ফরিদা ইয়াসমিন সুমি

নেককার

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

লায়লার মাকে ঘিরে ছোটোখাটো একটা জটলা ছিল। ক্রমেই সেটা বড় হচ্ছে। কেননা বিষয়বস্তু খুবই আকর্ষণীয়। মহানবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ)-কে স্বপ্নে দেখার ঘটনা বর্ণনা করছেন। কাহাতক আর মৃতব্যক্তিকে নিয়ে কথা বলা যায়। সকাল থেকে কেবল তা-ই চলছিল। দর্শক-শ্রোতারাও একই বিষয় বারবার শুনতে একঘেয়ে বোধ করছিল। আসরের বিষয়বস্তুর পরিবর্তনে তাই চমক এসেছে। শ্রোতারাও খুশি। যেকোনো আসরে বলবার মানুষ থাকে দু একজন। বাকি সবাই শ্রোতা। তবে মৃত্যুর ঠিক আগের কয়েকদিনের মধ্যে মৃতব্যক্তিকে কেউ স্বপ্নে দেখেনি কিংবা তার সাথে স্পর্শকাতর কোনো স্মৃতি নেই এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এরকম সমাবেশে সে-সব অভিজ্ঞতার মুখরোচক বর্ণনা অত্যন্ত স্বাভাবিক বলেই ধরে নেয়া হয়।

মৃতব্যক্তিকে নিয়ে দেখা স্বপ্নের বর্ণনা প্রায় শেষ। তার সাথে থাকা স্মৃতিচারণও হয়ে গেছে। চা-নাস্তাও খাওয়া হয়েছে কয়েক দফা। মৃতের বাড়িতে চুলা জ্বালানো নিষেধ। তাই লায়লার মা’র বাড়িতেই দুপুরের খাবারের আয়োজন চলছে। গোশত রান্নার সুগন্ধিতে সবার পেটে ছুঁচো ডন দিচ্ছে। গল্পে গল্পে আর কিছুটা সময় পার করে দিতে পারলে একেবারে খেয়ে বাড়ি ফিরতে পারবে। এমনটাই ভাবনা অনেকের মনেমনে।

পানের বাটা নিয়ে গোল করে বসেছে সবাই, প্রিয় মহানবী কী করে স্বপ্নে দেখা দিলেন তার বয়ান শুনতে। হনুফার মা পান সাজাচ্ছেন। কালাবুড়ি ছরতায় সুপারী কাটছেন। লায়লার মা থামির গোঁজ থেকে বিড়ির বাণ্ডিল বের করে  কালাবুড়িকে একটা বিড়ি দিলেন আগুন জ্বেলে আনতে। পানের সাথে একটু  সাদা পাতা আর দিনে ৩/৪টা বিড়ি, বহুদিনের অভ্যেস লায়লার মা’র। আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত বলেই একটু বেশি খাওয়া হচ্ছে।

একই ভিটায় তিন ভাইয়ের তিনটি  বাড়ি। তিনজনই পরলোকগত হয়েছেন। উত্তরসূরিরা কেউ এই গ্রামেই, কেউবা শহরে থাকে। তিনজন একসাথে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করলেও চালাকচতুর হওয়ার কারণে মেজোজন বেশি সম্পদ হাতিয়ে নিয়েছেন। অনেককে ঠকিয়েছেন এমন বদনামও আছে। তাতে অবশ্য কিছুই এসে যায় না। মেজভাইয়ের পরিবার এসব থোড়াই কেয়ার করে। কাঁচা পয়সার ঝনঝনানিতে লায়লার মা’র দাপটটাও একটু বেশি। তার স্বপ্নের বিবরণ শুনতে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়বে এটাই স্বাভাবিক।

বড় ভাইয়ের ছেলের বউ মরা বাচ্চা প্রসব করতে গিয়ে মারা গেছে। ফজরের আজানের ঠিক পরপরই। সারারাত কষ্ট পেয়েছে বেচারা। শেষরাতে রক্তক্ষরণ হতে হতে নিস্তেজ হয়ে যায়। খবর ছড়িয়ে পড়তেই ভোর থেকে সবাই আসতে শুরু করেছে। আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশিরা মিলে বিশাল বাহিনী। লায়লার মা নিজের কাঁধেই তদারকির দায়িত্ব নিলেন। প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখানোর সুযোগ সচরাচর হাতছাড়া করতে চান না। আশপাশ থেকে রাঁধুনিসহ সাহায্যকারীরা এসেছে। চারদিকে বেশ একটা উৎসব উৎসব ভাব।

খতিজা নামে যে মেয়েটা লায়লার মায়ের দেখাশোনা করে তাকেই রান্নাবান্না দেখভালের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কথায় বলে ‘সূর্যের চেয়ে বালি গরম’। খতিজার চলনে-বলনে এটা একদম স্পষ্ট।

আয়েশ করে মুখে পান পুরে বিড়িতে টান দিলেন লায়লার মা। তার গায়ের রং আর শারীরিক গঠনও প্রভাবশালী আর আসরের মধ্যমণি হওয়ার অনুকূলে। বুক চাপড়ে বলতে লাগলেন, উঁচা-লম্বা, শুভ্র শ্মশ্রুমণ্ডিত, অদ্ভুত সুন্দর, নূরানী চেহারার নবী যখন ধবধবে সাদা ঘোড়ায় চেপে দেখা দিলেন তখন তিনি নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না। জ্ঞান হারালেন। জ্ঞান ফিরলে আর খুঁজে পাননি আল্লাহর প্রিয় রসুলকে।

হাতের বিড়িটা শেষ হয়ে এলে এক ফাঁকে কালাবুড়ি তা সরিয়ে । নেয় এবার উচ্চস্বরে কাঁদতে শুরু করেন লায়লার মা। দর্শক-শ্রোতাদের কেউ কেউ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে এ ওর দিকে তাকাতে থাকে। তাদেরও কাঁদা উচিত কি’না বুঝতে পারছে না যেন! তবে কয়েকজন দ্বিধাহীনভাবেই তার সাথে কাঁদতে শুরু করে। একজন, দুজন ‘ইয়া নবী সালামআলাইকা’ বলেও রব তোলে। কেউ কেউ দরূদ শরীফ পাঠ করতে শুরু করে। দু একজন এগিয়ে যায় লায়লার মায়ের কান্না থামাতে। চোখের পানির অঝরধারায় ভিজে গেছে তার বুক।

ঝড়ের গতিতে খতিজা এসে ঢুকল, ‘ আহা, করেন কী আপনেরা! এম্নে কইরা কানলে তো মইরাই যাইব। এই নেককার মানুষটারে কী বাঁচতে দিতেন না?’

হঠাৎ নিজেদের অপরাধী মনে হতে লাগল সবার!

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu