দর্পণ ডেস্ক
একটি পূর্ণাঙ্গ ম্যাগাজিন। শিক্ষা, সাহিত্য ও গবেষণামূলক ম্যাগাজিন দর্পণ। ২০১৯ সালে ব্যতিক্রমধর্মী ম্যাগাজিন দর্পণ তার যাত্রা শুরু করে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে দর্পণ "গল্পবাজ" ম্যাগাজিন আত্তীকরণ করে।
দর্পণ ডেস্ক

তারুণ্যের জানালা – মনজুরুল ইসলাম

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

বাবলু, কেবলই শৈশব থেকে উত্তীর্ণ হয়ে এসেছিল কৈশোরের বৃত্তে। আর দশজন কিশোরের মতো বাবলুরও কৈশোরিক স্বপ্ন, ভাবনা, আবেগ ও উচ্ছ্বাস ছিলো একই রকমের। একটি কিশোরের সেই বয়সে স্বাভাবিকভাবে যতটা দুরন্ত ও চঞ্চল থাকবার কথা, তার কোনোটিই কিশোর বাবলু থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না। আর্থিক দিক থেকে বাবলুর পরিবার আনুপাতিকভাবে সচ্ছল না হলেও ও ওর পিতামাতার এই অসচ্ছলতাকে কখনোই ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উপলব্ধি করে নি। সঙ্গত কারণেই কৈশোরের তাড়নালব্ধ উচ্চাকাঙ্ক্ষা অথবা অতি-অভিলাষ ও কখনোই ওর নৈমিত্তিক আচরণের মাধ্যমে প্রদর্শন করে নি। কিন্তু বাবলু জানতো, সচ্ছলতা অথবা সক্ষমতা অর্জনের মূল চাবিটি একমাত্র শিক্ষার হাতেই। ভিন্নভাবে বললে বলতে হয়, ঐ কিশোর বয়সে যা ওর ভাববার বিষয় নয় সে বিষয়টিকেই ও ইতোমধ্যে আত্মস্থ করে নিয়েছিলো। ফলে ওর বোধে যা প্রবলভাবে রেখাপাত করেছিল তা হলো– যে কোনো মূল্যেই ওকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। আর এজন্য শিক্ষা নামীয় চাবিটিকে নিজের আয়ত্তে আনয়ন করা সর্বাগ্রে প্রয়োজনীয় ছিল। তাই সবসময়ই দেখা যেত, পড়াশুনার প্রতি বাবলুর ছিলো তীব্র আকাক্সক্ষা। ক্লাসের প্রথম সারির শিক্ষার্থী হিসেবে যে যে ধরনের বিশিষ্টতা অপরিহার্য তার সবগুলোই বিদ্যমান ছিলো ওর মধ্যে।

সময় পরিক্রমার এক পর্যায়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ শেষ করেছিলো বাবলু। ফলাফল অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক হওয়ায় আত্মপ্রতিভার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার। কিন্তু, সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিলো অভিভাবকবৃন্দের পরামর্শে, যখন সবাই ইউনিয়ন অথবা উপজেলাস্থ ডিগ্রি কলেজে পড়বার পরামর্শ প্রদান করেছিলেন। ফলস্বরূপ আশংকার কালো মেঘ দানা বাঁধতে শুরু করেছিলো বাবলুর মস্তিষ্কের প্রতিটি পরতে পরতে। যে কোনো মূল্যে স্বপ্নের বীজটিকে বাঁচিয়ে রাখবার নিমিত্তে উদগ্রীব হয়ে পড়েছিলো ও। নিজের ভেতর প্রোথিত প্রগাঢ় আত্মবিশ্বাসটির সাথে বাবা মাকে পরিচিত করাতে নতুন করে উদ্যোগী হতে হয়েছিলো ওকে। অবশেষে প্রাণান্ত প্রয়াসের মাধ্যমে ও ওর আকাঙ্ক্ষার নির্যাসের আস্বাদকে উপলব্ধি করাতে সক্ষম হয়েছিলো বাবা-মাকে। অবশ্য বাবলুর বিশ্বাসের ওপর ওর বাবা মায়ের পূর্বাহ্ণিক আস্থা অটুট ছিল। সে কারণেই নিজেদের আর্থিক দীনতার কথা ভেবে খানিকটা পিছিয়ে এলেও আড়ষ্টতার সকল সীমাবদ্ধতাকে জয় করে একেবারে শেষ সময়ে এসে বাবলুর বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্যে একটি আবেদন ফরম উঠিয়েছিলেন। তারপর থেকেই শুরু হয়েছিলো বাবলুর নতুন উদ্যমে পড়াশুনা। দিনরাত কঠোর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে নিজেকে প্রস্তুত করতে শুরু করেছিলো ও। যত কষ্টই হোক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আসন ওকে যে অধিকার করতেই হবে। নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই বাবার সাথে ঢাকায় পৌঁছে গিয়েছিলো বাবলু। অর্জিত আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ় প্রত্যয়কে অবলম্বন করে পরীক্ষাতেও অংশগ্রহণ করেছিলো। ঢাকা থেকে ফিরে আসবার পর প্রতিটি মুহূর্তে সমস্ত সত্তা জুড়ে যে বিষয়টি ওর চিন্তার জগতকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল সেটি হলো– পরীক্ষার ইতিবাচক ফলাফল প্রাপ্তির বিষয়টি।

একদিন হঠাৎ দুপুর বেলায় আকস্মিকভাবে দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করেছিলেন বাবলুর বাবা। তার আকস্মিক আগমনটি বাবলুর মায়ের মনে তাৎক্ষণিকভাবে একটি আশঙ্কাজনিত প্রশ্নের সৃষ্টি করেছিল– কোনো সমস্যা অথবা অসুবিধে হয় নি তো! বাবলুরও মনোজগতের গভীরে উত্তেজনার তরঙ্গ দোলায়িত হচ্ছিলো। ঝড়ের গতিতে ছুটে গিয়েছিলো ও বাবার কাছে। দু’হাত প্রসারিত করে পরম মমতায় ছেলেকে জড়িয়ে ধরেছিলেন বাবা। অবলীলায় চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু ঝরতে শুরু করেছিলো তার। বাবলু অনুমান করবার চেষ্টা করছিলো, হয়ত কোনো শুভ সংবাদ অপেক্ষা করছে ওর জন্য। অনেক কষ্টে বাবা যখন তার আবেগকে সংবরণ করবার মাধ্যমে সাফল্যের বিষয়টি প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তখন বাবলুও আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলো। প্রকৃতির প্রতিটি কোণ থেকে অঝোর ধারায় অভ্যর্থনার বৃষ্টিও ঝরতে শুরু করেছিলো। বাবলু খুঁজে পেয়েছিলো জীবনে চলার নতুন পথ। যে পথটি ছিল বহুদিনের প্রতীক্ষিত।

তারপর থেকে শুরু হয়েছিলো দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাবলুর পড়াশুনা। স্বাভাবিকভাবেই বাবার সামর্থ্য ছিল না সন্তানকে ঢাকায় রেখে পড়াশুনার খরচ চালানোর। প্রাথমিক পর্যায়েই যখন বাবা মায়ের এই সীমাহীন কষ্ট উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলো বাবলু, তখন থেকেই চেষ্টা করতে শুরু করেছিলো নিজের পায়ে দাঁড়াবার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হবার কারণে সেটি সম্ভবও হয়েছিলো স্বল্প সময়েই। ফলস্বরূপ অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার বিষয়টি কর্পূরের মতো উবে গিয়েছিলো। ঢাকায় অবস্থানকালীন অনবরত ছোট ভাইবোনদের উৎসাহ প্রদান করবার মাধ্যমে তাদেরকেও কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে সক্ষম হয়েছিলো। শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন ওর অভিজ্ঞতাগুলো বন্ধুদের সাথে বিনিময় করবার মাধ্যমে ওদের মেধাগত উৎকর্ষ বৃদ্ধিসহ জীবনের প্রকৃত বাস্তবতার ওপর জ্ঞান অর্জনে দীক্ষা প্রদান করেছিলো কোনো ধরনের অহমিকা ছাড়াই। ওর বন্ধুরাও সেই ইতিবাচক ভূমিকাটি গ্রহণ করেছিলো অত্যন্ত প্রসন্ন চিত্তে। যখনই গ্রামে আসতো বাবলু, তখনই অপেক্ষাকৃত কম বয়সী শিক্ষার্থীদের প্রেষণা প্রদান করতো এই লক্ষ্যে যে; তারাও যেন ওর মতো করে শিক্ষাজীবনে সর্বোচ্চ উৎকর্ষ সাধন করতে পারে।
আজ বাবলু সিভিল সার্ভিসের আওতাভুক্ত শিক্ষা ক্যাডারের সদস্য হিসেবে সরকারি কলেজে পাঠদানে ব্যাপৃত রয়েছেন। হয়ত একদিন বাবলুকে অনুসরণ করে স্ব-স্ব প্রতিভার প্রজ্বলন ঘটিয়ে প্রতিষ্ঠিত হবার মাধ্যমে রাষ্ট্রের সেবা প্রদানে সক্ষম হয়ে উঠবে তার ভাই, বোন এবং তাকে অনুসরণকারী গ্রামের পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরাও। উপর্যুক্ত বর্ণনাটি কোন গল্প নয়, পুরোপুরি বাস্তব জীবন থেকে উদ্ধৃত। হয়ত নিয়মিত অধ্যয়নের মাধ্যমে বাবলুর মতো অনেকই শত প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে বাস্তব জীবনে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের বোধের অন্তরালে যে প্রশ্নটি উত্থিত হতে পারে, সেটি হলো– গ্রামের সেই সহজ সরল বাবলু এবং বর্তমানের বাবলুর মধ্যে পরিবর্তন সাধিত হবার নেপথ্যে কোন কারণটি অন্তরিত?

সন্দেহাতীতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ই বাবলুর জীবনের বাঁক পরিবর্তন করেছে। ঋদ্ধ করেছে তার জীবন দর্শনকে। বিশ্ববিদ্যালয় যে কোনো শিক্ষার্থীর জন্য এমন এক ধরনের বটবৃক্ষ যার আশ্রয়ে আশ্রিত হয়ে একজন শিক্ষার্থী খুব সহজেই নিজেকে যুগোপযোগী ও যোগ্য করে গড়ে তুলবার সুযোগটি পেয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে বিপুল শিক্ষার্থীর সমারোহ এবং সৃষ্টিশীল পরিধি যেমন একজন শিক্ষার্থীকে সৃজনশীল করে তোলে তেমনি পণ্ডিত ব্যক্তিদের সাহচর্য এবং বিশাল বিদ্যাপীঠের স্বপ্নীল পরিবেশ জ্ঞান চর্চার এক অত্যুত্তম ক্ষেত্র তৈরি করে। প্রকৃত মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠবার ক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থীর নৈতিক মূল্যবোধ ও মানসিক উন্নতির বিকাশে যে সব গুণাবলীর প্রয়োজনীয়তা চরমভাবে অনুভূত হয় তার সমন্বয় ঘটাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ পালন করে থাকেন অবর্ণনীয় প্রভাবসম্পাতি ভূমিকা। পাশাপাশি একজন প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থীর অন্তর্জগতে প্রোথিত সকল গুণের বিকাশ ঘটাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অঙ্গনও সবসময় প্রস্তুত হয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত বাবলুর শৈশব এবং কৈশোর এতটাই শিক্ষাবান্ধব ছিলো যা একজন উদীয়মান তরুণের বেড়ে উঠবার ক্ষেত্রে ছিল অত্যন্ত ইতিবাচক। বাবলুর সূত্র ধরে আরো একটি প্রশ্ন এখন আমাদের চিত্তজুড়ে উত্থিত হতে পারে– যে কোনো তরুণ শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে কোন কোন গুণের সঞ্চার ঘটানো সম্ভব হলে সেই শিক্ষার্থীটি শিক্ষাক্ষেত্রে উৎকর্ষ অর্জনে সক্ষম হয়ে উঠবে?

সবসময়ের জন্যেই একজন শিক্ষার্থীর বেড়ে উঠবার ক্ষেত্রে যে দুটি বিষয়ের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম তা প্রথমত সেই শিক্ষার্থীর শারীরিক এবং মানসিক বিকাশ, দ্বিতীয়ত ধারাবাহিক অধ্যয়ন। আমরা সবাই জানি, বয়ঃসন্ধিকালের সময়সীমা ১৩ থেকে ১৮ বৎসর। এই সময়টি একজন কিশোরের বেড়ে উঠবার ক্ষেত্রে Transitional Period হিসেবে বিবেচিত। এই সময়সীমার সুষ্ঠু প্রয়োগের ওপর ভিত্তি করেই রচিত হয় একজন শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ। ক্রান্তিক সময়ের এই সীমার মাঝেই একজন শিক্ষার্থী মূল্যবোধ সম্পর্কে ধারণা সৃষ্টির সুযোগ পায় যার মাধ্যমে তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে থাকে। পরবর্তীকালে সেই ব্যক্তিত্বের ওপর নির্ভর করেই পরিচালিত হয় তার জীবনের ভবিষ্যৎ অধ্যায়। পাশাপাশি এই ক্রান্তিকালটিতে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক পরিবর্তনের ওপর ভিত্তি করে তাদের মানসিক পরিবর্তনটিও ঘটে থাকে। নানামুখী নেতিবাচক ভাবনায় নিজেদের সম্পৃক্ত রাখবার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য থেকে সরে আসবার সম্ভাবনাটি প্রকট হয়। এ সময়েই পরিবর্তনের এই কারণগুলো জানতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে তারা। সে প্রেক্ষিত বিবেচনায় এই সময়টিতে তাদের এই শারীরিক পরিবর্তন যে খুবই স্বাভাবিক, সেটি বোঝানোর দায়িত্বটি বর্তায় অভিভাবকবৃন্দের ওপর। অভিভাবক কিংবা পরিবারের সদস্য ব্যতীত অন্য কেউ তার শারীরিক পরিবর্তনের এই বিষয়টির ব্যাখ্যা প্রদান করলে কিংবা সেই শিক্ষার্থীটি বুঝতে আগ্রহী হলে, তাদের ভুল ব্যাখ্যা গ্রহণের মাধ্যমে সেই শিক্ষার্থীটি প্রতারিত হতে পারে। কিন্তু অভিভাবকবৃন্দ যদি সংকোচ না করে ব্যাখ্যা প্রদান করতে সক্ষম হন যে, এটি স্বাভাবিক একটি সমস্যা যা প্রত্যেকের জীবনেই ঘটে থাকে তাহলে সমস্যাটির সমাধান হবে একেবারে শুরুতেই। ফলস্বরূপ শিক্ষার্থীরা বিষয়টি নিয়ে অনর্থক সময় নষ্ট করবার মাধ্যমে নিজেদের বিপথে নেবার ভিতটি সৃষ্টির ন্যূনতম সুযোগ পাবে না।

দ্বিতীয়ত, যে কোনো শিক্ষার্থীর শিক্ষাক্ষেত্রে শীর্ষমাত্রার উৎকর্ষ নিশ্চিত করবার প্রশ্নে ধারাবাহিক অধ্যয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে প্রতীত। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে অধ্যয়নে ব্যাপৃত থাকবার ক্ষেত্রে নানামুখী প্রতিবন্ধকতা সামনে এসে উপস্থিত হয় যার মধ্যে অন্যতম হলো– অস্থিরতা ও মানসিক দৃঢ়তার সংকট, উপযুক্ত সঙ্গের অভাব, অর্থহীন অহংকার এবং অর্থনৈতিক দীনতা ইত্যাদি। এখন প্রশ্ন হলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে অস্থিরতা এবং মানসিক দৃঢ়তার সংকট সৃষ্টি হয় কীভাবে? অবশ্যই ধারাবাহিকতার মধ্যে দিয়ে নিজের পড়াশুনার পদ্ধতিটিকে চালিত করতে ব্যর্থ হলে। কোন শিক্ষার্থী যদি নিয়মিতভাবে পাঠে নিযুক্ত না থেকে পরীক্ষার পূর্ব মুহূর্তে পাঠের গতি বাড়িয়ে দেয় তাহলে অবশ্যম্ভাবীভাবে তার ভেতরে অস্থিরতার সৃষ্টি হবে এবং পরীক্ষার পূর্ব মুহূর্তে তার মানসিক ভিতটি শক্ত হয়ে উঠবে না। কারণ সেই শিক্ষার্থীটি প্রতিনিয়ত একটি অগোছালো পদ্ধতিতে নিজের জীবনটিকে যাপিত করতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। ছাত্র জীবনে যে কাজটি করবার প্রয়োজন সেটি না করে অন্য কোন কাজে নিমগ্ন রয়ে যাবে। এমনও হতে পারে, শিক্ষার্থীটি অপরিণত বয়সে এমন সব কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখবে, যা পরিণত বয়সকেও উত্তীর্ণ করে যাবে।

আমরা যদি এক্ষেত্রে বাবলুর প্রাত্যহিক জীবনটিকে বিশ্লেষণ করবার চেষ্টা করি তাহলে দেখতে পাবো, ওর জীবন প্রবাহ ছিলো অত্যন্ত গোছালো। একটি গ্রাম। যে গ্রামটি কদমতলা নামেই আদ্যোপান্ত পরিচিত। এই কদমতলা নামটি কখন, কীভাবে গ্রামটির মৌলিক নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেটি বর্তমান প্রজন্ম এবং এ প্রজন্মের পূর্ব প্রজন্মেরও কেউই সঠিকভাবে বিবৃত করতে পারেনি বা পারে না। শুধু লোকশ্রুতিতেই নামকরণটির বিভিন্ন কারণের কথা জানা যায়। কেউ কেউ মনে করেন, এই কদমতলা গ্রামটিতে বহুকাল পূর্বের কোন সময়ে বিশাল কদম বৃক্ষের সমারোহ অস্তিত্ববান ছিলো। আবার কেউ কেউ মনে করেন, এখানে মূলত একটি বৃদ্ধ কদম বৃক্ষ যুগ যুগ ধরে তার পল্লবের ছায়া এবং নির্দিষ্ট একটি ঋতুতে সে কদম কুসুমের অস্বাভাবিক রকমের প্রাণকাড়া সুগন্ধ দূর দূরাঞ্চলের সাধারণ মানুষদের বৃক্ষটির ছায়াতলে আসবার জন্যে অকপট আহ্বান জানাতো। কদমবৃক্ষটির পাশ দিয়ে যে ছোট্ট নদীটি এখনও বয়ে চলে সেই নদীটিতে নৌকো, ডিঙি ভাসিয়ে বিভিন্ন এলাকার মানুষ দূর দূরাঞ্চলে চলে যেত। সময় প্রবাহের সাথে সাথে এই নদীর উপর দিয়েই নৌকায় চড়ে আসতো বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তাদের বসতি নির্মাণের চেষ্টা করতে। তাদের এ চেষ্টার ফলেই এই ছোট্ট এলাকাটি কোন এক সময় একটি বর্ধিষ্ণু গ্রামে রূপান্তরিত হতে থাকে। কিন্তু গ্রামটির আয়তন বৃদ্ধি পেতে পেতে আজকের এই মুহূর্তে যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে তাকে আর বর্ধিষ্ণু বলা যায় না। পুরোপুরি বর্ধিত হয়ে গ্রামটি একটি নির্দিষ্ট সীমা লাভ করেছে। কিন্তু, যে কদম বৃক্ষটি নিয়ে এত কথা, উপকথা আর লোকশ্রুতি সেই কদম বৃক্ষেরই অস্তিত্ব আজকে এ গ্রামটিতে নেই। তবে নামটি রয়ে গেছে অক্ষতভাবে। গ্রামের পাশ দিয়ে যে ছোট্ট স্রোতবিহীন নদীটি বয়ে চলতো সেটি পূর্বের মতোই অবিকল রয়ে গেছে এখনও। এই নদীতেই বাবলু নিজের নৌকো অথবা ডিঙি না থাকলেও ঐ নদীটির ঘাটে বাঁধা কোনো পরিচিতজনের ডিঙিটি ঘাট থেকে খুলে নিয়ে একাই দাঁড় বেয়ে নদীটির এপার ওপার করতে অথবা কখনো কখনো সীমা ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে যেতে এবং ফিরে আসতে অপার সুখ অনুভব করতো। শুধু তাই নয়, বন্ধুরা মিলে দূরের কোনো গ্রামে কখনো ফুটবল, কখনোবা ক্রিকেট খেলতে যেত। বিশেষত বার্ষিক পরীক্ষা শেষে যখন পড়াশুনার চাপ থাকতো না তখন সকাল বেলায় খেলতে গিয়ে পড়ন্ত বিকেলে বাড়ীতে ফিরে আসতো। আর এ কারণে বাবার অনেক তিরস্কার আর মায়ের কড়া শাসন সহ্য করতে হয়েছিলো বাবলুকে। কিন্তু কখনোই ও ওর বাবার তিরস্কার অথবা মায়ের শাসনের প্রেক্ষিতে একটি শব্দও উচ্চারণ করে নি। এই ডিঙি বেয়ে এবং বিভিন্ন খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করে যে শারীরিক সক্ষমতা অর্জন করতো বাবলু সেই সক্ষমতাই প্রকারান্তরে ওর মানস গঠনে একটি বিরাট ভূমিকা রেখেছিলো।

এরই ফলশ্রুতিতে নিয়মিতভাবে অধ্যয়ন করবার পাশাপাশি নিয়মিত খেলাধুলার মাধ্যমে ওর শারীরিক গঠনটি ছিল সুপুষ্ট। আর তাই প্রতিদিন ও যা পড়তো তা মস্তিষ্কে দৃঢ়ভাবে গ্রন্থিত থাকতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পূর্ব মুহূর্তটি পর্যন্ত ওর এই জীবনাচরণ অব্যাহত ছিলো বলেই কিশোর বয়সে কোনো নেতিবাচক প্রলোভন দ্বারা প্রলোভিত হবার সুযোগ ওর মানসপটে সৃষ্টি হয় নি। এটি খুবই স্বাভাবিক যে, যখন কোনো শিক্ষার্থী নিয়মিত খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করবে না, তখন তার মানসিক গঠনটি পুষ্ট হবার ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হবে। যেহেতু শিক্ষা গ্রহণের প্রকৃততা নির্ভর করে সুপুষ্ট মস্তিষ্কের ওপর সেহেতু শারীরিক ক্রিয়াকলাপে অন্তর্ভুক্তিই কেবল একজন শিক্ষার্থীর মানস গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এটির কোনো বিকল্প থাকতে পারে না। কিন্তু, কোনো শিক্ষার্থী যদি অতিমাত্রায় কম্পিউটার গেমস খেলাসহ এ ধরনের অন্য কোনো খেলার অভ্যাস তৈরি করে তবে তার মধ্যে গেমস খেলার তীব্র আসক্তি সৃষ্টি হবে যা তার শারীরিক দক্ষতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তো কোন উপকারে আসবেই না বরং শরীরের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে শিক্ষার্থীটির মানসিক গঠন দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়ে উঠবার সম্ভাবনাটিও ক্ষীণ হয়ে আসবে।

তাই একজন শিক্ষার্থী যদি প্রতিনিয়ত এই ধারাবাহিক পড়াশুনা, খেলাধুলা এবং সহ-পাঠক্রমের মধ্যে নিজেকে নিমগ্ন রাখতে পারে তবে তার তারুণ্যের সময়গুলো ইতিবাচকভাবে ব্যবহৃত হয়ে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যের দিকে এগুতে থাকবে। সে কখনোই নেতিবাচক কোনো চিন্তার দ্বারা নিজেকে আবৃত রাখবার সুযোগ তো পাবেই না বরং প্রতিনিয়ত স্স্থুল চিন্তার আবহে নিজেকে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। কিন্তু, উপর্যুক্ত কার্যক্রমের মধ্যে নিজেকে সম্পৃক্ত না রেখে যদি সে ভিন্ন কোনো সঙ্গ দ্বারা নিজেকে জড়িয়ে রাখে যা তার অধ্যয়নের ক্ষেত্রে ঋণাত্মক প্রভাবক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে তবে সেটি তার চিত্তে যে কোনো সমস্যার সম্ভাবনাকে গভীর করে তুলতে পারে। ইদানীং শিক্ষার্থীরা Facebook ব্যবহারের মাধ্যমে সেই তাৎপর্যহীন বিষয়ের বাহুল্য প্রদর্শনের মাধ্যমে নিজেদের ধ্বংসকরণের পথটিকে প্রশস্ত করছে। অবশ্যই Facebook ব্যবহার করা যাবে যদি সেই ব্যবহারের অভ্যন্তরে ইতিবাচক বিষয়ের প্রাচুর্য থেকে থাকে। অতীতে বাবা, মা, বন্ধু কিংবা ভাইবোনের কাছে চিঠি লিখবার মাধ্যমে আমরা আমাদের অন্তর্নিহিত ভাবনাগুলোকে প্রকাশ করতে পারতাম। একই সাথে তাদের কাছ থেকে চিঠির উত্তর পেয়ে লাভ করতাম এক ধরনের পুলকিত সুখবোধ। তাদের চিঠি গ্রহণের জন্যে অপেক্ষার প্রহরটি প্রলম্বিত হতো এই ভেবে যে, কতক্ষণ পর ডাকপিয়ন আসবেন। চিঠি আসতে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে গেলে অমোঘ অস্থিরতায় কাটতো প্রতিটি দুপুর। যখন আসতো না তখন ভেবে নিতাম, আজ আসে নি তো কি হয়েছে, কাল তো আসবে। আমাদের অবচেতনাতেই আমাদের সত্তা জুড়ে সৃষ্টি হত এক অপরিসীম ধৈর্যবোধের। অতঃপর হলদে খামে ফাঁপা চিঠিটি যখন ডাকপিয়নের হাত ধরে আমাদের হাতে এসে পৌঁছাত তখন হৃদয় বন্দরে নোঙ্গর করতো অদ্ভুত এক সুখাবেশ। শব্দের পর সাজানো শব্দগুলি যখন আমাদের মস্তিষ্কে গিয়ে পৌঁছাত তখন অন্তর্দেশের প্রতিটি প্রান্তরকে নতুন করে জাগিয়ে তুলতো আমাদেরই অবচেতনায়। কোনো কোনো বন্ধুর সঙ্গে ম্রিয়মাণ হয়ে যাওয়া সম্পর্কগুলো আবারও সমৃদ্ধ হতো নতুন করে।

আজ Facebook, Twitter, E-mail, Whatsapp কিংবা Messanger এর কল্যাণে শিক্ষার্থীদের আর অপেক্ষা করতে হয় না। অবশ্য আধুনিকতার এই আবহে অপেক্ষা করবার সুযোগটিও কারো কাছে প্রত্যাশিত নয়। তবুও শিক্ষার্থীদের অন্তর্জগতজুড়ে কেন নিয়তই অস্থিরতা ক্রিয়াশীল রয়ে যায়? রয়ে যায় এ কারণেই যে, শিক্ষার্থীরা তাদের ভাবনাগুলোকে মাধুর্যপূর্ণ আবেগ সংযোজিত করে লিখতে উদ্যোগী হয়ে উঠতে পারে না। কোনো রকমে দু’একটা শব্দ লিখে মনের ভাব প্রকাশ করে থাকে। অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে অহরহ Post প্রদান করে অপেক্ষার প্রহরটিকে প্রলম্বিত করে উৎকণ্ঠিত থাকে এই ভেবে যে, কতজন তাদের এই Post টিতে Like দিলো এই প্রত্যাশায়। এতে করে একই সাথে শিক্ষার্থীরা Facebook ব্যবহারের মাধ্যমে যেমন সময় নষ্ট করছে তেমনি ব্যবহার না করেও চিন্তার জগতে তাদের ভাবনাগুলোকে Facebook এর সীমার আওতায় আবৃত রাখছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই মনের ভাবটিকে প্রকাশ করবার ক্ষেত্রটি হওয়া উচিত নির্দিষ্ট। এক হাজার বন্ধুর Like পাবার পরিবর্তে একজন বন্ধুর প্রকৃত ভালোবাসা নিশ্চিত করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বরং সেই শিক্ষার্থীটিই হবে বুদ্ধিমান, যে ফেসবুক ব্যবহারের মাধ্যমে নিজের অধ্যয়নের ক্ষেত্রে তা ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করতে পারবে। সেই ধরনের শিক্ষার্থী খুব সহজেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়ে উঠবে যে, খুব বেশি সময় ফেসবুক ব্যবহার করলে তার নেতিবাচক প্রভাব কতটা সুদূরপ্রসারী হতে পারে। যে শিক্ষার্থীটি এটি করবে সে তারই মতো করে অন্যান্য আরো অনেক শিক্ষার্থীকে এই কর্মে উদ্ধুদ্ধ করবার ক্ষেত্রে একটি প্রচ্ছন্ন ভূমিকা রেখে যাবে।

নিজেকে প্রকাশ করা প্রতিটি মানুষেরই স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। প্রকাশের মাধ্যমেই সে তার আত্মতুষ্টির অনুসন্ধানে মগ্ন থেকে যায়। হতে পারে সেটি লেখালেখি কিংবা সার্থক কোনো কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে। তবে সেই প্রকাশ ভঙ্গিটির নেপথ্যে যথার্থ কারণ অন্তরিত থাকলে তা আরো বেশি বাঙময় হয়ে ওঠে। কিন্তু যথেষ্ট কষ্টকর এবং তাৎপর্যপূর্ণ গভীরতা ব্যতিরেকে যদি তা প্রকাশ করা হয় সেক্ষেত্রে ক্ষতি হবার সম্ভাবনাটি প্রকট হয়ে উঠবে। কারণে অকারণে যথেচ্ছ ব্যবহারে নিরত থাকলে ক্ষতির সম্ভাবনাটি সবসময়ের জন্যই উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠবে। তাই, শিক্ষার্থীদের এই বিষয়টি সবসময়ের জন্যই অনুধাবন করবার মাধ্যমে ঠিক করে নিতে হবে যে, তারা কীভাবে তাদের শিক্ষাজীবনে উন্নয়নের অন্তরায় হিসেবে বিবেচিত উপকরণগুলো ব্যবহার থেকে নিজেদের নিবৃত রাখবে কিংবা ব্যবহারে সংযমী হবে যা তাদের শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারবে না।

এই প্রেক্ষিতটি বিবেচনায় শিক্ষার্থীটির সহপাঠী অথবা বন্ধু তাকে ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। যদি শিক্ষার্থীটি উপযুক্ত সঙ্গ প্রাপ্তিতে সক্ষম হয় তবে প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান অন্তরায় হিসেবে বিবেচিত বিষয়গুলো থেকে সে অব্যাহতি পেয়ে যাবে। কিন্তু, আদর্শ বন্ধুর অভাব অবশ্যম্ভাবীরূপে একজন শিক্ষার্থীকে ধারাবাহিকভাবে পড়াশুনাসহ মানসিক বিকাশ সাধনের ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত কর্মগুলোতে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখবার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে না। সেক্ষেত্রে কোনো শিক্ষার্থী কাদের সঙ্গে মেলামেশা করবে সেটি তার অন্তর্বোধ থেকে উৎসারিত উপলব্ধি দ্বারা বিবেচনা করবে। একটি শ্রেণিকক্ষে স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন মানসিকতার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করবে। তাই শিক্ষার্থী তার নিজের ভেতর প্রোথিত ইচ্ছেটিকে গুরুত্ব প্রদান করে তার সাথে যে শিক্ষার্থীটির সাযুজ্য খুঁজে পাবে তার সাথে মেলামেশা করলেই সেটি তার জন্য মঙ্গলময় হবে। সেক্ষেত্রে নিজেকে পুরোপুরি শিক্ষা গ্রহণের জন্যে প্রস্তুত রাখবার বিষয়টি অনিবার্য হয়ে উঠবে। শ্রেণিকক্ষে সবাই যদি অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ় বিশ্বাসী হয় এবং অভিভাবকবৃন্দ যদি যথার্থ যত্নশীল হন তাহলে সেই শ্রেণিকক্ষে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের বিপথে যাবার সম্ভাবনা সৃষ্টির মাত্রাটি উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাবে। কিন্তু এই ধরনের পরিবেশ সব স্কুল অথবা কলেজে দৃশ্যমান হয় না। সত্যিকার অর্থে কোনো রাষ্ট্র যদি শিক্ষায় উৎকর্ষ সৃষ্টির মাধ্যমে উন্নয়নের শিখরে অধিষ্ঠিত হতে চায় তবে এই ধরনের কল্পিত শ্রেণিকক্ষকে বাস্তবে রূপদান করা হবে একটি অনিবার্য শর্ত। এই বিষয়টির সহায়ক শক্তি হিসেবে নিজেকে সংযোজিত করতে একজন শিক্ষার্থীকে সেই তরুণ বয়সেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া তার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে যে, সে কার সঙ্গে মেলামেশা করবে? অনেক শিক্ষার্থীই হয়ত ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বাইরে কোথাও ঘুরে বেরিয়ে আসবার প্রস্তাব করতে পারে কিংবা ক্লাসের মধ্যে পড়াশুনার ব্যাঘাত ঘটতে পারে এমন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হবার আহ্বান জানাতে পারে। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষার্থীকে উক্ত আহ্বানগুলোয় সাড়া প্রদান না করে এমন সব কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করবার দিকে ব্রতী হওয়া প্রয়োজনীয় যা শুধু তার শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা হিসেবে বিবেচিত হবে।

অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে যারা নিয়ত সবার কাছে প্রিয় হয়ে উঠবার জন্যে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে থাকে। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে চায়। একইসাথে মনে মনে এটি প্রত্যাশা করে থাকে যে, শ্রেণিকক্ষের সবাই তাকে অনন্য ভাববে। অর্থাৎ তার মনোসংযোগ অধ্যয়নমুখী না থেকে এই নির্দিষ্ট দিকটির প্রতি কেন্দ্রীভূত থাকে। এই ধরনের শিক্ষার্থীদের ভেতরে বেড়ে উঠবার উজ্জ্বল সম্ভাবনা থাকবার পরেও অতি উচ্চ মাত্রার আবেগ কিংবা প্রত্যাশার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনাটি নিয়ত ক্রিয়াশীল রয়ে যায়। একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজনে বিভিন্ন প্রকৃতির শিক্ষার্থীদের সাথে মেলামেশা করবে– এটিই স্বাভাবিক। যদি সে কোনো বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা অর্জনে ব্যর্থ হয় তবে অপরের সহযোগিতা গ্রহণের মাধ্যমে সেই বিষয়ের ওপর যথার্থ ধারণা অর্জন করবে। কিন্তু প্রকৃত বন্ধু হিসেবে বেছে নেবে একজন অথবা একাধিকজনকে। যে বন্ধুদের সঙ্গে সে সব বিষয় বিনিময় করতে পারবে। এক্ষেত্রে যাচাই করবার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে এ কারণে যে, যে বন্ধুদের সে বন্ধু হিসেবে নির্বাচন করবে সেই বন্ধুদেরও যেন সম পরিমাণ আগ্রহ তার ওপর কেন্দ্রীভূত থাকে। এবং অবশ্যম্ভাবীরূপে বন্ধুত্ব সৃষ্টির প্রথম ভিতটি হবে অধ্যয়ন এবং অন্তিমে জ্ঞান অর্জন। এটি কারুরই অজানা নয়– প্রতিটি মানুষের জীবনে প্রকৃত বন্ধুর প্রভাব সীমাহীন। এই প্রকৃত বন্ধুর প্রভাব সারাজীবনজুড়ে অত্যন্ত ইতিবাচক হিসেবে কাজে আসে। ‘প্রকৃত বন্ধুর কাছে মনের গহীনে সুপোত্থিত অনুভূতিগুলো ব্যক্ত করলে আনন্দের মাত্রা যেমন নক্ষত্রালোকের সীমাকে ছাড়িয়ে যায় তেমনি সেই কথার গভীর অভ্যন্তরে যদি দুঃখ, কষ্ট এবং যন্ত্রণা অন্তরিত রয়ে যায় তবে সে দুঃখের মাত্রা হ্রাস পেতে পেতে অর্ধেকে নেমে আসে।’ প্রাবন্ধিক ফ্রান্সিস বেকনের এই উদ্ধৃতির মর্মোদ্ধারে নিরত হলে যে নিগুঢ় সত্যটি উদ্ভাসিত হয়ে উঠে, সেটি হলো– প্রতিটি শিক্ষার্থীর জীবনে এমন বন্ধুত্ব নির্বাচন করা প্রয়োজন, যে বন্ধুদের সঙ্গে সেই শিক্ষার্থী তার মনের সব ধরনের অনুভূতি বিনিময় করতে পারবে অতি অবলীলায়। এই বন্ধুদের সঙ্গে যদি সম্পর্কটি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন রয়ে যায় তবে পরোক্ষভাবে অবশ্যই তা সকলেরই জীবনকে দীপান্বিত করে তুলবে। একই সাথে যাপিত জীবনে উদ্ভূত সমস্যাগুলো মোকাবেলা করা উভয়ের জন্যেই সহজ হয়ে উঠবে। হয়ত সবাই এ বিষয়ে একমত হবেন যে, এই প্রকৃত বন্ধু খুঁজে পাবার উৎকৃষ্ট প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে উচ্চবিদ্যালয়। তাই বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন যদি কোন শিক্ষার্থী বন্ধুত্ব নির্বাচনের প্রথম শর্তটি অর্থাৎ পড়াশুনার প্রতি সেই বন্ধুদের আগ্রহ রয়েছে কিনা সেটি অনুধাবন করবার পর তার সার্বিক আচরণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বন্ধুত্ব নির্বাচন করতে সক্ষম হয় তবে সেটিও বিবেচিত হয়ে উঠবে শিক্ষা গ্রহণের একটি সার্থকতা হিসেবে। এমনকি শেষ পর্যন্ত যদি একাধিক বন্ধু থেকে সংখ্যাটি একজন বন্ধুত্বেও নেমে আসে তবুও সেই বন্ধুটির সঙ্গে নির্ধারিত সম্পর্ক বজায় রেখে জীবনের চলার পথটিকে মসৃণ করে তোলা সম্ভব হবে।

এটি ছাড়াও বন্ধু অথবা বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশার ক্ষেত্রে যে বিষয়টিকে সর্বোচ্চ মাত্রায় গুরুত্ব প্রদান করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সেটি হলো– শিক্ষার্থীর মধ্যে নিহিত অহংবোধের মাত্রা। কোনো শিক্ষার্থীর মধ্যে যদি এই ধরনের নেতিবাচক বিশিষ্টতা লক্ষ করা যায় তবে তাকে সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়াই হবে বুুদ্ধিমানের কাজ। এই ধরনের শিক্ষার্থীদের জন্যে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যেটি, সেটি হলো– তারা না পারে অপরকে ভালোবাসবার মতো শ্রেষ্ঠ কাজটিতে নিজেদের যুক্ত রাখতে, একই সাথে তাকে যে কেউ ভালবাসবে এমন কোনো বন্ধু সৃষ্টি করতে। যে অহংবোধ নিজের আত্মসম্মান বজায় রাখবার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে সেই পরিমাণ অহংবোধ নিজের ভেতরে অটুট থাকা ইতিবাচক কিন্তু সেটি কখনোই যেন প্রকাশিত না হয় সে দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা পরোক্ষভাবে প্রতিভারই প্রদর্শন। সুখের অনুভূতি শুধু নিজের মধ্যে আবদ্ধ না রেখে যখন বিনিময় করা সম্ভব হবে তখন সেই সুখের পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পাবে। নিজেকে আড়ষ্ট রেখে আত্মতৃপ্তি অর্জনে অনুসন্ধিৎসু হলে তা খুব বেশি দূর পথ অতিক্রমে সেই ধরনের শিক্ষার্থীদের সহায়তা করতে পারবে না। পাশাপাশি চিন্তার প্রসার ঘটানো হয়ে উঠবে এক্ষেত্রে আরো দুরূহ। অর্থাৎ চিন্তা কিংবা অনুভূতির প্রসারতা ঘটানোর নেপথ্যে যে ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির অনাবিষ্কৃত পথটি আবিষ্কৃত হবার সম্ভাবনাকে প্রোজ্জ্বল করে তুলতে পারে সেটি আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। বাবলু নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করবার পরেও গ্রামে গিয়ে ঠিকই ও তার বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা করেছে সাবলীলভাবে। শুধু তাই নয়, তাদেরকে উৎসাহ প্রদান করেছে ওর অভিজ্ঞতা থেকে, যাতে করে তারাও তাদের জীবনকে দীপিত করে তুলতে পারে। অর্থাৎ বাবলুর চিন্তা সেই সময়ে একটি বিশাল সম্ভাবনার ইঙ্গিতকে স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছিলো এবং স্পর্শ করেছিলো বলেই যে ও ব্যক্তিগত জীবনে সফল হয়েছে তা দ্বিধাহীন চিত্তে ব্যক্ত করা যায়।

এছাড়াও শিক্ষার্থীদের যে বিষয়ে তাদের অনুভূতিকে প্রগাঢ় করা গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো, দেশের সীমানা পেরিয়ে গেলে একজন মানুষ তার পুরো দেশকে উপস্থাপন করে। সেক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষই যখন ন্যূনতম মূল্যবোধটি অর্জন করতে সক্ষম হয়ে উঠবে না, তখন সেই নির্দিষ্ট মানুষটির জন্যে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাটি প্রবল হয়ে উঠবে। সুতরাং শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্যই যে জাতীয় উন্নয়ন এবং জাতীয় মানের উৎকর্ষ সাধন – সেটি প্রতিটি শিক্ষার্থীদের হৃদাসনে গ্রন্থিত করা সম্ভব হলে তারা কখনোই ব্যক্তিগত স্বার্থ নিশ্চিতকরণে নিজেদের লক্ষ্যটিকে স্থির করবে না। আর অহংবোধ প্রদর্শনের বিষয়টি তখন আপনা আপনি নির্বাপিত হয়ে যাবে। তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থটির সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে জাতীয় স্বার্থের বিষয়টিও। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, মাশরাফি বিন মর্তুজার মতো একজন খ্যাতিমান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার জাতীয় দলের নেতৃত্ব দেবার পরেও তার বন্ধুদের সঙ্গে আজ অবধি সম্পর্কগুলো অটুট রেখেছেন। হয়ত তার কিছু বন্ধু তার তুলনায় যোগ্যতায় অনেক নিম্নে অবস্থান করছেন। কিন্তু সে দিকটিকে বিবেচনায় না নিয়ে তিনি বন্ধুত্বের বন্ধনটিকেই সর্বোচ্চ মাত্রায় গুরুত্ব প্রদান করে তার আকাশছোঁয়া ঔদার্যকেই প্রকাশ করেছেন। শুধু তাই নয়, তার মতো তার এলাকা থেকে যাতে আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেটার বেরিয়ে আসতে পারে সে জন্যে স্ব-উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেছেন ক্রিকেট অ্যাকাডেমি। মাশরাফির এই বিরল দৃষ্টান্ত কি আমাদের এই শিক্ষাই প্রদান করে না যে– বন্ধু বন্ধুই, হতে পারে সে সম্পদ কিংবা মেধাহীন, তাই বলে তার প্রতি অহমিকা প্রদর্শন কখনোই এবং কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। একই সাথে নিজে মেধাবী হয়ে যদি সেই মেধার স্ফুরণ সকলের মাঝে প্রকীর্ণ করবার মতো উৎফুল্ল অভিপ্রায় লক্ষিত না হয় তবে সত্যিকার অর্থেই সে শিক্ষার্থী অথবা ব্যক্তিটি প্রকৃত মেধাবী কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উত্থানের একটি যথেষ্ট অবকাশই থেকে যায়।

কোনো শিক্ষার্থী যদি সম্পদের অপ্রতুলতা কিংবা মেধাগত প্রাচুর্যের অভাবে অভাবিত কোনো শিক্ষার্থীকে দূরে ঠেলে দেয় তবে সেটি হবে সেই মেকি মেধাবী শিক্ষার্থীর জন্য চরম দুর্ভাগ্যজনক। এক্ষেত্রে মেধাবী বলতে কি বুঝায়, সেই বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা প্রদান করা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। মেধাবী আমরা তাকেই বলবো, যার মেধার প্রাখর্য শুধু খাতা কলমের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে সর্ব বিষয়ে তার ইতিবাচক আচরণকে প্রতিফলিত করবে। এক্ষেত্রে সেই মেকি মেধাবী শিক্ষার্থীদের এই বিষয়টি মনে রাখা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে এ কারণে যে- প্রতিটি শিশুই প্রতিভা নিয়ে এই বিশ্বচরাচরে আসে। কিন্তু নিয়তির কারণে সবার ক্ষেত্রে সেই প্রতিভার প্রোজ্জ্বলন ঘটানো সম্ভব নাও হতে পারে। এখন যে মেকি মেধাবী শিক্ষার্থীটি তার দাম্ভিকতাপূর্ণ আচরণ প্রদর্শন করছে তার ক্ষেত্রে যদি আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টি একজন আর্থিকভাবে দুর্বল শিক্ষার্থীর মতো হতো তবে তার ক্ষেত্রে কি একই পরিণতি হতে পারতো না? তাদের অবশ্যই এই বিষয়ের প্রতি মনোযোগী হওয়া জরুরি যে, তাদের এই নেতিবাচক আচরণটি প্রত্যক্ষ করে অনেক অসচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থী তাদের আত্মবিশ্বাসটুকু হারিয়ে ফেলে। পারিপার্শ্বিক অবস্থার দ্বারা তারা এতটাই প্রভাবিত হয় যে, উন্নত শিক্ষা গ্রহণে শিক্ষা সহায়ক সকল উপকরণ প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা তাদের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় যা তাদের মানসিক অবস্থা দেখে বিলক্ষণ উপলব্ধি করা যায়। একসময় প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির স্পষ্ট ব্যবধান প্রত্যক্ষ করবার মাধ্যমে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। পড়াশুনা পর্বের সমাপ্তি ঘটিয়ে অর্থ উপার্জনে আগ্রহী হয়। শৈশবে বেড়ে ওঠা স্বপ্নের সমাধি ঘটে মাঝপথেই। মনের মধ্যে সৃষ্টি হয় এক ধরনের অস্থিরতা যা বয়ে বেড়াতে হয় জীবনের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত। আর এভাবেই হাজার হাজার প্রতিভাবান শিক্ষার্থী অকালেই ঝরে পড়ছে। তবে এসব প্রতিবন্ধকতার চার দেয়ালের মাঝে আবদ্ধ শিক্ষার্থীদের উত্তরণের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি সর্বোচ্চ ইতিবাচক প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে পারে সেটি হলো-পাঠ এবং একমাত্র পাঠের মাধ্যমেই পাঠ্যপুস্তকের সাথে মিতালি গড়ে তোলা। একই সঙ্গে তার প্রতিভার স্ফুরণ ঘটানোর জন্যেই অতিরিক্ত হিসেবে যদি সে তার নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগার থেকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃত বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠে উৎসাহী হয় তাহলে তার যে মেধাটির কথা উল্লেখ করা হলো সেই মেধাটিকে পরিচর্যা করে অগ্রগামী করবার একটি বিশেষ উপাদানও সে লভিত হবে যা তার জ্ঞানান্বেষণের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলকের কাজ করবে। এক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগার আছে কিনা, থাকলেও শিক্ষার্থী নিশ্চিত করবার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় কিনা সে বিষয়টি অবশ্য বিবেচ্য।

একজন শিক্ষার্থী, তার ভেতরে যত ধরনেরই সীমাবদ্ধতা থাকুক না কেন, যদি সেই শিক্ষার্থীটি অধ্যয়নের প্রতি নিজেকে সমর্পণ করতে সক্ষম হয় তবে কোন প্রতিবন্ধকতাই তার সাফল্য নিশ্চিতির ক্ষেত্রে বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়াতে পারে না। হয়ত সাময়িক সময়ের জন্যে তার কাছে অপ্রাপ্তির বিষয়গুলো তাকে পীড়িত করতে থাকে। কিন্তু যে মুহূর্তেই সে পড়ার টেবিলে বসে পড়ে, সেই মুহূর্ত থেকেই রাজ্যের সকল অমানিশাকে বিদায় জানিয়ে আপনা আপনিই সে আলোর পথে যাত্রা করতে শুরু করে। আমাদেরই চারপাশে আমরা যদি আমাদের দৃষ্টিগুলোকে প্রক্ষিপ্ত করি তাহলে খুব সহজেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হবো যে, প্রত্যন্ত গ্রামের অনেক শিক্ষার্থীই সকল সীমাবদ্ধতাকে জয় করে সাফল্যের শীর্ষ পর্যায়ে নিজেদের অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হচ্ছে। এক্ষেত্রে অভিভাবকবৃন্দ যদি তাদের সন্তানদের পড়াশুনা থেকে নিবৃত্ত রাখেন সেক্ষেত্রে করবার কিছুই থাকবে না। কিন্তু খুব কম অভিভাবকই বর্তমান সময়ে খুঁজে পাওয়া যাবে যারা তাদের সন্তানদের পড়াশুনার প্রতি প্রবল আগ্রহটি প্রত্যক্ষ করবার পর তাকে পড়াশুনা থেকে বিরত রাখবার মতো অমানবিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন। এক্ষেত্রে অবশ্যই প্রকৃত শিক্ষক এই ধরনের মেধাবী শিক্ষার্থীর মেধার বীজটির উদগমনে প্রাণান্ত প্রচেষ্টাটিও গ্রহণ করে থাকেন-যা সবসময়ই প্রত্যক্ষ করা যায়। তবে পুনরায় যেটি বলতে হয় সেটি হলো-একজন শিক্ষার্থীর শারীরিক, মানসিক থেকে শুরু করে তার পরিবারে যত ধরনের সীমাবদ্ধতাই থাকুক না কেন, যদি সেই শিক্ষার্থী শিক্ষা অর্জন করবার প্রবল আগ্রহটিকে তার বোধজুড়ে দৃঢ়ভাবে গ্রন্থিত করতে সক্ষম হয় তবে অবশ্যই সে সকল নেতিবাচক আবহগুলোকে তার বুদ্ধিদীপ্ত আচরণের মাধ্যমে ইতিবাচক হিসেবে সৃষ্টি করে নিতে সক্ষম হয়ে উঠবে। মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে বাবলু যখন উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলো যে, ওর পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া সম্ভব তখন বাবামাকে ঠিকই সম্মত করিয়েছিলো ও। যদিও গ্রামের সবাই ওকে স্থানীয় ডিগ্রি কলেজে ভর্তির পরামর্শ প্রদান করেছিলেন।

শিক্ষকতা জীবনে আমার সৌভাগ্য হয়েছিলো এমন একজন শিক্ষার্থীর সান্নিধ্য প্রাপ্তির। যে শিক্ষার্থীটিকে তার শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজনে সম্মুখীন হতে হয়েছিল এক সীমাহীন বাধার। ওর নাম জাকারিয়া। বাড়ী নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলায়। কোনো এক প্রশান্ত বিকেলে স্বাভাবিকভাবেই ক্রিকেট খেলায় নিমগ্ন ছিলো জাকারিয়া। কিন্তু, হঠাৎ বলের আঘাতে ওর কোমল দুটি চোখ প্রচণ্ডভাবে আহত হয়েছিল। চোখ থেকে যখন রক্ত ঝরছিল তখন কেউ ভাবতেও পারেনি আঘাতের মাত্রা এতটা প্রকট আকার ধারণ করবে। পরদিনই সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠে যখন ও অনুধাবন করেছিলো চোখ দুটি পুুরোপুরি দৃষ্টিশূণ্য, তখন কথা বলবার জন্য একটি শব্দ যে উচ্চারণ করবে সেই সামর্থ্যটুকু হারিয়ে ফেলেছিলো। পিতৃহীন পরিবার পড়েছিলো মহাসংকটে। তবুও গ্রামবাসীর সহযোগিতা ও নিজেদের সামর্থ্যরে সবটুকু উজাড় করে রংপুর, ঢাকা এবং সর্বশেষ ভারতের চেন্নাইয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করে চোখের আলো ফিরে পাবার ইচ্ছেটুকু বাঁচিয়ে রাখবার প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়েছিলো জাকারিয়া। জাকারিয়া খুব আপন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলো চিরচেনা সেই প্রকা- মাঠ, শিশির ভেজা ঘাস, পুকুর আর প্রকৃতির বৈচিত্র্যের রঙে সাজানো ওর নিজ গ্রামে নিজেকেই নতুন করে ঐ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যলীলার একটি অংশ করে নিতে। কিন্তু, শত প্রচেষ্টায়ও সেই স্বপ্ন সার্থক রূপ লাভ করে নি। অহর্নিশ অশ্রুসিক্ত কিশোর জাকারিয়া অবশেষে মেনে নিয়েছিলো সেই শাশ্বত নিয়তিকে।

অতঃপর ভর্তি হয়েছিলো লালমনিরহাট আর.ডি.আর.এস কর্তৃক পরিচালিত ব্রেইল স্কুলে। সে স্কুল থেকে অত্যন্ত নিষ্ঠা, ধৈর্য এবং শিক্ষা গ্রহণের প্রবল আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে দৃষ্টিহীন হয়েও ও এত ভালো ফল অর্জন করেছিলো যে, সেই ফলাফল ও মেধার ওপর ভিত্তি করে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ লাভ করেছিলো। কিন্তু সনদ জটিলতার কারণে যখন ও ওর কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে নি, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে শুরু করে ছুটে গিয়েছিলো শিক্ষামন্ত্রীর দপ্তর পর্যন্ত। অবশেষে ব্যর্থ হয়ে ভর্তি হয়েছিলো লালমনিরহাট সরকারি কলেজে। যতদিনই ক্লাস নিয়েছি ততদিনই প্রত্যক্ষ করেছি, ও প্রথম বেঞ্চে বসে পাঠ গ্রহণ করেছিলো। শুধু এতটুকু প্রচেষ্টার মাঝেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে নি ও। যখনই, যে বিষয়েই সমস্যায় পড়তো, হয় দেখা করতো, নয়তো ফোন করে জানবার চেষ্টা করতো সমস্যা সমাধানের। ওর এই প্রচণ্ড আগ্রহটি প্রত্যক্ষ করবার পর একদিন ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। আচ্ছা জাকারিয়া, তুমি এত উদ্দীপনা পাও কোথা থেকে? উত্তরে ও বলেছিলো– স্যার, যেদিন চেন্নাইয়ের শংকর নেত্রালয় হসপিটালের চিকিৎসকবৃন্দ আমাকে বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর সৌন্দর্য উপভোগের সামর্থ্য তোমার চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে গেছে’ সেদিনই আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ‘আমার মনের মধ্যে প্রোথিত আলোকে আমি এমন মাত্রায় প্রজ্বলিত করবো, যে আলো দ্বারা পৃথিবীকে স্বাভাবিকের তুলনায় অধিক পরিমাণে প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হবো।’ তারপর ও চূড়ান্ত পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করলো আর আমার স্মৃতিতে নিজেকে এমনভাবে প্রতিস্থাপন করে গেলো যা আজ অবধি প্রাণপূর্ণ রয়ে গেছে। যখনই জাকারিয়ার কথা মনে পড়ে তখনই নিজেকে সামলাতে পারি না, ভীষণভাবে আবেগতাড়িত হয়ে পড়ি। আপনা আপনি আমার শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরা নবরূপে উদ্দীপিত হয়ে ওঠে। শ্রেণিকক্ষে অবলীলায় ওকে উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করি অজস্র শিক্ষার্থীদের সম্মুখে। তারা যেন জাকারিয়ার মতো শত সীমাবদ্ধতায় বেষ্টিত থেকেও প্রত্যয়ী হয় সাফল্যকে নিশ্চিত করতে।

আলোচনার শেষ সীমায় এসে এটিই সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবী রাখে যে, কোনো শিক্ষার্থী যখন তার মানসিক শক্তির কাঠামোটিকে শিক্ষা গ্রহণের জন্যে প্রবলভাবে শক্ত রাখতে সক্ষম হবে তখন কোনো বাধাই তার সামনে বাধা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারবে না। অতীতের দিকে তাকালে আমরা খুব সহজেই দেখতে পাই যে, হিউয়েন সাঙ, মার্কো পেলো, ইবনে বতুতা, ফার্দিনান্দ ম্যাগেলান, জেমস কুক এবং রোল্ড আমুন্ডসেনসহ অনেক পরিব্রাজক এবং অভিযাত্রীবৃন্দ তাঁদের দীর্ঘ জীবনটিকে জ্ঞান অর্জন এবং দেশ পরিভ্রমণের নির্মোহ আকর্ষণে উৎসর্গ করবার মাধ্যমে সভ্যতাকে করে গেছেন ঋদ্ধ থেকে ঋদ্ধতর। এমনকি বর্তমান সময়ে তরুণ বিজ্ঞানীরা মঙ্গলগ্রহে দিনের পর দিন অবস্থান করছেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাসের স্বপ্ন দেখছেন। শত প্রতিকূলতার মাঝেও পৃথিবীর বহু রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, দার্শনিক এবং অভিযাত্রীবৃন্দ নিজেদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যটিকে স্পর্শ করবার নিমিত্তে লড়াই করে চলেছেন। পৃথিবী স্থিতিশীল হয়ে উঠবে সবসময়ের জন্যে– এটিই তাদের সমন্বিত প্রত্যাশা। আমাদের দেশের তরুণরাও যদি সেই বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের জীবনে ঘটে যাওয়া আখ্যানগুলো পর্যালোচনা করে তাদের নিজের জীবনে প্রতিফলনের জন্যে ন্যূনতম প্রচেষ্টাকে অক্ষুণ্ণ রাখবার প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় আগ্রহান্বিত হয়, তাহলে তারুণ্যের যে অদম্য শক্তির উৎকর্ষ, সেই উৎকর্ষ নিশ্চিত করবার ক্ষেত্রে যত দীর্ঘ দেয়ালই তৈরি হোক না কেন, তা ডিঙিয়ে সাফল্যের শীর্ষ চূড়ায় অধিষ্ঠিত হওয়া কখনোই অসম্ভব হিসেবে বিবেচিত হবে না।

তথ্যসূত্র:

১. Francis Bacon, Ramji Lall 2011, Selected Essays, Friends Book Corner | Dhaka | Page No 74 |

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu