তলপেটে ব্যথায় ছিড়ে যাচ্ছে মৌমিতার। বারবার ন্যাপকিন পাল্টাতে হচ্ছে তার। পাশের বাসার ভাবীর কথা অনুযায়ী গরম দুধ খাচ্ছে, বাথরুমে গেলে গরম পানি ব্যবহার করছে কিন্তু তেমন কোনো লাভ হচ্ছে না।
মৌমিতা প্রতিবার বাথরুমে গিয়ে দেখছে– কমোড লাল হয়ে যাচ্ছে রক্তে। মৌমিতার যোনীপথ বেয়ে গলগল করে নদীর স্রোতের মতো রক্ত পড়ছে। রাইনা ভাবী তার এক পরিচিত স্বাস্থ্য কর্মীর সাথে কথা ঔষধ এনে দিয়েছে তাতে একটু ভালো বোধ করছে মৌমিতা।
প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে মৌমিতা ওর বড় বোন মৌসুমিকে ধরার জন্য। মৌসুমি ভেংচি কাটছে আর বলছে ধরতে পারবিই না। বলছে আর মাঝে মাঝেই পেছন ঘুরে মৌমিকে ভেংচি কাটছে। অনেক কষ্টে তেতুল বানিয়েছিল মৌমি মান্দার ফুল আর ধনে পাতা দিয়ে।
মৌসুমি থাবা দিয়ে নিয়ে নিয়েছে পুরোটা। ছুটতে ছুটতে হাঁপিয়ে উঠেছে মৌমি। মাত্র বিশ মিনিট ঘুমিয়ে এই স্বপ্নটাই দেখছিল মৌমিতা। এরভেতরই ফোন বেজে ওঠে। ঘুম ভেঙে দ্যাখে সালেক ভাই পাঁচবার ফোন দিয়েছে এরভেতর। ফোন ব্যাক করে মৌমি বলে– সালেক ভাই শরীলডা খুব খারাপ আইজগো কোনোরহম চালাইয়া ন্যান। আইজ আইতে পারমু না।
সালেক বলে– আইজ বহুত নামীদামী লোকজন আইছে তোমার নাচ দ্যাকবো আর মদ গিলব। তুমি না আইলে ব্যবসা লাল বাত্তি। মৌমি আবার বলে- সালেক ভাই আমার শরীল খুবই খারাপ আর মাসিকে রক্ত যাইতেছে খুব। আমি আইজ সত্যইও পারমু না। অমনি সালেক ক্ষেপে গিয়ে বলে– খানকি, আধা ঘন্টার মইদ্দে তুই হাজির অবি। দুই তিনডা ন্যাপকিন সান্দা ভোদার ধারে। হেরপর আয়, নাইলে তোর চাকরি নাই। মৌমি অগত্যা শোয়া থেকে উঠে পায়ে নুপুর বাঁধে, ফোমওয়ালা ব্রেশিয়ার,কারুকাজ করা টপস, আর হাঁটুর নীচে স্কার্ট পরে। চোখ লেপ্টে কাজল পরে, কোমরে বিছা পরে, লাল লিপিষ্টিক পরে, বড় একটা নীল টিপ পরে যখন আয়নায় নিজেকে দেখে তখন মৌমি অনুভব করে ক্যান পুরুষ মাইনসের চৌক তার বুক থেইক্কা সরে না তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস দিয়ে বলে– আহারে রূপ যৌবন, আহারে পুরুষ মানুষ!
ন্যাপকিনের সাথে তুলা পেচিয়ে মৌমিতা ভালো করে প্রস্তুতি নিয়ে যায় বারে। তাছাড়া ব্লেডিং কমে এসেছে অনেকটা। স্টেজে উঠে– যারা তাসবীর তুছে নিকাল কে সামনে আ, সাজন সাজন, মেরি সাজন সাজন এবং তাল ছে তাল মিলা… এই তিনটি গানে ঘন্টা খানেক নাচে মৌমিতা। পাবলিক যখন ব্যপক ঘোরে তখন মৌমিতা অন্য একজনের কাছে স্টেজ দিয়ে নেমে আসে। চার-পাঁচজন টের পেয়ে একটু চিৎকার দিয়ে উঠেছিল। কিন্তু ততক্ষণে হাফ প্যান্ট আর ব্রা পরা সোনালী জমিয়ে ফেলেছে।
সেদিন সালেক নিজে পৌঁছে দিয়ে যায় মৌমিতাকে।
বিরিয়ানি কিনে দেয়, কোক কিনে দেয়। সিএনজিতে আসতে আসতে সালেক মৌমিতার স্তনে হাত দিয়ে বলে– মাইরি কী যে জিনিস তর দুদ দুইডা। মৌমি বিরক্ত হয়ে হাত সরিয়ে দিয়ে বলে– শয়তান মরদ! বইন ডাক পাড়ো আবার দুদ আতাও!
সালেক বলে– আপন বইনেরেও তো কিছু পুরুষ ছাড় দেয় না। তুই তো ডাকুইননা বইন।
রাতে নটায় একটা লিভিং রুম, ছোট একটা ড্রয়িং রুম আর রান্না ঘরের বাসাটাতে ঢুকে কেমন ভ্যাপসা একটা গন্ধ পায় মৌমিতা। জানালা খুলে দেয়। ঠান্ডা বাতাস এসে শরীর জুড়িয়ে দেয়। আর ভাবনার গভীরে ডুব দেয় মৌমিতা আর ভাবে দুইন্নাইতে এত কাম থাকতে ক্যান তারে যে বারে নাচতে অয়! মদ খাওয়া মরদগুলান ক্যাম্নে যে চৌক দিয়া তার দুদ দুইডা দ্যাহে! এর মইদ্দে মন্রী, পুলিশ, আর্মি, মেজিস্টেড হগলডি আছে। আবার দিনের বেলায় হেরা আবার মদের বিরুদ্দে বড় বড় কতা কয়।
নাহ আইজ খাইতে ইচ্ছা করতাছে না। পেট গুইল্লা বমি আইতাছে। এসব ভাবতে ভাবতেই মৌমিতার মনে পড়ে মায়ের কথা। জ্বর হলে মা কালিজিরা ভর্তা, ধইন্না পাতা ভর্তা দিয়ে গরম ভাত মাখাইয়া খাওয়াইয়া দিত। সেই ভর্তা ভাত আইজ খুব খাইতে মন চায়! কই যে গেল বুবু আর মায়! আর কোনোদিন বুজি দ্যাকতে পামু না হ্যাগো। একেবারে ডুকরে কেঁদে ওঠে মৌমিতা আর বুকের ভেতরটা তার দুমড়ে মুচড়ে যায় মা-বোনের জন্য।
পহেলা ফাগুনের দিবাগত রাত। সোয়ান বারে সেদিন প্রচুর লোক সমাগম হয়েছে। চৌদ্দ -ষোল বছরের কিশোর থেকে ষাট বছর বয়স্ক সকল পুরুষই আছে। কিছু ছেলে-মেয়ে আবার জোড়া বেঁধে এসেছে। মৌমিতা সেদিন সাদার ওপর রুপালি জরি সুতার কাজ করা নাচের ড্রেস পরেছে। সাথে রুপালি গয়না। মাথায় মুকুট। হাত ভর্তি রপালি চুড়ি। মনে হচ্ছে কোনো স্বর্গের দেবী নেমে এসেছে এই স্টেজে। সেদিন মৌমিতা বাংলা গানের সাথে নেচে চলছে প্রায় তিন ঘন্টা। আমার মন বলে তুমি আসবে, পাথরের পৃথিবীতে কাচের হৃদয়, সব সখীরে পার করিতে নেব আনায় আনা। নাচ শেষ করে মৌমিতা যখন বাসায় যাবে তখন ম্যানেজার সালেক বলে, পুলিশের কমিশনার সাইব তরে এক রাত্তির চায়। বিশ হাজার টেকা দিব। মৌমিতা বলে- না আ নাচ আমার পেশা। আমি পর পুরুষের লগে শুই না। সালেক ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে- হুউ নাচছ বারে আবার সততা চোদাছ! এই সুযোগ মিস করিস না। মৌমি বলে না সালেক ভাই এই পা জোড়ায় আমার মায়ের আশীর্বাদ আছে। মায়ের নিষেধ পর পুরুষরে শরীল দিতে। পেম থাকলে কতা আলাদা। আমি শরীল বেচি না।
সালেকের কাছে মৌমিতা ছুটি চায় তিনদিনের। সালেক জিজ্ঞেস করলে বলে, সে তার বন্ধবীদের সাথে কক্সবাজার যাবে তিনদিনের জন্য। সালেক হাসে আর বলে বেশি স্বপন দেহিছ না। তুই বারের নাচনেওয়ালী এইডা মাথায় রাহিছ। ছুটি তুই নে। তোর সততাও মানায় না, স্বপ্নও মানায় না। তার চাইতে বরং যতদিন রূপ যৌবন থাহে বেইচ্চা টেকা কামাই কর। মনে মনে খুব বিরক্ত হয় মৌমিতা।
কক্সবাজারের হোটেল সী ভিউ এর এসি রুমে শুয়ে আছে মৌমিতা আর সাব্বির। মৌমিতা খুব সুন্দর হালকা গোলাপি একটা ব্রা শেপ নাইটি পরেছে। মুখে নেই কোনো প্রসাধনী। সাব্বির বলছে তোমাকে জোছনা ধোয়া রাতের মতো সুন্দর লাগছে। মৌমিতা লজ্জামিশ্রিত হাসি দিয়ে বলে- বেশি বাড়াইয়া কইও না।
তারপর সাব্বির ঠোঁট ডুবিয়ে দেয় ঠোঁটে। সারা রাত ধরে চলে হরিণীর ওপর ক্ষুধার্ত বাঘের আক্রমণ। হরিণীও যেন তাতে ধন্য।
এইভাবে আট-নয় মাসের ভেতর সাব্বির আরও তিন-চার বার মৌমিতাকে নিয়ে যায় তার এক খালার বাসায়। খালা বেশ আপ্যায়ন করে চা-নাস্তা খাইয়েছে। আর সাব্বির দিয়েছে উদ্দাম আদর সোহাগ।
একটু হট ড্রেস আপ করতে বলা হয়েছে মৌমিতাকে। কারণ ১৪ ই ফেব্রুয়ারী বড়লোকদের ছেলেমেয়েরা ভ্যালেন্টাইন উদযাপন করতে এসেছে “সোয়ান” বারে। গোল্ডেন ব্রা আর কালো জরির মিনি স্কার্ট, সাথে বুক খোলা কালো এবং জরি সুতার এম্ব্রয়ডারি করা কটি পরে মৌমিতা নাচতে উঠেছে। সিলসিলা, হামে তুমছে পেয়ার কিৎনা, তু আতা হে সিনে মে, তাল ছে তাল মিলা…। ছেলেমেয়ে,বুড়ো, কিশোর সবাই ভুলে গেছে স্থান, কাল, পাত্র। মৌমিতার পায়ে সেদিন বুঝি সরস্বতী নিজে নুপুর বেঁধে দিয়েছেন। পা জোড়ায় সেদিন ভর করেছে তাবৎ শক্তি। এভাবে সব ভুলে নাচতে নাচতেই হঠাৎ করে মৌমিতা দেখে স্টেজটা কেমন উল্টো ঘুরছে। তারপর যখন টের পায় তখন দেখে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে, হাতে স্যালাইন লাগানো। সালেক হাসতে হাসতে এসে বলে, কী ভয় দেহাইছিলি বইন!
ব্লাড, ইউরিন এবং ইসিজি করা হয়েছে। রিপোর্ট আসলে ডাক্তার এবং নার্সরা অবাক হয় এবং নিজেদের ভেতরে লুকিয়ে ছাপিয়ে কথা বলে। অবশেষে সবচেয়ে সিনিয়র ডাক্তার মৌমিতাকে ডেকে বলে সে প্রেগন্যান্ট।
তার ডকুমেন্টে স্বামীর নাম উল্লেখ নেই। মৌমিতা খুব অনুরোধ করে কাউকে না জানাতে। কারণ খুব দ্রুত বাচ্চার বাবাকে সে বিয়ে করে ফেলবে, সে খুব ভালো মানুষ।
সকাল ৮. ৩০ সাব্বিরের ফোন বেজে চলেছে। ফোন রিসিভ হতেই শোনা যায় একটা বাচ্চা ছেলের কন্ঠস্বর। ফোন ধরে বলে হ্যলো তুমি কে বলছ? বাবা তো অফিস যায়। সাব্বির হাত থেকে ফোন নিয়ে নেয়।
অফিসে গিয়ে ফোন করলে মৌমিতা বলে আমি পেগনেন্ট। তাড়াতাড়ি বিয়ের ব্যবস্থা কর। আমি চাই বাবুটা আমার কোল জুইড়া আউক। সাব্বির নীরবে খুব হাসে তারপর বলে – তুমি যদি এবরশন করার টাকা চাও নিতে পারো। বিয়ের প্রশ্ন কেন আসছে? আমার দুই বাচ্চা এবং ওয়াইফ আছে। মৌমিতা ঘোর বিষ্ময়ে বলে– তুমি যে কইতা তুমি আমারে ভালোবাস? সেইডা কী? অভিনয়! সাব্বির উদার হাসি দিয়ে বলে– বোকা মেয়ে! ভালো তো বাসিই। নইলে তোমাকে নিয়ে কক্সবাজার যাব কেন? কিন্তু তোমার সাথে বিয়ে, সংসার কখনো সম্ভব? আমি অবিবাহিত হলেও তো হত না। যাক তুমি যা টাকা লাগে নাও বিকাশ নাম্বার দাও। আর যখন তখন ফোন করবে না!
খুব মুষড়ে পড়ে মৌমিতা। তার কাছে পুরো পৃথিবীটাকে মনে হয় জুয়ার আসর আর সমগ্র জলাশয় যেন মদের আধার। বারবার শুধু দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া হৃদয় নিয়ে ভাবে আমি বারে নাচি বলেই কী আমি বেশ্যা! আমার সততার কোনো দাম নাই! দুনিয়ায় কী খালি শরীল আর দুদ পাছারই দাম? ভালোবাসা কী সত্যিই এক ছলনার নাম! হাসপাতালের এক সিস্টার এগিয়ে আসে সহযোগিতার হাত নিয়ে। সালেকের কাছ থেকে ছুটি নেয় এক সপ্তাহ।
নিজের সাথে নিরবিধি যুদ্ধ আর বোঝাপড়া চলে মৌমিতার। প্রথমে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল।
যাদের সাথে সাবলেট থাকে সেই ভাই আর ভাবী এগিয়ে আসে। নিজেদের গ্রামের বাড়িতে ঘুরতে নিয়ে যায়। বুঝায় যে, মৌমিতার কষ্টে পৃথিবীর কারো কিছু আসে যায় না, এমনকি মরে গেলেও না। বরং প্রত্যেক মানুষকে নিজেকেই চেষ্টা করে বেঁচে থাকতে হয় এবং জীবন সুন্দর করে তুলতে হয়। এই এক সপ্তাহ মৌমিতা নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় ঘুরে দাঁড়াবে সে যেকোনো মুল্যে।
সে নাচ শিখবে। নাচ দিয়েই সে প্রমাণ করবে সে বেশ্যা নয় শিল্পী। এক সপ্তাহ পর বারে গিয়ে দেখে স্টেজে নতুন মেয়ে। সালেককে জিজ্ঞেস করে, কে এই মাইয়া?
সালেক বলে– নতুন নাচনেওয়ালী। আইসাই জমাইয়া ফালাইছে। তর ভাত শ্যাষ! মৌমিতা মুচকি হেসে বলে ভালোই তো। কষ্ট কইরা আর ভাত রাইন্দা খাওন লাগব না। জিলাপি আর মুড়ি খামু। মৌমিতা খুব খেয়াল করে দেখে ইলোরা এত ছোট কাপড় পরেছে যে তাকে ব্রেশিয়ার আর জাঙ্গিয়াই বলা যায়। আর যা নাচছে তাকে হাত-পা ছোড়া আর অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি ছাড়া কিছু বলা যায় না। কখনো নিজের স্তনে হাত দিয়ে ইশারা করছে আবার কখনো নিতম্বে।
প্রায় দশদিন মৌমিতাকে স্টেজ দেয়া হয় না। কিন্তু হঠাৎ পরিলক্ষিত হয় যে সোয়ান বারে জনসমাগম বেড়েছে কিন্তু অনেক কমে গিয়েছে ভদ্র আর সংস্কৃতিবানদের আনাগোনা। এক রাতে হঠাৎ করে বারে মারামারি লেগে যায়, যার সূত্রপাত হয় ইলোরার স্তনে এক গুন্ডা হাত দেয় আর অন্যরা তাতে প্রবল বাঁধা দেয়। তারপর দুই পক্ষ হয়ে যায়। ক্ষতি হয় প্রচুর বারের।
তিনদিন যায় না মৌমিতা বারে। শরীর খুব খারাপ। সকাল থেকে টয়লেটে গেছে অন্তত দশবার। সালেক ফোন করে বলে আইজকা তুই জমাবি সন্ধ্যা থেইকা নয়টা। মৌমিতা বলে দেখি। উঠে দুই-তিনটা কাঁচাকলা সিদ্ধ করে, ডাবের পানি খেয়ে এবং সিপ্রোসিন ঔষধ খেয়ে মৌমিতা স্টেজে ওঠে। আগেই সালেককে বলে দিয়েছে আজ লতা, সন্ধ্যা এবং গীতা দত্তের গান দিতে হবে ব্যাকগ্রাউন্ডে। মৌমিতা সেদিন নাচল স্টেজে টানা তিনঘন্টা। যেন কোনো সাধু শেষ ধ্যানে বসেছে এমনভাবেই। লোকজন নাচ শেষে মৌমিতাকে প্রশংসায় ভাসিয়ে দিচ্ছে। মৌমিতার চোখে শ্রাবণ ধারা আর ঠোঁটে হাসির শালুক।
এইবার মৌমিতার সাথে শত্রুতায় মেতে ওঠে ইলোরা। ভীষণ প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ করে ইলোরা। সালেককে জড়িয়ে বাজে কথা বলে। বলে যে ম্যানেজারের লগে প্যাট বাজাইছে! বাচ্চা হালাইয়া আইছে। সালেক একদিন চড় দিয়ে বসে। তখন মৌমিতা এসে প্রতিবাদ করে এবং ইলোরাকে বুঝিয়ে বলে যে বারে নাচলেও টিকে থাকতে হবে নাচ এবং ব্যক্তিত্ব দিয়ে। আর নাচ শেখাটাও দরকার। এরপর থেকে ইলোরা মৌমিতাকে বুবু বলে ডাকে।
মৌমিতা ভর্তি হয়েছে ক্লাসিক নৃত্যে। শুরুর দিকে সাথের শিক্ষার্থীরা তাকে খুব তুচ্ছতাচ্ছিল্য করত। তার সাথে কথা বলতে চাইত না, গ্রুপ ওয়ার্ক দিলে করতে চাইত না। ওস্তাদ বুলবুল খান যখন সবাইকে বুঝিয়ে বলেন যে– শিল্প এবং সমুদ্র সবাইকে কাছে টেনে নেয়, জাত-পাত বিচার করে না। যে ভালোবেসে তার কাছে যায় তাকেই বুকে টেনে নেয় তখন সবার দৃষ্টি ভঙ্গি পাল্টাতে শুরু করে। এরপর যখন সবাই দেখে মৌমিতার নাচ সবাই মুগ্ধ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে মৌমিতা সবার শ্রদ্ধাভাজন হয়ে ওঠে। সবাইকে মাঝে মাঝেই সবাইকে পিঠা-পাকোড়া বানিয়ে নিয়ে খাওয়ায়।
ইলোরাকে মাঝে মাঝেই সাজ, পোশাক দেখিয়ে দেয়, ঠিক করে দেয় আবার কখনো নেচে দেখায় মৌমিতা।
নিজে যায় একজন ডায়েটিশিয়ানের কাছে। নিয়মমাফিক খাওয়া, ঘুম, ব্যায়াম সব চালিয়ে নাচ শেখায় নিজেকে নিবেদন করে শতভাগ। এরসাথে শিখছে কী করে ভালো করে কথা বলা শেখা যায়।
পুরো দুই বছর ধরে মৌমিতা নাচ শেখে। পোশাক এবং কথার টোনে এসেছে বেশ পরিবর্তন। মৌমিতাকে দেখে চট করে বোঝার উপায় নেই সে বারের নাচনেওয়ালী।
এখন আর মৌমিতা শুধু সোয়ান বারে নাচে না। আশেপাশে সব বারে ক্লাসিক নাচ নাচে। ধীরে ধীরে মৌমিতার ডাক আসতে থাকে বিভিন্ন বার থেকে। আর মৌমিতার নাচের দিনে ভীড় করতে থাকে পুলিশের কমিশনার, এম্বাসাডর, বড় বড় ব্যবসায়ী, বড় বড় আর্মি অফিসাররা। মৌমিতা একজন পার্সোনাল সেক্রেটারি নিয়োগ দিয়েছে। মেকওভার করার জন্য প্রশিক্ষণ নিয়েছে। কারণ বিউটিশিয়ান রাখলে অনেক টাকা চলে যাবে।
একদিন নাচছে উচ্চাঙ্গ সংগীতের সাথে একটা অভিজাত রেস্তোরাঁয়। নাচ শেষে এক ভদ্রলোক এসে খুব বিনয় করে বলে, আপনি দারুণ নাচেন। ভারত নাট্যমের এত চমৎকার নাচ অনেকদিন দেখিনি। হাসিমুখে ধন্যবাদ দেয় মৌমিতা।
এরপর দেখা যায় মৌমিতার সবগুলো নাচে ভদ্রলোকের উপস্থিতি। এবং এক কোনায় বসে নিবিষ্ট চিত্তে দেখে মৌমিতার নাচ। একদিন একজোড়া সোনার নুপুর নিয়ে এসে বলে– এই নাবালকের সামান্য নিবেদন।
মৌমিতা নিতে চায় না। ভদ্রলোক বলে আমি নাঈম আমেরিকা থাকি। একেবারে একা মানুষ। বৌ ডিভোর্স দিয়ে চলে গেছে প্রায় দশ বছর, এক মেয়ে সে বিয়ে করে কানাডায় থাকে। আমি আমার বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। এবার দেশে এসে আপনার নাচ আমাকে খুব ভালো সময় উপহার দিয়েছে। দয়া করে ফিরিয়ে দেবেন না।
তারপর উপহার সামগ্রীতে যোগ হয়েছে জামদানী শাড়ি, রুপোর বিছা, হীরার নাকফুল অনেককিছুই। বহু গোধূলি আর ভর সন্ধ্যা ক্লান্ত হয়েছে দুজনের গল্প আর আড্ডায়। দেখতে দেখতে নাঈমের আমেরিকা যাওয়ার সময় চলে আসে। এক কাকডাকা ভোরে এক ট্রাক লাল গোলাপ নিয়ে নাঈম আসে মৌমিতাকে প্রপোজ করতে। মৌমিতা হাসতে হাসতেই কেঁদে ফেলে।
নাঈম বলে তুমি আমেরিকা চল। আমি একটা নাচের স্কুল বানিয়ে দেব তোমাকে। তোমার জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করব। আমরা বাকি জীবন আনন্দে কাটিয়ে দেব। তোমাকে দেশেও নিয়ে আসব প্রতিবছর দুইবার। মৌমিতা বলে এতসব আমার সইবে কেন? তুমি আজ খেয়ে যাও আমি নিজের হাতে রান্না করব তোমার জন্য। মৌমিতা রান্না করে শিং মাছের ঝোল, দেশী মুরগী, সরিষা ইলিশ, খেজুরের পাটালির পায়েস।
নাঈম বলে আমি তোমাকে শুধু একবার গভীর আলিঙ্গনে পেতে পারি। মৌমিতা মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়।
নাঈমের চলে যেতে আর তিনদিন বাকি। এরপর আপেল কাটতে গিয়ে হাত কেটে ফেলল। পুড়িয়ে ফেলল শিং মাছ আর সীমের বীচির তরকারি।
পরপর দুই রাত স্বপ্নে দেখল– আমেরিকায় বড় বিশাল স্টেজে নাচছে ভারত নাট্যম, কিন্তু নাচ শেষে হারিয়ে গেছে খুব প্রিয় রূপার নুপুর জোড়া। এভাবেই লোভ, প্রতিষ্ঠা, ভালোবাসা, ব্যক্তিত্ব সবাই এসেই তার নিজস্ব শক্তি প্রদর্শন করল মৌমিতাকে দুদিন। তারপর মৌমিতা ভাঙা ভাঙা হাতে চিঠি লিখতে বসে। বসার আগে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ভাবে আমি শিল্পী। কাগজ আর কলম হাতে নিয়ে মৌমিতা তাকিয়ে থাকে দূর দিগন্তে। চোখ থেকে টপটপ করে ঝরতে থাকে মুক্তো দানা।