এক.
আমাদের বাসাটা কলোনির শেষ প্রান্তে, তাই পাড়ার সব খবরই আমরা একটু দেরিতে পাই। সেদিন সকালে আমি সবে ঘুম থেকে উঠতে যাচ্ছি এমন সময় তৃনা এসে বলল, দাদা খবর শুনেছিস। আমি বললাম, কী খবর? আর তাছাড়া তুই তো কখনো আমাকে ভালো খবর বলিস না, তা বল দেখি কী খবর। বিছানায় বসে দুপা ছড়িয়ে তৃনা বলল, জানিস, নিতু দিদি আজ সকালে পালিয়েছে।
কথাটা শুনেই আমার শরীরটা একটু দুলে উঠলো। নিতু পালিয়েছে এটাও আমাকে শুনতে হলো। পাড়ার ছেলেমেয়েগুলি দিনকে দিন বেহায়া হয়েই চলেছে। তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠলাম। বাইরে বেরুচ্ছি এমন সময় আবার ফোন বেজে উঠলো। এদিকে মা এসে বলল, এই যে নবাবজাদা, বেলা যে কতখানি হয়েছে সেদিকে খেয়াল আছে। তোমার বান্ধবী ওই যে কি যেন নাম ছেলেদের মতো ঢেং-ঢেং করে ঘুরে বেড়াতো সে নাকি কোন মুখ পোড়ার সাথে পালিয়েছে, কলোনিটা একেবারে গ্যাছে, তা তোমাকেও তো বিশ্বাস নেই, দেখো তুমি আবার ওরকম কিছু করো না। আমি মাথা নিচু করে বললাম, আরে নাহ্।
মনের ভেতর কথাটা কেমন খচ্-খচ্ করছে, নিতু এমনটা করতে পারলো, পুরো এক বছর সুজনকে এভাবে ঘুরিয়ে শেষে কোন হতভাগাকে নিয়ে পালালো। গেট খুলে বের হতে যাবো সুজন এসে হাজির, আমি বললাম সুজন তুই!
– হ্যা, আমি। তোর জন্য আজ এমন হয়েছে, তুই বলতিস নিতু আমাকে খুব ভালোবাসে, এই তার নমুনা, শেষে একেবারে পালিয়ে গেলো।
– পালিয়েছে কার সাথে সেটা কিছু জানিস?
– কার সাথে আবার, মোবাইল ফ্রেন্ড নাটোরের সেই কিরণ। তুইতো বলতিস ওটা মোবাইলে অভিনয় প্রক্রিয়া চলছে, এখন আমি ঠিক বুঝতে পারছি আসলে মোবাইলে না, আমার সাথে অভিনয় প্রক্রিয়াটা চালিয়েছিলো ও।
– বুঝলাম কিন্তু ওতো আসলে এমন না।
– এমন না কেমন! চল আমার সাথে, নিঝুম তোর জন্যে বসে আছে।
নিঝুম এই ব্যাটা হলো আরেক সমস্যা। আজ কথার প্যাঁচে ফেলে আমার কানটা ঝালাপালা করে দেবে। নাহ্ নিতুর জন্য সব এরকম গুবলেট হচ্ছে। আমরা কয়েকজন মিলে একটা গ্রুপ করেছিলাম। আমি, নিঝুম, সুজন, নিতু, রুপা, রুমকি, শাওন আর পিকলু এই আট জনের একটা গ্রুপ। আমাদের কলোনিতে আমাদের গ্রুপটাকে সবাই ভালো চোখে দেখে। তাছাড়া বেশ ক’বছর পাড়ায় আমরা ফ্রি নাটক করে লাইম লাইটে চলে এসেছি আরকি।
আমাদের বন্ধুদের ভেতর খুব ভালো একটা সম্পর্ক আছে বিধায় আমরা একে অন্যের জন্য মাঝে মাঝে নিবেদিত হয়ে যাই, আর সেই জন্যই আমি সুজনের পক্ষ থেকে নিতুকে প্রেমের অফার করে ফেঁসে গেছি, কে জানতো ও এমন কাজ করবে। আমি একাজে যেতাম না, কিন্তু যখন দেখলাম সুজন নিতুকে পাবার জন্য নিতুর কথায় শীতের রাতেও নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তো স্নান করতে কিংবা সাত সকালে খেজুর গাছ থেকে খেজুর রস নিয়ে ঠিকই হাজির হতো। প্রতিদিন নিতুকে একটি কচুরীপানার ফুল এনে দিতো খালের পাড় থেকে, এতো জোঁকের ভয়কে সামনে রেখে ফুল আনা এসব তো ভালোবাসার জন্যে, তাই কাজটা করেছিলাম। গিয়ে দেখি নিঝুম বসে আমড়া খাচ্ছে, আমাকে দেখেই বলল, শালা প্রেমের মাস্টার হয়েছো, এখন যে নিতু সুজনকে ছেড়ে পালালো কেমন হলো? কিছুক্ষণের মধ্যেই এই বিষয়টা নিয়ে ঝগড়ার উপক্রম শুরু হয়ে গেলো। পরিশেষে সিন্ধান্ত নিলাম নিতুদের বাড়ি যাবো।
দুই.
নিতুদের বাড়ি গিয়ে আরেক মহা ফ্যাসাদ নিতুর মা বলে উঠলেন, তোমাদের সাথে থেকে থেকে আমার মেয়েটা এমন বদ হয়েছে। মেয়েটা আমার কত্তো ভালো ছিলো, এখন কিনা ফোনে আমার মুখে-মুখে তর্ক করে বলে কিনা গিয়েছি, ভালো করেছি আর আসবো না । আমাদের মুখে চুনকালি মাখাবি যদি জানতাম তাহলে এত স্বাধীনতা দিতাম না। আমি নিতুর ছোটটা মিতুকে জিজ্ঞেস করলাম, কিছু বলে-কয়ে যায়নি নিতু।
– দিদি একটা চিঠি লিখে গেছে।
মনে মনে ভাবলাম, চিঠির ঢং! ওনি রাজকন্যে হয়েছেন, পালিয়ে যাবার সময় আবার চিঠি লিখেছেন। বুড়োরা বলছে, এই এত্তটুকুন মেয়ে কী কান্ডটা করেছে রে বাবা! বলি, মা বাবার কথা কি একটুও মনে পড়ল না। ছ্যা-ছ্যা সিনেমা দেখে দেখে একেবারে গেছে দেশটা রসাতলে। আমার মুখ ফস্কে বেরিয়ে এলো, আপনাদের সময় তো আপনারা কম করেননি। চোখ বড় বড় করে বুড়োর দল আমার দিকে তাকালো ।
মিতুর হাত থেকে চিঠি পেয়ে সবাই একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। নিতু খুব কম কথায় লিখেছে–
মা, একবার ভেবে দেখো, তোমরা যদি আমাকে আয়োজন করে বিয়ে দিতে কত্ত খরচ হতো, তাই আমি পালিয়ে বিয়ে করে তোমাদের খরচ কতটা বাঁচিয়ে দিলাম তাই না। আর তাছাড়া বাবা যে কিপটে । আর আমি এখন বড় হয়েছি না, আমার স্বাধীনতা বলে একটা কিছু আছে না।
আমার কথা ভেবো না। মিতুর দিকে খেয়াল দাও।
–তোমাদেরই নিতু।
কিন্তু নিতু যে কার সাথে গেছে সেটা তো বোঝা গেল না। এমন সময় ওর মা এসে বলল, কাল রাতে আমার সাথে ঝগড়া হয়েছিলো মোবাইলে কথা বলা নিয়ে। ও যে ছেলেটির সাথে কথা বলতো তাকেই বলছিল পালিয়ে যাবে। আমি যখন এসব জিজ্ঞেস করেছি তখনই তো বেঁধে গেলো কুরুক্ষেত্র।
আমাদের যা বোঝার তা বুঝে নিলাম। আরও কিছুক্ষন থাকতাম কিন্তু পাড়ার লোকজন তো আমাদের দিকে এমন ভাবে চেয়ে আছে যেন আমরা সব কটা চিড়িয়াখানার বান্দর আর কি। পিকলু বলল, চল পালাই। আমিও দেখলাম ভাব ভালো না। নিতুর বাবা তো আমাদেরকে বললেন, তোমরা একটু আশে পাশে খুঁজে দেখো না! আমরা কী খুঁজবো! আর তাছাড়া সেই নিতুর ফোনের “কিরন” থাকে তো নাটোর। তার ফোন নাম্বার তো আমরা জানি না, কী করে খুঁজবো …
আমরা সবাই ফিরে এলাম তবে সুজন কিন্তু আমার পিছু ছাড়ল না। পুরো দুটো দিন ওকে বোঝালাম। কি যে যন্ত্রণা! রুপা আর রুমকি আমাদের সামনে দাঁত কেলিয়ে হাসে আর সবার সামনে এমন ভাব ধরে যেন কিচ্ছু বুঝে না মেজাজ আরো হট হলো। রুমকী বললো, কী লাভগুরু এখন কী হবে? আমি বললাম, বোঝাবো তোকে আরেক দিন।
চারদিন পর…
আমি ঘুমাচ্ছি ফোন বাজছে সেই কখন থেকে কেউ ধরছে না দেখে শেষে আমিই ধরলাম একি! এ যে নিতুর গলা। হ্যালো নিতু নাকি? ও প্রান্ত থেকে নিতু বলল, হ্যা রে, রুদ্র। আমি নিতু তোরা কেমন আছিস? আমি আসছি।
– কোথায় আসছিস?
– কোথায় আসছি মানে, তোদের কাছে।
– স্বামীসহ আসছিস তো, তোর বাবা তোকে পেলে চিবিয়ে খাবে।
– তোরা কেমন আছিস রে?
– ভালো না ।
– কেন রে, আমার জন্য মন খারাপ? এই আমি বাইরে থেকে ফোন করেছি রে বিল উঠছে।
– বাইরে থেকে কেন? তোর স্বামীর কি ফোন নেই নাকি? ফকির নাকি রে?
লাইনটা কেটে গেলো। ফোন রেখে উঠে দাঁড়ালাম।
এখন বিকেল। ভাবলাম যাই নদীর ধার থেকে ঘুরে আসি, কিন্তু তাও তো নানা সমস্যা। আজকাল নদীর ধারে ভালো মানুষের চেয়ে বাজে মানুষদের আড্ডাটাই একটু বেশি হয়। এইতো সেদিন কমবয়সী এক ছোকরা আমাকে বসে থাকতে দেখে বলে কিনা দাদা দেশলাই আছে, মানে ম্যাচ আর কি। আমি বললাম লাইটার খুঁজছো কিন্তু আমার কাছে তো নেই, তা এই অল্প বয়সেই শুরু করে দিয়েছো ।
ছোকরা যা বলল তা শুনে তো আমি হতবাক, বলে কিনা টেনশন! দাদা, টেনশন! মাথা ভারি হয়ে গেছে তো, তাই সিগারেট খাবো আর কি। আমি বললাম ও তাই আচ্ছা এখন যাও। আমি একটু সামনে দাঁড়ালাম হঠাৎ চোখ আটকে গেলো ব্রীজের উপর রিকসা থেকে নামছে নিতু। আমি তো অবাক, একটু জোড় হেঁটে সামনে গেলাম। আরে নিতুই তো। কিন্তু একা কেন? পালিয়েছিলো যে ওই ছেলেটি কোথায়?
আমি সামনে গেলাম। আমাকে দেখে বলল, আরে রুদ্র যে।
আমি বললাম— তোর হ্যাজব্যান্ড কোথায়?
আমার কথা শুনে নিতু খানিকটা হাসলো তারপর বলল— নাটকটা কেমন হলো রে, দারুণ না!
আমি বললাম– মানে?
– মানে বুদ্ধু আমি তো পালাইনি। মাসির বাড়ি গেছিলাম। এই ফাঁকে তোদেরকে একটু ঝালাই করে নিলাম।
– তার মানে? তোর চিঠি। তারপর তোর মাতো বলল, তুই পালিয়েছিস। কাকাবাবু তো তোকে কত জায়গায় খুঁজলো। তারপর আমরা যখন বললাম যার সাথে পালিয়েছিস সে নাটোর থাকে আর এখন তুই সেখানে আছিস, কাকাবাবুর সেকি দুঃখপ্রকাশ, তুই সবার সাথে এমনটা করতে পারলি।
– হ্যা পারলাম। বাবাকে কাল রাতেই বলে দিয়েছি আর মার উপর আমার একটু রাগ ছিলো তাই এ কয়দিন রুপাদের মামার বাড়িতে কাটিয়ে এলাম, সুজনের খুব লেগেছে তাই না রে!
– সে কি আর বলতে হয়। তাছাড়া রুপা একবারও বলল না যে, ও জানে তুই কোথায়। আমাকে বলতে পারতো। সব ধোলাই তো আমার উপর দিয়ে গেছে।
– রুপাকে আমি না করেছিলাম তাই ও বলেনি, তাছাড়া তোর এসব কোনো ব্যাপার না সেটা আমি জানি।
– কচু জানিস! দেখিস আমি এমন কিছু ঘটাবো সবকটাকে সাইজ করে ছাড়বো ।
– রুদ্র রাগ করছিস অ্যাই, তোর না রাগ নেই, তুই আমার সাথে চল, তুই না গেলে মা আমাকে খুব বকবে।
– পারব না। তুই যা আমি চললাম।
আমার সেদিন ভীষণ রাগ হয়েছিলো। এটা কোনো মজা করার সিস্টেম হলো?