হলের ক্যান্টিনের বিড়ালটার উপর আমার ভীষণ জিদ।
মাঝে মধ্যে ইচ্ছা করে বিড়ালটাকে ধরে হলের ছাদে নিয়ে যাই, এগারো তলা ছাদ থেকে বিড়াল পড়ে মারা গেলে প্রশাসন একে কিভাবে নেবে জানতে ইচ্ছে হয়। বিড়ালের আত্মহত্যা? অতঃপর আত্মঘাতী বিড়ালের আততায়ী খোঁজার দায় এড়াতে হয়ত গোটা বিড়ালের সমাজকে আল কায়েদার সাথে তুলনা দিয়ে দেবেন তারা। আবার এমনও হতে পারে গোটা ব্যাপারটাকেই এড়িয়ে যাওয়া হবে। হয়ত বলা হবে, বিড়াল সমাজের কেউ আমাদের কাছে অভিযোগ জানায়নি, জানালে আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখবো।
বিড়ালটার প্রতি আমরা তীব্র বিদ্বেষ হয়। বিড়ালের জীবনের প্রতি আমার হিংসা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু মেয়ে আছে যাদের মনে বিড়ালের প্রতি আলাদা মায়া থাকে। কষ্ট আরো তীব্র হয় যখন দেখি যেসব মেয়েরা বিড়াল ভালবাসে, তারা খুব সুন্দরী হয়। এই জীবনে কোনো সুন্দরীর দেখা পাওয়া হলো না, অথচ বিড়ালের মতো নির্বোধ একটি প্রাণী কিভাবে সুন্দরীদের এতো কাছাকাছি থাকার ভাগ্য নিয়ে জন্মালো? অবশ্য জগতের বেশিরভাগ অবিবাহিত সুন্দরীর আশে পাশে যেসব পুরুষ থাকে, তাদেরকেও আমার নির্বোধ মনে হয়। তাদের জীবন যায় সুন্দরী কোনো তরুণীকে মুগ্ধ করার চাকরি নিয়ে, মোহ ভাঙ্গে প্রেমিকার বিয়ের খবর শুনে চাকরির বিজ্ঞপ্তি পড়তে পড়তে।
আমার জীবনে সুন্দরী না আসলেও চাকরির বিজ্ঞপ্তি এসেছে। চাকরি আসেনি। সহমত ভাইয়ের ছায়া আছে বলে ছাত্রত্ব না থাকার পরেও এখনো হলে থাকতে পারছি। অথচ, বিড়ালটা কিছু না করেই হলে থাকছে দিনের পর দিন। একটা সামান্য প্রাণী কেনো এতো সুবিধা পাবে? তাই বিড়ালটাকে আমি একেবারেই সহ্য করতে পারি না। মাথার মধ্যে খুন চেপে যায়, বিড়ালটাকে এগারো তলা থেকে ছুঁড়ে মারতে ইচ্ছে করে।
ইচ্ছাটা অবদমিত করে রাখি। বিড়াল মারার খরচ অনেক। আড়াই কেজি লবণ নাকি সদকা দিতে হয়, গামছা দিতে হয় আরো কী কী নিয়ম আছে। নিয়ম না মানলে অলৌকিক সমস্যা দেখা দেয় বলে শুনেছি। আপাতত লৌকিক সমস্যা নিয়েই মুশকিলে আছি।
তিন বেলা খাওয়ার সামর্থ্য নাই বলে দুপুর পর্যন্ত ঘুমাই, তারপর একসাথে ‘ফুড টুগেদার’ করি। নাশতা আর দুপুরের খাবার একসাথে খাওয়ার নাম ফুড টুগেদার। আমার মতো আরো অনেকেই এই কাজ করে।
মেজাজটা খারাপ হয় বিড়ালকে দেখলে। শালা আমি খেতে পারি না ঠিকমতো আর এই বিড়াল দৈনিক চৌদ্দ বেলা খায়। খাবারের টেবিলে বসলে মায়া মায়া করে তাকিয়ে থাকে যেনো তাকে দয়াবত হয়ে কিছু দেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে দয়া মায়া সব হারিয়েছি। এখন কারো প্রতি কোনো মায়া হয় না। ভিক্ষুক দেখলে এখন জিজ্ঞেস করি, “যে সার্টিফিকেট দিয়া ভিক্ষা করো, ওগুলা আসল না নীলক্ষেত থেকে বানায় আনসো?” তারা ক্ষুদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করে। আমি কনভিন্স হই না। নীলক্ষেত থেকে আস্ত পিএইচডি থিসিস বানিয়ে টিচার হয়ে যাচ্ছে কেউ কেউ, আর ভিক্ষুক একটা মেডিকেল ডকুমেন্ট তো বানাতেই পারে। এর মধ্যে তেমন কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে সব জায়েজ আছে।
আজকে বিড়ালটাকে ক্যান্টিনের ভেতর পেলাম না। খাবার খাওয়ার পর অন্যমনস্ক হয়ে ভুলে ডালের বালতিতে হাত ধুয়ে ফেলতে গিয়েছিলাম প্রায়। হয়ত বিড়ালটার কথা ভাবছিলাম। হলের ডালের চেহারাও হাত ধোয়া পানির মতো, পাতলা হলুদ।
ক্যান্টিন থেকে বের হয়ে দেখি যুদ্ধ যুদ্ধ অবস্থা। বাস্কেটবল কোর্টের সামনে কয়েকটি বিড়াল সতর্ক অবস্থায় পায়চারি করছে। তাদের সামনে দুইটি কুকুর ধূর্ত ভঙ্গিতে আক্রমণ করার পূর্ব প্রস্তুতি নিচ্ছে। কুকুরগুলোকে আমি চিনি। এদের একটা পা চাটা কুকুর, আরেকটা পল্টিবাজ। বিড়াল আর কুকুরের মাঝখানে অবস্থান একটি হাড্ডির।
হাড্ডি দেখে বায়োলজি বিভাগের বন্ধু শানাই বললো, “দেখতে মানুষের মেরুদন্ডের মতো”।
আমি বললাম, তুই না কথা দিয়েছিলি আর নেশা করবি না?
শানাই একটা গোল্ডলিফ সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললো, সিগারেট ছাড়া এখন আর কিছু খাই না।
তাহলে এমন অদ্ভুত কথা বলিশ কেনো?
কি বললাম, আজব!
বললি যে ওটা নাকি মানুষের মেরুদন্ডের মতো দেখতে! এতো কাল্পনিক কথা কিভাবে আসে তোর মাথায়?
শানাই বুঝতে পারলো। সেও বললো, মেরুদন্ড আছে এমন কাউকে সে চেনে না। এটা কার মেরুদন্ড কে জানে!
শানাই হাড্ডিটা চুপি চুপি নিয়ে নিলো। তার পিছু নিলো পা চাটা কুকুরটা। শানাইকে দেখলাম, পা চাটা কুকুর তার পিছু নেয়ায় সে খুশি হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, হাড্ডির লোভ দেখিয়ে কিছুদিন কুকুরটার আনুগত্য পাওয়ার খেলা খেলবে সে।
আমি চলে আসলাম ক্লাসে। সামনের বেঞ্চ দখল করতে হবে। নিজে বসে পাশে আরো কয়েকটা সিট দখল করে রাখি আমার গ্রুপমেটদের জন্য। তাছাড়া, সামনের বেঞ্চে বসলে স্যারদের নজর পাওয়া যায়। স্যার কিছু বললে হাত কচলিয়ে সুর দেই, জি স্যার, একদম ঠিক স্যার, আপনি মহান স্যার।
বিকালে শানাই এর রুমে গেলাম। তাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। সে বললো, সে আরো একটা হাড্ডি পেয়েছে। দেখতে মেরুদন্ডের হাড়ের মতো। আমি বললাম, কিন্তু এতো চিন্তার কি আছে? এগুলো তো শুধুই হাড়, আর কিছু না। শানাই বললো, হাড্ডি পাওয়া যাচ্ছে মানে এখনো মেরুদন্ড ওয়ালা মানুষ আছে, এটা শুভ লক্ষণ নয়। তারা গোপনে সংগঠিত হচ্ছে, গভীর ষড়যন্ত্র ।
আমিও এবার কিছুটা চিন্তিত হলাম। শানাইকে বললাম, এগুলো যে মানুষের মেরুদন্ডের হাড্ডি তা কাউকে জানানো যাবে না। শুধু ভাইকে জানাবো। শক্ত একশনে যেতে হবে।
শানাই বললো, প্রক্টরকে জানাই কি বলিস?
হ্যা জানানো যায়৷ মেরুদন্ড পাওয়া গেছে শুনলে স্যার নিশ্চয়ই একশন নিবে। স্যার মেরুদন্ড একদম সহ্য করতে পারে না।
প্রক্টরকে জানানো হলো। প্রক্টর স্যার শুনেই তো লাফ দিয়ে উঠলেন। বলো কি! মানুষের মেরুদন্ড? ইন্নালিল্লাহ…
স্যারকে চিন্তিত দেখাচ্ছিলো। আমি সহমত ভাইয়ের কাছে গেলাম। ডান হাতটা বাম হাতের উপর রেখে কিছুটা নত নত মুখে তেলতেলা হয়ে বললাম, ভাই মেরুদন্ড পাওয়া গেছে।
কিসের মেরুদন্ড?
মানুষের মেরুদন্ডের মতো দেখতে…
ভাই হাসতে লাগলো। সবাই হাসলে আপন মনে হয়, ভাই হাসলে হিংস্র মনে হয়। ভাই না হাসলেই আমি খুশি হই, কিন্তু এখন ভাইয়ের হাসি দেখে আমিও হাসি। তাল মেলানো হাসি।
আমার ভূমিকা চিরকালই এই। চিরকাল বলতে যতদিন হলে আছি আর কি। দোহারার মতো ভাই যা বলবে পেছন থেকে সেটাই রিপিট করবো। ভাই যদি বলে, সূর্য পশ্চিম দিকে উঠে লিখে ফেসবুকে প্রচার করতে, আমি সেটাই করবো, সাথে ভাইয়ের একটা ছবিও দিয়ে দিবো।
মেরুদন্ডের জায়গা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে হবে না। মিছিল করবো। ফার্স্ট ইয়ার ডাক দে, জড়ো কর।
আমি বললাম, জি ভাই, জি ভাই।
ফার্স্ট ইয়ারকে ডাক দিতে গেলাম। আমাকে দেখেই সবাই সালাম দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো হ্যান্ডশেকের জন্য। এই অনূভূতিটা অসাধারণ। নিজেকে সেলিব্রেটি মনে হয়। দুই একটা ছেলে অবশ্য তেলাপোকার মতো লুকাতে চাইলো। ক্লাস আছে, শরীর খারাপ এসব অজুহাত দিতে চাইলো। হালকা চোখ রাঙ্গানি দিতেই সব ঠিক। সব এক জায়গায় এসে স্তূপ হলো।
মিছিল শুরু হলো।
চিল কাবাডি চিলের দার
হাড্ডি গুড্ডি খবরদার…
চিল কাবাডি চিলের দার
হাড্ডি গুড্ডি খবরদার…
এইদিকে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় হাড্ডি নিয়ে কানাঘুষা পড়ে গেছে। সবাই একটা আতংকে আছে। মেরুদন্ডের হাড্ডির মেসেজ টা কি?
অনেক প্রশ্ন। উত্তর নেই।
সহমত ভাই এইদিকে শানাইকে সতর্ক থাকতে বলছে। উপর থেকে চাপ আসছে, মেরুদন্ডের হাড্ডির উৎস যেনো সমূলে নির্মূল করা হয় অতি দ্রুত। শানাই ভাইকে বললো, সে সতর্ক, হলের সবাইকে ভয় দেখিয়ে সে কবজায় রাখবে।
ভাই বললো, ভয় বলে দেখানো যায় না, ভয়ের কাজ করতে হবে।
শানাই বললো, আপনার নির্দেশের অপেক্ষায় ভাই৷ শুধু বলেন কি করতে হবে…
ভাই বললো, হাড্ডি গুলো গুড়া করে দাও। সবাই বুঝুক মেরুদন্ডের হাড্ডির জোরে পায়তারার সুযোগ এই ক্যাম্পাসে নেই।
শানাই বললো, ভাই দেখে মনে হয়, হাড্ডি অনেক মজবুত, অল্প বয়সী হাড্ডি।
ভাই হাসলো। ভাইয়ের হাসি দেখলে আমার ভয় করে। আমি অপেক্ষায় আছি, ভাই কি নির্দেশ দেয়। নিশ্চয়ই যুগোপযোগী কোনো সিদ্ধান্ত দিবে সে।
ভাই বললো, মজবুত মেরুদন্ড ভাঙ্গা কি এতোই কঠিন? উপায় আছে।
কি উপায় ভাই?
হাতুড়ি। হাতুড়ি দিয়ে হাড্ডিগুলো গুড়া গুড়া করে দাও।
শানাইয়ের চোখ ঝিলিক দিয়ে উঠলো। এবার সে কাজের মতো একটা কাজ পেয়েছে। মেরুদন্ডের হাড় ভেঙ্গে দেয়ার জন্যে শানাই হন্যি হয়ে হাতুড়ি খুঁজতে লাগলো।
আমার ক্ষুধা পেয়েছে। পকেটে টাকা নাই। বিড়ালটা ঠিকই খাচ্ছে দৈনিক চৌদ্দ বেলা। বিড়ালটার উপর আমার ভীষণ জীদ। এগারোতলায় আমি দাঁড়িয়ে আছি। আচ্ছা, আমি যদি এখন লাফ দেই বিড়ালটা কি খুব খুশি হবে?