দর্পণ ডেস্ক
একটি পূর্ণাঙ্গ ম্যাগাজিন। শিক্ষা, সাহিত্য ও গবেষণামূলক ম্যাগাজিন দর্পণ। ২০১৯ সালে ব্যতিক্রমধর্মী ম্যাগাজিন দর্পণ তার যাত্রা শুরু করে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে দর্পণ "গল্পবাজ" ম্যাগাজিন আত্তীকরণ করে।
দর্পণ ডেস্ক

বাঘের বাচ্চা – আখতারুল ইসলাম

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

সুন্দরবনের পশুর নদীতে ঘূর্ণিস্রোত, প্রচন্ড ঝড় তুফান। বিপদ সংকেত শুনে মানুষ নিরাপদে যেতে পারলেও যেতে পাড়ে না বনের যত পশু-পাখি। মরমর করে ভাঙছে সুন্দরী, গরান– ওড়ে যাচ্ছে ডালপালা।

এক বাঘিনী তার সদ্য জন্ম দেয়া বাচ্চাকে রক্ষার চেষ্টা করছে। প্রচন্ড বাতাস, তুফান কিছুই মানছে না। পানির স্রোত নদীর কিনার বেয়ে বনের ভেতর ঢুকছে, কিছুই মানছে না। ধুরধুর করছে কাঁপছে বাঘিনীর মন। নিজকে রক্ষা করা যাচ্ছে না, তদুপরি বাচ্চা। গরান গাছের একটা ডাল এসে পড়ল মাথার অদূরে। ভয়ে চিৎকার করে ওঠে বাঘিনী। যে কিনা বনের রাণী, যে ভয়ে চিৎকার করছে। ভাবা যায়! প্রাকৃতির এ ধ্বংসযজ্ঞে অসহায় আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই তার। একটা বড় গাছে বাচ্চাকে মুখে নিয়ে ওঠার চেষ্টা করে হঠাৎ প্রচন্ড বাতাসে বাচ্চা পড়ে যায় মুখ থেকে।দেখতে না দেখতে তাকে নিয়েও গাছটি উড়ে যায় অনেক দূরে। বাচ্চা হারিয়ে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করে বাঘ। কিন্তু নিজেকেও রক্ষা করতে পারে না।

যখন বাতাস-ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থামে তখন নিজেকে আবিষ্কার করে দূরের এক জঙ্গলে। গাছের ডালে আটকে থাকা মূমুর্ষ অবস্থা। কিন্তু বনের ওদিক-সেদিক ছোটাছুটি করেও খোঁজে পায়নি বুকের ধনকে। শেষে ধরেই নিয়েছে এই জলোচ্ছ্বাসে বাচ্চা মারা গেছে।

শরণখোলা নদীর পাশের এক গভীর অরণ্য, সাথে একটা সরু রাস্তা– দুটি চিত্রা হরিণ, একটা বন বিড়াল, দুটি বন্য কুকুর ঘূর্ণিঝড়ে কোনোমতে প্রাণে বেঁচে আস্তে আস্তে সঙ্গীদের খুঁজছে। হাঁটতে হাঁটতে পাশের বন হতে কান্নার শব্দ শুনে থমকে দাঁড়ায়।

হরিণ বলল, কোনো বাচ্চার কান্না হবে।

কুকুরও বলল, হ্যাঁ তাইতো।

গিয়ে দেখে বাঘের বাচ্চা। একটা গাছের ডাল চাপা পড়ে পায়ে আঘাত পেয়ে কাঁতরাচ্ছে।

হরিণ দেখে বলে, মরুক।

কুকুরও বলছে, হ্যাঁ, বাঘের বাচ্চা। ওকে বাঁচিয়ে লাভ নেই। ওরা বাবা, মা, ভাই, বোনের উপর কত অত্যাচার করে মারে। খেয়ে হাড় কঙ্কালের অস্তিত্বও রাখে না।

পথে ভালুক ও গন্ডার আসছে। হরিণ, কুকুর ও বন বিড়ালকে দেখে বলল, কি করছো? ঘূর্ণিঝড় কেমন মোকাবেলা করলে?

হরিণ বলল, ভালুক ভাই, কোনোমতে বেঁচে আছি।

ওখানে কী করছ?

এদিকে আসো। একটা বাঘের বাচ্চা। মুমূর্ষ অবস্থায় কান্না করছে।

কী বললে, কই দেখি।

ছুটে আসে ভালুক, গন্ডার। দেখে সত্যিই বাঘের বাচ্চার কান্না করছে।

হরিণ বলল, বাঘের হিংস্র থাবায় যদি আমার ছোট ছেলেটা বাঁচতে পারেনি। আমি ওকে মেরে আমার বাচ্চা মারার প্রতিশোধ নেব।

ভালুক বলল, না হরিণ, কেউ অসহায় হলে তাকে সাহায্য করা উচিত। আর বাচ্চাটি ঘূর্ণিঝড়ে আহত। ওকে বাঁচানো আমাদের কর্তব্য।

কুকুর চেঁচিয়ে বলল, আরে রাখো তোমার কর্তব্য ও দায়িত্ব। আমাদের যখন ধরে, বাঘের কাছে কত কাকুতি মিনতি করি, বাঁচাও! বাঁচাও! বলে,– কিন্তু বাঘ তো নির্দয়ের মতো আমাদের মেরে মাংস খেতে একটু দয়াও করে না।

গন্ডার বলল, তোমাদের মনে ক্ষোভ আছে ঠিক কিন্তু ওকে আগে রক্ষা করি। তারপর শাস্তি দেয়া যাবে। বাঘ নিষ্ঠুর-হিংস্র বলে তো আমরা হিংস্র হতে পারি না।

চিত্রা হরিণ বলল, দেখো তোমরা ভালো সেজো না, আমার মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছে।

বন বিড়াল বলল, হরিণ তোমার দুঃখ আমরা বুঝি একটু মাথা ঠান্ডা করো। আগে গাছের গুড়ি ফেলে ওকে বাঁচাই তারপর দেখা যাবে।

ঠিক আছে তোমরা যখন বলছো।

সবাই মিলে এবার গাছের ডালটি ফেলে দেয়, বাঘের বাচ্চাটাকে তুলে নেয়। তুলে নিয়ে গেলো হরিণের ঘরে।

ভালুক বলল, একদম ছোট বাচ্চা, জন্মের পর পর নিশ্চয় বাবা মাকে হারিয়েছে।

কুকুর বলল, তাই মনে হচ্ছে। আমার একটা কথা কেমন হয় সবাই ভেবে দেখতে পার।

হরিণ বলল, কী, কুকুর ভাইয়া।

শোন, ওকে (বাঘের বাচ্চাকে) আমরা আমাদের মতো করে মানুষ করবো, তারপর ও বড় হলে ওই হবে বাঘের প্রতিপক্ষ।

হরিণ বলল, চমৎকার। গুড আইডিয়া, একদম ঠিক বলেছো।

সবাই তাতে সম্মতি দিল।

হরিণ, বন বিড়াল, সজারু, বন ছাগলসহ বনের সব পশুপাখি ব্যাপারটা জানলো।

একেক জন একেক দিন বাঘের বাচ্চার দেখাশোনার দায়িত্ব নিল। তরতর করে বেড়ে উঠছে বাঘের বাচ্চা, কিন্তু বাঘের বাচ্চা হয়েও আচার আচরণ সব হরিণ, ছাগল, কুকুর, বিড়ালের মতো।

কোনো বড় প্রাণীর দ্বারা আক্রান্ত হলে বাঘের বাচ্চা অসহায়ের মতো বলে, আমি ছোট আমাকে মেরো না। আমাকে রক্ষা করো! আমাকে খেয়ে ফেলো না, আমি আর আসবো না। এবারের মতো ছেড়ে দাও। মাফ করে দাও। আমাকে বাঁচাও!

এসব মন্ত্র পড়া শেখানো মুখস্ত বুলি। এসব দেখে হরিণ, শেয়াল, বাঁদর, হনুমান খুব খুশি হয়। বাঘের বাচ্চার এমন অবস্থায় খুব মজা পায় তারা। এভাবে দিন যায় রাত আসে। হঠাৎ একদিন সবাই পশুর নদীর তীরে যে যার মতো খাবার খুঁজতে বের হয়। তারা ঘাস, লতাপাতা, পানি পান করছে। নদীর জলে ভেসে থাকা এক কুমির এদের সাথে বাঘের বাচ্চাকে দেখে অবাক পায়। ভাবছে, একি কান্ড! এদের সাথে বাঘের বাচ্চা!

সেদিন এদিক ওদিক হাঁটছিল এক বাঘ। হঠাৎ তার চোখে পড়ে অদূরে ঘাস খাচ্ছে একটা বাঘের বাচ্চা। সাথে হরিণ, বানর, বন ছাগল, ভালুক, ময়ূর, দোয়েল শ্যামাসহ অনেক পশু পাখি।

ঘাস খেতে খেতে হরিণ দেখে একটা কাক কা কা করে চিৎকার করছে। এই চিৎকার মানে বিপদ। চোখ তুলে দেখে বিশাল দেহের এক ডোরাকাটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার। হরিণ লেজ তুলে এক ডাকে সবাইকে সতর্ক করে, বাঘ হেলে দুলে আসছে। হরিণ, ছাগল ও সেই বাঘের বাচ্চাসহ যে যার মত প্রাণ নিয়ে দৌড়াচ্ছে।

বাঘ আজ হরিণ, বন ছাগল বা অন্য প্রাণী ধরার জন্য দৌড়াচ্ছে না। দৌড়াচ্ছে তার প্রজাতির বাঘ কিভাবে অন্য প্রাণীদের সাথে থেকে অসহায় আচরণ করছে সেটা জানার জন্য। এটাতো অসম্ভব। বাঘ দৌড়ে সামনে গিয়ে আগলে ধরে বাঘের বাচ্চাকে।

বাঘের বাচ্চা বলছে, প্লিজ আমাকে মের না, আমি ছোট, আমি অসহায়, এবারের মতো ছেড়ে দাও। পরে চিৎকার করে, বাঁচাও! বাঁচাও।

বাঘ বলল, কী বলছ এসব। তুমি কে জানো?

বাঘের বাচ্চা, হ্যাঁ আমি অসহায় ছোট প্রাণী আমাকে মেরো না।

বাঘ বলল, থাম! এসো আমার সাথে, তুমি আমার স্বজাতি। আমাদের একই প্রজাতির বনের বাঘ।

বাঘের বাচ্চা কিছুতেই বিশ্বাস করছে না, ভয়ে ভয়ে বাঘের সাথে যাচ্ছে। বাঘ বাচ্চাটিকে নিতে নিতে একটা বড় কুয়ার পাশে নিয়ে যায়, বলল, দেখ তোমার চেহারা দেখ। বাঘের বাচ্চা দেখে সত্যি সে বাঘ। এতোদিন যাদের সাথে সে বড় হয়েছে, তাদের মতো চেহারার সাথে তার মিল নেই।

বাঘ বলল, আমার চেহারার সাথে মিল আছে কিনা দেখো।

বাঘের বাচ্চা বলল, হ্যাঁ।

এবার বাঘের বাচ্চা নিজের অস্তিত্ব, নিজের পরিচয় বুঝতে পারে।

 

[সুন্দরবনের উপকথার ছায়া অবলম্বনে রচিত]

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu