ে নেতা টেতা নাই নেকি?’
পায়ের পাতায় প্যাডেলে জোর চাপ দিতে দিতে নিশে বললো, ‘অধিক সন্ন্যেসীতে গাজন নষ্ট। নেতা নাই মানে? ঘরে ঘরে নেতা।’
‘বলো কী? তালে রাস্তার এই হাল ক্যান?’
‘ওই যে কলাম অধিক সন্ন্যেসী—’
‘আচ্ছা বাপ, ইদিক কোন পাটির জোর?’
‘না গো, সে খপর তোমায় আমি দিতি পারবো না।’
‘ক্যান?’
‘ও সপ নে মাথা ঘামাবার সমায়ই পাইনে।’
‘এট্টা বিড়ি খাবা নেকি?’
‘দেও যদি তালে খাতি পারি। কিন্তুক অহন না। খানিক পথ পেরোয়ে নিই। গায়ে খানিক ঘাম ঝরুক। পায়ে টুস ঝিম ধরে আসুক। এই তো সবে উঠলাম।’
‘আমার কিন্তুক এট্টা খাতি পারলি বড়ো ভালো হত। কত পথ পেরোয়ে আলাম। শরীলডার ওপর দে ঝক্কি গেল কত। এট্টা বিড়ি না খালি—’
‘তা খাও না ক্যান?’
‘তোমার সামনে একা একা—’
‘এট্টা তো মাত্তর বিড়ি। দই সন্দেশ তো আর না।’
‘তুমি কিন্তুক ভালো কথা কও ভ্যানঅলা।’
‘আবার ভ্যানঅলা?’
‘নিশে।’
‘নিশেপতি। নাম ডা ক্যামন সোন্দর দ্যাহো। অথচ ভাগ্য?’
‘ভাগ্য বুঝি তোমার খারাপ? তা সোংসারে আর কেডা কেডা আছে?’
‘আমি ছাড়া সোংসার আছে বলতি রাত্তিরকালে মাথা গোঁজার ঠাঁই— ছোট্ট একখান পাটকাঠির বেড়া দেওয়া ঘর। ঘরের সামনে ফালি উঠোন। গোডা দুই আমগাছ। আর মাথার ওপর এই বড়ো আকাশ ডা।’
‘আর ঘরণী?’
‘সে আমার ভাগ্যে নি কো।’
‘বলো কী ভ্যানঅলা?’
‘নিশে।’
‘ইজ্ঞে নিশে।’
‘আমার মার বড়ো সাধ ছেল আমারে বে দে সোন্দর এট্টা বৌ আনবে ঘরে। নাতি নাতনি কোলে নেবে। কিন্তুক—’
‘কিন্তুক কী?’
‘মা ডা হঠাৎ করে মরে গেল। আমার ও আর বে হল না।’
‘ক্যান? বে হল না ক্যান?’
‘কেডা দেবে? এট্টা বে করার কত ঝামেলা কও দেহি। আমি একলা মানুষ। কোনও মেইয়ের বাপ তো আর বাড়ি এস্যে মেইয়ে দে যাবে না। আগে তো তারে পস্তাব দিতি হবে। নিজির বে’র কথা নিজির মুহে—’
কথায় কথায় সময় যায়। রাতের আঁধার আরও গাঢ় হয়ে আসে। ঝোপঝাড়ের মাথায় মাথায় একটু যেন কাছাকাছি সরে আসে জোনাকির আলো। আকাশের তারারা পশ্চিমে সরতে থাকে। গাঁ গেরামের প্রকৃতি নিস্তব্ধ, নিঝুম। রাত্রি কত হল কে জানে। আকাশের তারা দেখে ঠাওর পায় না নিশে। প্যাডেলে চাপ দিতে দিতে তবু ঘাড় কাত করে আকাশের দিকে তাকায়। অসমান ইটের রাস্তায় ভ্যানের চাকা অন্ধকারে পথ চলতে গিয়ে হোঁচট খায় বারবার।
আর এভাবে চলতে চলতে গায়ে ঘাম ঝরতে শুরু করলে পা দুটো খানিক জিরেন দেওয়ার জন্য থামলো নিশে। রাস্তাটা এখানে একদম ফাঁকা। দুই ধারে ধানি জমি। চোত মাসের রোদ নির্ঘাত দুপুর বেলায় এখানে আগুন ঝরায়। এখন এই রাতের বেলায় দেখে তেমনটা অবশ্য মনে করার উপায় নেই। দারুণ মনোরম একটা দক্ষিণের হাওয়া বইছে। এটা বসন্তের হাওয়া। তবে তার গায়ে ফুলের গন্ধের চেয়ে ভেজা একটা সোঁদা গন্ধই বেশি মিশে আছে। দুই পাশের জল জমা ধানখেত থেকে উঠে আসছে গন্ধটা। এক এক সময় গন্ধটা বড়ো টানে নিশেকে। তখন কেবল মনে হয়— ইস, এক ফালি নিজের জমি যদি থাকতো—
রাস্তার একপাশে ভ্যানটাকে দাঁড় করিয়ে সিট থেকে নেমে পড়লো নিশে। আধঘন্টার ওপর একটানা চালিয়ে পা দুটো টনটন করছে। মাথার ভেতরে হাজার ঝিঁঝিঁর ডাক। গায়ের জামাটা ঘামে জবজবে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে। খানিক জল খেতে পারলে বেশ হত। সেই কোন বিকেলে ভ্যানের ওপর শুয়ে পড়ার আগে দু ঢোক খেয়েছিল। গলাজুড়ে কেমন একটা কেঠো অনুভূতি। কিন্তু এখন এই রাত বিরেতে এমন ফাঁকা মাঠের মাঝে জলই বা পায় কোথা। কোমরে প্যাচানো গামছাটা খুলে চোখ-মুখ-ঘাড়ের ঘামটা মুছে নিয়ে লোকটাকে বললো, ‘কই, দেও দেহি।’
হঠাৎ করেই যেন চমকে উঠলো লোকটা, ‘কী?’
‘বিড়ি।’
‘ও।’
লোকটার গলায় আশ্বস্ত হওয়ার একটা সুর টের পেল নিশে। লোকটা বিড়ি দেশলাই বের করে প্রথমে নিজে ধরালো একটা। তারপর এগিয়ে দিল নিশের দিকে।
বিড়ি ধরিয়ে বড়োসড়ো এক টান দিয়ে নিশে বললো, ‘ওহ, মাথা ডা য্যান হালকা হইয়ে গেল।’
স্বস্তির শ্বাস ফেললো লোকটাও। সেই কখন থেকে নেশাটা চেপে ছিলো ভেতরে। বিড়ির ধোঁয়া পেটে যেতেই অনেকটা সুস্থ বোধ করলো সে। চোখে মুখে ফুটে উঠলো একটা তৃপ্তির আভাস। এমনটা নিশেরও হলো। তবে রাতের আঁধারে কারোরটা কারোর চোখে পড়লো না।
বিড়ি টানতে টানতে একবার আকাশের দিকে তাকালো নিশে। কত যে তারা বেল কুঁড়ির মতো ফুটে আছে সেখানে। আচ্ছা, তারাদের গায়েও কী গন্ধ হয়?
লোকটা জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হল নিশেপতি, কী ভাবো?’
বিড়ির শেষটুকু আঙুলের টোকায় সামনের ধান জমির মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিশে বললো, ‘জগতে ভাবার জিনিসির কি শ্যাষ আছে?’
‘না, তা অবশ্যি নাই। তবু সবাই তো আর সব জিনিস নে ভাবে না।’
‘তাগের অত কিছু ভাবার সমায় কোথা? বৌ, ছেলে, মেইয়ের কথা ভাবতি ভাবতিই তো সমায় চল্যে যায়। অন্য কথা ভাববে কহন?’
‘যদি কিছু মনে না করো তো তোমারে এট্টা কথা কই ভ্যানঅলা?’
‘নিশে।’
‘ইজ্ঞে নিশে।’
‘তোমার মুহে তুমি কবা, আমি আবার কি মনে করবো?’
‘তুমি এট্টা বে’ করো। নতুন একখান সোংসার হোক। নতুন একখান ঘর। গোবর লেপা উঠোন। উঠোনের পাশে তুলসী চারা। সনঝেবেলায় পিদিম জ্বলবে। শাঁখ, উলুর আওয়াজ ওঠপে। সারাদিন ভ্যান চালায়ে গে দাওয়ায় বসলি তালপাখা নেড়্যে বাতাস দেবে। জলের গেলাস এগোয়ে দেবে। তারপর—’
আচমকা কোথায় যেন তীব্র একটা সুখের আকুতি অনুভব করলো নিশে। কোনো দিন এমনি করে ভাবার সময় হয়নি তার। কিংবা নিজেই ভাবে নি। আজ লোকটার কথায় হঠাৎ করেই ভাবতে শুরু করলো। আর অমনি মনে হল সত্যিই যেন কীসের একটা অভাব তার রয়ে গেছে। যে অভাব পূরণ না হলে জীবনের অনেকটা অপূর্ণ রয়ে যাবে। দেখা হবে না তার চেনা জগতের বাইরের সেই অচেনা জগৎ। সাজানো গোছানো বাড়িটা। দুইবেলা ঝাট দেওয়া গোবর লেপা উঠোন। মাথায় ঘোমটা টেনে সন্ধেবেলায় তুলসীতলায় সাঁঝপ্রদীপ জ্বালানো একটা বৌ। শঙ্খ, উলুর আওয়াজ। ধূপের গন্ধ। আর রাতের বেলায় অমোঘ আকর্ষণের সেই আদিম আলিঙ্গন।
‘কী হলো, ভাবো কী?’
চমকে উঠলো নিশে, ‘তোমার কথা-ই ভাবি। তা বে যে করবো, মেইয়ে দেবে কেডা?’
‘জগতে মেইয়ের কী অভাব বাপ?’
‘আমার ওই সামান্য ভিটে টুকুন ছাড়া আর কি আছে? সারাদিন ভ্যান চালায়ে রোজগার করি।’
‘কিন্তু তোমার মধ্যি যে অনেক বড়ো একখান মন আছে।’
‘মন দেহে কেউ মেইয়ে দেয়?’
‘যদি দেয় তুমি বে’ করবা?’
‘ইজ্ঞে তা কত্তি পারি। কিন্তুক মেইয়ে দেবে কেডা?’
‘যদি আমি দেই?’
‘মানে?’— ভীষণই চমকে উঠলো নিশে।
‘আমার ছোট মেইয়েডার গায়ের রং এট্টু কালো হতি পারে, কিন্তুক দেকতি শুনতি মন্দ না। তবু যে ক্যান বে’ হল না আজও। তুমি যদি তারে বে’ করো—’
বাকিটুকু শোনার ফুরসৎ পেল না নিশে। তার দুই চোখে ভেসে উঠলো এতদিনের দেখতে না পাওয়া একটা ছবি। একখানা সাজানো গোছানো ঘর। গোবর লেপা উঠোন। তুলসীগাছ। সাঁঝপ্রদীপ। আলতা পরা দু খানি পায়ের উঠোনময় চলে বেড়ানো। আধো আধো বোল ফোটা ছোট্ট শিশুমুখ।
‘ও বাপ, ভাবো কী?’
উত্তর দিতে পারলো না নিশে। সমস্ত কথারা তার হারিয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে থেকে সরে যাচ্ছে দৃশ্যগুলো। কোথায় রাত্রি? কোথায় আঁধার? দুধ সাদা জোছনায় চরাচর ভেসে যাচ্ছে। সমগ্র সত্তায় তীব্র একটা সুখের অনুভূতি। দু পা এগিয়ে এসে হাত রাখলো ভ্যানরিকশাটার গায়ে। তারপর তাতে উঠে বসে দু পায়ের চাপ দিতেই স্পষ্ট দেখতে পেল ভ্যান নয়— জীবন্ত এক পক্ষীরাজের পিঠে চেপে বসে আছে সে। মাটি ছাড়িয়ে আকাশ— তারও ওপরে অনেকখানি উঁচুতে উঠে দুইপাশে ডানা ছড়িয়ে উড়ে চলছে তার পক্ষীরাজ। তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে বুঝি বা আজই পৌঁছে যাবে সেই রাজকন্যার কাছে, যে কিনা নিশের অপেক্ষায় বসে আছে।