দু ঘন্টা ধরে অঝোরে বৃষ্টি হয়েই চলেছে। রবীনবাবু ঘড়ির দিকে তাকাতে প্রমিলা বলল, তুমি এত চিন্তা কর না তো! যাও খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়।
কী করে ঘুমব? রাত ১০টা বাজতে চলল বাড়ির মেয়ে এখন ও ঘরে ঢুকল না, আজকাল যা অবস্থা রাস্তাঘাটের, তার ওপর আবার বৃষ্টি থামবারই নাম ধরে না, রবীনবাবু কথাগুলো বলতে বলতে দরজা দিকে এগিয়ে গেলেন।
বলছি তো এসে পড়বে, ও আমাকে যাওয়ার সময় বলে বেরিয়েছিল কলেজ শেষ করে তার বন্ধুর বাড়ি যাবে তারপর ফিরবে, তাই ফিরতে হয়ত একটু দেরি হতে পারে।
প্রমিলার কথা শেষ না হতেই উত্তেজিতভাবে রবীনবাবু বলল, দেরি হবে তা নয় ঠিক আছে, তা বলে এত দেরি। এই তো প্রিয়া এসে পড়েছে, শান্তি! চলো খেতে দাও এবার।
যতই রাগ জমাট বাঁধুক না কেন মেয়ের মুখ দেখা মাত্রই রবীনবাবু গলে যান, মেয়েকে কথা শোনানোর মত অত শক্ত বুক উনার নয়। প্রিয়াকে তিন খুব ভালোবাসেন। কিছু না বলেই নিজের ঘরে ঢুকে যায় প্রিয়া।
প্রমিলা খাবার বেড়ে প্রিয়াকে ডাক দেয়। আজ বৃষ্টি হচ্ছিল, তোর বাবা বলল খিচুড়ি আর বেগুন ভাজা করতে। তুইও খেতে ভালোবাসিস তাই বানিয়েছি, তাড়াতাড়ি চলে আয় খেতে। ভেতর থেকে উত্তর আসে, তোমরা খেয়ে নাও আমি খেয়ে এসছি। কী জ্বালাতন রান্না করে সন্ধ্যে থেকে বসে আছি, মহারানী আমার বাইরে থেকে খেয়ে এসছেন। খাবে না সেটা তো আগে বললেই হয় তাহলে শুধু শুধু এত রান্না করতাম না। আরে বাবা মেয়ে খাবে না তো কী হয়েছে এই দেখো আমি খাচ্ছি, এই বলে বেগুন ভাজাটা হাঁসি মুখে দাঁত দিয়ে কামড়ে নিলেন রবীনবাবু। স্বামীর মুখে দেখে প্রমিলার মুখে মুচকি হাসি উঁকি দেয়।
রাত ক্রমেই বেড়ে চলেছে কিছুতেই প্রিয়ার দুচোখে ঘুম আসতে চাইছে না। হয়ত সে তার মনটাকে স্থির করতে পারছে না। বিছানা ছেড়ে উঠে বাথরুমে গেলো। ফিরে এসে একটা গল্পের বই নিয়ে শুয়ে পড়তে লাগল।পাশ ফিরে বই পড়তে পড়তে তার দুচোখে হালকা ঘুম নেমে এসেছে।
হঠাৎ একটা অট্টহাসির শব্দে গোট ঘরটা যেন তোলপাড় করছে। চোখ খুলতেই সে চমকে উঠল, দেখে ঠিক একই রকম দেখতে একটি মেয়ে তার উল্টো দিকে শুয়ে আছে হুবহু যেন আর একটি প্রিয়া। হাসতে হাসতে সে বলল– কী প্রিয়া ঘুম ভেঙে গেল, না ঘুমতে পারছো না?
– মানে?
– হুম, মানে? প্রিয়া মানে-টা তো বড় কঠিন, তা এখন সেরকম কোন ভয় লাগছে না তো?
– ভয়! কীসের ভয়?
– এত ন্যাকা সাজিস না তো, আরে তুই যে পাপটা করে এলি।
– পাপ? আমি? আমি কোন পাপ করিনি।
– পাপ করিসনি বলছিস, তাহলে ব্যারাকপুরে গেছিলি কেনো?
– ব্যারাকপুরে! ও আমি তো তিয়াশার বাড়ি গেছিলাম।
– তিয়াশার বাড়ি গেছিলি, তা কী জন্য?
– কলেজের বন্ধু মানে অনেকদিন দেখা হয়নি তাই।
– হা হা হা তুই আমাকে লুকচ্ছিস প্রিয়া, আমি বলছি শোন তুই তিয়াশার কাছে যাসনি, তুই তিয়াশার স্বামীর কাছে গেছিলি।
– স্বামী! আমি কেনো যাব ওর স্বামীর কাছে?
– কেনো যাবি, ওই পাপ কাজটা করার জন্যে।
– কেনো একই কথা বারবার বলছিস? বলছি তো আমি কোন পাপ করিনি।
– আচ্ছা ঠিক আছে, মেনে নিলাম তুই কোন পাপ করিসনি। কিন্তু তিয়াশার স্বামীর কাছে গেছিলি তো?
– হ্যাঁ গেছিলাম, তাছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না।
– কিছু করার ছিল না প্রিয়া, সত্যি করে বলত চেষ্টা করলে কী তোরা পারতিস না?
– কী করতাম বল, বিয়ে যে করে নেব সে উপায় নেই, কী বলব বাড়িতে? অভীক এখনো বেকার। সেদিনের একটা ভুলের জন্য। আর যদিও বা আমি অভীককে বিয়ে করে নিই তাহলে কী সব ঠিক করে দিতে পারতাম? দুজনে কেউই আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারিনি। তারপর একটা বাচ্চাকে জন্ম দিয়ে ওর ভবিষ্যৎ কীভাবে সুনিশ্চিত করতে পারতাম, তাই…
– তাই তিয়াশার স্বামী ড: সুধীরের কাছে গিয়ে বাচ্চাটাকে নষ্ট করে এলি।
– তাহলে আর কী করতাম, জন্ম দিয়ে আর পাঁচটা লোকের মতো রাস্তার জঞ্জালে ছুঁড়ে ফেলে দিতাম যাতে কুকুর, বিড়াল ছিঁড়ে খায়, তা না হলে কোন অনাথ আশ্রমে বড় হওয়ার জন্য ছেড়ে দিতাম, তারপর সে হারিয়ে যেত কোন অন্ধকার চোরা রাস্তায়, চাই না এইরকম যন্ত্রনার জীবন তার থেকে আমি তাকে এ স্বার্থপর পৃথিবীর আলো দেখার আগেই মেরে ফেললাম।
বালিশের পাশে রাখা মোবাইল ফোনটা বেজে উঠে। চোখ খুলে ফোনটা ধরতেই ফোনের ওপাশ থেকে অভীকের গলায় ভেসে আসে, গুড মর্নিং সুইটহার্ট! সকাল হয়ে গেছে, উঠে পড়ো।