পাঁচ ফিট দশ ইঞ্চি এ দেহটার প্রতিটি প্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্নভাবে পরিণত এবং পরিপূর্ণ। যেমন নাক; তরতরে সোজা, চোখ দুটো ডাগর ডাগর, ভ্রু ঘন আর কালো— যা নাকের খাজটায় এসে জুড়ে গেছে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি এমন পরিপূর্ণ একজন মানুষ, যাকে এতো এতো করে জানি, অথচ তার নামটাই জানি না— তাই তাকে আমরা লোকটি বলে সম্বোধন করব, যাকে এসব পরিণত এবং পরিপূর্ণ অঙ্গ-প্রতঙ্গের সমন্বয়ে তেমন একটা দৃষ্টি আকর্ষক কেউ বলে মনে হয় না।
পরিপূর্ণ অথচ পরিণত না। হয়তো সে জন্যই তাকে আর দশটা মানুষের থেকে আলাদা করার কিছু নেই। অথচ গড়পড়তা এই লোকটি বাইরে যতটা সাধারণ, ভেতরে যেন ততধিক জটিল। এমন এক সুতো, যাকে অগণিত গেরো পড়া এক দুঃসাধ্য গিঁট বলা যায়।
আসলে লোকটাকে বুঝতে হলে আমাদের সহজতর সূত্র ধরে এগুতে হবে— এতো দিন ধরে তার হাঁটা-চলা-ঘুমানো-মেলামেশাসহ সব কিছু পর্যবেক্ষণ করে এই সিদ্ধাদ্ধে আমি উপনিত হতে পেয়েছি; বলতে পারেন আবিষ্কার। লোকটার ধরণ-ধারণ আবিষ্কার করেছি।
ফলে লোকটাকে বুঝতে আমাদের খুব সহজ, গড়পড়তা পদ্ধতিতে এগুতে হবে। সেটা কেমন?
প্রথমত লোকটার অর্থনীতির দিকটি ধরা যাক। আয়ের উৎস অর্থাৎ লোকটা চলে কীভাবে? পৈতৃক সূত্রে দেশের প্রাণকেন্দ্রে, এক অভিজাত এলাকায় একটি বিক্রি করে দেওয়ার পরও তার তিন-তিনটি ফ্ল্যাট মজুদ। সেগুলোর তিনটিই আবার ভাড়া দেওয়া। লোকটি অভিজাত এলাকার নিজের ফ্ল্যাটগুলো ভাড়া দিয়ে একটা মধ্যম মানের নির্জন এলাকার কানাগলির পুরনো দালানের চিলেকোঠা নিয়ে থাকে। এ থেকে আমরা তার অর্থনীতি এবং মনোবৃত্তির একটা ধারণা পাই। লোকটা অর্থনীতিকভাবে সাভলম্বী এবং নির্জন স্বভাবের। ফলে তার অর্থসংকট সংক্রান্ত কোনো মস্তাত্ত্বিক জটিলতার আপাত সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের সন্দেহ থাকার কোনো কারণ নেই।
সন্দেহ তাও করা যায়। কারণ মানুষের নাকি অর্থ কখনো বেশি হয় না; বরং কম পড়ে। পৃথিবীর সবচে’ ধনী লোকটিরও অর্থ সংকট একটি নিত্য ঘটনা। এতো এতো অর্থ থাকার পরও নইলে কি তার অর্থের পেছনে কুকুরের মতো ছোটা থামত না? তবে লোকটা সে অর্থে যেহেতু একটু ব্যতিক্রী, ওই তিনটা ফ্ল্যাট না থাকলেও বুঝিবা তার চলে যেতো এমনটাও বলবো না, তারপরও কোনো-না-কোনোভাবে যে চলে যেত তাতে কোনো সন্দেহ নেই, তাই বলছিলাম অর্থ দিয়ে তাকে আমরা আপাতত বিচার করব না। যদিও অর্থই একমাত্র বিচার্য্য বিষয়।
ছোট থেকে বাবা-মার মধ্যেকার অসীম অশান্তি দেখে দেখে লোকটা বড় হয়েছে। অবশ্য তখন তো আর সে লোক ছিল না; নিতান্ত এক বালক। ফলে আবাল্য সে বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়া, সন্দেহ, মারপিট— এসব দেখে বড় হয়েছে। এগুলো ছিল নৈমিত্তিক ঘটনা। অথচ তারা বিয়ের আগে নাকি সাত বছর প্রেম করেছিলেন।
কক্সবাজার থেকে ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় আজ বছর চারেক হয় বাবা-মা গত হয়েছেন। লোকটার ধারণা, হয়তো তখনও তারা ঝগড়াই করছিলেন। বাবা হয়তো খিস্তি সহ্য করতে না পেরে স্টিয়ারিং ছেড়ে মায়ের গলা চেপে ধরেছিলেন। অমনি আইনজীবী দম্পতির গাড়িটা মালবাহী ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা খায় আর পিত্ত-রঙের প্রিমিওটা গিয়ে পড়ে রাস্তার পাশে ডোবায়।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, তিনদিন পর সে বাবা-মায়ের মৃত্যুর খবর জানতে পারে। কারণ সে গত দুমাস হলো পিতা-মাতার জ্ঞাতব্যের বাইরে, বান্দরবানের দুর্গম এলাকার এক ঝুমে বাস করছিল। দুর্ঘটনার দিন হয়তো সে অঘোরে ঘুমাচ্ছিল কিংবা পাহাড়ের মাথায় পা ছড়িয়ে হাত-পা এলিয়ে দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে চোখের সহ্যক্ষমতা নিয়ে গবেষণায় নিমগ্ন ছিল অথবা এও হতে পারে, তখন সে পাহাড়ি বাঙ্গি খাচ্ছিল। এবারকার এই ভ্রমণে সে দিন-রাত এই করেই কাটিয়েছে। মন চাইলে হেড়ে গলায় গানও গেয়েছে। গান বলতে আকথা-কুকথা মুখ দিয়ে যা এসেছে বেসুরো গলায় সুর সেধেছে। সাগর-নকুলের ভাষায়, সে গান, না গানের ‘মায়রে বাপ’— অতকিছু ভাবার সময় নেই।
এই তো ভেজালটা বাঁধিয়ে বসেছি। একেই বলে নিজের ফাঁদে নিজে পড়া। এইবার নিশ্চয় আপনি বুঝতে পারছেন, লোকটার নামও আমি জানি, কিন্তু লোকাচ্ছি। হ্যাঁ, সে সাগর নকুল আর আমার বন্ধু। কিন্তু তার নাম না বলার ব্যাপারে আমি পাথরের মতো অটল। তাই তাকে আমরা লোকটি বলেই সম্ভোধন করব। যদিও প্রসঙ্গটি নিয়ে মনের মধ্যে একটা খচখচ থেকেই যাবে। তো লোকটার কথায় ফেরা যাক।
সে যেদিন বাসায় ফিরল, শুনল তার বাবা-মার কবর হয়েছে আজিমপুরে। জায়গা দুটো আগেই কেনা ছিল নাকি। যদিও তার কিছুই জানত না লোকটা। লোকটা ঢাকায় ফেরার পর প্রথম কাজ ছিল ধানমন্ডির বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের গায়ে টু-লেট ঝুলিয়ে দিয়ে নিজের জন্য একটা বাসা দেখতে লেগে যাওয়া।
বাসা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে বিলাসবহুল আসবাব সব বেচে দেয়। একদম সস্তা দরে। নিজের শৈশবের গন্ধমাখা খাট আর বুকসেলফটা নিয়ে তার নতুন ঠিকায় ওঠে যায়। আত্মীয়-স্বজন এটা-ওটা বলে। এ পরিস্থিতিতে যা হয়ে থাকে আরকি— মুরুব্বি আর গারজিয়ান-গুরুজন বেঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠে। এখনও তার বেত্যয় ঘটেনি। কিন্তু সে নির্বিকার। কারো কথার তোয়াক্কা সে করে না। নিজের সিদ্ধান্তে অটল।
আসলে সেদিনের পর সে যে কোথায় গেল, কিছুদিন আর তার টিকিটিরও খোঁজ পাওয়া গেল না। শুধু দেখা গেল, ফ্ল্যাটগুলোতে নতুন ভাড়াটিয়া ওঠেছে। আর সব আগের মতোই। যেন এই পৃথিবীতে গত তিনদিন আগে চট্টগ্রাম সড়কে কিছুই ঘটেনি। সূর্য যেমন আগেও পূর্ব দিকে উঠত এবং পশ্চিম দিকে ডুবত এখনও তাই।
কেবল নতুন ভাড়াটিয়া; তাদের কর্তাব্যক্তিটি অন্যান্যদের মতো অফিসে যান, বিকেলে ফেরেন। বাড়ির বাচ্চারা স্কুলে যায় আবার ফেরে। বারান্দায় এখনও সন্ধ্যা হয়। বাবা-মায়ের ফ্ল্যাটে শুধু যোগ হয়েছে বেতের একটা ইজি-চেয়ার; সেটাও পুরনো। বিকেলে বৃদ্ধমতো এক লোক এসে বসে, কিছুক্ষণ পর চলে যান।
এই বারান্দায় বাবা-মায়ের তুখোড় ঝগড়ার সময় কতদিন সে আশ্রয় নিয়েছে। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জানলার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়েছে— পরিস্থিতি কী দেখার জন্য।
ছ’মাস হয়ে গেছে চিলেকোঠার জীবন। পুরো ছাদ খা-খা করেছে। একটা ফুলের টবও নেই। ছাদের এককোণে কতগুলো ছাইয়ের স্তুপ।
ছোটকালে ক্যাডেটে পড়ার কারণে তেমন কোনো বন্ধুবান্ধবও নেই লোকটার। কারো সঙ্গে কথা বলতেও মন চাইত না তেমন একটা। নাক-মুখ গুজে এডভেঞ্চার, থ্রিলার পড়ে দিন কেটেছে; এক ধরণের অন্তমুখী জীবন। এখন এই পর্যায় এসে সে স্বভাবটাই রয়ে গেছে চৌদ্দ আনা। যদিও কিছু কিছু কিম্ভুত ব্যাপার নতুন যোগ হয়েছে। এই যেমন ‘কথা’, কারো সঙ্গে বলতে শুরুছে তো বলতেই আছে। শ্রোতারও যে দুটো-একটা কথা থাকতে পারে তা তার কখনো মনেই পড়ে না। ফলে শ্রোতা অচিরেই হাপিয়ে উঠে। ‘বিরক্তিকর’ একটা টেগ লাগিয়ে ভেগে পড়ে। পরে দূর থেকে দেখলে, তার খপ্পর থেকে বাঁচতে অন্যপথ ধরে। এ পস্থিতির ব্যাপারে সেও কিন্তু সম্মুখ অবগত। কিন্তু সংযম সে রাখতে পারে না। পরে পস্তায়। তাই সেও পারত পক্ষে কারো সঙ্গে কথা বলা এড়িয়ে চলে। একান্তই কথা বলতে হলে হু-হা বলে সটকে পড়ে।
বেশির ভাগ সময় নির্বাক যুগের লেম্বপোস্টের চেয়েও নিঃশ্চুপ হয়ে হাঁটতে থাকে রাস্তায়। মাথায় নানা ধরণের চিন্তার উদয়াস্ত হতে থাকে, সংলাপ তৈরি হতে থাকে। তর্ক-বিতর্ক হয়। আর সে হাঁটে, ক্ষিধে পেলে যেকোনো একটা রেস্টুরেন্ট বা টঙ্গ দোকানে ঢুকে পড়ে।
সেদিন হাঁটতে হাঁটতে হাতিরঝিল চলে এলো। ক্লান্তি নিয়ে একটা বেঞ্চে বসল। মাথার উপর রেন্ট্রি কড়ুই গাছ— ঘুরে ঘুড়ে পাতা পড়ছে। এখন বাংলা কী মাস? কী মাসে পাতা ঝড়ে? হবে একটা কিছু। মাসের কি কোনো ঠিক আছে, না ঋতুর? শীত ঢুকে যাচ্ছে বসন্তে, বর্ষা অনুপ্রবেশ করছে শরতে, এদিকে শরতের দেখা নেই! ঋতু আর কী ঠিক থাকবে— পৃথিবীর বুকের উপর মানুষ যেভাবে চেপে বসেছে, এর ফলতো তাকে ভোগ করতেই হবে। কোথায় যেন একবার পড়েছিল—
‘মানুষকে কুকুর বলবেন না।
কুকুর আপনার কী করেছে যে তাকে এতো বড় অপমান করবেন?
মানুষকে মানুষই বলুন।
মানুষ একটা ত্যাড়াবাঁকা বাল, আরশোলা চোদা, মাদারডিম— তাতে কী হল!
তার চে’ বলুন, তুই একটা মানুষ বটে!
এর চেয়ে বড় গালি হয় না আর।’
ফলে মানুষকে আমি মানুষই বলতে চাই। তুই একটা মানুষ বটে!
সামনে ঝিলের জলে গোধূলির সূর্যাস্তের মন বিষণ্ণ করা রঙ কুটিকুটি হচ্ছে। মানুষ মঙ্গলগ্রহে চলে গেছে, কিন্তু মনরোম এই দৃশ্যের অন্তর্গত কীভাবে হবে? সম্ভবত এর একমাত্র রাস্তা কবিতা। এটা আবার কবিতার প্রতি বেশি পক্ষপাত হয়ে গেলনাতো? হলে হোক। কবিতাই শুরু, কবিতাই শেষ; কবিতার জয় হোক।
এসব দৃশ্য আর চিন্তার ভেতর লোকটা একটা ভাস্কর্যের মতো বেঞ্চিতে বসে আছে। এর মধ্যে দুটো ছেলে-মেয়ে হাত ধরাধরি করে চলে গেল।
পরের দৃশ্যটি আর সহ্য করতে না পেরে লোকটা গল গল করে বমি করে ভাসিয়ে দিল। বমির কিছুটা পড়ল নিজের গায়েও। মনের ভেতর ভয়ানক বিরক্তি ও ঘৃণার ঝড় বয়ে গেল। এসব বয়ে নিয়ে সে বাসায় চলে এলো। বিছানায় শুয়ে পড়ে মরণপন লড়াই করে ঘুমকে পরাস্ত করেতে পড়ল।
পরদিন ঘুম থেকে উঠেই তরতাজা পত্রিকাটা হাতে নিল। খাটে বসে কেচি দিয়ে পত্রিকার সবগুলো পৃষ্টার মেয়ের ছবি কাটল। পিনাপ করে দেশলাই হাতে চলে এলো ছাদের কোণে। ভারী বাতস বাইছে। বাতাস বাঁচিয়ে ছাইগাদার উপর রেখে কাগজগুলো পুড়িয়ে দিল। পানি ছিটিয়ে দিল যাতে ছাই না উড়ে।
পানি গরম করে একমগ চায়ের সঙ্গে টোস্ট খেয়ে বেরিয়ে পড়ল সেদিনের মতো। পথে নেমে পড়া আরকি। কোনো উদ্দেশ্য নেই, কোনো উদ্দেশ্যহীনতাও নেই। এর বাইরের কেমন ধারার একটা হাঁটা। পথে ভাস্কর্য দেখলে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে, ভালো একটা লেখা দেখলে দাঁড়িয়ে পড়ে, সুন্দর ফুল ফুটে থাকতে দেখলে দাঁড়িয়ে দেখে। শিল্পকলার দিকে চলে এলে মঞ্চনাকট দেখে, সিনেমা হল পড়লে সিনেমা দেখে, খেতে মন চাইলে খায় আর রাত হলে বাসায় ফেরে। ঘুমানোর আগে মন চাইলে হস্তমৈথুন করে, কাঁদতে মন চাইলে কাঁদে আর কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে।
সেদিন চা দোকানে বসেছিল লোকটা। কবি মতো চেহারার একটা ছেলে তার বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছিল— খেচতে খেচতে তার নাকি কররেখা মুছে গেছে, এখন অফিসে তার ফিঙ্গার কাজ করতে চায় না। বলেই তাদের কী হাসি! অদ্ভুত সুন্দর হাসি। ছেলেটার হাসি শুনে মনে হলো স্বচ্ছ পানিতে টুপ টুপ শব্দে পাথের টুকরো পড়ছে।
একথা মনে হতে মনে পড়ল, সেদিন ওই ছেলেটার সঙ্গে কথা বলতে তার কতই না ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু কিছু বলা হয়নি। এভাবে কত মানুষের সঙ্গে তার কথা বলতে মন চায়, কিন্তু কারো সঙ্গে কথা বলতে সে সাহস করে না। ওই যে তার কথা-বাতিক; বলতে নিলে শুধু বলতেই থাকে। এ যে বিরক্তিকর সেতো তা ভালোভাবেই জানে।
এর বাইরেও তাকে বলা যায় ইচ্ছের খুনি। কতশত ইচ্ছে যে এভাবে খুন করে তার কোনো হিসেব নেই। খুব করে খেতে মন চাইলেই সে খায় না, দেখতে মন চাইলেও দেখে না। সে কখন কী করে আর কী করে না, সেটা বলা খুব মুশকিল। তবে তা নিয়ে প্রশ্ন করা অনেকটা আমাদের দুটো হাত কেন, একটা নাক কেন আর এখন রাত তিনটা কেনর মতো বলে আপনার মনে হবে হয়তো। কারণ সে তার জীবনে এতোটাই অভ্যস্ত আর স্বতফূর্ত।
হাঁটতে হাঁটতে আজ হঠাৎ সে লক্ষ্য করল শিল্পকলার সামনে চলে এসেছে। কোনোদিক না তাকিয়ে, কোনো কথা না ভেবে সে তখনই একটা টিকেট কেটে বসে গেল মঞ্চনাটক দেখতে। মাঝে মধ্যেই সে শিল্পকালায় আসে। আসে বলতে, চলে আসে, পা তাকে নিয়ে আসে। হাঁটে এবং কখন যেন সে নিজেকে শিল্পকলার সামনে আবিষ্কার করে। কোনো নাটক থাকলে একটা টিকিট কিনে সুরুৎ করে ঢুকে পড়ে এককোনায় গিয়ে বসে যায়।
সেটা খুব ভালো লাগা থেকে তা বলা যাবে না। বলা যায় এও একটা অভ্যস্ততারই অংশ। সে মূলত হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন শিল্পকলার সামনে চলে আসে, সুরুৎ করে শিল্পকলায় ঢুকে পড়ে এবং একটা টিকিট কাটে। প্রবল বা অপ্রবল কোনো আকর্ষণ থেকে না।
অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের মতো নাট্যকলারও করুণ দশা। নতুন কোনো ভাবনা নেই, নেই কোনো নিরীক্ষা। ঘুরে ফিরে একই জিনিস, ডায়ালগের কৃত্তিমতা আর দর্শক হিসেবে নির্দিষ্ট কিছু মানুষ। ঘুরেফিরে তারাই। ফলে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় মুখ চেনাচেনি হয়ে যায়। যদিও খুব যত্ন করে লোকটা এই ব্যাপারটা এড়িয়ে চলে। কারো সঙ্গে কথা না, কারো সঙ্গে চোখাচোখিও না। নাটক শুরু হলে ঢুকে, শেষ হলে বেরিয়ে যায়। কিছুটা সময় কাটিয়ে মৃত্যুর আরও কাছাকাছি হওয়ার একটা তুলনামূলক ভালো উপলক্ষমাত্র।
আজ হঠাৎ একজন শাড়িপরিহিতা এগিয়ে এলো। মাথার বা-দিকে সিঁথি করা, কাঁধ-ছোয়া চুল। কানে শাড়ির সঙ্গে মেচিং করে কলাপাতা রঙের দুটো গহনা; সম্ভবত কাঠের। দোলগুলো কতগুলো চূর্ণচুলের আবডালে মৃদু নাচছে।
জুতোতে ‘টুকটাক্’ শব্দ তুলে এগিয়ে এসে বলল,
‘আমাদের নাটক দেখতে আসার জন্য ধন্যবাদ। আপনাকে চিনি। অবশ্য নাম নিজ্ঞেস করলে বলতে পারব না।’
মেয়েটা হেসে এমনভাবে গৃবাভঙ্গি করল যেন, চেহারা চিনলেও তার নাম না জানারই কথা। কিন্তু সে ভঙ্গিমায় আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। নেই অচেনাসুলভ জড়তা।
গ্যালারির মাঝামাঝি জায়গায় একদম মাঝের চেয়ারটায় বসা লোকটা। তার সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে মেয়েটা। সে লোকটার উত্তর শোনার অপেক্ষায় আছে। কিন্তু লোকটা কোনো কথাতো বললই না, তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। কোলের পানির বতল ছিটকে গিয়ে পড়ল মেয়েটার সামনে। পায়ের গতিতে বাতাসকে চাপকাতে চাপকাতে হলরুম থেকে বেরিয়ে এলো। অতঃপর সোজা বাসায়।
সেদিন না খেয়ে দুবার হস্তমৈথুন করে শুয়ে পড়ল। নিজেকে তার মনে হচ্ছে আখের ছিবড়া। যার সমস্ত রস ইতোমধ্যে পিষে পিষে নিগড়ে নেওয়া হয়েছে। সেদিন রাত কাটল না-ঘুমে, না-জাগরণে— অদ্ভুত এক অসুস্থতায়। চোখ দিয়ে ঝরল অবিরল ধারায় পানি। যদিও সেরাতের আবহাওয়া ছিল অস্বস্তিকর গরমের ভেতর কাগুজিলেবুর শরবতের ভেতর একখণ্ড বরফের মতো। ভ্যাবসা গরমের মধ্যে এক পশরা বৃষ্টি হয়ে গেছে আর এখন বইছে মৃদুমন্দ বাতাস।
পরদিন রুটিনমাফিক পত্রিকার কাটিংগুলো পুড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল। পুরান ঢাকার আহসান মঞ্জিলের মাঠে বসে বিকেলটা কেটে গেল। সন্ধ্যায় এসে ঢুকল রমনায়। একটা বেঞ্চে শুয়ে ঘুমিয়ে গেল। রাত সাড়ে নয়টার দিকে সিকিউরিটি গার্ড এসে ডেকে তুলল।
মনে হলো মশার কামড়ে রীতিমতো পা ফুলে ডোল হয়ে গেছে। ওঠে দাঁড়িয়ে বোঝা গেল আরও বাজে অবস্থা, কেউ যেন দুই কাধে দুটো বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। এতো ভারী বোধ হচ্ছিল শরীর, তবু এভাবেই হাঁটতে শুরু করল।
এ যেন এক হাঁটাবাবা। হাঁটছে তো হাঁটছেই। এই মনে হচ্ছে পড়ে যাবে, এই মনে হয় বসে যাবে, এই মনে হয় কোন গাড়ি উপরে ওঠে যাবে। কিন্তু কিছুই হবে না। এভাবে টলমল পায়েই সে মোহাম্মদপুর পৌঁছে যাবে।
সংসদের সামনে ফাকা রাস্তায় শা-শা করে ছুটছে গাড়ি। অথচ এই রাস্তাটুকুর আগেও জ্যাম, পরেও জ্যাম। শুধু এই টুকো রাস্তা ফাঁকা। এটুকুতেই ড্রাভাররা যেন পাগল হয়ে ওঠে। সমস্ত জ্যামের মাশুল তারা সংসদের সামনের এই পনের সেকেন্ডের পথে এসে তুলে নিতে চায়।
সংসদের মাঝামাঝি আসতে ধুম করে একটা শব্দ হলো। লোকটা চেয়ে দেখল, একটা সাইকেল দুমড়ে পড়ে আছে, পাশে একটা মেয়ে কাতরাচ্ছে। মেয়ের কাছ থেকে একটা রক্তের নালা মুহূর্তে বেরিয়ে এলো। দ্রুত গতিতে ড্রেনের দিকে যেতে শুরু করল। ইতোমধ্যে সাদা একটা পাজেরো হাওয়ার গতিতে রাস্তার বাঁকে মিলিয়ে গেল।
লোকটা প্রথমটায় কী হলো বুঝতেই পারছিল না। একটা শব্দ, সাদা কার; অতঃপর মেয়েটা রাস্তায় পড়ে। পাশে দাঁড়ানো লোকটা। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে এসব।
দুর্ঘটনায় কবলিত মেয়েটাকে দেখে সে চমকে উঠল। এতো শিল্পকলার সেই মেয়ে! যে যেচে কথা বলতে এলো, ওদিকে লোকটা যাকে এক রকম অপমান করেই চলে এলো। লোকটার মনে হলো, এর চেয়ে অন্যায় আর পৃথিবীতে হতে পারে না। তার কারণেই সম্ভত এই দুর্ঘটনাটা ঘটল! কিন্তু এভাবে তো হাবাকেবলার মতো বেশি সময় দাঁড়িয়েও থাকা যায় না। হতভম্ব হয়ে বসে থাকার সময় এটা না।
এদিকে কোনো ট্রান্সপোর্টও পাওয়া যাচ্ছিল না। যাতে করে আহতকে হাসপাতালে নেওয়া যায়। তবে গাড়ি যে আচ্ছে না, তাও না। আসছে, যাচ্ছে — কেউ থামছে না। যেন এখানে একটা হা-মুখ বেরিয়েছে — থামলেই তাদের গিলে ফেলবে। এখানে এসে, লোকটার হাতের ইশারার পর যখন বিষয়টা বুঝতে পারে, তাদের গতি যেন দ্বিগুণ হয়ে যায়। অগত্যা আহতাকে কোলে নিয়ে লোকটা সহরোওয়ার্দির দিকে হাঁটতে শুরু করল।
মানুষের নাকি দুটো ওজন — একটা সে যখন সচেতন, অন্যটা সে যখন অচেতন। ফলে মেয়েটার ওজন লোকটার পক্ষে কঠিনই ছিল। কিছুদূর নিয়ে গিয়ে মেয়েটাকে মাটিতে নামাতে বাধ্য হলো। ফের কোলে নিয়ে দৌঁড়ানোর চেষ্টা করল। এবার যেন কিছুটা তার সহায় হলো। এরমধ্যে একটা রিক্সা পাওয়া গেল।
রিক্সওয়ালা প্রথমটায় রাজি হতে চাচ্ছিল না। তখন তাই ঘটল, যা ইতোপূর্বে লোকটার থেকে ঘটেনি এবং তাতে সে নিজেই কিছুটা অপ্রস্তুত্য। তার গলায় যেন সিংহ গর্জে উঠল। রিক্সওয়ালা আর দ্বিতীয় রা না-কেটে গায়ের সবটুটু জোর নিয়োগ করে পেডেল ঘুরাতে শুরু করল।
সহরওয়ার্দি হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে ভর্তি করা হলো। ভর্তির পর জানা গেল তার মা নেই। বাবার ভিন্ন সংসার আছে। নিজে টিউশানি করে পড়াশুনা শেষ করে স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নিয়েছিল সবে। পাশাপাশি থিয়েটার করতো।
ইতোমধ্যে নিউজ হলো, ঘটনা জানাজানি হলো। অনেক বন্ধু এলো মেয়েটাকে দেখতে। হাতে গোছা গোছা ফুল। কিন্তু কেউ অর্থ নিয়ে এলো না। এমনকি পরিবারের পক্ষ থেকেও কোনো অর্থিক সহায়তার সম্ভাবনা দেখা গেল না। লোকটা কোনো উপায় না দেখে, প্রায় অর্ধেক মূল্যে একটা ফ্ল্যাট বেচে দিল। ফলে চিকিৎসা আটকে থাকল না।
আমরা যখন এখন ভাবি, আশ্চর্য হয়ে যাই! লোকটা কেন এসব করছে? তার মতো মানুষ, তার কাছে এসবের কী অর্থ থাকতে পারে! কোনো অর্থ নেই— ঠিক। কিন্তু লোকটা তাই করছিল, যা করার কোনো মানে নেই, তার মতো লোকের পক্ষে তো অবশ্যই। তারপরও খুব জোরালোভাবে ধরলে, অর্থাৎ ছাই দিয়ে ধরলে, বলতে হবে তার ভাল লাগছিল। এসব করে ভেতরে তার একটা অপরিসীম শান্তি কাজ করছিল। ভেতরে এক ধরণের কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছিল সে— যার না শব্দ, না অশ্রু— কোনটাই পৃথিবীর আলো-বাতাসে বেরিয়ে আসে না, এক অদ্ভূত অনুভূতি দেয়; তার জন্য যা একদম অভিনব। ভেতরজুড়ে তার একটা সুখ; যে সুখে পাখি তার বাচ্চার মুখে পোকা পুরে দেয়। অশ্রুর রেখা শুকিয়ে যাওয়া এক দুঃখী মুখে সুখের হাসি ফুটে উঠার মতো। লোকটার অবস্থাটা ছিল ঠিক তেমন।
সেদিন রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল লোকটা। হাসপাতালের রিসিপশনের একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে। রাত হয়তো তিনটা। ডাক্তার ডেকে তুলল। লোকটা গিয়ে দেখল গায়ের সব নলটল খুলে নেওয়া হয়েছে। সাদা এপ্রোন দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে মেয়েটার নির্জীব শরীর।
কোন কথা না বলে লোকটা আস্তে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। হাসপালের বাইরের ডানদিকের একটা রেন্ড্রিকড়ুই গাছের নিচে এসে কান্নায় ভেঙে পড়ল। লোকটা বোধহয় জীবনে এই প্রথম শারীরিক আঘাত না পেয়েও এভাবে কাঁদছে। তার চোখের নোনতা পানি পৃথিবীর আলো, হাওয়া আর মাটি চুক চুক করে চেটে খাচ্ছে।
মা-বাবার কবরে কখনো লোকটার যাওয়া হয়নি। খুঁজে পেতে একটু কষ্ট হলো। হাজার হাজার কবর। এই এতোটুকু জায়গায় হাজার হাজার মানুষ সহাবস্থান করছে। কোনোদিন কোনো ঝগড়া নেই, শব্দ নেই, রা-টি পর্যন্ত নেই। অথচ পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে আমাদের কত কত জায়গা লাগে!
অবশ্য কবরস্থানে বৈশম্য চোখে পড়ে না, তা না। কোনো কবরের স্থায়িত্ব ছয় মাস, যে কবরটা কেনা হয়নি। কোনোটা কিনে তাজমহলের মতো করে রাখা হয়েছে— দেখলেই বোঝা যায় এটা টাকাওয়ালা ব্যক্তির কবর।
মা-বাবার কবরের কাছে আসতেই লোকটার কেমন অস্বস্তি হতে লাগল। সবুজ রঙ-করা লোহার কেয়ারি দেওয়া পাশাপাশি দুটো করব। একবার ভাবল, ফিরে যাই। আবার মত বদলাল। কাছে গেলে তার মনে হলো, কবরে শুয়েও যেন তারা ঝগড়া করছে আর সেই শব্দ তার কানে এসে লাগছে। পরে দেখল, হ্যাঁ, দূরে একটা নতুন কবরে কেয়ারি দেওয়ার জন্য মাটিতে বাঁশ পোতা হচ্ছে। হাতুরির শব্দ।
মা-বাবার পাশে দুটো কবরের জায়গা কিনে নিল লোকটা। একটাতে কবর খুড়তে বলে চলে এলো। এবটা পিকআপ ভাড়া করে নিয়ে সোজা হাসপাতল। হাসপাতালের পক্ষ থেকে জানানো হলো, লাশ নেই, বাড়িতে নিয়ে গেছে পরিবারের সদস্যরা এসে।
‘বাড়ির সদস্যরা?’
‘হ্যাঁ।’ ডাক্তার সম্ভত পুরো ঘটনাটা জানেন। সে এগিয়ে এসে লোকটার সঙ্গে হাত মেলালেন এবং অপর হাতে পিঠে মৃদু চাপড় দিয়ে বললেন, ‘ব্যস্ততা আছে, যাই। একদিন বাসায় আসেন, চা খাব। আপনার মতো আমারও কেউ নেই।’
লোকটার মুখে বোঝা যায় না এমন একচিলতে হাসির রেখা ফুটে উঠল।
পিকআপ নিয়ে লোকটা শাহবাগ চলে এলো। ফুলের দোকনগুলো থেকে সব গোলাপগুলো কিনে নিল। পিকআপে তুলে আজিমপুরে মা-বাবার পাশের খোড়া কবরের কাছে নিয়ে এলো। একটি ফুল বাদে বাকিগুলো কবরে রেখে মানুষের মতো চাটাই, বাশের খণ্ডগুলো বিছিয়ে দিয়ে কবর দিয়ে দিল। হাতের গোলাপটি বাবা-মার কবরের মাঝ বরাবর রেখে চলে এলো।
রাতে অপার ক্লান্তি নিয়ে গা-টা বিছানায় ঠেকাতে না-ঠেকাতে চোখে ঘুম নেমে এলো। হঠাৎ মনে হলো, তার পা ফসকে যাচ্ছে। সে পড়ে যাচ্ছে খাদে। চট করে ঘুম ভেঙে গেল। ওঠে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে পানি খেল। ছাদে একটু হাটাহাটি করে ফের শুয়ে পড়ল।
ওমা! একি, এ দেখি বাবা-মা। হসছেন। সেই ফ্ল্যাট, পুরনো সেই সুফা…। তারা একে অপরের কাঁধে হাত দিয়ে বন্ধুর মতো বসে আছেন। যেন দোস্ত তারা এভাবে হেটে আসলেন। একটা অপরিচিত পার্কে অশোক গাছের নিচে বেঞ্চিতে বসে আবার হাসলেন। কাঠগোলাপের আদুরে গন্ধ নাকে পাচ্ছিল লোকটা। বাবা আবার কবে থেকে এ পরফিউম ইউজ করেন— এই প্রশ্ন লোকটার ভেতর গুমরে উঠছিল, কিন্তু কিছুতেই বলতে পারছিল না, বেরুচ্ছিল না।
হঠাৎ তাদের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়ে গেল। কিছুক্ষণ ঝগড়া হলো। তারপর পেছন ফিরলেন এভাবে যেন পেছনে তাদের অনাথ ছেলেটি দাঁড়িয়ে, তা তারা জানেন। কানে কানে বললেন— ‘তুমি আমাদের ঝগড়াটাই দেখলে, ভালোবাসা দেখলে না!’