জুয়েল মিয়াজি

প্রেমিকা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

ঐ যে ঐ দিন বৃষ্টিস্নাত বিকেল বেলায়! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে যেদিন চুমো কেলেঙ্কারি হয়েছিল ঘটনাটি সেদিনেরই। রিমঝিম বৃষ্টি বিড়ম্বনায় সময় কাটানোর জন্য আমরা তখন আশিক ভাইয়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম আর কিছু গল্প করছিলাম। আমরা মানে আমি, সালমান, রমিজ আর তানহা। তানহাই প্রথম দেখেছিল। তানহার একটা বাজে স্বভাব আছে। সবাই যখন গল্পগুজবে ব্যস্ত থাকে তখনো সে আনমনে মোবাইল টেপে। মাঝেমাঝে আমাদের বন্ধুদের মধ্যে তর্কবিতর্ক যখন চরমে পৌঁছে তখন নিজের পক্ষে লোকবল বাড়ানোর জন্য আমরা যদি আলাদা আলাদা ভাবে তার কাছে সমর্থন চাই। তানহা তখন অনেকক্ষণ ধরে মোবাইল স্ক্রিনের দিকে নত হয়ে থাকা মাথাটা উপরে তুলে হাবলাদের মত বলে, কি…ই। আমাদের তখন রাগের সীমা থাকে না। যেন গালিগালাজ না করলে হার্ট অ্যাটাক করে মরবে সবাই। কিন্তু তানহার বাজে স্বভাব। গালিগালাজেও যখন শোধরানো গেল না তখন পরাজয় বরণ করে ক্ষোভবশত তাকে নিয়ে আমাদের কমন ডায়লগ হলো ‘শালা মুড়ি ভেজে খা’। অবশ্য তানহা মুড়ি খেতেই বেশ পছন্দ করে। আমরা খাচ্ছিলাম গরুর খাঁটি দুধের চা। চা তানহা খায় না। মুড়ির সাথে পিয়াঁজ মেখে খেতে খেতে সে ফোন টিপতেছিল। আমাদের মধ্যে কথা হচ্ছিল  সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সে মেয়েটাকে নিয়ে। পুরো ক্যাস্পাসের ক্রাশ অথবা আতঙ্কক, অথবা আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র ফাহাদ ভাইয়ের ভাষায় গজব! ফাহাদ ভাই বলে, তোমরা যেটাকে ক্রাশ বলো, আজ থেকে হাজার বছর আগে নবীরা এটাকে চোখের যেনা বলে গেছেন। আমরা ভাইয়ের কথায় মাথা নাড়িয়ে সাড়া দেই। বলি, হ্যা ভাই, কাল থেকে আমরা ভালো হয়ে যাব। কিন্তু সে কাল আর কখনো আসে না। আমাদের আলেমে জালেমে মিলিয়ে অবিরাম বৃষ্টিধারার মতো কথোপকথন চলতেই থাকলো। বেশ মনোযোগ দিয়ে কোনো শিল্পীর যেন একটা নতুন গানের অ্যালবাম নিয়ে কথা বলতেছিল রমিজ। রমিজের কথা হলো সে যাই বলুক না কেন তা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে সকলের এবং তাকে সমর্থন জানাতে হবে। আমি, সালমান তাই করছিলাম।

হঠাৎ তানহা এই ‘দেখ! দেখ!’ বলে চিৎকার চেঁচামেচি করে উঠলে মনোযোগ আমাদের অন্য দিকে চলে যায়। কী অপূর্ব দৃশ্য! এর আগে কখনো যেনো আর দেখিনি। তীব্র রোদে শুকিয়ে যাওয়া ফসলী জমিতে বৃষ্টির ফোঁটা পড়লে মাটি যেমন উর্বর হয়ে যায় তেমনি উর্বর হয়ে উঠলো আমাদের হৃদয়। বুক কাঁপতে লাগলো। বেদনায় নাকি আনন্দে বুঝতে পারিনি। আমি তানহার দিকে তাকিয়ে দেখি সেও আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সালমান রমিজ বারবার ছবিটা জুম করে দেখতেছিল। এত সুন্দর করে মানুষ চুমু খায় কিভাবে? আমি ভাবতেছিলাম ভাঙা হৃদয়, যে হৃদয় কখনো প্রেমিকার প্রেমের স্বাদ পায়নি, সেখানে আজ এতো প্রেম এলো কোথা থেকে!

সুমির কথা মনে পড়ে গেলো। ক্লাস সিক্সে সুমি অন্য স্কুল থেকে এসে আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। কমবয়সী মনে এটা ভালোলাগা নাকি ভালোবাসা ছিল প্রথমে বুঝতে পারিনি। সুমিকে দেখলেই মুখে কথা আটকে যেতো আর খুব শরম করতো। এতে করে পরে আর সুমিকে কখনো প্রেমের কথা বলা হয়ে উঠেনি, একটা আশঙ্কা কাজ করতো। সুমি কখনো আমাকে ভালোবাসবে না। তার জন্য তার উপযোগী একটা সুন্দর বালক প্রয়োজন যে বালক এই বালিকার প্রেমসাগরে অবাধ বিচরণ করবে। তাই সুমিকে ভুলতে বসেছিলাম! পরে হঠাৎ ইন্টারমিডিয়েটে পড়াকালীন এক কাছের বন্ধুর সাথে যেদিন সুমির বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, সেদিন ভালোবাসা ঈর্ষায় রূপ নিল। সে ঈর্ষা আজও কাটেনি। অভিমানও হতো! খুব সুদর্শন হলে অভিমান করে বলতাম, হায় বিধাতা! সে থেকে প্রেমিক-প্রেমিকা দেখলে ভীষণ জেদ হয়। গালিগালাজ করলেই যেন পৈশাচিক আনন্দ মেলে। আমরা খুব করে বকে দিয়েছিলাম ওদেরকে। ছি! ছি! দেশটা রসাতলে গেলো। আরো কত কিছু যে দেখবো জীবনে, বুঝলি রমিজ? পৃথিবীতে আরো অনেক কিছু এখনো দেখার বাকি আছে! রমিজ বুড়ো মানুষের মতো সজোরে নিঃশ্বাস ফেলে সায় দেয়, ঠিক বলছস, দোস্ত। পৃথিবীটা আর আগের মতো নেই, নাফরমানি আর বেহায়াপনায় ভরে গেছে পৃথিবী। সব শালারা লুচ্চা বদমাশ! বাপ-মা কষ্ট করে পড়াশোনা করার জন্য টাকা পাঠায় আর এরা পড়াশোনা বাদ দিয়ে বদমায়েশি করে বেড়ায়। ছি! ছি! আমাদের একটা নির্দিষ্ট কালচার আছে তো। সালমান কালচারের সংজ্ঞা-উদাহরণ টেনে চুমো কেলেংকারিতে জড়িত প্রেমিক প্রেমিকাকে শাসাচ্ছিল। তার মুখভঙ্গি এমন ছিল যেন তাদের চোখের সামনে পেলে কালচার হত্যার দায়ে জ্যান্ত কবর দিয়ে ফেলতো।

সবার রক্ত গরম হয়ে যাচ্ছিল, তাই একের পর যুক্তিতর্ক দিয়ে সবাই প্রেমিক প্রেমিকার অশুভ কামনা করছিল। ওদিকে বৃষ্টি তখনো থামেনি। আশিক ভাইয়ের চায়ের দোকানের টিনের চালের শ্রুতিমধুর আওয়াজ যেন আমাদের বুকের হাহাকারটা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিল। সে হাহাকার, অভিমান যখন ক্ষোভে পরিণত হয়, তখন আমাদের কালচারের জন্য এতই ভালোবাসা জন্মেছিল যে, যদি তখন আমাদের সামনে কেউ বহুদিনের বাঙালি সংস্কৃতিতে মিশে যাওয়া ভাত না খেয়ে পোলাও খেতো তাহলে এক কোপে তার মাথাটা কেটে ফেলতে দ্বিধাবোধ করতাম না আমরা। রাগ কমানোর  জন্য তানহার মতো রমিজ-সালমান ডাটা অন করে নিজ ওয়ালে স্ট্যাটাস দিতে লাগলো। শতশত চুমো বিষয়ক স্ট্যাটাসে ওয়াল ভরে যায়, আমাদেরসহ অনেকের।  বিরক্ত হয়ে ফেসবুক অফ করে মেসের দিকে রওনা হলাম সকলে। কিন্তু মোস্তফা ভাইয়ের দোকান পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একনম্বর গেট সংলগ্ন ছাত্রী হলের পাশে আসলে আমাদের মন আবারো আন্দোলিত হতে লাগলো চরম সুখে অথবা চরম বেদনায়। কেউ মশকরা করছে হয়তো আর নয়তো সিরিয়াস! না না আমার মনে হয় কোন বদমাশ পোলা এটা করেছে, রমিজের মুখের কথা টেনে নিয়ে তানহা অন্য দিকে  যুক্তি দেখায়। সালমান মাথা নাড়ায় চারদিকে, ‘হা’ বলেছে নাকি ‘না’ বলেছে এটা বুঝার আগে আমি তানহার শরীরে হাত রেখে দ্রুত ছাত্রী হলের দেয়ালে লেখা বিজ্ঞপ্তিটি পড়তে লাগলাম হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিতে।

(প্রেমিকা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি!)

আমাদের সিঙ্গেল দুই বন্ধুর জন্য একজন গুণবতী, রূপবতী মেয়ে দরকার। শিক্ষাগত যোগ্যতা : অনার্স পড়ুয়া হতে হবে। বেতন: বিয়ে করার আগে কোনো রকম বেতনভাতা দেওয়া হবে না। তবে প্রকাশ থাকে যে, মনের মিলন হলে সকল স্বার্থক প্রেমের মতো বিবাহ পরবর্তী পাত্রীর আমরণ সকল ভরণপোষণ চালাব। সুতরাং প্রেমিকা হতে চাইলে যোগাযোগ করুন।

হ্যালো: ০১xxxxxxx

বিজ্ঞপ্তিটি পড়া শেষ হলো বলতেই। একে অপরের মুখ দেখাদেখি হাসির প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেলো। তানহাই যেন সবচেয়ে ভালো প্রতিযোগী, সবকিছুতেই তার দুষ্টু বুদ্ধি আগে খেলে। মার্কার কলম দিয়ে তানহা দেয়ালের বিজ্ঞপ্তিতে দেওয়া নাম্বারের পাশে নিজের নাম্বার বসিয়ে দিল, তারপর তার দেখাদেখি রমিজ। রমিজের পর সালমানও তার মুঠোফোন নাম্বারটি বিজ্ঞপ্তির শেষ লাইনে বসিয়ে দিল। শেষমেশ আমিও নিজেকে অসামাজিক বলে পরিচয় দিলাম না।

এরপর মেসের দিকে রওনা হলাম। সেদিন ক্যাম্পাস থেকে মেসে ফেরার পথটা যেন শেষই হচ্ছিল না। নানানরকম জীবন দর্শন নিয়ে কথা হচ্ছিল। দেখতে দেখতে আমাদের বয়স অনেক হয়ে গেছে। রমিজ, পড়াশোনা করতে হবে প্রচুর। তানহা ভাঙা গলায় দুঃখ ভাগ করে, আব্বার দিকে নজর দেওয়া যায় না। কবে না জানি মরে যায়। আব্বা মনে হয় আমার চাকরি-বাকরি হওয়ার আগেই মরে যাবে। সালমানের হঠাৎ ভাইয়ের কথা মনে পড়ে, বড় ভাই কষ্ট করে টাকা পাঠাচ্ছে। তার প্রতিদান কিভাবে দেওয়া যাবে? আর কতকাল? না এসব প্রেমটেম করা আমাদের শোভা পায় না। প্রেম ভালোবাসা ভালো না। বুঝলা বন্ধুরা? বন্ধুরা মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। হা, সত্যিই প্রেম খুব খারাপ জিনিস। এর ফাঁদে না পড়াই ভালো। সময় এখন নিজের পায়ে নিজে দাড়াবার। এভাবে হাজারো চিন্তা মাথায় নিয়ে সেদিন রাতে খাওয়া দাওয়া না করেই ঘুমোতে গেলাম আমরা। অনেকক্ষণ ধরে টিএসসির ছবিটার কথা ভাবতে ভাবতে চোখে ঘুম ধরলো। ঘুমের মাঝে একটা বাজে স্বপ্ন; খুব নিষ্ঠুর, স্বার্থপর সে স্বপ্ন। যে স্বপ্ন অতীতকে ভুলিয়ে দিয়ে নিজের ক্যারিয়ার গঠন চিন্তা বাদ দিয়ে শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবতে শেখায়। জীবন সম্পর্কে  সিরিয়াস  সব চিন্তা ভাবনা থেকে মন উঠে গিয়ে, টিএসসির সে ছেলেটির জায়গায় নিজেকে আর মেয়েটির জায়গায় প্রথম ভালো লাগা কোন যুবতীকে কল্পনা করে ঘুমের মধ্যে দেহ মন শিহরিত হয়ে উঠে। ভালো সরকারী জব করার স্বপ্ন দেখা মনটি চরম অসিরিয়াস হয়ে নিজেকে অন্য এক জগতে নিয়ে যায়। সেখানে প্রেম আছে কাম আছে। সে রাজ্যের হাজারো প্রেমিক-প্রেমিকা সব বাদ দিয়ে শুধু সারাদিন ঠোঁটে ঠোঁট রেখে চুমু খায়।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu