দাঁতে দাঁত পিষে তিনি বিনোদের সব কথা হজম করলেন, মুখে কিচ্ছুটি বললেন না, টুঁ শব্দটিও করলেন না। মনে মনে শুধু বললেন, ‘শালা রামছাগল, একটা সময় কতো নাকানিচুবানি তোরে খাওয়াইছি। আর আইজকা তুই জ্ঞানের জাহাজ চালাইলি আমার সামনে! আগের সেই দিন নাই রে আমার… থাকলে দেখতি কী খেইল দেখাই তোরে।’ সময়ে কতো কী-ই না দেখতে হয়- ভাবতে ভাবতে খুব নীরবে বিনোদ বাবুর কক্ষের বাইরে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালেন তিনি। হম্বিতম্বি আর চোখ রাঙানোর সময় তার চলে গেছে অনেক আগে।
বিনোদ বাবু আয়েশ করে একটা সিগারেট ধরালেন, ধোঁয়ার গোল কুণ্ডলীর ভেতর দিয়ে নির্বিকার দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে দেখলেন শরাফত মোল্লার চলে যাওয়া। আহা রে, বেচারা! বয়স সত্তর ছুঁইছুঁই, কিন্তু দেখলে মনে হয় অশীতিপর। এককালে এ অফিসের ডাকসাইটে কর্মকর্তা ছিলেন। ‘বস’ হিসেবে তাকে যতোটা না ভয় পেতো অধস্তনরা, তারও অধিক ভয় পেতো শরাফত সাহেবের তিরিক্ষি মেজাজ আর মানসিক নির্যাতনের বদঅভ্যাসকে। আরও একটা বদঅভ্যাস ছিল তার- ‘চোগলখুরি’। যার দোষ তাকে তেমন কিছুই বলতেন না; অথচ খগেনের বদনাম নগেনের কাছে, নগেনের দোষ বিনোদের কাছে না বললে তার পেটে গ্যাস জমে যেতো। অবশ্য বাইরের লোকদের সঙ্গে ব্যবহার ছিল অতি অমায়িক। তার সঙ্গে যে কেউ প্রথমবার গল্প করতে বসলে ভাববে- আহা হা, শরাফত সাহেবের মতো মানুষ হয় না। এমন নিবেদিতপ্রাণ অফিসার এদেশে বিরল। বোধহয় এই অফিসটা টিকে আছে শুধু শরাফত মোল্লা আছেন বলেই। তিনি ছাড়া তো অফিসের অন্যরা কেউ কোনো কাজ করেই না, হয়তো কাজকর্ম ঠিকমতো বোঝেও না। শরাফত সাহেবের রিটায়ারমেন্টের পরে হয় এই অফিসটা বন্ধ হয়ে যাবে অথবা কর্তৃপক্ষ শরাফত সাহেবকে হাতেপায়ে ধরে কাকুতি-মিনতি করবে- ‘আপনে আরো কয়দিন থাকেন, স্যার। আপনে গেলে গা অফিসটা বন্ধ হয়া যাইবো, আমরাও তো না খায়া মইরা যামু। আপনে যায়েন না গো, স্যার।’
সময় গড়িয়ে যায় বটে কিন্তু এসবের কোনোকিছুই ঘটে না। একদিন রোদ ঝলমলে সকালে অফিসের কনফারেন্স রুমে শরাফত সাহেবের চাকরি-শেষের বিদায় অনুষ্ঠান হয়। নানা অজুহাতে অনেকেই সেখানে যোগদান করে না। গুটিকয়েক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা দায়সারা বক্তব্য দেন, নিতান্ত অনিচ্ছায় শরাফত সাহেবের টুকটাক গুণবন্দনা করেন। যাবার বেলা শরাফত মোল্লার সঙ্গে যায় অফিস-কর্মীদের চাঁদার টাকায় কেনা কুরআন শরিফ, তসবি, জায়নামাজ, টুপি আর ফ্রেমে বাঁধানো একখানা মানপত্র।
সেই থেকে কদিন পরপরই শরাফত সাহেবকে দেখা যায় অফিস-আঙিনায়। বয়সের চেয়েও বয়স্ক, কপালে অযাচিত বলিরেখা, ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে নিয়ে এ টেবিল ও টেবিল সে টেবিলে ধর্ণা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। দাপ্তরিক দেনাপাওনার হিসাব নিষ্পত্তির জন্য। কেউ-ই পাত্তা দিচ্ছে না তেমন। সবাই অদ্ভুত কোনো চিড়িয়া দেখার মতো চোখ করে তাকায়, কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে ফ্ল্যাশব্যাকে যায়, মনে পড়ে অতীতের সেই শরাফত মোল্লাকে। অধিকাংশজনই এটা সেটা হাবিজাবি কথাবার্তা বলে। আজ হবে না, অমুক স্যার নাই- উনার সাইন লাগবে, রোববার সকালে আসেন। কেউ দাপ্তরিক কাজের ব্যস্ততা দেখায়, সন্তর্পণে এড়িয়ে যায়। অতি সজ্জনদের কেউ কেউ মন চাইলে সালাম-আদাব দেয়, কুশল জানতে চায়, চা খাবেন কি না জিজ্ঞেস করে।
যুগের অধিক সময় বয়ে গেছে। স্থানে স্থানে এসেছে নানা পরিবর্তন। বিবর্তনের হাওয়া লেগেছে মানুষের মনেও- ভাবেন শরাফত। চোখের কোণ বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ার আগেই তা মুছে ফেলেন। সিঁড়ি বেয়ে নামবার কালে নড়বড়ে শরীরটা আরো একবার দুলে ওঠে। পড়ে যেতে যেতে কোনোরকমে তাল সামলে সোজা হয়ে দাঁড়ান শরাফত মোল্লা। মাথাটা বড্ড ভোঁ ভোঁ করছে। খুলির ভেতরটা যেন এক অদ্ভুত অডিও প্লেয়ার। বিনোদ বাবুর শেষ কথাগুলো বারবার রিওয়াইন্ড হয়ে বেজেই চলেছে সে ক্যাসেট প্লেয়ারে।
‘আজ কটা বছর ধরে ঘুরছি, বিনোদ বাবু। ঘুরছি আর ঘুরছি। বৃদ্ধ মানুষ আমি, দেহমনে জরা এসেছে। আর তো পারি না। কী করবো, বলতে পারেন, বাবু?’
এইটুকু শোনার পর একটু নীরস হাসলেন বিনোদ বাবু। তারপর একটানা বলে চললেন-
‘স্যার, বসেন; চা-কফি যা-ই মন চায় খেতে পারেন। আর দয়া করে আমার কয়টা কথা মন দিয়ে শোনেন। আপনি মুরুব্বি মানুষ, কী আর বলবো আপনাকে! এককালে আপনি এই অফিসের ‘জাঁদরেল বস’ ছিলেন। দিনের পর দিন আপনি কারণে-অকারণে অধস্তনদের যেভাবে নিংড়েছেন, একেকজন আড়ালে-আবডালে চোখের জল পর্যন্ত ফেলেছে। কাকে আপনি শান্তিতে চাকরি করতে দিয়েছেন, বলতে পারেন, স্যার? আপনার ভয়ে তটস্থ থাকতো সবাই। অন্যদের কথা ছাড়ুন, এই আমার কথাই ধরুন। কতো রাত যে আপনাকে স্বপ্নে দেখে আতঙ্ক নিয়ে ঘুম ভেঙেছে- চিন্তাই করতে পারবেন না। আমার যখন নতুন চাকরি- এক সকালে পনেরো পাতার একটা শিট কম্পোজ করতে দিয়ে বললেন- এমডি স্যারের জরুরি কাজ, দ্রুত করতে হবে, এখনই লাগবে। পাগলের মতো কাজটা শেষ করে প্রিন্ট কপি দিলাম আপনার ডেস্কে। দিন দশেক পর আবিষ্কার করলাম- ওগুলো আসলে বাতিল কাগজ ছিলো। ওয়েস্ট বিন থেকে তুলে আমাকে দিয়েছিলেন আপনি। মুহূর্তেই আপনার প্রতি শ্রদ্ধাবোধটুকু কর্পূরের মতো উড়ে গিয়েছিলো সেদিন। এরকম আরো আরো কতো যে দুঃস্মৃতি আপনাকে নিয়ে! বিশ্বাস করেন, স্যার! তবু কিছু মনে রাখিনি আমি, মনে মনে বারবার ক্ষমা করেছি আপনাকে। কিন্তু, স্যার! জীবন-বাস্তবতা বড়ো কঠিন। জগতে কোনোকিছুই চিরস্থায়ী নয়। না পদ-পদবি, না ক্ষমতা, না আমরা। আসলে আপনি বিগত দিনে যে বীজ বুনেছেন, যে চাষাবাদ করেছেন- তারই ফসল আজ ফলেছে, স্যার। আপনার এখন ফসল তোলার সময় এসেছে। দেনাপাওনার হিসাব কি শুধু টাকাকড়ি দিয়ে হয় নাকি, স্যার! সব দেনাপাওনারই হিসাব নিষ্পত্তি করতে হয় এক জীবনে। যাই হোক, অনুগ্রহপূর্বক আপনি এবার আসুন, স্যার। আমার জরুরি কাজ পড়ে আছে। ভালো থাকবেন।’
খুব নীরবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পরবর্তী সিঁড়িটির দিকে পা বাড়ান শরাফত মোল্লা। হম্বিতম্বি আর চোখ রাঙানোর সময় তার চলে গেছে। বপন, রোপণ আর চাষবাসের মৌসুম পেরিয়ে এখন তার ফসল তোলার মৌসুম।