আশ্চর্য্য অবশ্যগ্রাহ্য শুধু এই জ্ঞানে যে বিমল মিত্রের– “মিলনান্ত”– যার জন্ম অপূর্ব গর্ভজাত– বললেও অন্তরে অতৃপ্তির পরিসর ব্যাপকভাবে বিস্তৃত থেকে যাবে। অথচ বিমল মিত্র সার্থক গল্প রচয়িতা জ্ঞানে স্বীকার্য কিনা প্রশ্ন সাপেক্ষ।
প্রাসঙ্গিকভাবে আরও দৃশ্যমান কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তিরই যথার্থ মূল্যায়ন আর একজন অপ্রতিষ্ঠিত(?) লেখকের রচনায়। যার কর্মের শুরু (অবশ্যই এখানে একটি নির্দিষ্ট সৃষ্টি) টুকরোর আকারে আর শেষ অসম্ভব অসম্পূর্ণ আত্মতৃপ্তির মূল্যায়িত ক্রন্দনে। এবং যার– “মিলনান্ত”– নামের গোটা অন্তরাল নিখুঁত, সূক্ষ্ম এবং পরিপূর্ণভাবে আচ্ছাদিত ব্যাঙ্গাত্মকতার নীল প্রলেপে। –“যে কাহিনী মিলনের নামে প্রগাঢ় বঞ্চনার বেদনায় অশ্রুসজল”– যার পরিচয় এবং বর্ণনার অনুমিত প্রয়োজনে বর্তমান কালের একজন শক্তিধর সাহিত্যিক ড. মযহারুল ইসলাম মন্তব্য করতে সাহসী হয়েছেন– “বাংলা সাহিত্যে যে কয়েকটি মুষ্টিমেয় বিরল সার্থক গল্প আছে তাদের মধ্যে অন্যতম।”
“ছোট গল্পের সূচনা ধীর, স্থির নয় বরং আকস্মিক এবং দ্রুত এবং এ কারণেই ছোট গল্পের চারিত্রে থাকে বাস্তব এবং কল্পনার এক অপূর্ব সমন্বয়”– ড. মযহারুল ইসলামের এ উক্তির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের এক কথায় ছোট গল্প সম্পর্কে কয়েকটি কথা– ‘যা সিদ্ধ ধারণার গতিতে আপেক্ষিক শক্তি সঞ্চারে বলিষ্ঠ ভূমিকার অধিকারী’– সেখানে বলা হয়েছে– “ছোট গল্প হচ্ছে প্রতীতি (Impressism) জাত একটি সংক্ষিপ্ত গদ্য কাহিনী– যার একতম বক্তব্য কোন ঘটনা বা পরিবেশ বা কোন মানসিকতাকে অবলম্বন করে ঐক্য সংকটের মধ্য দিয়ে সমগ্রতা লাভ করে।”
এবারে উদ্ধৃতি দুটো থেকে আরও দুটো কথা বেছে নেয়া যাক:
(১) “আকস্মিক এবং দ্রুত”
(২) “অবলম্বন করে সমগ্রতা লাভ”
এখানে লক্ষণীয় খণ্ডিত ঘটনা, আকস্মিক পরিবেশ, স্থুল অথবা সূক্ষ্ম মানসিক যন্ত্রণা– যার সবগুলোই দ্রুততম জীবনের গর্ভ থেকে টুকরোর আকারে জন্মিত। আর এই টুকরোকে অবলম্বন করে সমগ্রতা লাভের মধ্য দিয়েই ছোট গল্পের প্রবাহিত গতির সামগ্রিক পরিপূর্ণতা। অর্থাৎ বিষয়বস্তু তো আছেই তার উপর দৃষ্টিভঙ্গি– এক কথায় শরীর নির্মাণের কলা কৌশলগত দিক– যা গল্পের চরিত্রে এবং গতিতে বলিষ্ঠতা দানে প্রথম এবং মুখ্য প্রেরণা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে প্রেরণা কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের– “মুসলমানীর গল্প”– চরিত্রে অনুপস্থিত। যে অনুপস্থিতিই তার পুরো গল্পকেই আত্মার নৈকট্য থেকে বিচ্ছিন্ন ক’রে দূরতিক্রম্য এক বিশাল ব্যবধানের শেষ প্রান্তে সংস্থাপিত করেছে। বিশেষতঃ তাঁর অন্যান্য ছোট গল্পগুলির সাথে “মুসলমানীর গল্প”-কে তুলনা করলে সে রকমই মনে হয়।
ধরে নেয়া যাক, গল্পের প্রয়োজনে হবির খাঁর চারিত্রিক গুণগত বৈশিষ্ট্য এবং অবশ্যম্ভাবী উপস্থিতি– যে উপস্থিতি গল্পের সমাপ্তিকে প্রভাবিত করেছে সব চাইতে বেশী। হবির খাঁ ছাড়া এ গল্প যেন আর এগুতে পারছিল না। অথবা গল্পের গতি রূদ্ধতার যে আবর্তে নিপতিত হয়েছিল সেখান থেকে হবির খাঁ’র দৃশ্য এবং অদৃশ্য প্রভাবই তাকে টেনে টেনে শেষ পর্যন্ত শেষ লগ্নে এনে দাঁড় করিয়েছেন। যদিও গোটা গল্পটিতে হবির খাঁ’র উপস্থিতি কেবল কয়েক মুহূর্তের জন্যে মাত্র তিন বার তবুও তার প্রভাব ডাকাত দল কর্তৃক কমলা অপহৃত হবার পূর্বমুহূর্ত থেকে গল্পের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রলম্বিত। কমলা অপহৃত হবার পূর্ব মূহূর্ত থেকে কমলাকে তার নিজ বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া এবং কমলা স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমান হিসেবে ধর্মান্তরিত হবার অভিপ্রায়টি হবির খাঁ-এর কাছে প্রকাশ করবার কালটি পর্যন্ত তিনি শারীরিকভাবে মাত্র তিন বার দৃশ্যমান থাকলেও এর পর থেকে তার শারীরিক উপস্থিতি অদৃশ্য গল্পের সমাপ্তি অবধি। তবে তার মানসিক উপস্থিতির প্রভাব গল্পের অন্তিম মুহূর্ত অর্থাৎ কমলা ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে মেহেরজান নাম গ্রহণ করে বংশীবদন অর্থাৎ কমলার কাকার দ্বিতীয় কন্যা সরলার বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে পালকিতে চড়ে সরলা ওর শশুর বাড়ীতে যাবার পথে আবার কমলার মতো একইভাবে ডাকাত দলের হাতে পড়লে ‘খবরদার’– বলে এই মেহেরজানই সরলাকে রক্ষা করে তার বাবা মায়ের কাছে পৌঁছে দেয়া পর্যন্ত।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়– মেহেরজান ‘খবরদার’– শব্দটি উচ্চারণ করবার সঙ্গে সঙ্গে ডাকাত দল ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে একযোগে বলে ওঠে–‘ঐরে, হবির খাঁর চেলারা এসে সব নষ্ট করে দিলে।” এ সংলাপটি এখানে উদ্ধৃত করবার উদ্দেশ্য– হবির খাঁ’র শরীরি উপস্থিতি ওই মুহূর্তে না থাকলেও তার অদৃশ্য প্রভাবটি প্রকটিত। এরপর কাকার কাছে সরলাকে পৌঁছে দিয়ে মেহেরজান বলে–“কাকা, প্রণাম তোমাকে। ভয় নেই, তোমার পা ছোঁব না। এখন একে তোমার ঘরে নিয়ে যাও, একে কিছুতে অস্পৃশ্য করে নি। কাকীকে বোলো অনেক দিন তাঁর অনিচ্ছুক অন্নবস্ত্রে মানুষ হয়েছি, সে ঋণ যে আমি এমন করে আজ শুধতে পারব তা ভাবি নি। ওর জন্যে একটি রাঙ্গা চেলী এনেছি, সে এই নাও, আর একটি কিংখাবের আসন। আমার বোন যদি কখনো দুঃখে পড়ে তবে মনে থাকে যেন তার মুসলমান দিদি আছে, তাকে রক্ষা করবার জন্যে।”
অথচ পূর্বোক্ত উক্তিগুলোকে তুলাদ– ক’রে বিচার করলে প্রথমেই অনুমিত হবে হবির খাঁ আরোপিত চরিত্র। আর আরোপিত বলেই মনে হয়েছে অবাস্তব। কেননা প্রথমতঃ ডাকাত দলের লোকেরা এতটা উদার এবং মানবিক হতে পারে না। কারণ, এতটা উদার, মানবিক এবং ধর্ম, বর্ন নির্বিশেষে যে কোনো ধর্মের প্রতি, যে কোনো বর্নের প্রতি এতটা শ্রদ্ধাশীল হলে তারা ডাকাত হতে পারতো না। যেহেতু হিংসা এবং লুণ্ঠনই তাদের ধর্ম। দ্বিতীয়তঃ দলগতভাবে তারা সনাতন অথবা ভিন্ন যেকোনো ধর্মের অনুসারী হলেও কেবলমাত্র একজন নিরস্ত্র মানুষের একটিমাত্র নির্দেশে তাদের লুণ্ঠিত দ্রব্যটিকে ছেড়ে দিয়ে প্রস্থান করবে– এমনটি ভাবা যায় না। যদি তাই-ই হতো তাহলে তো যে অঞ্চলটিতে তিনি বসবাস করেন সে অঞ্চলের পরিধির ভেতর শুধু ডাকাতি কেন যে কোনো ধরণের অপরাধ সংঘটিত হবারই কথা নয়।
এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, গল্পটি রচিত হয়েছিল ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসের ২৪ থেকে ২৫ তারিখের মধ্যে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন প্রবল বেগে চলমান। জার্মান নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের ভয়াবহ এ যুদ্ধটি শুরু হয়েছিল ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে। জার্মান নেতৃত্বাধীন সামরিক বাহিনীর প্রধান ছিলেন চরম স্বেচ্ছাচারী নাৎসি একনায়ক এ্যাডলফ হিটলার। এই হিটলারের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ নেতৃত্বাধীন সামরিক বাহিনীকে তখন বলা হতো মিত্রবাহিনী বা মিত্রশক্তি। গোটা ভারত তখন ব্রিটিশ সরকারের শাসনাধীন। এবং ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলনটিও তখন একেবারেই তুঙ্গে। এই আন্দোলনের পাশাপাশি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলিকে নিয়ে আর একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের দাবী নিয়ে ভারতীয় কংগ্রেসের সমান্তরাল আর একটি আন্দোলন গড়ে তোলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে ‘মুসলিম লীগ’ নামীয় একটি রাজনৈতিক দল। এ ধরনের রাজনৈতিক এবং সামরিক জটিলতম একটি পরিস্থিতিতে অন্ততঃ ভারতের হিন্দু এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে যাতে কোনো প্রকারের বিভেদের সৃষ্টি হতে না পারে– যে পরিস্থিতিটির ন্যূনতম কোনো সুযোগ জার্মান সামরিক জোট কোনোক্রমেই গ্রহণ করতে না পারে– এ লক্ষ্যটিকে সামনে রেখে ব্রিটিশ সরকার একের পর এক নানা ধরণের কৌশল, অপকৌশল অবলম্বন করতে থাকে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্ভবতঃ এ প্রেক্ষিতটিকে বিবেচনা করেই ভারতের হিন্দু এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ সেতুবন্ধ রচনার জন্যেই মুসলমান ‘হবির খাঁ’-নামীয় চরিত্রটিকে উভয় সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির প্রতীক হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। আর এ কারণেই চরিত্রটিকে মনে হয়েছে কৃত্রিম এবং আরোপিত যা– সঙ্গত অর্থেই অবাস্তব।
এই চরিত্রটির অবাস্তবতার প্রভাবে গোটা গল্পই হ’য়ে গেছে বাস্তবতা বহির্ভূত এবং গল্পটি লেখকের একটি ‘কল্পচারী’ বোধের ‘দায়সারা’-দিকটির দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করেছে। প্রকারান্তরে যা– মেকীত্বের আবরণেই আবৃত থেকে গেছে শেষ পর্যন্ত। যেখানে ‘হবির খাঁ’-এর স্পর্শাতীত ব্যক্তিত্ব, আকাশচুম্বী দায়িত্ববোধ অনুভূতিতে আবেদন সৃষ্টির চাইতে বিপরীত তাকেই প্রকাশ করেছে উলঙ্গভাবে। তার প্রতি এক ধরণের সন্দেহই প্রকটিত হয়ে উঠেছে বারবার। কাকা, কাকীর চরিত্রগত আচরণ, সামাজিক বিধি ব্যবস্থার বাধ্যবাধকতার বিষয়গুলিকেও পক্ষপাতিত্বের শানিত ছুরি দিয়ে করা হয়েছে দ্বিখন্ডিত। যেখানে বংশীবদনের ভ্রাতার কন্যা কমলাকে ডাকাতদলের কবল থেকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে হবির খাঁ বংশীবদনের বাড়িতে পৌঁছে দেবার পর কমলা কর্তৃক তার কাকার গলা জড়িয়ে ধরে ওকে গ্রহণ করবার– “কাকামনি, আমাকে তুমি ত্যাগ কোরো না।”-এ ধরনের আকুতি জানিয়ে দু’চোখের পানি দিয়ে কাকার বুক ভিজিয়ে দিয়েছিলো সেখানে কাকার উত্তরটি ছিল– “উপায় নেই মা! আমাদের যে হিন্দু ঘর, এখানে তোমাকে কেউ ফিরে নেবে না, মাঝের থেকে আমাদেরও জাত যাবে।” এ কথাটি বলার আগে আরও এক কাঠি ওপরে উঠে কাকী তার স্বামী এবং কমলাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলো– “দূর করে দাও অলক্ষীকে। সর্বনাশিনী, বেজাতের ঘর থেকে এসেছিস আবার, তোর লজ্জা নেই!” স্ত্রীর এ কথা শুনবার পর কাকা আর কমলাকে গ্রহণ করে নি। কমলা বাধ্য হয়েছিলো হবির খাঁ-এর সাথে আবার তার বাড়ীতেই ফিরে যেতে। কিন্তু মেহেরজানরূপী কমলা যখন কাকার দ্বিতীয়া কণ্যা সরলাকে ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষা করে কাকার বাড়ীতে গিয়ে কাকার কাছে পৌঁছে দিলো কাকা অথবা কাকী কেউই কিন্তু তখন সরলাকে ফিরিয়ে দিলো না। সামাজিক বিধি বিধানের প্রযোজ্যতার ক্ষেত্রে এই যে পক্ষপাতিত্ব– এই নিকৃষ্ট সংকীর্ণতার দিকটিকে প্রকটভাবে উন্মোচন করাই বোধ করি এ গল্পটির একটি বিশেষ দিক। আর একটি দিক হলো– কমলা ফিরে আসবার পর কমলাকে উদ্দেশ্য করে কাকী যখন বলে ওঠেন– “…সর্বনাশিনী, বেজাতের ঘর থেকে এসেছিস আবার, তোর লজ্জা নেই!” তখন মুসলমান হবির খাঁ হয়ে ওঠেন ‘বেজাত’। কিন্তু মুসলমান মেহেরজান যখন সরলাকে কাকা, কাকীর কাছে পৌঁছে দেয় তখন মেহেরজান আর ‘বেজাত’ থাকে না, সে জাতে উঠে যায়। কারণ সরলা কাকা, কাকীর কণ্যা যা কমলা ছিলো না। এই যে মূল্যবোধের অবক্ষয়, ধর্মীয় গোঁড়ামির হিংস্রতা, স্বার্থ-কেন্দ্রিক পক্ষপাতিত্ব– এ সবের ওপর ধর্মনিরপেক্ষতার একটি ‘সান্ত¦না-প্রলেপ’ প্রদান করতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘মুসলমানীর গল্প’টিতে হবির খাঁ নামের এই মুসলমান চরিত্রটি সৃষ্টি করে। কিন্তু মূল্যবোধের নিম্নগামীতা এবং উগ্র ধর্মান্ধতার প্রবল খরস্রাতে হবির খাঁ ভেসে গেছেন খরকুটোর মতো। রবীন্দ্রনাথ যে লক্ষ্যটিকে বাস্তবায়নের প্রয়োজনে হবির খাঁ চরিত্রটি সৃজন করেছেন এবং ওই চরিত্রটির মাধ্যমে হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সুসম্পর্কের যে দৃষ্টিনন্দন তিলোত্তমার বিগ্রহটি মূর্তিত করতে চেয়েছেন বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে গভীরতর বিশ্লেষণে সে সৃজনটি দৃষ্টিনন্দন তিলোত্তমা না হয়ে বরং হয়ে পড়েছে দৃষ্টিকটু উপহাসের অবয়ব। কাকীর কথায় কমলার শারীরিক সৌন্দর্যই যেমন সব ‘সর্বনাশ’-এর মূল কারণ একইভাবে যদি বলা হয় সাধারণ মানুষের নির্জলা উপহাসই হবির খাঁ চরিত্রটির প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ব আর অসাধারণ প্রভাবের অকাল মৃত্যুর অনিবার্য কারণ– অসঙ্গত হবে না বোধকরি।
আর একটি বিষয় লক্ষণীয়- প্রথমতঃ গল্পের কাঠামোতে সৃষ্ট চরিত্রকে যদি গ্রন্থির স্বীকৃতি দেয়া যায় তবে বোধ করি এমন একটি ধারণাকে সমর্থন করা অন্যায় হবে না যে– “মুসলমানীর গল্প”- এর সবগুলো গ্রন্থিই শিথিল থেকে শিথিলতম। যে শিথিলতার কারণে গল্প তার নির্মাণজাত দিক থেকে অস্বাভাবিক রকমের দুর্বল হ’য়ে পড়েছে।
দ্বিতীয়তঃ যেহেতু কথিত গল্পের সূচনা সূক্ষ্ম মানসিকতা প্রসূত নয় এবং গল্পের বিষয়বস্তুর অভ্যন্তরে মনস্তাত্বিক বিশ্লেষনের অবকাশ নেই বললেই চলে (যার সূচনা অত্যধিক মন্থরতায় ও সমাপ্তি ততোধিক স্থবিরতায়) ঠিক সেই হেতু অন্তরের পরিধিতে বিশেষ অতৃপ্ততার মধ্যে যে বর্ণনাতীত তৃপ্ততার জন্ম সম্ভব হতে পারতো এবং অন্তরের তৃষ্ণাকে তৃপ্ততার পূর্ণতা দিয়ে ঋদ্ধ করতে পারতো এই সৃষ্টিটিতে কেন যেন মনে হয়েছে– তা একটি অনির্ণীত ব্যর্থ মূর্তির মতো একেবারেই নির্বাক থেকেছে অন্তিমে এসেও।
অথচ লেখকের ‘ছুটি’– গল্পটির পরিণতিতে কিশোর ‘ফটিক’-এর করুণ মৃত্যু, ‘পোস্টমাষ্টার’– গল্পটিতে কিশোরী রতন-এর অসহায় মানসিক হাহাকারের সাথে সাধারণ মানুষের অন্তরার্তি যেন একাকার হয়ে যায়, সাধারণ মানুষ যেন ওদের পরিণতিতে ওদের মর্মান্তিক যন্ত্রণাকে নিজেদের আত্মায় ধারণ করে আকুলিত হয়ে ওঠে। আবার ‘কাবুলিওয়ালা’– গল্পটিতে আফগানিস্তান থেকে এ দেশে আসা আঙ্গুর, আপেল, কিসমিস, বাদাম ইত্যাদি বিক্রেতা মধ্যবয়সী মুসলমান ‘রহমত’-এর সাথে পাঁচ বছর বয়সের একটি কন্যা ‘মিনি’-র যে সখ্যতা গড়ে ওঠে সে সখ্যতাটুকুই যেন হিন্দু এবং মুসলমানের মধ্যে অনন্তকাল ধরে টিকে থাকবার বিশাল সেতুবন্ধ সৃষ্টির আবহের জন্মদান সম্ভব করে তোলে। এখানে হবির খাঁ-এর মতো কৃত্রিম এবং আরোপিত সৃষ্টির প্রয়োজন হয় না।
গল্পটির উপসংহারে– দীর্ঘ আট বছর পর জেল থেকে ফিরে প্রথমেই মিনিদের বাড়ীতে এসে মিনির বাবার কাছে মিনিকে অর্থাৎ রহমতের ভাষায় ‘খোঁকী’-কে দেখবার আকুতি জানালে মিনির বাবা যখন বলেন– ‘আজ আর মিনির সঙ্গে দেখা হবে না’– তখন রহমত কিছুটা সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। কিছু সময় পর রহমত বুঝতে পারে আজ নিশ্চয়ই কিছু না কিছু হয়েছে, নইলে মিনির বাবা তো কখনই রহমতের সাথে এভাবে কথা বলেন না। শুধু এটুকু উপলব্ধি করতে পারে আজ আর মোটেও মিনির সঙ্গে ওর দেখা হবে না। রহমত কিছু সময় স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে থেকে ঘুরে দাঁড়ায় এবং সামনের দিকে দু’পা বাড়িয়ে আবার মিনির বাবার কাছে ফিরে এসে ওর গায়ের আলখাল্লার পকেট থেকে কিছু আঙ্গুর, কিসমিস, বাদাম বের করে মিনির বাবার হাতে দিয়ে ওগুলি মিনিকে দিতে বললে মিনির বাবা কয়েকটি টাকা রহমতের সামনে তুলে ধরে টাকা ক’টি ওকে গ্রহণ করতে বললে রহমত উত্তর দেয় এ ভাবে– “আপনার বহুত দয়া, আমার চিরকাল স্মরণ থাকিবে– আমাকে পয়সা দিবেন না। বাবু, তোমার যেমন একটি লড়কি আছে, তেমনি দেশে আমারও একটি লড়কি আছে। আমি তাহারই মুখখানি স্মরণ করিয়া তোমার খোঁকীর জন্য কিছু কিছু মেওয়া হাতে লইয়া আসি, আমি সওদা করিতে আসি না।”-এর উত্তরে মিনির বাবা মনে মনে বলে– “তখন বুঝিতে পারিলাম, সেও যে আমিও সে, সেও পিতা আমিও পিতা। তাহার পর্বতগৃহবাসিনী ক্ষুদ্র পার্বতীর সেই হস্তচিহ্ন আমারই মিনিকে স্মরণ করাইয়া দিল।”– এরপর মিনির বাবা মিনিকে ডেকে রহমতের সামনে আনয়ন করলে লাল চেলি পরা বিয়ের ক’নে মিনিকে দেখে রহমত থতমত খেয়ে হাসি মাখা মুখে শুধু বলেছিল– “খোঁকী, তোমি সসুরবাড়ি যাবিস্ ?” রহমত বুঝতে পেরেছিলো রাঙ্গা চেলি পরা যে মেয়েটি ওর দাঁড়িয়ে সে-ই মিনি। মিনির আজ বিয়ে। একটু সময় নিয়ে রহমত কি যেন ভাবলো। হয়তো ভাবলো- ওর মেয়েটিও এতদিনে এত বড়টি হয়েছে– ওকেও এবার বিয়ে দিতে হবে।
রহমত ফিরে যেতে উদ্যত হলে মিনির বাবা একটি কাগজের নোট রহমতকে দিয়ে বলেছিলো-“রহমত, তুমি দেশে তোমার মেয়ের কাছে ফিরিয়া যাও! তোমাদের মিলনসুখে আমার মিনির কল্যাণ হউক।” এই যে একজন বাঙ্গালী হিন্দু আর একজন আফগান মুসলমানের হৃদয়জঃ আর্তি একটি বিন্দুতে এসে এক হয়ে গেলো– এ যে কী অপার সুখের তা ভাষা দিয়ে প্রকাশ করা কোনোমতেই সম্ভব নয়। এ শুধু আত্মিক অনুভবের বিষয়। এবং এই আপত্য স্নেহ, আপত্য মমতা– এখানে হিন্দু মুসলিম অথবা কোনো বর্ন গোত্রের কোনো প্রকার প্রভেদ নেই। সবাই একে অপরের সাথে অচ্ছেদ্য। আর এ যেন ঠিক অনাবিল ঝর্নাধারার মতো পূত পবিত্র। সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে একে প্রকাশের রূপ একই। এখানে কে হিন্দু আর কে মুসলিম অথবা কে বাঙ্গালী আর কে-ই বা আফগানী এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। আর এর জন্যে কোনো কিছুকে আরোপনের প্রশ্নও অবান্তর।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পোস্টমাষ্টার, ছুটি অথবা কাবুলিওয়ালাই শুধু নয় তাঁর অন্যান্য ছোট গল্পগুলির মধ্যে বিশেষতঃ শাস্তি, সমাপ্তি, আপদ, ক্ষুধিত পাষাণ, নষ্টনীড়, হৈমন্তী, রাজটিকা, মনিহারা, দৃষ্টিদানসহ আরও অনেক ছোট গল্পের পাশে ‘মুসলমানীর গল্প যেন বড় সংকীর্ণ, বড় জড়োসড়ো।
তাহলে এখন কোন প্রশ্নের অবকাশ না রেখে নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, গল্পকার হিসেবে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অসামান্য সাফল্যের পরেও, তার গল্পগুলি কালকে উত্তীর্ণ করে যাবার পরেও কেন ‘মুসলমানীর গল্প’-টি কালের তুলাদন্ডে উত্তীর্ণ হতে পারলো না? প্রশ্নটি থেকেই যাবে। উল্লেখিত ছোট গল্পগুলি– যেগুলির বিষয়বস্তুগত উৎকর্ষতা, নির্মাণগত কৌশল– বিশেষ ক’রে মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ– অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচিত হ’তে পারে। কিন্তু ‘মুসলমানীর গল্পটি’-র ক্ষেত্রে তিনি কি উত্থিত প্রশ্নটির উর্ধ্বে উঠতে পারবেন?
এবারে আসা যাক তাঁর আকাশচারিতার প্রশ্নে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সামগ্রিক সাহিত্য কর্মের মধ্যে কবিতা এবং গানের সংখ্যাই অধিক। জীবনের শেষ মুহূর্তটিকে পর্যন্ত তিনি কবিতার প্রয়োজনে ব্যবহার করেছেন। হয়তো বা কবিতার মুকুরেই তিনি বিম্বিত করতে চেয়েছিলেন একান্ত মনোজ কামনার নিরীহ মূর্তিকে এবং যথেষ্ট সফলতার সাথেই সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু এই সক্ষমতাই হয়তো বা বিশেষ একটি ক্ষেত্রে তাকে তাঁর অজান্তে নিশ্চিত করে ব্যর্থতার অন্তরে প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছে।
তিনি লিখেছেন, লেখার মধ্যেই আত্মমুক্তির পথ নির্দেশ করেছেন, বোধশক্তি প্রশ্বস্ত করেছেন কিন্তু যে জ্ঞানে তিনি পথ নির্দেশ করেছেন এবং নির্দেশিকা লিখেছেন সে নির্দেশিকা নির্দেশিত পথকে প্রশ্বস্ত করবার প্রয়াসে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন মাত্র। তিনি অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন অথচ তা ‘মুসলমানীর গল্প’-টিতে এসে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। অর্থাৎ ব্যাপক সাধারণের অন্তর্লোকে স্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছেন (যদিও এ ক্ষুদ্র ব্যর্থতা তাকে স্বীকৃতির সিংহাসন থেকে উৎখাত করতে পারেনি, তবুও ক্ষুদ্র হলেও ব্যর্থতাই তো!)। তাঁর সংখ্যাতীত কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, গীত, এমন এক অবস্থানে অবস্থান করছে যার চার পাশের অত্যুজ্জ্বল আলোর বন্যা অমিত শক্তির অসংখ্য চোখের দৃষ্টিকে প্লাবিত করছে অথচ প্লাবিত হয়েও সে সব চোখের দৃষ্টি কোনো ক্ষেত্রে সেই অন্তর্লোকে নিবদ্ধ হতে পারছে না– যেখান থেকে এ আলোর প্লাবন উৎসারিত হচ্ছে। ‘মুসলমানীর গল্প’– সে ধরনেরই একটি উপলব্ধি।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের– “পৃথিবী”– কবিতা থেকে–
‘তোমার চক্র তীর্থের পথে পথে ছড়িয়ে এসেছ
শত শত ভাঙ্গা ইতিহাসের ——-অবশেষ
বিনা বেদনায় বিছিয়ে এসেছ তোমার বর্জিত সৃষ্টি
অগণ্য বিস্মৃতি স্তরে স্তরে।’
লক্ষণীয়, অতি সামান্য কয়েকটি কথার মধ্যেই অনায়াসে অঙ্কিত হ’য়ে গেছে একটি বিশাল বস্তুর সংক্ষিপ্ত শরীর এবং তার ছোট মানসলোক– যে মানসলোকে একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা, একটা ক্ষুব্ধ অভিমান নিয়ত আপনাকে দগ্ধ করছে। অথচ সে দগ্ধতাকে ছাপিয়েও সৃষ্টিই তার আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল থাকবার প্রাণপাত প্রচেষ্টায় সক্রিয় থেকেছে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। তারপরেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সে প্রাণপাত প্রচেষ্টাও রূপ লাভ করেছে ব্যর্থতার আঙ্গিকে। যেমন-‘মুসলমানীর গল্প’।
যারা সূক্ষ্ম অনুভূতি এবং তীক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে কথাগুলো বিশ্লেষণে চেষ্টিত হবেন তাদের অন্তরায়তনেই হয়তো কথাগুলোর যথার্থ মূল্যায়িত আবেদন নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। কিন্তু যাদের অন্তর্দৃষ্টিতে তীক্ষ্মতার যথেষ্ট অভাব লক্ষিত, যাদের অনুভূতি স্থুল থেকে স্থুলতম তারা কি এর পূর্ণ তথা সমগ্র মর্মার্থ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন না? এবং যদি পড়েন তবে কি সেক্ষেত্রেও দ্বিতীয় অর্থে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি বিশেষ প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে পড়বেন না?
কবির একই কবিতার উদ্ধৃত পঙতি ক’টি আরও অনুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষনের প্রয়োজনে অবশ্যই বিবেচিত হবার যোগ্য-
০১. ‘……তীর্থের পথে পথে ছড়িয়ে এসেছ
শত শত ভাঙ্গা ইতিহাসের ……অবশেষ’
০২. ‘বিনা বেদনায় বিছিয়ে এসেছ তোমার বর্জিত সৃষ্টি
অগণ্য বিষ্মৃতির স্তরে স্তরে।’
কবি নিজেই বলছেন– তীর্থের পথে পথে ভাঙ্গা ইতিহাসের অবশেষ ছড়িয়ে আসা হয়েছে এবং বিষ্মৃতির স্তরে স্তরে তিলমাত্র বেদনা বিধুর না হ’য়ে অগণন বর্জিত সৃষ্টিকে বিছিয়ে আসা হয়েছে। অর্থাৎ ভাঙ্গা ইতিহাসের অবশেষ আর সে ধরনের সৃষ্টিকে তিনি গ্রহণযোগ্য হবার মতো যথার্থ যোগ্য বলে মনে করেন নি। যোগ্য বিবেচিত না হবার কারণকেও তিনি স্পষ্ট করেছেন– ‘ভাঙ্গা ইতিহাস’ এবং ‘বর্জিত সৃষ্টি’– ব’লে। যার প্রমাণ– ‘মুসলমানীর গল্প’।
[divider style=”solid” top=”20″ bottom=”20″]