শিউলি একটি মফস্বল শহরের মেয়ে। মেয়েটি দেখতে অনেক সুন্দর। নিজ শহরেরই একটি কলেজে পড়াশোনা করে সে। বলতে গেলে তার কলেজের প্রায় সকল মেয়ের থেকে সে সুন্দরী। স্বভাবতই তাকে অনেক ছেলে পছন্দ করে। কিন্তু তার বাবা একজন গরীব কৃষক। তাই মেয়েকে বেশিদূর লেখাপড়া করানোর পক্ষপাতী তিনি নন।
কিছুদিন ধরে শিউলি একটি সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। সমস্যাটি হচ্ছে, পাড়ার কিছু বখাটে ছেলেপুলে তাকে ভীষণ বিরক্ত করছে। তাই আজ শিউলি রেগে গিয়ে সব থেকে অভদ্র ছেলেটার গালে চড় বসিয়ে দিয়েছে। ছেলেটি রাগে গজগজ করতে করতে বলল– কাজটা তুই ভালো করলি না। এর মজা তুই টের পাবি। হারে হারে টের পাবি।
শিউলি এক অাল্লাহ ছাড়া আর কাউকেই ভয় পায় না। তাই সে অভদ্র ছেলেটির কথা গায়ে লাগায় না। সে তার মতোই চলতে থাকে। প্রতিদিন কলেজে যাওয়া আসা করে। তেমনি একদিন কলেজ যাওয়ার পথে, সেই অভদ্র ছেলেটা শিউলির মুখে এসিড ছুড়ে মারলো। শিউলি মুহুর্তের মাঝে বিকট আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। স্থানীয় সবাই হন্তদন্ত হয়ে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। শিউলিকে বাঁচানো গেল কিন্তু ডাক্তার বললেন যে, শিউলির মুখ আর কখনোই ভালো হবে না।
এ ঘটনার পর থেকে শিউলির বাবা মা শিউলির সাথে প্রায় সময় গঞ্জনা দেওয়া কথাবার্তা বলে। যেমন ওর মা কিছুদিন আগে বলেছিল– তুই মরতে পারিস না। বেঁচে আছিস ক্যান? তোর পোড়া মুখ নিয়ে কে বিয়া করবে?
শিউলির বাবাও ওকে বলে– ম্যাট্রিক পাশ কইরা পড়াশোনা ছাইড়া দিলেই পারতি। পড়াশোনা করছিস ক্যান? এখন তো তোকে বিয়া দিবার পারবো না। আমার ঘাড়ত বইসা থাকবি সারাজীবন।
এগুলো কথা শুনে শিউলির আত্মহত্যা করতে মন চায়। এখন আর সে কলেজে যায় না। তার বাবা যেতে দেয় না। একদিন গিয়েছিল বাবার কথা অগ্রাহ্য করে। কিন্তু বান্ধবীদের খোঁচা দেওয়া কথা যেন বাবা মায়ের কথার চেয়েও বেশী তিতা মনে হয়।
একদিন দুপুরবেলা খাওয়ার সময় শিউলি খাবারে পোড়া ভাত পায়, তাই মাকে বলে– মা, ভালা ভাত নাই? এইডা তো পোড়া।
উত্তরে তার মা বলে– যার মুখটাই পোড়া সে ভালা ভাত দিয়া কী করবে? ঐ খাবার না খাইতে পারলে তোর খাওনের দরকার নাই। মইরা যা তুই।
এ কথা শুনে শিউলির খুব খারাপ লাগে। সে সিদ্ধান্ত নেয়– আত্মহত্যা করবে। এ সিদ্ধান্ত নিয়েই সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে, চলে যায় রেলওয়ে স্টেশনে। উদ্দেশ্য ট্রেনের চাকার নিচে নিজেকে সঁপে দেওয়া। স্টেশনে যাওয়ার পর জানতে পারলো, পরবর্তী ট্রেন এখন থেকে আরও বিশ মিনিট পরে আসবে। তাই সে প্লাটফর্মেই বসে রইলো। হঠাৎ সে দেখতে পেলো প্লাটফর্মে তার থেকে কিছু দূরে বসে একটি মেয়ে কাঁদছে। বয়স আনুমানি চব্বিশ-পঁচিশ হবে। তার খুব ইচ্ছে হলো মেয়েটির কাছে গিয়ে তার কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করতে। তাই সে আর দেরি না করে মেয়েটির কাছে গিয়ে বললো– আপনি কাঁদছেন কেন আপু?
মেয়েটি চোখের পানি মুছে শিউলির দিকে তাকালো। তাকিয়েই সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো– আপনার মুখটা পুড়লো কীভাবে আপু?
– আমার গল্পটা পরে বলবো। আগে আপনার কান্নার কারণটা বলুন আপু।
তারপর মেয়েটি বলা শুরু করে– দুঃখের কথা আর কী বলবো আপু? আমি অনেক অভাগী একটা মেয়ে। আমার নাম লিপি। পড়াশোনা করতে চেয়েছিলাম। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষাও দিয়েছি। আল্লাহর রহমতে রেজাল্টও আমার ভালো হয়। আব্বা আর পড়াতে চাইনি। তবুও জোর করে এখানেই একটা ডিগ্রি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে অনার্স পড়া শুরু করি। অনার্স পড়া শেষ করতে করতেই আমার বয়স ২৪ পেরিয়ে যায়। বাবা আর আমাকে পড়াতে চায় না। বিয়ে দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগে। কিন্তু কেউ আমাকে বিয়ে করতে চায় না। আমার নাকি বয়স বেশি হয়ে গেছে। অবশেষে ঘটকের মাধ্যমে একটা প্রস্তাব আসে। ছেলের মিষ্টির দোকান আছে। কিন্তু বয়স্কা মেয়ে বিয়ে করতে নাকি তার যৌতুক চাই। বাবা সেই শর্তেই রাজী হয়ে গেল। কোনোমতে মেয়েকে পার করতে পারলেই তিনি খুশি। যৌতুক হিসেবে তারা টিভি, ফ্রিজ আর মোটর সাইকেল চেয়েছিল। আর আমাকে এক ভরি স্বর্ণালংকার দিয়ে নাকি সাজিয়ে দিতে হবে। আমার গরীব বাবার পক্ষে কি এত কিছু দেয়া সম্ভব! তিনি টিভি আর আমাকে স্বর্ণালংকার দিলেন। ফ্রিজ আর মোটরসাইকেল পরে দিবেন বলে কথা দেন। বিয়ের এক বছর পর কোনোমতে টাকা জোগাড় করে বাবা একটি সেকেন্ড হ্যান্ড মোটর সাইকেল কিনেছিল। সে কথাটা ওরা জানতে পারার পরপরই আমার উপর অমানবিক অত্যাচার শুরু করে দেয়। আর বাবাকেও বলে দেয় যে, যদি ফ্রিজ আর নতুন মোটর সাইকেল এক মাসের মাঝে দিতে পারে তাহলে সেকেন্ড হ্যান্ড মোটর সাইকেল দেয়ার অপরাধ ক্ষমা করে দিবে আর যদি না দিতে পারে, তাহলে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিবে। আজ সেই এক মাস পূর্ণ হলো আপু। ওরা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। কোন মুখে আমি বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো!
এ কথাগুলো শুনে শিউলির মনে হল, মেয়েটি তার মতোই অভাগী। শুধু দুর্ভাগ্যের ধরণটা ভিন্ন। তারপর শিউলি লিপিকে তার দুঃখের কাহিনী বললো। লিপি শিউলির কথা শুনে বললো– আমিও তো আত্মহত্যা করতে এসেছি আপু। কিন্তু এখন তোমার সাথে পরিচয় হওয়ার পর মনে হচ্ছে, আত্মহত্যা না করে এ সমাজকে কিছু একটা দেখিয়ে দেই।
শিউলি লিপির কথায় সায় দিয়ে বললো– হুম। কিন্তু এই মুহুর্তে করবো-টা কী?
তারপর লিপি জানায় যে, সে নাকি সেলাই করতে পারে।
কথাটা শুনে শিউলি কিছুক্ষণের জন্য আনন্দিত হলেও পরক্ষণেই আবার ভেঙে পড়ে। ওদের কাছে না আছে সেলাই মেশিন না আছে টাকা।
কিন্তু লিপি তাকে অাশ্বাস দিয়ে জানায় যে, সে তার কানে থাকা দুলজোড়া বিক্রি করে দিবে।
কিন্তু শুধুমাত্র কানের দুল বিক্রির টাকায় তো আর সেলাই মেশিন কেনা যাবে না। শিউলির হাতে একটা আংটি ছিল, সে ঐটা বিক্রি করারও সিদ্ধান্ত নেয়। দুজনের প্রচেষ্টায় অবশেষে একটা সেলাই মেশিন কিনতে সক্ষম হয় তারা।
দুজনে ঢাকায় যায়। বস্তির একটি বাড়িতে ওঠে। শিউলি বাড়ি বাড়ি ঘুরে জামা সেলাই এর অর্ডার নিয়ে আসে, আর লিপি ওগুলো সেলাই করে আবার শিউলির হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেয়। কয়েক মাস পর আর শিউলির বাড়ি বাড়ি ঘুরতে হয় না। লোকজনই তাদের কাপড় দিয়ে যায় সেলাই করার জন্য। তাদের কাছে তুলনামূলক সবকিছু সাশ্রয়ে হয়। তাই সেলাই এর অর্ডার এখানে বেশি। কিছুদিন পর আর একটি সেলাই মেশিন কিনে ফেলে ওরা। এতদিনে শিউলিও সেলাই করা শিখে গেছে। অনেক রোজগার হয় তাদের। এখন আর তারা বস্তিতে থাকে না। বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে।
ভাগ্যের ফেরে তারা নিজেদের মতো আরেকটি মেয়ের সন্ধান পায়। মেয়েটির নাম সুমি। সেই মেয়েটি আবার বুটিক্স-এর কাজ ভালো জানে। ধীরে ধীরে তারা একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান দাঁড় করায়। নাম দেয় ‘স্বপ্নের নীড় সেলাই এ্যান্ড বুটিক্স’।
এটা সেই প্রতিষ্ঠান, যেখানে হাজার হাজার আত্মহত্যা করতে চাওয়া মেয়েদের কর্মসংস্থান হয়। তারা আর সমাজের বোঝা নয়। আজ তারা স্বাবলম্বী।