দর্পণ ডেস্ক
একটি পূর্ণাঙ্গ ম্যাগাজিন। শিক্ষা, সাহিত্য ও গবেষণামূলক ম্যাগাজিন দর্পণ। ২০১৯ সালে ব্যতিক্রমধর্মী ম্যাগাজিন দর্পণ তার যাত্রা শুরু করে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে দর্পণ "গল্পবাজ" ম্যাগাজিন আত্তীকরণ করে।
দর্পণ ডেস্ক

বাঘবন্দী – মনোজিৎকুমার দাস

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

গ্রামের ছেলে রমণীমোহন। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া চিত্রা নদীতে বোশেখ মাসে হাঁটু জল থাকলেও কিন্তু জোয়ারের সময় অল্পস্বল্প জল ফুঁলে ওঠে। তা দূর থেকে ঠাহর করা না গেলেও নদীর পাশের লোকজন তা কিন্তু ঠাহর করতে পারে। ভাটার সময় আবার জল নেমে যায়। চোত বোশেখ এলেই ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা নদীর হাঁটু জলে দাপদাপি করে। রমণীমোহন সাত ক্লাসে পড়েও ছোটখাট আর নাদুসনুদুস সুন্দর চেহারার জন্যে সে সহজেই তার চেয়ে ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে মিশে যেতে পারে। প্রাইমারী স্কুলে পড়া ছেলেমেয়েদের সাথে খেলাধুলো করায় তার সহপাঠীরা তাকে ঠাট্টা তামাশা করে নাজেহাল করতে ছাড়ে না। তবুও রমণীমোহন গরমকাল এলে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের সাথে চিত্রা নদীর জলে খেলায় মেতে উঠতে পিছিয়ে হয় না।

শ্রাবণ মাস এলে চিত্রা নদীর এ কূল ও কূল জলে টইটুম্পুর হয়। চুপসে যাওয়া যৌবন হারানো নারী যেন আবার টসটসে যৌবনবতী হয়ে উঠে। বর্ষাকালে চিত্রা নদীতে নৌকা ভাসে। পানসি নৌকা চলাচল করে পাল তুলে। সে সময় রমণীমোহনদের হিজলতলার ঘাট থেকে যাত্রীরা পানসি নৌকায় আসা যাওয়া করে। নদীর ঘাটের উপরেই রমণীমোহনদের বাড়ি। রুমের জানালা দিয়েই সে নদীর দৃশ্য দেখতে পায়। বর্ষার চিত্রা নদী থেকে ঠান্ডা বাতাস জানালা দিয়ে তার রুমে এসে লাগে। শ্রাবণ থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত তিন মাস এ নদী মানুষের কলকাকলীতে মুখর থাকে। হিজলতলার ঘাট থেকে নারী পুরুষ সবাই নৌকায় ওঠে কিংবা নৌকা থেকে নামে।

গ্রামের মধ্যে চৌধুরী বাড়ির নামডাক এখনো অনেক। এক সময় তাদের পরিবার ছিল একান্নবর্তী। সে আমল থেকেই এ বাড়ির ছেলেরা বাইরে চাকরীবাকরী করে আসছে। ব্রিটিশ আমলে ওবাড়ির ছেলেরা কলকাতায় চাকরী করতো। দেশভাগের পর চৌধুরী বাড়ির বড় তরফ কলকাতায় চলে গেলেও চৌধুরী বাড়ির জৌলুস কোন অংশে কমে নি। এ বাড়ির ছোট তরফের ছেলে রমণীমোহন। ওরা দু’ভাই এক বোন। দিদি চিত্রা সবার বড়। নদীর নামের সাথে মিলিয়ে দিদির নাম নাকি রেখেছিলেন ঠাকুমা। একাত্তরের যুদ্ধের আগের বছরে ঠাকুমা মারা যান, আর রমণীমোহনের জন্ম হয় একাত্তরে। সে বড় হয়ে ঠাকুমার ছবি দেখেছিল। তার নাম কে রেখেছিল তা সে জানে না। তবে তার ঠাকুমা রাখেন নি এটা নিশ্চিত।

কিশোর রমণীমোহন স্কুলের শেষ ক্লাসে উঠার পর তার নামের মাহাত্ম্য বুঝতে পারে। পন্ডিত মশাই বয়স্ক মানুষ এবং রসিকও বটে। অনেকের বাবা কাকা ও দাদা দিদিরা এককালে তার কাছে পড়েছে। রিটায়ার করতে বছর খানেক বাকি আছে মাত্র। ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা তার নাতি নাতনির বয়সী। তাই তিনি প্রায় প্রায়ই তাদের সাথে হাসিঠাট্টা করেন।

একদিন হিন্দুধর্ম ক্লাসে পন্ডিত মশাই দশকর্ম অধ্যায় পড়াতে গিয়ে তিনি তাদের ক্লাসের ছেলেমেয়েদের নামের ব্যাখ্যা করতে থাকেন। ওই ক্লাসের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অর্ধেক ছেলে আর অর্ধেক মেয়ে। পন্ডিত মশাই বললেন,‘ শিশুদের নামকরণ অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যদিও নাম মানুষকে বড় করে না। স্বভাব চরিত্র, আচার আচরণ ও ভাল কাজের দ্বারা মানুষের নামের মাহাত্ম্য প্রকাশ পায়। তোমরা তোমাদের নাম থেকে—’ পন্ডিত মশাইয়ের কথা শেষ করার আগেই রমণীমোহন বলে, ‘আমাদের প্রশান্তের নাম অশান্ত রাখলে ভাল হতো না স্যার?’ রমণীমোহনের কথায় প্রশান্ত তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে। মেয়েরা রমণীমোহনের কথায় খুশি হয়। কারণ প্রশান্ত মাঝে মধ্যেই তাদেরকে আজবাজে কথা বলে তাদের বিরক্ত করে। সত্যি সত্যি তাদের পুরো ক্লাসের মধ্যে প্রশান্ত দুরন্ত স্বভাবের ছেলে। তাদের ক্লাসের মেয়েদের মধ্যে সাবিত্রী, মুক্তি আর শাহানা সবচেয়ে ভাল ছাত্রী । ছেলেদের মধ্যে রমণীমোহন, শাহরিয়ার ও শাহীন সবচেয়ে ভাল ছাত্র। লেখাপড়া , খেলাধুলো, গান বাজনায় এরাই সবচেয়ে বরাবরই কৃতিত্ব দেখিয়ে আসছে। মেয়েদের মধ্যেও দু’একজন বাচাল স্বভাবের হলেও পড়াশোনায় কিন্তু ভাল। তাদের মাঝ থেকে শিবানী স্যারকে প্রশ্ন করে, ‘রমণীমোহননের নামটা খুব সুন্দর, তাই না স্যার?’ শিবানীর কথা শুনে রমণীমোহন তার প্রতি কটাক্ষ করে। ক্লাসে সোরগোল উঠলে পন্ডিত মশাই সবাইকে শান্ত করে কথা শুরু করেন,‘নামের কিছু শব্দের সাথে বিশেষণ যোগ না করলে নামের অর্থ প্রকাশ পায় না। যেমন ধর কোন পুরুষ ছেলের নাম রাধা হতে পারে না। হবে রাধাকান্ত, অর্থ করলে দাঁড়ায় রাধার সখা বা রাধার বন্ধু। ঠিক তেমনই রমণী শব্দের অর্থ সুন্দরী নারী, মোহন শব্দের অর্থ মুগ্ধকারী বা চিত্তহারী । তাহলে রমনীমোহন শব্দের অর্থ দাঁড়াল সুন্দর নারীর চিত্তহারী বা মুগ্ধকারী।’ পন্ডিমশাইয়ের কথাশুনে শিবানীর মতো সুন্দরী মেয়েরা হেসে উঠল। অন্যদিকে, সুদর্শন চেহারার রমণীমোহন যেন লজ্জায় রাঙা হয়ে যায়।

একসময় সে ভাবল কেন তার বাবা-মা তার এ ধরনের একটা নাম রেখেছেন। তারপর থেকে দুষ্টছেলেরা তাকে নিয়ে কত রকমের হাসিঠাট্টা করতে শুরু করল। এমনকি আড়ালে আবডালে তার নাম নিয়ে হাসিঠাট্টা করতে কসুর করল না। মেয়েদের মধ্যে মুক্তি সবচেয়ে ভাল ছাত্রী। রমণীমোহন মেধাবী ও সুদর্শন হওয়ায় মুক্তির সঙ্গে তার সম্পর্কটা মধুর। সে রমণীমোহনকে সমীহ করে আসছে বরাবরই। পাশাপাশি বাড়ি তাদের একটু দূর সম্পর্কের দাদাই হয় রমণীমোহন। মুক্তির মা তাকে একদিন বলেছিল, ‘তোর থেকে রমণীমোহন সাত মাসের বড় কিন্তু। ওকে তুই দাদা বলে ডাকবি। তোদের দু’জনের জন্ম পশ্চিম বাংলার ধুবুলিয়া শ্মরণার্থী ক্যাম্পে। ওর জন্ম হয় একাত্তরের মে মাসে আর তোর জন্ম ষোলই ডিসেম্বরের বিজয় দিবসের দু’দিন পরে। তাই আমরা তোর নাম রাখলাম মুক্তি।’ সেই মুক্তি একদিন রমণীমোহনকে নিভৃতে পেয়ে বলে বসল,‘দাদা, তোর নামটা রমণীমোহন কে রেখেছিল রে? আমার নাম মুক্তি হলে তোর নাম হওয়া উচিত ছিল বিপ্লব।’ মুক্তির প্রশ্নের উত্তর দিতে তার ইচ্ছে হয়নি।

বাড়ির ভাত খেয়ে স্থানীয় কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে স্টার নম্বর পেয়ে আই.এসসি পাশ করার পর ঢাকা ভার্সিটিতে কেমিস্ট্রিতে অনার্স নিয়ে আর মুক্তি রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস এ ভর্তি হল। মুক্তি মনে করেছিল রমণীমোহনও ডাক্তারী পড়বে। কিন্তু সে ওপথ মাড়ায় না। বড়দা সুুপ্রিয় চৌধুরী ঢাকায় ফ্লাট কেনায় রমণীমোহনের সুবিধাই হয়। সুপ্রিয় একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে সিইও। সুপ্রিয় এর এক ছেলে এক মেয়ে। ঢাকার মিরপুরে নিজস্ব ফ্লাট ও নিজস্ব গাড়ি ও ড্রাইভার থাকায় ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করানোর সুবিধা থাকলেও বৌদিকে অসুবিধা ভোগ করতে হয় ছেলে মেয়েকে স্কুলে আনা নেওয়া করতে।

রমণীমোহন ঢাকাতে পড়াশোনা করতে আসায় দাদা বৌদিও স্বস্তিবোধ করে। অফিসের কাজে প্রায় প্রায়ই সুপ্রিয়কে দেশের বাইরে যেতে হয়। সুপ্রিয় ঢাকায় থাকলে অফিসে যাবার কালে ছেলেমেয়েদেরকে ও ওদের মাকে স্কুলে নামিয়ে দেয়। স্কুল ছুটি না হওয়া পর্যন্ত ওদের মাকে স্কুলে অপেক্ষা করতে হয়। স্কুল ছুটি হবার পর তাদের বাড়ি ফিরিয়ে নেবার জন্য সুপ্রিয় ড্রাইভার দিয়ে গাড়ি পাঠায়।

মীরপুরের মুন গার্ডেন ম্যানসনের পাঁচতলার ফ্লাটের পুরোটাই দাদার কেনা নিজস্ব ফ্লাট। ফ্লাটের ফাস্ট ব্লকে তারা নিজেরা থাকে।

ওই ফ্লাটের সেকেন্ড ব্লকে নি:সন্তান এক দম্পতি তাদের ভাড়াটে। স্বামী স্ত্রীর ছোট্ট সংসারে ছেলেপুলে না থাকায় তাদের দু:খের অন্ত নেই। বৌদির কাছ থেকে রমণীমোহন ওদের সম্বন্ধে যৎসামান্যই জেনেছিল।

লিফট থেকে প্রথম একজন অপরিচিত মহিলাকে তাদের পাঁচতলায় নামতে দেখল রমণীমোহন। বৌদি বলেছিল ভদ্রমহিলার বয়স পয়ত্রিশের মত হবে, আর তার স্বামীর বয়স ষাটের কাছাকাছি। তার স্বামী কুমারস্বামী রাজন একটা বিদেশী ফার্মের চাকুরীর সুবাদে ঢাকায় অবস্থিত অফিসে সাউথইস্ট রিজিওনের দায়িত্ব প্রাপ্ত সিইও হয়ে এসেছেন। কুমারস্বামী রাজনের পৈত্রিক আবাস দক্ষিণ ভারতে হলেও ছোটবেলা থেকে কলকাতায় মানুষ। স্ত্রী কমলিনী কলকাতার বাঙালি মেয়ে। দেখে তো মহিলাটিকে পঁচিশ বছরের বেশি বলে মনে হয় না রমণীমোহনের। সে ভাবে, এ মহিলাটি অবশ্যই বৌদিদের ফ্লাটের সেকেন্ড ব্লকের বাসিন্দা নয়। তার মনে কেন যেন মহিলাটি সম্বন্ধে কৌতূহল দেখা দেয়।

লিফট থেকে মহিলাটিও তার সাথেই পাঁচতলায় নামে। লিফট থেকে বের হয়ে আসার সময় তাদের চোখাচোখি হলেও কেউ কারো সাথে কথা না বললেও কিন্তু মহিলাটি রমণীমোহনের আপাদমস্তকের প্রতি দৃষ্টিপাত করে। এটা দেখে সে ভাবে, তার কলেজের বন্ধুরা ঠিকই বলত, তার প্রতি চোখ পড়লে কোন মহিলাই তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারে না। মহিলাটিও কিন্তু কম সুন্দরী নয়। চেহারা বাঙালির মত হলেও পোশাকআশাক কিন্তু বাঙালিদের মত নয়। পরনে পায়ের সাথে আটা চুড়িদার পাজামা। গায়ে হাঁটু অবধি লম্বা আটোসাটো সবুজ রঙের কামিজ, তার উপরে একটা পাতলা ফিনফিনে কাপড়ের শর্ট জ্যাকেট। লাল রঙের একটা স্কার্ফ গলায় পেঁচানো। উন্নত স্তনদুটো ফিনফিনে কাপড়ের জ্যাকেট ভেদ করে বের হয়ে আসায় রমণীমোহনের চোখ সেদিকে পড়ে। ভদ্রমহিলা সত্যি সত্যি নজরকারার মত সুন্দরী। রমণীমোহন মহিলাটির দিক থেকে নজর ফিরিয়ে নিজেদের ফ্লাটের দিকে হনহন করে হাঁটতে থাকে। মহিলাটি কিন্তু মন্ত্রমুগ্ধের মত রমণীমোহন যেদিকে যায় সেদিকের পানে চেয়ে থাকে।

রমণীমোহন তার রুমের অ্যাটাচ বাথ থেকে হাত পা ও চোখেমুখে জল দিয়ে ফিরে এসে বিছানায় শুয়ে একটু রিফ্রেশ হয়ে ডাইনিং রুমে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। কেন যেন একটু আগে দেখা মহিলাটির কথা মনের কোণে ভেসে উঠছে তা সে ভেবে পায় না। সে ভাবে, মহিলাটি হয়ত পাশের ব্লকের গেস্ট হবে। বৌদিকে জিজ্ঞেস করলে ভদ্রমহিলার পরিচয় পাওয়া যেতে পারে। একটু বিশ্রাম করেই সে ডাইনিংরুমের দিকে পা বাড়ায়। ডান দিকের সেকেন্ড ব্লকের দিকে তাকিয়ে লিফট থেকে নামা ভদ্রমহিলাকে লাল টুকটুকে রঙের শাড়ি পরে ব্যালকোনীতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার খটকা লাগে। বৌদি বলেছিল তাদের ফ্লাটের সেকেন্ড ব্লকের কুমারস্বামী রাজনের স্ত্রীর বয়স পঁয়ত্রিশের উপরে, তাহলে এ মহিলাটি কে?

রমণীমোহন ডাইনিংরুমে ঢোকার পরপরই ব্যালকোনীতে দাঁড়িয়ে থাকা তার সাথে একসঙ্গে লিফট থেকে নাম মহিলাটিকে গলা ছেড়ে রবীন্দ্র সঙ্গীতের কলি -‘মুখপানে চেয়ে দেখি, ভয় হয় মনে— ফিরেছ কি ফের নাই বুঝিব কেমনে ।। আসন দিয়েছি পাতি—’ গাইতে গাইতে ডাইনিং রুমে ঢুকতে দেখে রমণীমোহন অবাক হয়। ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজাতে সাজাতে বৌদি চোখ না তুলেই বলে উঠে, ‘কুমু বৌদি, ফিরেছে কি ফেরে নাই এখনো বুঝতে পার নি?’ সে দেওরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,‘এদিকে তাকিয়ে দেখ নাগরটি ফিরেছে কি ফেরে নাই?’ বৌদির কথা শুনে রমণীমোহনের মুখটা লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠে। বৌদি তাকে নিয়ে অনেক হাসিঠাট্টা করে তাই বলে একজন অপরিচিত মহিলার সামনে—! দু’জন কেতাদুরস্ত মহিলার সামনে তার মুখ দিয়ে কথা বের না হলেও সে ভাবে, তাহলে এই সুন্দরী মহিলাটিই কুমারস্বামী রাজনের স্ত্রী কমলিনী, সাবিত্রী বৌদি যাকে কুমু বৌদি বলে সম্বোধন করছে।

‘তাহলে এই তোমার সেই নাগর!’ গান থামিয়ে মহিলাটি সাবিত্রী বৌদিকে বলে, ‘বরটার সাথে সাথে ফাওটি তো ভালই পেয়েছ। লাজুক লাজুক চেহারার তোমার ফাওটি কিন্তু চোরের মত মেয়েদের দিকে তাকাতে ওস্তাদ!’ মহিলাটির কথার ফাঁকে তার দিকে রমণীমোহন তাকিয়ে বুঝতে পারে কথা বলার সময় মহিলাটির মুখে টোল পড়ে। ক্ষণিকের মধ্যে তার সহপাঠিনী শিবানীর মুখটা তার মনের কোণে ভেসে উঠে। কথা বলার সময় ওর মুখেও টোল পড়ত। একদিন শিবানীকে নিভৃতে পেয়ে সে তাকে বলেছিল,‘কথা বলার সময় গালে টোল পড়লে মেয়েদের খুব সুন্দর দেখায়।’ শিবানী তার কথা শুনে মুচকি মুচকি হেসেছিল।

ক্ষণিকের মধ্যেই রমণীমোহন বর্তমানে ফিরে আসে। বৌদি রমণীমোহনের সাথে কুমু বৌদির পরিচয় করে দেয়। ‘ এ হচ্ছে কুমারস্বামী রাজনের বেটার হাফ কমলিনী রাজন। বাঙালি বাড়ির মেয়ে কমলিনী থেকে কুমু নামে পরিচিত হওয়াটাই স্বাভাবিক, তাই না কুমু বৌদি?’ বৌদির কথা থামিয়ে দিয়ে দেবরটির দিকে তাকিয়ে আবার বলতে থাকে,‘কুমু বৌদি, এই হচ্ছে সেই রমণীমোহন , যার কথা তোমাকে প্রায় প্রায়ই বলি। বাংলায় এম.এ টা পাশ করেছ যখন, তখন রমণীমোহন শব্দের অর্থ: সুন্দরনারীর চিত্তহারী বা মুগ্ধকারী পুরুষ, তাতে তুমি জানই।’
‘ ও তোমার চিত্তহরণ করে বসে আছে , আর কোন নারীর চিত্তহরণ করার ক্ষমতা কী আর তার আছে!’ কুমু বৌদি ফুটকি কেটে বলে।
‘ না , ভাই কুমু, ও করবে আমার চিত্তহরণ! তাহলেই হল! ’

‘ লিফট থেকে এক সাথে নামার পর আমার দিকে একবার মাত্র ঠারে ঠারে একবার চেয়ে তোমার রমণীমোহন কেটে পড়ল। তুমি ভাই, মুগ্ধ না হলেও আমি কিন্তু ওকে দেখে কুপোকাত!’

তাকে নিয়ে ঠাট্টা তামাসা করায় রমণীমোহন প্রথম দিকে বিরক্ত হলেও এক সময় তার মনটাতে খুশির ভাব জাগে। সে এত দিন গ্রামের কলেজে পড়াশোনা করে এসেছে। ভাল ছাত্র হিসাবে মেধাবী ছাত্রীদের সাথে মেশবার অনেক সুযোগ পেলেও কখনোই এ ধরনের কথাবার্তা তাদের কাছ থেকে শোনে নি। কিছুটা সময় নীরব থাকার পর সাবিত্রী বৌদি কথা শুরু করে, ‘বেচারীর বড় দু:খ একে তো ছেলেপেলে নেই, তার উপর স্বামী বেচারা প্রায় প্রায়ই হিল্লিদিল্লি করে বেড়ায়। স্বামী বেচারা বাইরে গেলে কুমু বৌদিকে দেখাশোনা করার কেউ থাকে। ’

গ্রামের ছেলে রমণীমোহন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে নতুন একটা পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে সক্ষম হয় অল্পদিনের মধ্যেই। সে তার নিজের আপন বৌদির ফাইফরমাস কাটতে হয় না। কিন্তু দক্ষিণভারতীয় কুমারস্বামী রাজনের পত্নী কমলিনী রাজনের ফাইফরমাস খাটতে হয় নিত্যদিনই। বেচারী স্বামী প্রায় প্রায়ই দেশের বাইরে থাকায় কুমু বৌদি হাতের লাঠি এখন রমণীমোহন। কুমু বৌদিকে যথাসাধ্য সাহায্য জন্য সাবিত্রী বৌদি তার দেবরকে বার বারই বলে আসছিল। ‘বেচারীর স্বামী বাইরে বাইরে থাকেন তাই তুমি কুমু বৌদির ফ্লাটে মাঝে মাঝে যেও, যদি দোকান থেকে কিছু কিনতেটিনতে দেয় তবে এনে দিও।’ সেই থেকেই কুমু বৌদির বাসায় রমণীমোহনের অবাধ যাতায়াত শুরু।

রমণীমোহনের দৃষ্টিতে কুমু বৌদির স্বামী কুমারস্বামী রাজন খুবই ভাল মানুষ। ছয় তলার পুরো ফ্লাট একজন পুলিশ অফিসারের। তার স্ত্রী প্রায় প্রায়ই দাদাদের ফ্লাটে আসে, আরো আসে তাদের নিচের তলার সীমা ভাবী ও তার ননদ রিতা। এক সময় সীমা ভাবী সাবিত্রী বৌদির সঙ্গে একই কলেজে পড়ত। সেই সুবাদে সীমা ভাবীর সাথে সাবিত্রী বৌদির গলায় ভাব। সেও তার বান্ধবীর দেবরটি কুমু বৌদির ওখানে আসা যাওয়ার কথা জানে। ড্রয়িংরুমের পাশ দিয়ে যাবার সময় সীমা ভাবীর কথা রমণীমোহনের কানে যায়। ‘বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্য্যা। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীকে বুড়ো লোকটা সঙ্গ দিতে পারে না, এটা বড়ই দুঃখের ব্যাপার। তোর রমণীমোহনটি একটু আধটুকু সঙ্গ দিয়ে কুমু ভাবীকে আনন্দেই রাখছে তাহলে!’ সীমা ভাবীর কথাগুলো রমণীমোহনের ভাল লাগে না। সাবিত্রী বৌদি সীমা ভাবীর কথায় প্রতিবাদ না করায় সে অখুশি হয়।

বেশ কয়েকদিন থেকে কুমু বৌদিকে বিষণ্ণ অবস্থায় থাকতে দেখে সাবিত্রী অবাক হয়। তারা স্বামী স্ত্রী দু’জনেই সম্প্রতি সিঙ্গাপুর থেকে কয়েকটি টেস্ট করিয়ে এসেছে। দু’জনের টেস্টেই নেগেটিভ কিছু ধরা পড়ে নি। তবে কেন তার স্বামী এত কিছু করেও তাকে সন্তান দিতে পারছে না? এটা কমলিনীর একমাত্র দুঃচিন্তার কারণ। সে এসব কথা সাবিত্রী বৌদিকে বলতে কমলিনী দ্বিধা করে নি।

কমলিনী ভাবে, তাকে মা হতেই হবে। যদি তার ছেলেপুলে না হয় তবে তার স্বামীর অগাধ সহায় সম্পত্তি নয়ছয় হয়ে যাবে, আর তার সহায় সম্পদ বারভূতে লুটেপুটে খাবে। তাকে যেনতেন ভাবেই মা হতে হবেই, একরাতে অনেক ভেবে ভেবে সে সংকল্প করে। তার স্বামীর প্রথম পক্ষের স্ত্রী তার বাচ্চা ছেলেসহ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। ওই ছেলেটিও যদি বেঁচে থাকত তবে সে কুমারস্বামী রাজনের সম্পত্তির একটা উত্তরাধিকারী অবশ্যই হত। কমলিনীর মনে ঘোর লাগে। সে ভাবে, তবে কী সে নিজে গর্ভধারণ করতে অক্ষম। এক সময় তার স্বামীর সন্তান জন্ম দেবার ক্ষমতা ছিল, কিন্তু এখন তা নাও থাকতে পারে। তার স্বামী সন্তান উৎপাদনে অক্ষম সে কথা সে নিজে বুঝতেও পারলেও তার স্বামী ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজনরা তা বুঝতে নারাজ। তার স্বামী ও তার আত্মীয় স্বজনরা জানে এক সময় তার ঔরসে একটা ছেলে জন্মে ছিল।

কমলিনী জানে সে নিজে একজন সতী নারী। নিজের চরিত্রকে সে কখনোই কলুসিত করে নি। পনেরো বছরের দাম্পত্য জীবনে তার স্বামী তাকে কম সুখে রাখে নি। কিন্তু তার ছেলেপেলে না হওয়ায় স্বামী ও তার আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে তাকে উঠতে বসতে গঞ্জনা শুনতে হচ্ছে। বন্ধ্যা নারীর গঞ্জনা থেকে কমলিনী বাঁচতে চায়।

কুমারস্বামী রাজন ইন্ডিয়ান এয়ার লাইন্সের সকালের ফ্লাইটে জরুরী কাজে এক সপ্তাহের জন্য বোম্বের হেড অফিসে গেছেন। সাতদিন স্ত্রীর সান্নিধ্য থেকে তিনি দূরে থাকবেন এ জন্যে কুমারস্বামী রাজন রাতের রানী কমলিনীকে রাতভর উপভোগ করেছেন মনের সুখে। নীলাভ ডিম লাইটের আলোয় আলোকিত দুগ্ধফেনিভ শয্যায় নিজেকে স্বামীর কাছে মেলে ধরে কম তৃপ্তি পায় নি কমলিনী। সুখের রেশ কিন্তু কমলিনী বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে নি, তার একটা কারণ প্রস্ফুটিত পুষ্পে ভ্রমর ঠিকই বসে কিন্তু ফল তো ধরে না!

ছেলেমেয়েদের স্কুলের গরমের ছুটিতে বিমান বাংলাদেশে এয়ারলাইন্স এর গত পরশু সন্ধ্যার ফ্লাইটে ছেলেমেয়েকে নিয়ে সাবিত্রী বৌদি যশোর শহরের ষষ্ঠীতলার বাপের বাড়ি গেছে। বাসায় দেবর রমণীমোহ থাকবে সে ভরসাতেই তার বাপের বাড়ি বেড়াতে যাওয়া। কুমু বৌদির স্বামীর মত রমণীমোহনের বড়দা সুপ্রিয়ও দেশের বাইর , তবে বোম্বাইতে নয় কলকাতায়।

যশোর যাবার আগে সাবিত্রী বৌদি দেবরের সামনেই কুমু বৌদিকে বলেছিল,‘এক সপ্তাহের জন্যে দেবরটিকে তোমার জিম্মায় রেখে গেলাম। দেখ, তোমার জিম্মা থেকে ও যেন পালিয়ে না যায়।’

‘আমি তোমার রমণীমোহনকে বাঘবন্দী করে রাখব, যাতে আমার হাত থেকে কোথায়ও পালিয়ে যেতে না পারে ।’

‘তোমার হাতে সঁপে দিয়ে গেলাম, তোমার যা করতে ইচ্ছে তাই কর, তবে দেখ ও যেন উপোস করে না থাকে।’ সাবিত্রী কথাগুলো বলে মুচকি মুচকি হাসে।

রাতে দু’জনের ডিনারের আয়োজন করতে করতে কমলিনী ভাবে, ‘ সাবিত্রী রমণীমোহনের খাবার দাবারের ব্যবস্থা করা অর্থেই বলেছে ‘ দেখিস উপোস করে না থাকে।’ সে মনস্থির করে ওকে সে অন্যদিক থেকেও উপোসী রাখবে না। পাঁচতলার পুরোটাতে এখন মাত্র দুটো প্রাণী ছাড়া কেউ নেই। তাদের ফ্লাটের কেউই রাতে দরজা আটকিয়ে ঘুমায় না। মেইন গেট বন্ধ থাকায় কেউই দরজা আটকিয়ে ঘুমানোর কথা কেউই কখনো ভাবতে পারে না।

রাতে কুমু বৌদির ওখানে গিয়ে রমণীমোহন তাকে দেখে অবাক হয়। সে ভাবে, আজ রাতে কুমু বৌদি এমন সাজে সেজেছে কেন! হঠাৎ করে তার দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হয় কুমু বৌদির বুকের দিকে, টাইট গেঞ্জির নিচে তার ব্রা-হীন বুকের সুঢোল স্তনযুগোলের অর্ধেকাংশ রমণীমোহনের চোখে পড়ে। কে বলবে সে একজন তিরিশোর্ধ নারী। দুধে আলতায় মেশানো টসটসে চিবুকদ্বয়ে গোলাপী আভা। ওষ্ঠদ্বয়ে গোলাপী রঙের আভা, কেশগুচ্ছ বিননীবদ্ধ যেন এক অনিন্দ্যসুন্দরী অষ্টদশী।

‘কুমু বৌদি, আজ কি তোমার বিবাহবার্ষিকী, এ জন্যই কি তুমি এমন সাজে সেজেছ?’ রমণীমোহন জিজ্ঞেস করে।

‘বিবাহবার্ষিকী হলে কী তোমার রাজনদা বোম্বেতে থাকত? তোমার রূপে মুগ্ধ হয়ে আজ আমার মনে রঙ লেগেছে, ঠিক না?’ জবাব পাবার অপেক্ষা না করে সে রমণীমোহনকে ডাইনিং রুমে নিয়ে আসে। ডিনার টেবিল নানা রকম পদের খাবারে সাজানো। তারা টেবিলের সামনে পাশাপাশি বসে। ‘আজ পর্যন্ত যা তোমাকে খাওয়াই নি তাই আমি তোমাকে—’ কথা শেষ না করেই কুমু বৌদি রমণীমোহনের ঠোঁটে একটা চুমু দিয়ে বলে,‘এস আমরা ডিনারটা করে নেই।’ আচমকা কুমুবৌদির এ ধরনের আচরণে সে হতবাক! সে কিছু একটা বলতে যায়। কিন্তু তার কথা থামিয়ে দিয়ে কুমু বৌদি বলে,‘এখন আর কোন কথা নয়। ডিনার শেষ করার পর যা বলার বলা যাবে।’ কথাটা বলেই সে তার গায়ে অ্যাপ্রোনটা পরে নেয়।

ডিনারর শেষ করার পর রমণীমোহন বলে, ‘ ঘুম পেয়েছে, এখন তবে উঠি, কুমু বৌদি। ’

‘এত সকাল সকাল ঘুম পেয়েছে তোমার! এতদিন সাবিত্রী বৌদির আঁচলের তলায় ছিলে আজ কিন্তু আছ আমার —’ কথা শেষ না করে সে রমণীমোহনের পাশে বসে পড়ে আবার বলে,‘ সাবিত্র বৌদি তোমাকে আমার জিম্মায় রেখে গেছে। তাহলে এখন থেকে আমার কথায় তোমাকে উঠবস করতে হবে।’ তার কথায় রমণীমোহন মুগ্ধ হয়ে হেসে উঠে বলে, ‘ওহ! তাই নাকি।’

কুমু বৌদি এক সময় রমণীমোহনকে জাপটে ধরে বেডরুমে গিয়ে বিছানার উপর বসিয়ে বলে,‘আগে কি কখনো এখানে এসেছ? এতদিন আছ যদি আমার বেডরুমেই না আস তবে তুমি অবশ্যই ভাববে আমি তোমারে পর পর ভাবি।’ কথাটা বলেই সে রমণীমোহনের পাশে বসে। সে এতক্ষণ খেয়াল করে নি রুমে নিষ্প্রভ গোলাপী আলো জ্বলছে। সে তার গা থেকে অ্যাপ্রোনটা খুলে ডিভানের উপর রাখে। এতে রমণীমোহনের মনে কোন প্রতিক্রিয়া হবার কথা নয়। কিন্তু সে এবার যা করে তাতে সে রীতিমত লজ্জায় পড়ে। তার চেখের সামনেই হঠাৎ করে সে তার গায়ের গেঞ্জিটা খুলে নাইটি পড়তে থাকলে তার উদম শরীরের আনাচেকানাচেয় ক্ষণিকের জন্য রমণীমোহনের চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নেয়। কুমুবৌদির কিন্তু সেদিকে কোন প্রকার ভ্রুক্ষেপ করে না।

সে বিছানায় রমণীমোহনের পাশে বসেই বেড সুইজটা অফ করে দিতেই পুরো রুমটা অন্ধকারে ঢেকে গেল। আর সে সময়ই কুমু বৌদি অস্ফুট স্বরে বলল, ‘এখন দেখ তোমাকে কিভাবে বাঘবন্দী করি। নীল রঙের কাঁচপোকা কিভাবে তেলাপোকাকে পাকড়াও করে নিয়ে যায় তুমি দেখেছ হয়ত। তুমি স্বেচ্ছায় ধরা না দিলে তোমাকেও ওই ভাবে পাকড়াও করব। ’

কিছু বুঝে উঠবার আগেই রমণীমোহন কুমু বৌদির বাহুলগ্না হয়ে তার বিছানায় যেতে বাধ্য হয়। রমণীমোহনের জীবনে এমন অভিজ্ঞতা কোনদিনই হয় নি। সে এক সময় পাগলের মত শিবানীকে ভালবাস তো। এখনো তাকে ভালবাসে, কিন্তু লঞ্চ ডুবিতে রাক্ষসী পদ্মা তাকে কেড়ে নেয়ায় সে এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

কুমু বৌদির দু’বাহুর মাঝ থেকে ছাড়া পাবার জন্যে সে এক হাত দিয়ে বেড সুইজটা অন করে দিলে সারা রুমটা আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলে সে কুমুবৌদির চোখেমুখে কমনীয়তার লেশমাত্র দেখতে পায় না। তার চোখে যেন কামনার বহ্নি! এমন চেহারায় কুমু বৌদিকে সে কখনোই দেখে নি। সে কুমু বৌদির হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বিছানা থেকে নেমে সোফায় বসলে কুমু বৌদিও তার পাশে এসে বসে। মুহূর্তের মধ্যে কুমু বৌদির মুখে বিষণ্ণতার ভাব ফুটে ওঠায় রমণীমোহন অবাক হয়।

সে সময় কুমু বৌদি কাঁদো কাঁদো কন্ঠে তাকে একটা কথাই বলে,‘নষ্টা মেয়েছেলে নই আমি। আমি যে বন্ধ্যা নারী নই সেটা প্রমাণ করার জন্যে আমি তোমাকে পেতে চাই। আমাকে করুণা কর।’ কথা শেষ করে কুমু বৌদি রমণীমোহনের হাত জড়িয়ে ধরে।

রমণীমোহন কুমু বৌদির কাছে নতি স্বীকার করে। কুমু বৌদি নিজেই গোলাপী ডিম লাইটটা জ্বেলে দিলে রুমটাতে এক ধরনের মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি হয়। কমলিনী মনে মনে বলে, ‘ওকে ছেদা কথা বলে কাজ হবে না। ওর মত একজন সুবোধ বালককে উত্তেজিত করে তুলে ওর যৌবনের প্রথম অভিষেক আমাকেই করতে হবে। ওকে মাতাল করে তোলার শক্তি আমার এখনো নি:শেষ হয়ে যায় নি ! ’

রমণীমোহন সোফায় বসে আছে। মুখে কোন কথা নেই। কুমু বৌদি গা থেকে নাইটি খুলে ফেলে রমণীমোহনের গা ঘেষে সোফায় বসে তাকে জড়িয়ে ধরে ওর গালে একে পর এক চুমু দিতে থাকে। কমলিনীর মনে হল ফিনফিনে সুতির অর্ন্তবাসের আড়ালের স্তন দুটো রমণীমোহনের শরীর স্পর্শ করায় ওর শরীরও যেন গরম হয়ে উঠছে। কমুু বৌদির চুমুর জবাবে সেও তাকে একটা চুমু দেয়। কমলিনী মনে মনে বলল, ‘ ওর মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিচ্ছে। আমার বয়স্ক স্বামীকে রাতে যদি উত্তেজিত করে তুলতে পারি তবে এই যুবক ছেলেটিকে কেন পারব না।’ এক পর্যায়ে কমলিনী বজ্রের মতো আঘাত হানলে ছেলেটি যেন পাগল হয়ে উঠে।

কমলিনী উপলব্ধি করল উনিশ বিশ বছরের একজন যুবক কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে, তার চেয়ে বেশি বয়সী স্বামীর কাছ থেকে জীবনে এমন সুখ কমলিনী উপভোগ করে নি। এক সময় কমলিনীর মনে হল সে যেন বাসর রাতের কনে।

সাতদিন পর সবাই বাসায় ফিরে এল। বাঘ একবার রক্তের গন্ধ পেলে রক্তের পেছনে ছুটতে চায়। তারা ফিরে আসার আগে আরো তিন রাত রমণীমোহন কুমু বৌদিকে সুখের সাগরে ভাসিয়ে দেয়।

তারপরের ঘটনা সংক্ষিপ্তই বলতে হয়। কুমারস্বামী রাজন পরের মাসে বোম্বের হেড অফিসে বদলী হয়ে যাওয়ায় কমলিনীরা ঢাকার পাঠ চুকিয়ে বোম্বে চলে গেল। এদিকে সাবিত্রী বৌদি ফিরে আসার পর পরই রমণীমোহন হলে সিট পেয়ে যাওয়ায় ওখান থেকে হলে গিয়ে উঠল।

ভার্সির্টির পাঠ শেষ করে রমণীমোহন দাদার মাল্টিন্যাশনাল ফার্মে যোগদান করার পর থেকে সে আর.মোহন চৌধুরী নামে পরিচিত হয়। চাকুরী পাবার পাঁচ বছরের মাথায় সাবিত্রী বৌদির মাসতো বোন অবন্তিকার সাথে রমণীমোহনের বিয়ের পর তার ভাগ্যের চাকা সামনের দিকে চলতে শুরু করে। পর পর দুটো প্রোমোশন পাবার পর সে তাদের ফার্মের দিল্লি অফিসের বস হওয়ায় নতুন বৌ অবন্তিকা পয়মন্ত মেয়ে বলে সবার প্রশংসা পেল। বিয়ের তিন বছর পরে অবন্তিকার ছেলে জন্ম দেয়ায় সবচেয়ে বেশি খুশি হল তার স্বামী ।

দিল্লিতে আর.মোহন চৌধুরীকে এখন সবাই মোহন সাহেব বলে সম্বোধন করে। সে দিল্লির ইন্ডিয়া গেটের কয়েক কিলোমিটার দূরের অভিজাত আবাসিক এলাকার দশতলা রোজ গার্ডেন ম্যানসনে সাত তলার একাংশে বাসা নিল। এই ম্যানসনের সাত ও আট তলার দুটো ফ্লাটের মালিক এক দক্ষিণ ভারতীয়। আটতলার একাংশে মালিক থাকে এতটুকুই রমণীমোহন শুনেছে। মালিকের সাথে তখনো সাক্ষাৎ ঘটে নি। বাসা ভাড়া নেবার এগ্রিমেন্ট ও পেমেন্ট তার ম্যানেজারের সাথেই হয়েছে।

তার কারকে ওভারটেক করার জন্য আর একটা কার সিগন্যাল দিলে আর.মোহন চৌধুরী সামনের লুকিং গ্লাসে দেখতে পায় একজন বয়স্কা মহিলা পেছনের কারটা ড্রাইভ করছে। ইচ্ছে করলে সে সাইড দিয়ে পেছনের কারকে জায়গা করে দিতে পারত, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছে যাবে বলে বা’দিকে টার্ন নিয়ে কার স্লো করাতেই রোজ গেট কিপার গেট খুলে দিলে সে রোজ গার্ডেন ম্যানসনের বেসমেন্টে কার ঢুকিয়ে দেয়। পেছনের কারটা সোজা রাস্তায় না গিয়ে তার কারের পেছনে দাঁড়ালে ম্যানসনের সিকিউরিটি গার্ডটা যে ভাবে সালাম ঠুকল তাতে আর.মোহনের চৌধুরীর মনে হল ভদ্রমহিলাটি হয়ত বড়সড় কেউ হবে হয়ত। নিজের কার বেসমেন্টে ঢোকার পর পেছনের কারের ভদ্রমহিলার সাথে আর.মোহেনের চৌধুরীর চোখাচোখি হতেই ভদ্রমহিলাটি নয় দশ বছরের একটা বাচ্চা ছেলেকে, ‘একটু ভেতরে বস , বাবা’ বলে কারের ড্রাভিং সিট থেকে উঠে কারের দরজা খুলে তার দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘ আমায় কি চিনতে পেরেছ, রমণীমোহন ?’
মহিলাটির পরনে হালকা সোনালী রঙের সিল্কের ধুতি, বিধবা মহিলারা এ ধরনের ধুতি শাড়ির মতো করে পরে থাকে। ধুতির কালচে পাড় জরির সুতোর তৈরি। প্রায় পাঁচ ফুট লম্বা দেহে ধুতিটা শাড়ির মতো করে পরায় মহিলাটিকে সুন্দর লাগছে। সে অবাক হল এই ভেবে যে দিল্লিতে কে তাকে রমণীমোহন নাম ধরে তুমি বলে সম্বোধন করতে পারে! এখানে তো তাকে কেউ রমণীমোহন নামে চেনে না।

সে বিধবা মহিলাটির মুখের দিকে চেয়ে আমতা আমতা করে বলল,‘ মনে তো করতে পারছি না , তবে কোথায় যেন আপনাকে দেখেছি।’

বিধবার পোশাক পরা বয়স্ক মহিলাটি এবার তার নিজের পরিচয় দিল।

‘প্রায় এক যুগ পরে তোমাকে এ বেশে দেখে আমার চিনবার কথা নয়। তোমার কত পরিবর্তন হয়েছে!’ সে মহিলাটিকে বলল।

‘নয় বছর হতে চলল আমি এ বেশে আছি। ঢাকা থেকে বোম্বে বদলি হয়ে আসার কয়েক মাস পরে কুমার স্বামী হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলে আমি অকূল পাথারে পড়ি। ঈশ্বরের ইচ্ছায় এতদিন পর আবার তোমার সাথে দেখা হল। তুমি কোথায় থাক, আর কী করছ, বিয়ে করেছ?’ কুমু বৌদি এক নিঃশ্বাসে এতগুলো প্রশ্ন করায় রমণীমোহন শুধুমাত্র দুটো প্রশ্নের উত্তর দিল।
‘চাকুরীর সুবাদ এই ম্যানসনের সাত তলায় ভাড়া থাকি। ’

‘ওহ! বেশ!’

এবার কুমু বৌদি তার গাড়ির কাছ থেকে বেশ একটু সরে এসে যা বলল রমণীমোহন তার মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারল না।

‘তোমার ছেলেটি কারের সামনের সিটে বসে আছে। তা, তুমি বিয়ে করেছ? ছেলেপেলে কি হয়েছে?’

‘তুমি কী আবোলতাবোল বলছ! আমার চার মাসের একমাত্র ছেলে এখন হয়ত উপরের সাত তলার ফ্লাটের আমার বাসায় তার মা অবন্তিকার কোলে শুয়ে স্তন পান করছে। আমার ছেলে তোমার কারে বসে থাকবে কেন?’

‘তাহলে তোমার অবন্তিকার চার মাসের একটা ছেলে আছে। প্রকৃতপক্ষে তোমার কিন্তু সব মিলে দুই ছেলে।’

‘দুই ছেলে?’

‘হ্যাঁ, তুমি আমাকে একটা সুদর্শন সন্তান উপহার দিয়েছ।’
তার কথাটা শুনে রমণীমোহন রোমাঞ্চিত হল।

‘ওইতো সে কারে বসে আছে, এখন ওর বয়স ন’বছর কয়েক মাস। ঠিক যেন তোমার মতো দেখতে। যা হোক তুমি আমার রক্ষাকর্তা। তোমার স্বর্গীয় দান আমার স্বামীর উপার্জিত অর্থকড়ি ও সহায় সম্মতির উত্তরাধিকার লাভে সক্ষম হয়েছে। তা নাইলে আমার স্বামীর সব সহায় সম্পদ তার ওয়ারিশরা লুটে পেটে খেত। তোমরা আমাদের ফ্লাটের সাত তলা আছ , আর আমরা আছি আট তলায়। ওই দুটো ফ্লাটই আমার স্বামীর।’ কুমু বৌদির কথা শুনে রমণীমোহন তো হতবাক।
কুমু বৌদি কারের কাছে এগিয়ে গিয়ে তার ছেলেকে বলল, ‘বাবা, কুনাল এদিকে শোন তো।’

হ্যাফ প্যান্ট পরা সুন্দর স্বাস্থ্য চেহারার নয় দশ বছরের ছেলেটি কার থেকে নেমে এলে কুমুবৌদি তার ছেলেকে বলল, ‘এই হচ্ছে তোমার সেই বাংলাদেশী মামা।’
মায়ের কথা শুনে সে রমণীমোহনকে নমস্কার জানালে সে তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কোন ক্লাসে পড়, বাবা।’

জবাবে ছোট্ট ছেলেটি বলল , ‘ ক্লাস ফোরে।’

‘আমরাও এই ম্যানসনের সাত তলার ফ্লাটে থাকি, আমাদের বাসায় বেড়াতে এস কিন্তু।’ রমণীমোহন কথাটা বলে ছেলেটির মুখের দিকে চাইল। ছেলেটি মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি কারে বসি আপনি মামার সাথে কথা বলে আসুন।’

‘তাই কর , বাবা, আমি এসে জিনিসপত্রগুলো হোল্ডার থেকে বের করছি।’

ক্ষণিকের মধ্যে রমণীমোহনের মনটা পেছনে ফিরে গেল । সে ভাবল, ‘নি:সন্দেহে আমার ছেলে পুরোপুরি আমার মত দেখতে, আমার ঔরসজাত সন্তান, আমার তখন আঠারে উনিশা বছর বয়স , আর মহিলাটি আমার চেয়ে পনেরো ষোল বছরের মত বড়। আমার অজান্তেই ছেলেটির জন্ম। গত নয় বছরে সে বেড়ে উঠেছে।’

‘আমাকে খারাপ মেয়েছেলে ভাবাটা তোমার পক্ষে অস্বাভাবিক নয়। বিয়ের পনেরো বছরের মধ্যে যে স্বামী আমাকে সন্তান দিতে পারল না তার উপর ভরসা করে কি তার অগাধ সম্পত্তি আর ব্যাংক ব্যালান্সকে রক্ষা করতে পারতাম?’ কমলিনী তাকে বলল।

রমণীমোহনের মুখ থেকে কোন কথা বের হল না। কুমু বৌদি বলল, ‘ তুমি আমাকে ঘুণাক্ষরেও বৌদি বলে ডাকবে না। দিদি বলে ডাকবে। দূর সম্পর্কের মাসতুতো দিদি বলে পরিচয় দেবে তুমি তোমার বৌয়ের কাছে , আর ফ্লাটের মালিক আমরা তোমার বৌকে বলার দরকার নেই। সাবধান , কেউ যেন জানতে না পারে আসল কথাটা। তা নইলে তোমার আর আমার দু’জনেরই সর্বনাশ হয়ে যাবে।’

‘ঠিক আছে দিদি ।’

‘আমি চাইনে তুমি এখনো আমার কাছে বাঘবন্দী হয়ে থাক। তুমি এখন তোমার বাসায় যাও, আমি একটু পরে উপরে যাব।’ রমণীমোহন কী যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার কোন কথা না শুনে সে সেখান থেকে প্রস্থান করল।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu