সৌর শাইন

ভুলবিদ্যার দাবাখেলায় সিংহ রাজার কেশর

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

তখন উত্তপ্ত ও উত্থিত পৃথিবীর বাসিন্দা আমি! বনের ভেতর ছুটছি তো ছুটছি! পায়ের তলায় শুকনো শালপাতার মর্মর শব্দে মিলিয়ে যাচ্ছে চাঁপার কণ্ঠস্বর!

….সৌরোষ, যাসনে, দাঁড়া বলছি!

আমি দাঁড়াতে পারছি না, ছুটছি, পালাচ্ছি, জ্বালাচ্ছি সব! পুরো শালবন আমার পিছু পিছু ছুটছে!

পঁচিশটি বসন্ত কেটে গেল। এখনো সেই ছুটতে থাকা পুরনো স্মৃতি মনে পড়লে হাসি পায়, হাসতে হাসতে আমি গড়াগড়ি দেই বিছানায়। এখনো কানে বাজে চাঁপার একগুচ্ছ ভৎর্সনা। সে কানের কাছে বার বার বলতে থাকে, তোর মতো বোকা আর হয় না। সৌরোষ, তুই এমন বোকা কেন রে?

সিগারেটের ধোঁয়া উড়ছে মহাকাশের গন্তব্যে। আর মগজের ভেতর স্মৃতির ঢেউ! বোকাময় স্মৃতির আবডালে একদিন আমি আরোহণ করেছিলাম। আমি বোকা, সত্যিই আমি বোকা, অর্ধেক বোকা আমি, পুরোপুরি বোকাও আমি। ভীষণ বোকাটে আমি। এই বোকামিতেই প্রথম কৈশোরের কতগুলো বছর আমি ভয়ে জড়সড় হয়ে কাটিয়েছি, পালিয়ে বেড়িয়েছি দিনের পর দিন। দূরত্বের এই দুরভিসন্ধিকে লালন করেছি কত শত দিন-সপ্তাহ-মাস মিলিয়ে বছর বছর… এর যেন ইয়ত্তা নেই। শরীরের ঘ্রাণ শুঁকেও দূরে ঠেলে দিয়েছি চাঁপাকে। ওর কান্না ভরা চোখ দেখে যতটা না মায়া অনুভব করতাম এর চেয়েও বেশি ছিল আমার আত্মভয়। বিদঘুটে অনুভূতিরা আমাকে পিষে মারতো প্রতিনিয়ত। পাগল হবার ভয় গলা টিপে ধরতো। আমি দিনের পর দিন, রাতের পর রাত অন্ধকার ঘরে কাটিয়েছি। একা কেঁদেছি। সে কান্নার শব্দ এই পৃথিবীর কেউ শুনতে পায়নি। কখনো কখনো নিজেই নিজের কান্নার গলা টিপে ধরেছি। নিকষ অন্ধকারের ভেতর গুহা মানবের মতো বসে রয়েছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মানসিক যন্ত্রণায় দুনিয়াতে অনবরত আঁধার নামতো কুয়াশার মতো। আজ বর্তমানে দাঁড়িয়েও ওসব নির্ঘুম রাতের হিসেব কষতে ভয় হয়।

হ্যাঁ, দীর্ঘ যন্ত্রণার বেড়াজালে বন্দি আমি! তবুও যখন চাঁপার বুকে মাথা রেখে নিশ্বাস উত্তপ্ত হত তখন এক ঝটকা শান্তির পরশ খেলে যেত আমার ভেতরে। চুমুতে ছিলো তৃপ্তি। চাঁপা চাইতো আমাকে আরেকটু কাছে টানতে। ওর শরীরে জ্বরের মত কাঁপুনি জাগত, পরস্পরকে জড়িয়ে ধরতেই সেই কাঁপুনি আমাকে গ্রাস করত। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে নিশ্বাস ঘন হয়ে যেত। চাঁপার বাম হাত আমার উরুসন্ধি স্পর্শ করতেই বিদ্যুৎ তরঙ্গে পৌরুষ অস্তিত্ব উত্থিত হতো! কোমল হাতের পরশটুকু পাথরকে আরো পাথরে পরিণত করত, পাথুরে ক্ষুধা বেড়ে যেত তুমুল বেগে। আর আমার হাত ওর বুকে রাখতেই জগতে জাগত প্রলয়। পিষতে থাকা এত চাপ এত ঝাঁকুনিতে যেন ওর লেশমাত্র ব্যথা ছিলো না। ঠোঁটে তীব্র কামড়েও নির্বিকার ও। যেন কামনায় অবশ ওর গোটা দেহ। আর যখন ও আমাকে অন্ধ কামে মশগুল করতে করতে টাউজারটা সরাতে চাইতো তখনই আমার হুঁশ হতো। তখনই আমি সব বন্ধন দূরে ঠেলে দৌড়ে পালাতাম। সে দৌড়ে যেন গোটা পৃথিবী ভয়ে ভয়ে দৌড়াতে থাকত। আর আমি নিজেকে প্রবোধ দিয়ে বলতে থাকতাম, এই সীমাটুকু অতিক্রম করলেই সব তছনছ হয়ে যাবে। এক অপ্রিয় সত্য চাঁপার সামনে প্রকাশ পাবে আর আমি চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবো। বিচ্ছেদের ভয় আমাকে মিথ্যুক হতে শিখিয়েছে, আমাকে বানিয়েছে ভীতু, আমি গড়েছে নিকৃষ্ট বোকা রূপে।

এরপর থেকে আমি চির বোকা। আজ বোকা অভিধানে আমার নাম লেখার পর, একটি পুণ্যময় স্বীকারোক্তি প্রকাশ পেল। সে রাতগুলো কেমন ছিল? একা, নিস্তব্ধ শূন্যতায় হাহাকার চতুর্দিক! ঘড়ির কাঁটা অনায়াসে ছুটে যেত রাত দুইটা থেকে তিনটার ঘরে। জানালার ওপাশে থাকত রাতজাগা পাখি। ওসব দিনে বিদঘুটে অন্ধকার এসে ঠাঁই নিয়েছে উরুর ভাঁজে। অসহ্য ছিলো সব! যেন একগুচ্ছ তাণ্ডব এসে ভেঙেচুরে দেয় প্রতিমুহূর্তকে। অথচ, এমনটা তো হবার কথা ছিলো না। চারপাশে সবার হাসি মাখা মুখের ভিড়ে আমিই কেবল বেমানান। বেমানান আমার একগুচ্ছ কেশর, এগুলো ইচ্ছে করে টেনে তুলে ফেলতে। চেষ্টা তো কম করিনি, ব্যথায় দুচোখ বন্ধ হয়ে আসে, পারি না। ব্লেডের আঘাতেও হয়েছে রক্তারক্তি! সে যন্ত্রণা কোনোদিন কাউকে প্রকাশ করতে পারিনি।

লবণাক্ত জলে দু’গাল ভিজে, অথচ..। শুধু কি ব্যথায় এত কষ্ট, না ভয়। প্রচণ্ড ভয় আমাকে গলা টিপে ধরে, ভয় আমাকে গিলে খেতে চায়, ভয় আমাকে পাগল রূপে রাস্তায় ছুঁড়ে দেয়। পাগল, ওই পাগলটা বার বার দুঃস্বপ্নে এসে ধরা দিতো। পাগলটা আমার স্মৃতিতে ভীষণ পুরনো, অথচ মনে হতো আমিই সেই পাগল, আমিই নগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি রাস্তায় রাস্তায়। আমার শরীর জুড়ে কালি-ধূলি ময়লা, মাথা ভর্তি জট পাকানো চুল, মুখ ভর্তি জট দাঁড়ি আর নাভির নিচ থেকে হাঁটু অবধি নিকষ আন্ধার রাত!

ভাবতেই আমার শরীর কাঁটা দেয়, টাউজার কোমর থেকে নামিয়ে দেখতে থাকি উরুসন্ধি। অসহ্য লাগে এই দৃশ্য। পুরুষাঙ্গ বেচারাকে খুব অসহায় মনে হয়। কালো কুৎসিত জঙ্গলের মাঝে সে তীব্র বোকা। যন্ত্রণা ভুলতে হিংস্র হয়ে উঠতাম কখনো কখনো, বীর্যস্খলনের পর আমার বাঁধ ভাঙা কান্না আসতো। পুনরায়, সেই অন্ধকার উরুসন্ধির ভয় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতো। জগতের এক বিচ্ছিন্ন নিয়ামক হয়ে আমি যেন রাতের স্রোতে কচুরিপানা কেবল! নিজের প্রতি অভিমান হতো, অথচ আমি এই জেলখানা ভাঙতে পারিনি। ঘর থেকে বেরোতে গেলে হাজারো বাধা আমার পা জড়িয়ে ধরতো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হালকা দাড়ি-গোঁফগুলো দেখতাম। ওগুলো আমাকে আনন্দ দিতো বটে, বড় হবার তীব্র বাসনাও জাগাতো। কেবল ওই একখণ্ড অন্ধকার আমাকে তটস্থ করে রাখতো।

ওসব রাত ছিল ভীষণ আতঙ্ক ভরপুর যন্ত্রণার। হাতঘড়িটা রাতের পর রাত টিক টিক ছুটতে থাকে। ভয়গুলো দলা পাকাতে থাকে বুকের ভেতর। চাঁপার মুখটা ভেসে ওঠত। ওর একগুচ্ছ পুরনো কথা বার বার কানে বাজে।

সে বলত, কোনো পাগলকে আমি বিয়ে করবো না। পাগলকে আমি ভয় পাই।

এসব কথা যেন সহ্য হতো না। মনে হতো, আমি সত্যিই পাগল হয়ে যাচ্ছি। ওর বলা সেই লক্ষণগুলো যে আমার মধ্যে বিরাজমান।

ঘুম ভাঙা বিস্তৃত মনোভূমিতে আমি অসহায় মুসাফির। কাচের টুকরোর মতো ঘুম ভাঙা দৃশ্যগুলোর ভেতর দিয়ে যখনই ছুটতে থাকি, তখন মনে হয় পা দুটো রক্তাক্ত যন্ত্রণায় জখম। কখনো লুটিয়ে পড়ি কাঁটার উপর, গোটা শরীর তখন রক্তাক্ত। মৃত্যু যন্ত্রণার লেলিহান শিখায় পুড়তে পুড়তে একসময় রাত উড়ে যায়। একগুচ্ছ ক্ষতাক্ত শাসন এসে কড়া নাড়ে। আর ঘুমানো যায় না, আর ঘুম আসে না, ঘুমানো তখন ভুল।

কখনো কখনো ইচ্ছে করত পাঠ্য বইগুলোকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলি। পড়তে ভালো লাগে না। লিখতে ভালো লাগে না। কখনো মনে হয় এসবের চেয়ে হারিয়ে যাওয়া ভালো। হারিয়ে যেতে চাই, হারাতে হারাতে ঘুমাই। ঘুমের ভেতর ভাসে চাঁপার মুখ। ওকে জড়িয়ে ধরতে চাই। সে আমাকে কোমল আগ্রহে কাছে টানে। সে মুহূর্তে চুমুর তীব্র আনন্দ পিষে মারতে চায় আমাদের। সৌখিনতার অপূর্ব অনুভূতি ঢেউ খেলে যেত তখন চাঁপার হাসিতে। ঝাপটে ধরা মাধুর্য আমাদের নিয়ে চলে এক নির্জন দ্বীপে। মুগ্ধতা ও নগ্নতার আভিজাত্য আমাদের ঘিরে ধরে। স্বপ্নের গতিরেখা কামনার সর্বোচ্চ সূচক বিন্দু স্পর্শ করে, যখনই মনে পড়ে উরুসন্ধির দৃশ্যটা তখনই আমি আদমের মতো ছিঁটকে পড়ি রাক্ষসের দ্বীপে, অভিশপ্ত পৃথিবীতে। আর চাঁপা ছিঁটকে পড়ে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে।

নিজেকে লুকাতে আমি ছুটতে থাকি মাইলের পর মাইল। চাঁপা আমাকে খুঁজে বেড়ায় কামিনী সঙ্গীত কণ্ঠে ধারণ করে। দুটো শরীর ও মন তীব্র তেষ্টায় এক হতে চায় অথচ পারি না। পালাতে পালাতে আমি ক্লান্ত! ক্লান্ত আমার দুচোখ!

মনে পড়ে, ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। বাবা তখন দূর প্রবাসে। সংসারে কেবল আমি ও মা। মা কখনোই চাইত না আমি বাইরে কোথাও যাই। বাইরের কারোর সাথে মেশা, মাঠে খেলাধুলা করতে যাওয়া ছিল একেবারে নিষিদ্ধ।

বড় ভাইয়ার অকাল মৃত্যু আমাদের পরিবারে যে শোকের ছায়া ফেলেছিল তা মায়ের মন থেকে কখনোই ঘুচেনি। আমি স্কুল থেকে ফিরতে দেরি হলে মা অস্থির হয়ে যেত।

শৈবব থেকেই মা আমাকে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলত, সৌগতকে হারিয়ে আমি একা হয়ে গেছি। আমার ভয় হয়, তোর যদি কিছু হয়ে যায় বাপ, আমি কাকে নিয়ে বাঁচবো।

আমি নিরুত্তর হয়ে কাঁদতাম। দাদার কথা মনে পড়ত।

মা বলতে থাকত, খোদার কসম খেয়ে বল, আমার কথার অবাধ্য হবি না।

আমি হাউমাউ করে কেঁদে দিতাম। কিন্তু অবাধ্য হবো না, এমন কসম আমি গ্রহণ করতে পারিনি।

মায়ের আবেগে গড়া শিকলবন্দি এই মায়া আমাকে একদিকে যেমন কাঁদাতো অন্যদিকে রাগান্বিত স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যেত অন্য দিগন্তে। স্কুল ফাঁকি ও চুপিচুপি বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানোই তখন আমার জন্য বিন্দু বিন্দু স্বাধীনতা। স্বাধীনতা উদযাপনে কখনো কখনো যে ধরা পড়িনি তা নয়। বেশ কয়েকবার স্কুল বদল করতে হয়েছে এসব অপরাধের কারণে। মাত্র ছয় মাস টিকেছিলাম কওমি মাদ্রাসায়, তারপর বের করে দেয়া হলো। আমার প্রতি অপারগ মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। নতুন স্কুলে ভর্তি হবার পর চাঁপার সাথে পরিচয়। সময় যেতে যেতে আমার বনে ছুটে বেড়ানোর গোপন মিশনের একমাত্র বিশ্বস্ত সঙ্গী ও সাক্ষী হয়ে উঠে সে।

চাঁপাদের বাড়িটা ছিল গ্রামের একদম শেষ প্রান্তে! ওরা সনাতন ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়েছিল, সম্ভবত ওর ঠাকুর্দার বাবা প্রথম মুসলিম হয়। তারপর থেকে ওরা বাঙালি মুসলিম হিসেবেই পরিচিত। চাঁপাদের পরিবারে দরিদ্রতা ছিল নিত্য সঙ্গী। ওর বাবার কোনো ফসলি জমি ছিল না। বর্গাচাষি হয়ে গেরস্থের কাছে চাষের জন্য জমি ভিক্ষে চাইত।

আমাদের গ্রামের বাড়িগুলো ছিল বেশ দূরে দূরে। চাঁপাদের বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি ছিল দশ মিনিটের পথ। এই গ্রামের একেকটা বাড়ির মাঝামাঝি ছিল শাল গাছে ভরপুর। বলা যায়, গ্রামগুলো শাল গাছের পাতার আঁচলে জড়ানো। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামের মধ্যে যেন বিচ্ছিন্নতার দেয়াল তৈরি করে দেয় এই ঘন শালবন।

ঘুড়ি উড়ানো দুপুরে চাঁপা ও আমি বয়ে বেড়াতাম এক একটা রূপকথা। মুক্ত বিহঙ্গের মতো ছিলো আমাদের দৌড়-ঝাঁপ। নতুন স্কুলে সহপাঠীদের মধ্যে সবার সাথে আমার তেমন সখ্য গড়ে ওঠেনি। পেছনের বেঞ্চে বসা চাঁপা ও আমার মধ্যে বন্ধুত্বটা গড়ে উঠে কোনো এক অজানা কারণে।

শৈশবের শেষ দিনগুলোতে প্রেমের জোয়ার এসেছিল। তখনই কাঁচা পৃথিবীর কামনার রস আস্বাদন করেছিলাম তীব্র তৃপ্তিতে। এই শালবনই ছিলো তখন আমাদের বৃন্দাবন।

চৈত্রের দিনে শালবনে ফুলের মেলা জমত। সুঘ্রাণে মউ মউ মাদকতায় ভরপুর থাকত চারপাশ। তখন আমাদের বাধ না মানা বালকবেলা, হাতে হাত ধরে ছুটে চলা। চাঁপা মধু ভীষণ ভালোবাসত, বনের ভেতরে কোথায় মৌচাক আছে তাই আমরা খুঁজে বেড়াতাম। গাছের ডালে কিংবা মাটির টিলায় কোটর ভর্তি মৌচাক থাকত। ছোটো ছোটো মৌচাকগুলো দেখে দেখে রাখতাম, অপেক্ষা থাকত মধুতে পূর্ণ হবার। যেদিন মৌচাক ভাঙার পরিকল্পনা থাকত, আমাদের আয়োজন করতে হতো নানা সরঞ্জামের।

স্কুল ফাঁকি দেয়া নির্জন দুপুরে আমরা যেতাম মধু শিকারের উদ্দেশ্যে। পাটকাঠিতে খরকুটো বা শালপাতা বেঁধে আগুন জ্বেলে ধোঁয়া ছড়াতাম মৌচাকে। মৌমাছিগুলো দৌড়ে দূরে পালাত। আর আমরা মৌচাক ভেঙে কলাগাছের বাকল ভরে মধু নিতাম। কখনো কখনো দোকান থেকে পঞ্চাশ পয়সার পলিথিন কিনে সঙ্গে নিতাম মধু জমানোর জন্য।

মধু ঝরানোর সময় চাঁপা বলত, পুরো চাক ভাঙিস না। মৌমাছিগুলো আবার এসে বাসা বাঁধবে।

আমি কখনোই পুরো মৌচাক ভাঙিনি। আবার ওরা সুখের সংসার পাতুক তাই চাইতাম। চাঁপার হাসিমাখা মুখ ও টলটলে মধু আনন্দে যেন একাকার হয়ে যেত। প্রতিবারই মৌমাছিদের দু’চারটে কামড় যে আমি খাইনি তা অস্বীকার করার জো নেই।

আমরা আরো খুঁজে বেড়াতাম তালআঁটি, মেটেআলু। শালবনের ভেতরে অনেক তালগাছ ছিলো। লম্বা লম্বা ওসব গাছের তাল কেউ কখনো লোকালয় থেকে এসে সংগ্রহ করত না, কারণ গ্রামেই ঢের তালগাছ ছিল। বনের বানর, কাঠবেরালি ও পাখিদের তাল খাওয়া শেষ হলে আঁটিগুলো গাছের নিচে পড়ে থাকত, সেগুলো আবার শেকড় গজিয়ে চারা হতো। শীতের শুরুতে ওসব তালআঁটিতে মজাদার শাঁস হতো।

স্কুল পালানো দুপুরে ওই তালআঁটি আমরা কুড়িয়ে আনতাম। তালআঁটি কাটার জন্য কামারশালা থেকে বিশ টাকা দিয়ে একটা দা কিনেছিলাম। কারণ, বাড়ি থেকে দা আনা-নেয়াটা ঝামেলার ছিল, ধরা পড়ার ভয় তো ছিলোই। কেনা দা-টা ছোট্ট অথচ ভয়ঙ্কর ধারালো ছিল। আমি ও চাঁপা তালআঁটি কেটে কেটে ধবধবে সাদা মিষ্টি শাঁস বের করে খেতাম। তারপর দা-টা লুকিয়ে রাখতাম বনের ভেতরেই। এছাড়া কখনো কখনো আমরা ডজন ডজন মেটে আলু জমাতাম। সেগুলো পুড়িয়ে লবণ মিশিয়ে খেতে ভীষণ মজা ছিলো।

বৃন্দাবনের আরম্ভ স্মৃতিটা এখনো জ্বলজ্বলে। অগ্রহায়ণের দুপুর! একদিন তালআঁটি কুড়াতে বনের ভেতরে যাই। হঠাৎ আকাশ কালো হয়ে আসে। হাওয়া বয়ে যেতে থাকে উত্তর থেকে দক্ষিণে। চাঁপার মুখ শুকিয়ে আসে। ও বলে, চল্ বাড়ি চলে যাই।

বনের এতটা ভেতরে চলে এসেছি যে ফিরতে গেলেও বৃষ্টির ফাঁদেই পড়তে হবে। তাই আমি ওর কথা নাকচ করে দেই। বরং তালআঁটি কুড়ানোর উদ্দেশ্যে আরো গভীর বনে তালগাছগুলোর কাছে যেতে থাকি।

এক সময় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি নামতে শুরু করে। কোথাও আশ্রয় নেবার উপায় ছিলো না। হঠাৎ চোখ পড়ে একটি মরা তালগাছের কোটরের দিকে। পাতাশূন্য দণ্ডায়মান ওই তালগাছটা যেন স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়ানো। দূর থেকেই বোঝা যায় গাছের ভেতরটা একেবারে ফাঁপা।

চাঁপাকে বলি, চল ওই গাছটার ভেতর গিয়ে দাঁড়াই।

ততক্ষণে চাঁপার পাতলা ফ্রক হালকা ভিজে গেছে। এদিকে কোটি কোটি বৃষ্টির ফোঁটা শিশিরের মতো চক চক করছিল আমার গায়ের সোয়েটার ও টাউজারের উপর।

চাঁপা তালগাছের কোটরের কথা শুনে এক বাক্যে সাড়া দেয়। আমরা দৌড়ে কোটরের কাছে এগিয়ে যাই।

চাঁপা সতর্ক হয়ে বলে, ভেতরে সাপটাপ থাকতে পারে।

আমি ফাঁপা গাছটার ভেতর মাথা বাড়িয়ে ভেতরটা দেখে বলি, ভয় নাই। সাপ এমন জায়গায় থাকে না।

তালগাছের গুঁড়ির দিকে একটু ভাঙা ছিল, ওটা দা দিয়ে আরেকটু কেটে দরোজার মত বানিয়ে ফেললাম। যেন গুহামুখ! ভেতরের আবর্জনা বাইরে ফেলে আমরা ছোট্ট কোটর ঘরটাতে ঢুকে পড়ি। সেদিন বৃষ্টির পানি দুজনকে ছুঁতেও পারেনি। শীতকালের এক পশলা বৃষ্টি যেন শীতলতা বাড়িয়ে দিয়েছিল কয়েকগুণ।

চাঁপা থরথর কাঁপছিল। ওকে আমার সোয়েটারটা পরিয়ে দিলাম। তবুও ও কাঁপছিল, নেতিয়ে পড়ছিল প্রায়। হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরি। চাঁপা আমার বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রাখলো। ও যেন চির উষ্ণতা কাতর। আমি তখন বুক পেতে দেই, দু’হাতে দুটো দেহ একাকার করে রাখি। অল্প জায়গায় এই যে জড়াজড়ি করে দাঁড়ালাম এতেই আমাদের চিরসন্ধি ঘটে গেল।

অনেকক্ষণ পরে চাঁপা চোখ খুললো। কেবল বলল, চল বর-বউ খেলি!

অবুঝ হলেও কেমন যেন সবই বুঝতাম। সিনেমাতে দেখা জুনিয়র নায়ক-নায়িকাদের মতো মনে হতে লাগল নিজেদের।

চাঁপা আদিম খেলার রূপ-নেশা স্বাদ-রসদের প্রস্তাব আমার কাছে উপস্থাপন করল। এক অজানা আকর্ষণ আমাদের নগ্নতার দোরগোড়ায় পৌঁছে দিলো। আদম-হাওয়ার সেই আদিম খেলা আমাদের গ্রাস করলো।

আমাদের মতো বালক-বালিকার এই অপরিপক্ব কাঁচা বাসর কি প্রকৃতির কোনো খেয়াল নাকি অভিশপ্ত সঙ্গম? আমি জানিনে। প্রশ্নটা অজস্রবার উঁকি দিতো মনের ভেতর। পঁচিশটি বসন্ত শেষে আজও সেই উঁকি দেয়া থামায়নি।

তারপর কত শতবার এই বর-বউ খেলায় মেতেছিলাম এর হিসেব কষিনি। মৃত তালগাছের সেই ছোট্ট কোটর আমাদের বাল্য ভালোবাসায় যেন জীবন ফিরে পেয়েছিল, যত্নে পেয়েছিল সাংসারিক রূপ! কোটরের ভেতরটা দা দিয়ে কেটে-ছেঁটে পরিষ্কার করি, তখন তালকাঠের ধারালো ফলাগুলো আর আমাদের জন্য বিপদজ্জনক ছিলো না। চাঁপা কোটরের ভেতরে কিছু খেলনার আমদানি করেছিল, মাটির হাঁড়ি-পাতিল এইসব। টগরফুল, ভাঁটফুল, মাধবীলতাসহ আরো কতশত ফুল দিয়ে সে কোটর সাজাতো, আর আমাদের কাঁচা সঙ্গমে যেন সুগন্ধির জোয়ার জাগত এইসব ফুলের শরীরে।

কখনো কখনো আমার মনে ভীষণ পাপবোধ জাগত।

চাঁপাকে বলতাম, এসব খেলা ভাল না। পাপ হবে।

চাঁপা আমাকে উল্টো ক্লাসের মেডামের মতো বোঝাত, এই খেলার মধ্য দিয়েই পৃথিবীতে আমাদের জন্ম। এই খেলা আছে বলেই এত প্রাণের উৎসব!

চাঁপা আরো বলত, জানিস সৌরোষ, মিতা আপু আর রাজন ভাইয়াও এগুলো করে।

আমি অবাক হয়ে বলি, কী বলিস এসব?

ও বিস্তারিত খুলে বলে। চাঁপার বড়ো বোন মিতার বিয়ে হয়েছিল পাশের বাড়িতে থাকা লজিং মাস্টার রাজন ভাইয়ার সাথে। বিয়ের পর থেকে রাজন ভাইয়া চাঁপাদের বাড়িতেই থাকে। ঘরের অভাবে ওরা সবাই একই ঘরে থাকত।

চাঁপা বলতে থাকে, একবার বৃষ্টির দিনে আমরা সবাই রান্না ঘরে বসা, মা সিমের বিচি বেজে দিচ্ছে, আমরা সবাই খাচ্ছি। তখন আপু-ভাইয়া শোবার ঘরে এসব করছিল, আর বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখে ফেলেছি। কথাটা বলেই চাঁপা তুমুল শব্দে হাসতে থাকে।

হাসি থামিয়ে বলে, স্কুলে কাউকে এসব বলিসনে।

আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বলি, এসব মাথা-মুণ্ডু বলতে যাবো কেন?

এভাবে যদি দিনগুলো কেটে যেত, দোষ ছিলো না একবিন্দু। একদিন স্কুল ছুটির পর আমরা ফিরছিলাম। পথে এক অভিশপ্ত দৃশ্য হাজির হয়, যা আমার জীবনের কৈশোর মুহূর্তকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে।

রাস্তায় ধূলি উড়িয়ে একটা পাগল টগবগিয়ে ছুটছে তখন। একদল দুষ্ট ছেলে পাগলটাকে ঢিল ছুঁড়ছে। পাগলটার জটপাকানো চুল-দাড়িতে ভরপুর মুখ থেকে নোংরা গালি বেরোয়। ভাঙাচোরা দাঁতগুলো দেখতে ছিলো ভয়ানক! এর চেয়েও ভয়ানক ছিলো পাগলটার দেহের নিম্নাংশ। নগ্ন পাগল! পুরো শরীরে এক টুকরো জামা নেই। নাভির নিচে হাঁটু অবধি এক জঙ্গল অন্ধকার। দেখে মনে হয়, ওখানে অন্ধকার ছাড়া কিছু নেই। সবটাই দখল হয়ে আছে কালো জঙ্গলে। এতটুকুই ছিল সেই মুহূর্তের অভিশপ্ত দৃশ্য!

চাঁপা সেদিন হাঁটতে হাঁটতে বলেছিল, জানিস সৌরোষ, পাগলদের ওখানে এমন জঙ্গলই থাকে। যারা ভালো মানুষ, পাগল নয়, তাদের এসব থাকে না।

আমি তখন বলতে থাকি, আমার ওখানে এসব নেই।

চাঁপা মিষ্টি হেসে বলে, আমি তো জানি তুই পাগল না। তবুও বাড়ি গিয়ে দেখিস।

আমি রাগান্বিত হয়ে বলি, তুই কি আমারটা দেখিসনি?

চাঁপা বলে, আন্ধার তালঘরে কি সবকিছু দেখা যায়?

সেদিন বাড়ি ফিরে আমি নাভির নিচের অংশ সতর্ক হয়ে দেখেছিলাম। ওটার আশপাশ মসৃণ একেবারে। কোনো নোংরা চুলের অস্তিত্ব ছিলো না। তখন আনন্দময় ছিলো আমার মগজের হিসেব।

পরদিন সেই তালকুঠুরিতে আমরা আদিম খেলায় মেতে ওঠি। পরস্পরের ঊরুসন্ধি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম। সেদিন ওই পাগলের মতো দুর্দশা আমাদের ছিলো না। আমরা তখন আনন্দিত! আমাদের কাঁচামন বার বার স্বীকৃতি দিচ্ছিল আমরা যেন নিষ্পাপ নিষ্কলুষ দেব-দেবী! আমাদের কোথাও ত্রুটি নেই, নেই ভুলের ছিঁটেফোঁটা! ভ্রান্তির নির্ভুলে যেন জলশূন্য খাঁ খাঁ প্রান্তরে ডিপ মেশিনের জল ছড়িয়ে পড়ছে, হৈ-হুল্লোড় লেগেছে ফসলের সংসারে। কিংবা ঝর্ণার জলে অনিন্দ্য নৃত্য জেগেছে প্রকৃতিতে! জগতের কোনো কাঁচাঘাটে তখনও শৈবাল বাসা বাঁধেনি, কোনো জঞ্জাল এসে বিপত্তি সৃষ্টি করেনি।

চাঁপা বলতে থাকে, আমাদের যদি ওখানে এমন জঙ্গল থাকত আমরা কবেই তো পাগল হয়ে যেতাম। তুই-আমি আমরা কেউ পাগল নই।

জানিস, আমাদের দূর সম্পর্কের একটা পাগলি ফুফু ছিল। দাদির মুখে শুনেছি, ফুফুটা জামা পরত না। একদিন গাবগাছে ফাঁস দিয়ে মরেছে। আমার মনে হয়, পাগলি ফুফুটার ওখানেও জঙ্গলের মতো অবস্থা ছিল।

আমি আরেকটু কথা বাড়িয়ে বলেছিলাম, জানিস চাঁপা, পাগলটার তো হিসুটাও নেই। সব শুধু জঙ্গল।

চাঁপা হেসে বলে, হুম। পাগলরা তো আমাদের মতো বর-বউ খেলে না, তাই তো ওদের ওই জিনিসটা নেই। যারা এসব খেলতে জানে ওরা কখনো পাগল হয় না। আমাদের মিতা আপু আর রাজন ভাইকেও তো দেখেছি, ওদেরও ওখানে এমন জঙ্গল নেই। ওরাও ভালো আছে, কেউ পাগল নয়।

আমাদের কাঁচা ভাবনায় গড়া এই থিওরি সেদিন আমি ততটা স্মরণ রাখতে চাইনি। কিন্তু মনের ভেতর গেঁথে গিয়েছিল। আমি পাগল নই, এই ভাবনাতেই সন্তুষ্ট ছিলাম। আনন্দিত ছিলাম। এই আনন্দের পরিণতি যে এত জঘন্য হবে ভাবিনি।

কেটে গেল অনেকদিন। এরপর একদিন চাঁপা বলেছিল, ওর দাদি রাগ করে বলেছে যে, ওকে রাস্তার ওই পাগলের সাথে বিয়ে দিবে।

এতে চাঁপার সেকি অভিযোগ। সে ক্ষোভে জ্বলতে জ্বলতে বলে, আমি জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই তাই দাদি বলে আমাকে ওই নেংটু পাগলের সাথে বিয়ে দিবে। যদি পাগলের সাথে বিয়ে হয়, তখন তো আমার কপাল পুড়বে।

চাঁপার এই দুঃখ প্রকাশের মধ্যে ছেলেখেলাই ছিল সবচেয়ে বেশি। আমার হাসি পাচ্ছিল। তবুও ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলাম, ভাবিসনে চাঁপা আমিই তোকে বিয়ে করবো। পাগলের সাথে তোর থাকতে হবে না।

একসময় সহপাঠিদের মধ্যে চাঁপা ছাড়াও আরো কয়েকজনের সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ওরা ছিল ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু ছেলে। ওদের কাছ থেকে আমি দাবা খেলা শিখি। ঘুরে বেড়ানোর দলে ওদেরকেও পেয়ে যাই। এভাবে দিন যেতে যেতে আমাদের ক্লাস ফাঁকি, পড়ালেখা ফাঁকির পরিধি কেবল বাড়তে থাকে। সাধারণত স্কুলে প্রথম ক্লাসে শিক্ষার্থীদের হাজিরা ডাকা হতো, তাই শুধুমাত্র প্রথম ক্লাস পর্যন্তই ছিল আমার স্কুলটাইম, তারপর নিরুদ্দেশ। ওদের সাথে ছুটে যেতাম সুবর্ণপুর মার্কেট, নদীর ঘাট, চন্দন হাট, পরদেশি মাজার প্রভৃতি জায়গায়!

কিন্তু গহীন বনে ঘুরে বেড়ানোর একমাত্র সাথী ছিল চাঁপা, চিরকালেরই একজন সে। চাঁপা আমাকে একটা কথা বার বার বারণ করত, কারোর কাছে যেন আমি আমাদের বর-বউ খেলার কথাটা প্রকাশ না করি। আমি ওর কথা চিরকাল অক্ষয় রেখেছি।

টিফিনের টাকা জমিয়ে একদিন আমি ছোট্ট একটা দাবার বোর্ড কিনে ফেলি। সাদা ও কালো রঙের কতগুলো চকচকে ঘুঁটি! তালকুঠুরিতে বসে চাঁপাকে দাবা খেলা শিখিয়েছিলাম। তবে ওর দাবার চালগুলো বরাবরই ছিলো ভুলে ভরা, হেরে যেত বার বার। বনের ফুল-ফল কুড়ানোর বাইরে আমরা দাবাখেলায় কতশত দিন ফুরিয়ে দিয়েছি সে হিসেবও নেই।

একদিন চাঁপা তালকুঠুরিতে নতুন একটি খেলনা নিয়ে আসে। ওটা সাদা রঙের একটি প্লাস্টিকের সিংহ! সিংহটার কেশরগুলো ছিল কাজলের কালি মাখা!

আমি বলতাম বোকা নাকি তুই, সিংহের কেশর কখনো কালো হয়?

-সাদাই ছিল। আমি কালি মাখিয়ে দিলাম।

-কেন?

-সাদা কেশর ভালো দেখায় না। সিংহ গর্জন করবে, কালো কেশর দুলবে এই তো সুন্দর!

চাঁপার এসব খামখেয়ালি আমাকে তেমন টানত না। আমাকে টানত ওর সেই বর-বউ খেলা। কোনো কোনো দিন দাবা খেলায় হেরে যাবার কারণে ও বর-বউ খেলা খেলতে চাইতো না। তখন আমিই ইচ্ছে করে হেরে যেতাম। আর ওকে খুশি করে বর-বউ খেলায় ডুবে যেতাম। কি এক বোকামো সেই খেলাটা, বুঝি না জানি না কিছুই তবুও এক অদম্য আকর্ষণ আমাদের টানত। বাল্যকালে এই অংশটুকু রহস্যের বিস্তৃতি যে গোটা জীবনব্যাপী তা তখন অনুভব করার শক্তি ছিল না।

তারপর অনেক সূর্যোদয় হলো, সূর্যাস্ত গেল। ভর্তি হলাম হাই স্কুলে। কিন্তু, পড়াশোনার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র মনোযোগ ছিল না। ক্লাস ফাঁকি দিতে দিতেই জীবন কাটছে। আমার আছে শালবন, আছে চাঁপার মতো একজন। যদিও চাঁপা তখন আর স্কুলমুখী হয়নি। তাই নতুন স্কুলে যেতে কখনোই মন থেকে সায় ছিল না।

ক্লাস ফাঁকির বিষয়টা মা ঘুণাক্ষরেও জানত না। অকৃতকার্য ছিলাম, তবুও ক্লাস সেভেনে আমাকে প্রমোশন দেয়া হলো। অন্যদিকে অভিভাবক ডাকিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষের সেকি শাসানি, এতেই সর্বনাশ ঘটল! সেদিনই মা প্রথম জানতে পারে গত চারমাস ধরে আমি স্কুল কামাই দিচ্ছি। আর বিগত পুরো বছরে মাত্র ঊনত্রিশ দিন স্কুলে উপস্থিত ছিলাম। এরপর থেকে আমার কপালে দুর্ভোগ নেমে আসে। ঘরে দরোজা লাগিয়ে মা আমাকে পেটালো। পিঠ ফুলে যায় আঘাতে আঘাতে। বার বার, জিজ্ঞেস করে এতদিন স্কুল ব্যাগ নিয়ে কোথায় গিয়েছিস?

আমি নিরুত্তর। কণ্ঠনালীতে তখন জমাট কান্না!

মা মারতে মারতে বলেছিল, তুই কি আমার মরা মুখ দেখতে চাস? আজ আমার বড়ো ছেলে বেঁচে থাকলে এমন করত না। সে তোর মতো অমানুষ হতো না।

মায়ের কথা শুনে আমার মনে হচ্ছিল, দাদা না মরে যদি আমি মরে যেতাম তবেই ভাল হতো। কোনোভাবে যদি খোদাকে রাজি করিয়ে দাদাকে ফিরিয়ে আনতে পারতাম। তাহলে আমি মরে গিয়ে দাদাকে ফিরে আসতে বলতাম।

মা তো বাবাকে সবকিছু চিঠি লিখে জানিয়েছিল। বাবার নির্দেশে আমার অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। চারজন শিক্ষক বাড়ি এসে পড়াত। ঘর আর বারান্দার মধ্যে আমি আবদ্ধ! সাত-আট মাস এভাবে কাটে। আমি গৃহবন্দি! কয়েকদিন পরপরই মাকে পায়ে ধরে কেঁদে বলতাম, আমাকে বাইরে যেতে দাও মা।

মা বলত, তোর মতো অমানুষকে বাইরে যেতে দিতে পারিনে। ঘরেই আটকা থাকবি। বাঁচতে হলে এখানেই বাঁচবি! মরতে হলে এখানেই মরবি!

বাঁচা-মরার দিন গুনতে গুনতে একদিন মায়ের মনে দয়া হলো! আমার বিচরণ ক্ষেত্রে বেড়ে দাঁড়ায় বাড়ি থেকে পাড়ার সীমানা পর্যন্ত! কিন্তু কারোর বাড়িতে যেতে মানা। আমি পাড়ার শেষ প্রান্তে ছুটে যাই, খুঁজে বেড়াই চাঁপাকে। কিন্তু, ওর যেন কোনো হদিসই নেই। পাড়ার রাতুলকে দিয়ে চাঁপাকে খবর পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু, চাঁপা কিছুতেই আমার সাথে দেখা করতে রাজি হলো না। পরে জানতে পারি, এসবের পেছনে মা দায়ী। মা একদিন কারোর কাছ থেকে জানতে পারে আমি চাঁপার সাথে ঘুরে বেড়াই। তখনই মা ওর পরিবারকে অনেক কটু কথা বলেছিল। সেই থেকে চাঁপার মনে কষ্ট! চাঁপার মনের কষ্ট দূর করার সাধ্য আমার ছিল না। দূর থেকে কেবলেই ওর অভিমান অনুভব করেছিলাম।

আমার বন্দি জীবন কাটছে প্রতিনিয়ত! গৃহ শিক্ষক এসে যতদূর সম্ভব আমাকে বিদ্বান বানাচ্ছে! মা এতেই নিশ্চিন্ত হচ্ছেন! এরই মাঝে হঠাৎ একদিন বাবা বিদেশ থেকে বাড়ি চলে আসেন। তখন থেকে আমি যেন আরেক যমরাজ্যে পতিত হই। সারাদিন শাসন আর পড়ালেখা! আরবি শেখার জন্য আরেকজন শিক্ষক রাখা হলো! বাবার নির্দেশে শিক্ষকের দেয়া জ্বালা-যন্ত্রণা কয়েকগুণ বেড়ে গেল! সারাক্ষণ আমাকে চোখে চোখে রাখা হতো। ঘরবন্দি আমার পড়াশোনা, শিক্ষক আসে শিক্ষক যায়। লিখতে পড়তে ক্লান্ত আমি। কেবল পরীক্ষার সময় এলে বাবা আমাকে স্কুলে নিয়ে যায়। পরীক্ষা শেষে আবারো নজরবন্দি জীবন। খাপছাড়া দিনগুলোর সেই বন্ধুদের চিরশত্রু ভাবত বাবা-মা। ওদের কাছ থেকে সরিয়ে রাখতেই আমার উপর এত আইন জারি!

এভাবে দীর্ঘ এক বছর কেটে যায়। ততদিনে আমি এক বিচ্ছিন্ন পাখি। যেন পঙ্গুত্ব আমাকে জড়িয়ে ধরেছে! অন্ধকার ঘরে বন্দি আমি!

কখনো কখনো পরীক্ষা দিয়ে স্কুল থেকে একা ফেরার পথে চাঁপার সাথে দেখা হতো। কখনো ও কথা বলত। কখনো চুপচাপ আমাকে কেবল তাকিয়ে দেখত। আমার দুর্দশার কথা শুনে ও অভিমান ভুলে যায়! বলেছিল, তোর উপর অভিমান করতে পারি আমি?

অন্য একদিন পথে চাঁপার সাথে দেখা। সেদিন বাবা সাথে ছিল না। আমাকে দেখে ও বলেছিল, কতদিন ধরে আমরা তালঘরে যাই না। বর-বউ খেলাটা…

আমার কষ্ট হচ্ছিল তখন। কারণ, বাড়ির সীমানা পেরিয়ে স্বাধীনভাবে অন্য কোথাও যাবার এখতিয়ার আমার ছিল না। এই শৃঙ্খল, এই নিষেধাজ্ঞা আমাকে পড়াশোনায় মনোযোগী করেছে বটে, কিন্তু মানসিক যন্ত্রণা হাজারগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ততদিনে ঊরুর পাশে জেগে উঠা কুৎসিত অন্ধকার আমার চিরচেনা পৃথিবীকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিলো!

এসব দেখে শক্ খাই। মনে পড়ে সেই কথাগুলো! আমিও পাগল হতে চলেছি, নিশ্চিত পাগল হয়ে যাচ্ছি।

সেই পুরনো স্মৃতি ভয় রূপে আবির্ভূত হয় আমার সামনে, আমাকে কেটে ফালি ফালি করতে থাকে। অন্তরাত্মা থরথর কাঁপে প্রতিদিন। আমি দুঃস্বপ্নের যাঁতাকলে পিষে যাচ্ছি। একটা রাস্তা! ধূলি ভরপুর দুপুর! চারপাশে ড্যাব ড্যাব চোখে তাকানো মানুষজন। একটা নগ্ন পাগল ছুটছে। একদল বদমাশ ছেলে পাগলটাকে ঢিল ছুঁড়ছে, পাগল… পাগল… শব্দের প্রতিধ্বনি আসছে সমস্বরে…। দৃশ্যটা ভেঙে যায়, ঘুমভাঙা চোখে চারপাশ কচলাতে থাকি আমি। ওই পাগলটাই যে আমি!

বন্দিত্বদশা এক সময় আমাকে নিরুপায় বিদ্রোহী করে তোলে। বাবা-মায়ের সব নিষেধাজ্ঞা আমি অমান্য করি। শিক্ষক এলেও আমি পড়তে চাইতাম না। আমি বলতাম, কী হবে পড়ে? আমি তো পাগল হয়ে যাচ্ছি।

পাগলামির সব প্রভাবই যেন আমার মধ্যে ছিল, কেবল নগ্ন হওয়াটা বাকি।

আমার উচ্ছৃঙ্খলতার কাছে সবই হার মানে। লেখাপড়া উচ্ছন্নে রেখে আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি। কখনো স্কুলের জানালায় উঁকি দিয়ে দৌড় দেই। যেতাম বাজারে, নদীর ঘাটে। আমাকে দেখে সবাই হাসতো, মজা পেতাম।

মানুষজন আমাকে দেখে বলত, বেশি পড়ে ছেলেটার ব্রেইন আউট হয়ে গেছে! ব্রেইনে চাপ খেয়েছে!

এরই মাঝে পথে চাঁপা একদিন আমাকে ধরে বলে, সৌরোষ চল, তালঘরে যাই।

আমি তৎক্ষণাৎ রাজি। পথ হাঁটতে হাঁটতে আমরা চুটকি ফল চিবুতে থাকি। চিরচেনা বনে আবারও আমরা হাঁটছি।

চাঁপা বলে, তুই কেন যে এই বাহানা ধরেছিস তা কিন্তু আমি জানি।

-কী জানিস তুই?

-পড়াশোনা ফাঁকি দিতেই তো এমন নাটক করছিস তাই না?

আমি আচমকা হেসে মাথা নেড়ে বলি, তুই বেশি চালাক।

-জানিস সৌরোষ, তোকে এতদিন খুব মনে পড়েছে। কতদিন পরে তোর সাথে হাঁটছি!

চাঁপার কথাগুলো শুনছি আর শুনছি! চাঁপাকে কেমন যেন অচেনা লাগছে! নিজেকেও অচেনা লাগছে তখন! সবকিছু কেমন পাল্টে গেছে!

তালকুঠুরিতে গিয়ে খুঁজে পেলাম আমার সেই পুরনো দা। মরিচা ধরে বেহাল দশা। কেবল কঙ্কালটুকু যেন পড়ে আছে। চাঁপা বলে, কামারের দোকানে নিয়ে আবারও ধারালো করা যাবে এই দা।

ওর কথা শেষ না হতেই দা-টা ছুঁড়ে ফেলে দেই বনের ভেতর। বলি, ওটা এখন সারাজীবনের জন্য ধারালো হয়ে যাবে।

তালকুঠুরিটার আকার যেন আমাদের চেয়ে অনেক ছোটো হয়ে গিয়েছে। কিংবা আমরা অনেক বড় হয়ে গেলাম! যে কুঠুরিতে দুজন জড়াজড়ি করে আদিম খেলায় মশগুল হতাম, সেখানে এখন একজন চাইলেও প্রবেশ করতে পারবে না।

চাঁপা বলল, মনে পড়ে না পুরানো খেলার কথা?

আমি মাথা নেড়ে বলি, হুম।

খেলবি আবার?

আমি বিস্ময়ে তাকাই ওর দিকে। চাঁপার বুক আমার ছোটো মামীর স্তনের মতো বড় লাগছে। ও যেন আর ছোট্ট নেই!

শালপাতার বিছানায় আমরা গড়াগড়ি দেই। শরীরে শরীর লেগে বিদ্যুৎ খেলে যায়! বজ্রপাত জাগে বুকের ভেতর! জামার উপরে চাঁপার হাতের স্পর্শে আমার পুরুষাঙ্গ কঠোর হয়।

চাঁপা বলে, আমাকে সত্যিই বিয়ে করবি?

আমি বলি, হুম। হাজারবার বিয়ে করবো।

ও বলে, একবার করলেই হবে।

চুমুতে চুমুতে শিহরণ গ্রাস করে জিহ্বার ডগায়! চুটকিফলের স্বাদ আস্বাদন আরো তীব্র হয়। যখনই চাঁপা আমার পুরুষাঙ্গ ছেড়ে টাউজার খুলতে হাত বাড়ায়, তখন আমার মুখ শুকিয়ে আসে। শক্ত করে টাউজার ধরে ফেলি, ওর হাত সরিয়ে দেই। আমার পুরো পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে আসে। এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নেই, চাঁপা কামক্ষুধায় ছটফট করতে থাকে।

আমি ওকে ফেলে পালাতে থাকি। না কিছুতেই এই দৃশ্য চাঁপাকে দেখানো যাবে না। ও যদি আমাকে ঘৃণা করতে থাকে আমি আর বাঁচতে পারবো না। হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ছুটে আসি। নিজেকে অভিশপ্ত ভাবতে থাকি। মনে হতে থাকে, কাউকে ঘরবন্দি করে রাখলে বুঝি পাগল হয়ে যায়। যন্ত্রণার কলেবর বাড়তে থাকে। বাবা-মায়ের উপর অভিমান জমে।

কাঁদতে কাঁদতে রাত বাড়ে! হঠাৎ চিৎকার করে উঠি, মাথার চুল ছিঁড়তে থাকি! আশপাশের বাড়ির মানুষজন এসে আমাদের উঠোনে জড়ো হয়! বাবা-মা নির্বিকার দৃষ্টিতে চোয়াল শক্ত করে আমার কাণ্ড দেখে!

আমার ব্রেন আউট হয়ে গেছে কথাটা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের আত্মীয় স্বজন এসে বাড়িতে ভিড় করে। চাঁপা ও মা কেবল বিশ্বাস করে, সবই আমার সাজানো নাটক। পাড়াপড়শি মাকে নানা কবিরাজি চিকিৎসার উপদেশ দেয়, কিন্তু মা এতে কান দেন না।

কয়েকদিন পরের কথা। সুবর্ণপুর বাজার থেকে ফেরার পথে চাঁপার সাথে দেখা। আমি লজ্জ্বায় মুষড়ে পড়ি। সে আমার ডানহাতটা শক্ত করে ধরে। বলে, এখন কোথায় পালাবি?

-কই নিয়ে যাবি আমাকে?

চাঁপা চোয়াল শক্ত করে বলে, তোকে আজ বিয়ে করবো! আমরা এখন বর-বউ খেলবো, চল আমার সাথে।

চাঁপা আমাকে ওর দাদির ঘরে নিয়ে যায়। দরোজা আটকে বলে, আজ বাড়িতে কেউ নেই।

আমি বলতে থাকি, আমি ওসব করবো না। আমি পাগল হয়ে গেছি!

চাঁপার রাগান্বিত গলা। বলে, পাগল হয়েছিস তো কী হয়েছে? ব্রেইন আউট হলেও বর-বউ খেলা যায়। পড়া ফাঁকি দিতে কত ঢঙ!

আমি বিস্ময়ে চাঁপার দিকে তাকাই। বলি, তুই জানিস না, আমি সত্যিই পাগল হয়ে গেছি! পাগলের মতো আমার ওখানেও কালো জঙ্গলে ভরে গেছে।

চাঁপা আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বলে, তোর মুখটা চুপ রাখবি?

আবারো বিদ্যুৎ তরঙ্গে শরীর পুড়ে যায়। ওর হাত আমার উরুসন্ধিকে দগ্ধ করে। চুমুতে চুমুতে জোয়ার আসে। হঠাৎ ওর শীতল হাত টাউজারের ভেতর প্রবেশ করে। ভয়ে আমার শরীরের একটা শীতল স্রোত বয়ে যায়। রক্তশূন্য মুখে আমি ওর দিকে তাকাই। চাঁপা অনায়াসে আমার অন্ধকার কেশরে হাত বুলাচ্ছে, কিছুই বলছে না। ভীষণ অবাক হই। ভেবেছিলাম, কালো কেশর দেখে ও আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিবে, পাগল বলবে! কই কিছুই তো বললো না।

এবার আমিই বলে উঠি, চাঁপা, আমারও কিন্তু পাগলের মতো ওখানে চুলের জঙ্গল হয়েছে। আমিও এখন থেকে পাগল হয়ে যাবো। এজন্যেই তো তোর থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি! এমন পাগলকে তো তুই বিয়ে করবি না, তাই না?

চাঁপা হেসে বলে, তুই তো বোকা! এগুলো কাটিসনে কেন? জঙ্গল করে রেখেছিস কেন?

চাঁপার কামুকীভাব ও নির্বিকার ভঙ্গি আমাকে বাকরুদ্ধ করে দিলো! যে ভয়ে এতদিন পালিয়ে বেড়ালাম, এতে ওর বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ নেই! যেন সবই স্বাভাবিক! যেন এমনই হবার কথা ছিল!

ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে একটা প্রশ্ন করতে গিয়ে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। ওকে জিজ্ঞেস করি এভাবে, সেই যে বৃষ্টির দিন তোর মিতা আপুকে যখন রাজন ভাইয়ার সাথে দেখেছিস, ওদের কি ওখানে এমন জঙ্গল ছিল?

-না ওসব নেই। ওসব তো থাকে তোর মতো পাগলদের। পাগল ছাড়া জগতের সবাই ওইসব ছেঁটে রাখে!

-কি বলিস! আমি তো সারাটা জীবন ভেবেছি, ওখানে এগুলো হওয়া মানেই তো পাগল হয়ে যাওয়া! তাই তো আমার এই দশা!

চাঁপা হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে! ও নিজেকে উন্মুক্ত করে আমার সামনে মেলে ধরে। ওর ওখানেও আলোআঁধারি সন্ধ্যার মতো হালকা কেশর! হাত বাড়াতেই চাঁপা হেসে দেয়। আমার বিস্ময় ভরা কণ্ঠ তখন স্তম্ভিত! বলতে থাকি, আমি তো পালিয়েছিলাম তোর ভয়ে! যদি তুই দেখে ফেলিস ওসব! তখন কী ঘটবে তাই তো যত দুশ্চিন্তা!

চাঁপা হাসতে হাসতে আমার উত্থিত জগত স্পর্শ করে বলে, ওরে বোকা! তোর ওখানে ওসব জন্মাবে না কেন? সবারই তো হয়! এগুলো জঙ্গল নয়রে, সিংহ রাজার কেশর! তোর সিংহ রাজাটা কি ভয়ানকভাবে গর্জাতে গর্জাতে দাঁড়িয়ে আছে!

চাঁপার এসব কথা শুনে সেদিন আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছিলাম না। আমার মগজে যেন নতুন সূর্যোদয় ঘটল! স্বর্গের সরোবর থেকে স্নান করে তখন আমি পৃথিবীতে বেঁচে ওঠি! চোখের সামনের ভেসে উঠে কালো কেশরের সেই খেলনা সিংহটা! যেন তেজদীপ্ত গলিত লাভার মতো দৃষ্টি! অতঃপর, একগুচ্ছ ভুলকে ছুটি দিয়ে সিংহ রাজা কেশর ঝাঁকিয়ে দূর দিগন্তে ঝাঁপিয়ে পড়ে..!

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu