তুই ছেড়ে দিলি কেন? কেন দিলি বল! আরে এ শহরে আমরা এখন রাজনীতি করি। আমরা লিডার। আমাদের এক ডাকে সারা শহর জুড়ে হাজার নেতা বের হয়ে রাজপথ দখল করবে। আর তুই কিনা তাকে কিছু না বলেই ছেড়ে দিলি। ও, আমার শক্তি নিয়ে সন্দেহ আছে তোর! শাওন বেশ ক্ষুদ্ধ হয়ে কথাগুলো এক ভাবে বলে যাচ্ছে। রেগে রেগে কথাগুলো বললেও আবিদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। মোহাম্মদপুরের বাসস্ট্যান্ড এলাকা দিয়ে কিছুদূর এগিয়ে যাবার পর হঠাৎ করেই আবিদ বলে বসলো, শাওন-একটু চুপ থাক। এতটা বিনয়ের সুরে বললো যে, বেলুন থেকে বাতাস বের হয়ে গেলে যেমন দেখাই শাওন সেরকমই চুপসে গেল। এতটা রেগে থাকা মানুষকে সহজে ঠান্ডা করা যায় না! অথচ আবিদের এক কথায় শাওন নিজের চুলের মধ্যে হাত চালাচালি করছে। দু’জন পাশাপাশি হাঁটছে। পাশ দিয়ে দূর পাল্লার বাসগুলো যাত্রী তুলে নিয়ে ছুটে যাচ্ছে। হৈচৈ আর ক্রিং ক্রিং শব্দে মুখিয়ে আছে। সব কিছুতেই একটা আওয়াজ হলেও আবিদ এবং শাওনের মুখে কোন আওয়াজ নেই। কারো সাথে কথা নেই। চুপ চাপ পথ চলছে দু’জন। হাঁটতে হাঁটতে একটি রেস্টুরেন্টে বসে পড়ে দুই জন।
শাওন– রেষ্টুরেন্টে বসে পঁচা চা খাওয়াবি আর এক গাদা জ্ঞান দিবি। তোর কোনো জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। জীবনে হারতে শিখিনি, এই তোর জন্য, তোর জন্য…।
আবিদ– বস, চা না হলে, অন্য কিছু খাবি। যতটা বিরক্ত প্রকাশ করা যায় ততটায় বিরক্ত প্রকাশ করে বসে পরলো শাওন।
শাওন– বসলাম কিন্তু জ্ঞান দিবি না।
আবিদ দুটো চা দিতে বলে চুপ থাকে। চা খাওয়া শেষে। আবিদ শাওনকে নিয়ে রিক্সায় উঠে। মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডে শাওনকে নামিয়ে দিয়ে, আবিদ শ্যামলীতে চলে যায়।
রিক্সায় যেতে যেতে আবিদ মোবাইল ফোনে শাওনকে বলে, রাগ করিস না, আমি নিজেই ব্যবস্থা নিব। শাওন কথা বলে না, কয়েক বার হ্যালো বলে চুপ থাকে আবিদ। এক মিনিট পর শাওন ওপাশ থেকে বলে ওঠে, যা ভাল মনে করিস কর, আমার কি?
বিষয়টি এ পর্যন্ত থেমে নেই। মোহাম্মদপুরের ঘটনাগুলো ফোনে ফোনে শাওনের গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধা পর্যন্ত পৌঁছেছে। শাওন নানাভাবে বুঝিয়ে বলার পরেও মা-বাবার চিন্তা কমেনি বরং বেড়েছে। মা-বাবাকে বোঝানোর পর রোহিতার ফোন। রোহিতা ও শাওন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ করছে। ফাস্ট সেমিস্টার থেকে লাস্ট সেমিস্টারে এসেও তাদের মধ্যে কখনো ভুল বোঝাবুঝি হয় নি। একে অপরের সাথে সমঝোতার বিষয়টি অন্যরকম। এই সমঝোতা দিয়ে তারা অনেকটা পথ এগিয়ে গেছে। তাদের মধ্যেকার সম্পর্ক এতটায় এগিয়েছে যে, আর কোনোভাবেই পিছিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বিবিএ-টা শেষ হলে অন্য কিছু ভাববে রোহিতা। তাদের একটা ছোট্ট ঘরের ডিজাইন মনে মনে এঁকে রেখেছে। কিচেন এর রঙ-টা পর্যন্ত এঁকে রেখেছে। মাঝে মাঝে সে এই স্বপ্নের কথাগুলো শাওনকে বলতো।
শাওনের এসবের চেয়ে রাজনীতির কথাগুলো বেশি পছন্দ হতো। দেশটাকে সে ভিন্নভাবে সাজাতে চায়। রোহিতার স্বপ্ন যেমন ছোট্ট ঘরে নানা রঙ আর তাতে দুইজনের স্বপ্নপূরণ গল্প থাকবে। ঠিক তেমনি শাওনের স্বপ্ন রাজনীতি করে দেশের ছাত্রদের সুশিক্ষা করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখা। বেকারত্ব দূর করে সুন্দর দেশ গড়ার কাজে নিজেদেরকে মনোনিবেশ করা। একটি রাষ্ট্রকে আরো গতিশীল করা। অর্থনীতি, মুক্তমত প্রকাশ করার অধিকারকে আরো দৃঢ় করা। এমন সব স্বপ্ন শাওনের বুকে দীর্ঘদিন ধরেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্বপ্ন যেখানে বাসা বাঁধে সেখানে স্বপ্ন পূরণ ছাড়া অন্য কোনো কথা শুনতে নেই। রোহিতাও কথাগুলো শুনলো না। রোহিতা কিছুই বুঝতে চায় না, শুধু বলেছে কোনো অঘটন হলে তার কি হবে।
শাওন মা-বাবাকে বোঝাতে পারলেও রোহিতাকে বোঝানো সম্ভব হয়নি। রোহিতার কণ্ঠে কান্নার একটা ঢেউ ছিল। শাওন সেটি বুঝতে পেরেছে। রোহিতাকে সে কোনভাবেই ছাড়তে পারবে না। গত চার বছরে তাদের এমন কোনো কথা নেই যা দুই জন জানে না। রোহিতা বারবার ফোন রাখার কথা বললেও ফোন রাখছে না। শুধু বলছে তুমি রাজনীতির জন্য এমন কোন ঝামেলায় জড়াবে না যাতে তোমাকে …। এর বেশি কথা বলতে পারে না রোহিতা। কথাটার এখানে এসে থেমে যায়। আর কেঁদে যাচ্ছে। তুমি রাজনীতি ছেড়ে দাও। তোমার কোনো কিছুই আমার দরকার নেই। শুধু তোমাকে দরকার। শাওন তার স্বপ্নকে বলি দিতে পারছে না। রোহিতা যে স্বপ্ন এঁকেছে, সে স্বপ্ন পূরণ করতে চায়। অথচ শাওন তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারছে না।
এ দেশকে সে আরো সুন্দর করে সাজাতে চায়। এ দেশ হবে যুবকদের সাজানো গোছানো একটি আধুনিক দেশ। জীবনের মাত্র একটি ঘটনা, অনেকগুলো স্বপ্ন থেকে পিছিয়ে দেবে এটা ভাবতেও পারছে না শাওন। শাওন জানে যারা মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ধারালো অস্ত্র নিয়ে ধাওয়া করেছিল, তারা দেশের ভাল চায় না। তারা দেশের জন্য ক্ষতিকর। তারা সমাজের জন্য ক্ষতিকর। তাদের তো রুখে দিতে হবে। যারা অমঙ্গলকর তাদের রুখে দিতে হয়। কাউকে না কাউকে রুখে দাঁড়াতে হয়। শাওন এসব বোঝে কিন্তু, রোহিতা বুঝতে পারছে না। রোহিতা শুধু নিজের জন্য ভাবছে। নিজেকে নিয়ে ভাবছে। রোহিতার কান্নার শব্দ শুনতে পারছে শাওন। শাওন একবার বললো, তুমি কিছু ভেবো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। রোহিতা কিছু বলে না, ফোনের লাইনটা কেটে গেল। আবারো কল দিতে গিয়ে রোহিতার ফোন বন্ধ পেল শাওন। বেশ কয়েকবার ডায়াল করলেও কল যাচ্ছে না। শাওন আবিদকে ফোন দিয়ে রোহিতার কথাগুলো বলে দিল। আবিদও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আবিদ শাওনকে বলে দিল রাত ১২ টা হতে চললো, ঘুমিয়ে যা। সকালে দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। আবিদের কথায় মানসিক শান্তি পেল না শাওন। রোহিতার কথা তার বারবার মনে হচ্ছিল। তার মায়াবি মুখ শাওনকে ভিন্ন কিছু ভাবাচ্ছে। রোহিতার রুমমেটকে ফোন দিয়ে পাওয়া গেল না। এবার শাওন নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারছে না। রোহিতাকে খুব কাছে পাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে তার। কাছে নিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, এসো পূর্ণিমা রাতে পাশাপাশি বসে জোস্নায় ভিজি। পৃথিবীর সমস্ত কালো মুছে যাক নতুন আলো উদিত হোক। তোমাকে ছাড়া ভিন্ন কিছু ভাবছি না।
রাত বাড়লো। কিন্তু রোহিতাকে ফোনে আর পাওয়া গেল না। হলো টা কি? ফোনে চার্জ নেই, ফোন নস্ট হলো, নাকি নেটওয়ার্ক নেই। এসব নানা কিছু ভাবালেও শাওন নিজেকে একা ভাবতে লাগলো। খুব করে রোহিতার হাত ধরতে ইচ্ছে হচ্ছে। কি করবে উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। উপায় না পেয়ে রোহিতার সেই ছাত্রী হোস্টেলের দিকে রওনা হলো শাওন। বেশি দূরত্ব নয়। এক কিলোমিটার হবে। শাওনের ইচ্ছে সেখানে গিয়ে নৈশ্য প্রহরীর মাধ্যমে রোহিতার খবর নেবে। রাস্তায় বেরিয়ে পড়ার পর সে দেখলো দিনের ঢাকা আর রাতের ঢাকার পার্থক্য। লোকজন নেই। মাঝে মাঝে কয়েকটা গাড়ি ইট পাথরের পথ ধরে দ্রুত গতিতে ছুটে যাচ্ছে। সিগন্যাল বাতি মানছে না কেউ। এই পথগুলোই মানুষকে আলোর পথ দেখায়। আবার ভুল হলে এই পথেই মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে কত চেনা অচেনা মুখ। পায়ে পায়ে পথ এগিয়ে যাচ্ছে শাওন। চিন্তিত শাওন ফোন হাতে নিয়ে রোহিতাকে কল করতে বরতে রাস্তা পার হতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে ফেললো শাওন। একটা গাড়ীর সাথে ধাক্কা লেগে রাস্তার পাশে ছিটকে পড়লো। রাস্তার পাশের ফুটপাতের উপর মাথায় আঘাত লেগে রক্ত বের হলো। শাওন একবার উঠে দাঁড়াবার চেস্টা করেও পারলো না। সে পড়ে গেল। মাথার ঠিক পিছনে আঘাত লেগেছে শাওনের। বেশ রক্ত বের হচ্ছে। সেখানেই পরে থাকলো। কেউ ঘটনাটি দেখেনি। ধাক্কা দেওয়া গাড়িটি পালিয়ে গেছে। পথের পাশে শাওন পড়ে ছিল রক্ত মাখা দেহ নিয়ে। রোহিতা বারবার মোবাইলে কল করেও শাওনের কোন খোঁজ পাচ্ছে না।
খুব ভোরে আবিদের কাছে ফোন এলো, আবিদ ফোনটা রিসিভ করেই কান্নার শব্দ পেল। শাওনের লাশ পাওয়া গেছে। কিভাবে কি হলো কেউ কিছুই বলতে পারছে না। কারা বা কি ঘটনা তা নিয়ে তদন্ত করছে পুলিশ। যারা শাওনকে ধাওয়া করেছিল তারা নাকি পুলিশের কারণে এলাকা ছেড়েছে। আবিদের হাত থেকে মোবাইল ফোনটা পড়ে গেল। আর কিছু জানা গেল না।