মনোজিৎকুমার দাস
লালন রবীন্দ্র স্মৃতি বিজড়িত বহমান গড়াই নদীর তীরে কুষ্টিয়া শহরের কোটপাড়াস্থ মাতুলালয়ে ৪ নভেম্বর ১৯৪৭ সালে মনোজিৎকুমার দাসের জন্ম । পৈত্রিক নিবাস মাগুরা জেলার শ্ৰীপুর উপজেলার হানু নদী পাড়স্থ মাশালিয়া গ্রামে। ১৯৬৭ সালে তিনি মাইকেল মধুসূদন কলেজ থেকে স্নাতক ও ১৯৭০ সালে রাজশাহী শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয় থেকে বি.এড. ডিগ্রি লাভ করেন। পিতা-মোহিতকুমার দাস, মাতা-দুর্গা রাণী দাস।
মনোজিৎকুমার দাস

স্টুয়ার্ট ক্যামিন্সকির গল্প: জ্যাসন সাইকসের রহস্যাবৃত খুন

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

স্টুয়ার্ট এম. ক্যামিন্সকি (১৯৩৪-২০০৯) একজন প্রখ্যাত আমেরিকান মিস্টিরিয়াস স্টোরি ও নভেল লেখক। রহস্য গল্প ও উপন্যাস, ফিল্ম স্টোরির লেখক হিসাবে তাঁর খ্যাতি বিশ্বজোড়া। ইংরেজি ভাষায় তাঁর লেখা একটি গোয়েন্দা কাহিনিকে ‘জ্যাসন সাইকসের রহস্যাবৃত খুন’ নামে বঙ্গানুবাদ করা হলো।


চারদিক অন্ধকারে ঘেরা। আমি কিছুই দেখতে পারছিলাম না, কিন্তু আমাকে উদ্দেশ্য করে এডলফ হিটলার সম্বন্ধে কাকে যেন চিৎকার করতে শুনলাম। আমি চোখ খুললাম। কিন্তু আমি কাউকেই দেখতে পেলাম না। আতঙ্কের মধ্যে থাকলেও বুঝতে পারলাম, আমি কোথায় আছি। জ্যাকেট দিয়ে মাথাটা ঢেকে ওখান থেকে বের হয়ে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিলাম। আমি বুঝতে পারলাম আমি কোথায় আছি, আমি কে এবং আমি সেখানে কী করছিলাম।

লস এঞ্জেলসের ১৯৩৮-এর ফেব্রুয়ারির ঠান্ডার এক রাত। আমি টোবি পিটারস, একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। শহরের বাইরে থেকে মৃত্যুর হুমকি আসা একজন সিনেমা ডিরেক্টর মিস্টার ডি.ডবলু. গ্রিফিথকে চোখে চোখে রাখার জন্য আমাকে নিয়োগ করা হয়েছে। কোনো সমস্যার উদ্ভব ঘটলে তিনি যেব কোনো প্রকার অসুবিধায় না পড়েন সে জন্য সার্বক্ষণিক ভাবে তাকে পাহাড়া দিতে হবে আমাকে। আমাকে দিনে পনের ডলার দেয়া হবে।

আমি জ্যাকেট খুলে বিছানায় বিশ্রাম করতে যাবার সময় সাউদার্ন রেডিওতে মুন সং গাইছিলেন জিনেট ম্যাকডোনাল্ড । আমি বিছানা থেকে উঠার সময় ফুয়েরার হিটলার নিজেকে ন্যাশনাল ডিফেন্সের চিফ এবং এভিয়েশনের মিনিস্টার হারম্যান উইহেম গোয়েরিংকে ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত করার ঘোষণা দেবার খবর রেডিওতে শুনতে পেলাম। আমি উঠে দাঁড়ানো মাত্র ডি.ডবলু. গ্রিফিথকে দরজা খুলে এগিয়ে আসতে দেখলাম।

‘মি. পিটারস!’, তিনি গুরুগম্ভীর কণ্ঠে আমার নামটা উচ্চারণ করতে করতে পিঠ সোজা করে রুমের মধ্যে ঢুকলেন।

আমি বললাম, ‘খবর শুনছিলাম।’

আমার কথা শুনে গ্রিফিথ আমার দিকে তাকালেন। তার উচ্চতা পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি, আমার চেয়ে দুএক ইঞ্চি বেশি। আমার অনুমান তার ওজন ১৮০ পাউন্ডের মতো। আমার চেয়ে বিশ পাউন্ড বেশি হবে হয়তো। আমার বয়স একচল্লিশ, আর তার ষাটের বেশি। তার পরনের কালো স্যুটের উপর একটা সাদা জামা আর গলায় কালো টাই।

‘আপনাকে আমার কিছু বলার আছে।’ গ্রিফিথ বললেন। তার কথা শুনে আমি বিরক্ত হলাম।

‘আপনি ওখানে ছিলেন না!’ গ্রিফিথ আবেগপ্রবণ কণ্ঠে বললেন। ‘সামান্য ব্যাপারে একটা লোক খুন হয়েছে।’

‘খুন! কে খুন হয়েছে?’ আমি বারবার তাকে প্রশ্ন করলাম।

তিনি তার কন্ঠস্বর নিম্নগ্রামে নামিয়ে এনে পরিষ্কার ভাবে বললেন, ‘বসে না থেকে আপনি কাজে লেগে পড়ুন। একজন মানুষ খুন হয়েছে, তার কুলকিনারা করুন।’

‘পুলিশকে ডাকুন।’ আমি তাকে স্পষ্ট বললাম।

‘আপনি হয়তো জানেন শহর থেকে বেশ দূরে আমরা থাকি।’ তিনি আমাকে মনে করে দিলেন। ‘শহরের পুলিশদের ফোন করা হয়েছে, কিন্তু তাদের আসতে কিছুটা দেরি হবে।’

শহরের পুলিশদের সাথে এক সময় আমি সম্পৃক্ত ছিলাম।

‘কে খুন হয়েছে?’ আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম।

‘ভোর হবার পর থেকে প্রত্যেকই একই প্রশ্ন করে যাচ্ছে।’

গ্রিফিথ বললেন, ‘ভিকটিমের নাম হচ্ছে জ্যাসন সাইকস। গলায় ছুরিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে ডিনার টেবিলে পাওয়া যায়।’

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে তাকে খুন করেছে?’

‘আমি বলতে ভয় পাচ্ছি, তবুও বলছি এ খুনের একটা রহস্য আছে।’ গ্রিফিথ বললেন। ‘চলুন আমরা স্পটে যাই।’

দরজা দিয়ে বের হবার সময় আমার মনে হলো আমাকে একটা কাজের জন্য নিয়োগ করলেও আমাকে কিন্তু দুটো কাজে হাত লাগতে হবে। আমি বুঝতে পারলাম গ্রিফিথ এ খুনের হত্যাকারীকে খুঁজে বের করার জন্যে আমাকে গোয়েন্দা হিসাবে নিয়োগ করতে চাচ্ছেন। আমি তাকে বলতে চাইলাম যে আপনাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছে। খুনিদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়নি। খুনিদের খুঁজে বের করার জন্য আমার ডবল টাইম লাগবে।

সান দিয়াগো থেকে তিরিশ মাইল উত্তরে ক্যালিফোর্নিয়া উপকূলে আমরা কোর্টিস নামে একজন প্রোডিউসারের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

গ্রিফিথ আশা করেছিলেন যে কোর্টিস তাকে একটা কাজ দেবেন। কোর্টিস একজন নাম করা প্রোডিউসার। তিনি দু’জনকে ম্যানেজ করেন, তাদের মধ্যে ডোল্লার্ড নামে একজন কৌতুক অভিনেতা, আরেকজন অর্থের যোগানদার জ্যাসন সাইকস।

ডি. ডবলু গ্রিফিথ তার যুবতী স্ত্রী কেন্টাকিকে লস এঞ্জেলেসের রুজভেল্ট হোটেলে রেখে এসেছিলেন। গ্রিফিথের মার্সিডিস চড়ে চলার পথে গ্রিফিথের সাথে ড্রিঙ্কস করার জন্য আমরা দু’বার থামলাম। গাড়িতে বসে গ্রিফিথ কেন্টাকি ও তার বাবা মা এর কথা বলেছিলেন। তারা কখনো তার তৈরি একটা ছবিও দেখেনি। তিনি বললেন, ‘তার মা সিনেমাকে ভাল চোখে দেখেন না।’

গ্রিফিথ তার যৌবনকালে অভিনেতা, প্লে রাইটার, বক্সার, রিপোর্টার এবং কন্সট্রাকশন এর মতো দুঃসাহসিক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কথা বলতে থাকলেন। আমরা দশ মিনিট আগেই সেখানে পৌঁছালাম। পৌঁছানোর আগে তিনি আর কোনো কথা বললেন না। আমরা নীরবে কোর্টিসের বাড়ির নিচের তলার সিঁড়ির দিকে গেলাম। তারপর এক সময় আমরা ডাইনিংরুমের দিকে পা বাড়ালাম। সুন্দর পোশাক পরা পাঁচজন ডিনার পরিবেশককে আমরা সেখানে দেখতে পেলাম। তাদের মধ্যে একজনের হাতে সালাদের প্লেট। তার পিঠের সাথে একটা ছুরি বাঁধা।

আমরা ভেতরে ঢুকলে ডিনার পরিবেশকরা আমাদের দিকে তাকাল। কোর্টিসের বয়স পঞ্চাশ বছরের মতো, চোখে হ্যারড এললয়েড-এর চশমা। তিনি প্রায়ই চশমার ভেতর দিয়ে কটমট চোখে তাকিয়ে থাকেন। তিনি তার মৃত গেস্টের দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে ছিলেন। আমরা সেখানে পৌঁছালে তিনি আমাদের দিকে চোখ ফেরালেন। মৃত লোকটির এক পাশে মিস ডেনিস গিলস নামের একজন মহিলা দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি রোগাপাতলা চেহারার একজন সুন্দরী মহিলা। মৃত মানুষটির অন্যপাশে জেমস ভ্যান নামের একজন অভিনেতাকে দেখা গেল। তাকে দেখে মনে হলো, লোকটা রাস্তার পাশে মিউজিক্যাল শো করেন। লোকটাকে বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল। তিনি যেন কাউকে খুঁজছিলেন। গ্রিফিথ মৃতদেহটির দিকে হতবুদ্ধিকর দৃষ্টিতে তাকালেন। লিউ ডোল্লার্ড মৃতদেহটির বিপরীত দিকে বসে ছিলেন। আমি লিউ ডোল্লার্ডকে আগে থেকেই চিনতাম। কোর্টিসের দলের প্রথম সারির অভিনেতা কোঁকড়ানো চুলওয়ালা কমেডিয়ান লিউ ডোল্লার্ড।

কোর্টিস একবার মৃতদেহটির দিকে তাকিয়েই চকিতে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আমাকে বললেন, ‘আপনি একজন ডিটেক্টটিভ, ফ্লিমের লোক নন!’

‘হ্যাঁ, আমি একজন ডিটেক্টিভ।’, আমি বললাম।

নিউইয়র্কের রাস্তায় কমিক প্রদর্শনকারী ডোল্লার্ড আমার দিকে তাকিয়ে দেতো হাসি হাসল।

আমি ডোল্লার্ডের একটা সিনেমা দেখেছিলাম। তিনি কিন্তু তার ছবিটিতে মজার কিছু দেখাতে পারেননি।

ফিল্মি স্টাইলের একটা খুন হয়েছে! আমি মিস ডেনিস গিলসের দিকে তাকিয়ে তার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলাম, আর সেই সময়ই গোঙানীর শব্দ শুনতে পেলাম। সাইকস যেখানে বসেছিল সেদিকে তাকালাম। গ্রিফিথ তার হাতের তালু মৃতদেহটা দিকে বাড়িয়ে কথা বলছিলেন।

আমরা সবাই সাইকসের মৃতদেহটির দিকে তাকালাম। তার মুখে তখনও সালাদ লেগে ছিল।

‘যা যা ঘটেছে তা কে কে দেখেছিল?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম। তারা সবাই লাশের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে একে অপরের দিকে তাকাল।

‘একজন পুরুষ মানুষ প্রকাশ্যে টেবিলে খুন হলো কিন্তু আপনারা তা কেউই দেখলেন না, এটা বিশ্বাস করতে কিন্তু আমার অবাক লাগছে!’ আমি জিজ্ঞেস করলাম,‘ আপনাদের মধ্যে কে দাঁড়িয়ে ছিলেন?’

‘কেউই না।’, ভ্যান নামের অভিনেতাটি ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন।

রুমে কোনো জানালা নেই। মৃত লোকটার মুখোমুখি একটা মাত্র দরজা। ডান দিকে আর একটা দরজা। কোনো দরজা দিয়ে বাইরে থেকে তার পিঠে ছুরি মারা সম্ভব না।

‘কেন আমরা লিভিংরুমে যাচ্ছি না?’ কোর্টিস উঠে দাঁড়িয়ে মৃতদেহটার দিকে এক নজর তাকিয়ে বললেন। ‘আমি মিসেস উন্ডলেসের সাথে কথা বলতে পারি।’

‘আপনি বসুন।’, আমি জিজ্ঞেস করলাম। ‘মিসেস উন্ডলেস কে?’

‘হাউসকিপার ও কুক।’ কোর্টিস জবাবে বললেন। ‘সাইকস খুন হবার সময় মহিলাটি কি এখানে ছিলেন?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

আমি চারদিকে তাকালাম। কারও মুখে কোনো কথা নেই!

‘আপনারা কেউ কি সাইকস খুন হবার আগে রুম থেকে চলে গিয়েছিলেন?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘শুধুমাত্র গ্রিফিথ চলে গিয়েছিলেন।’ ভ্যান বললেন।

‘পুলিশ না আসা পর্যন্ত আমরা এখানেই থাকব। কারও টয়লেটে যাবার প্রয়োজন হলে আমি সঙ্গে যাব।’ তাদের কথা মতো আমি মিস ডেনিস গিলস নামের একজনকে খুঁজতে থাকলাম। কিন্তু আমি তাকে দেখতে পেলাম না।

‘আপনি কি ভাবছেন?’ ডোল্লার্ড তার চোখদুটো উল্টিয়ে বললেন।

‘সাইকস কে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম। ‘একজন গুরুত্বপূর্ণ লোক।’ গ্রিফিথ জবাবে বললেন। ‘অর্থের যোগানদার।’ কোর্টিস বললেন। ‘তিনি ডি.ডবলু. গ্রিফিথকে একটা সিনেমা করার জন্য অর্থ দেবার কথা ভাবছিলেন। তার সিনেমাটির প্রডিউসার হবার কথা ছিল আমার।’

‘কাদের স্টার হবার কথা ছিল?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘ভ্যান ও মিস ডেনিস গিলসকে স্টার হবার কথা ছিল।’ কোর্টিস জবাবে বললেন।

‘কখনোই না।’ গ্রিফিথ প্রতিবাদ করলেন।

‘আপনিই পছন্দ করেছিলেন।’ কোর্টিস চিৎকার করে বলে উঠলেন।

গ্রিফিথ দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি জানতাম মৃত সাইকসের কোনো পুঁজি বিনিয়োগ করার ইচ্ছে ছিল না। তিনি ছিলেন অপেক্ষাকৃত কম বন্ধু ভাবাপন্ন । তবে সাইকস কিছু ঋণের কথাও বলেছিলেন। আজ রাতে তিনি তার ধার পরিশোধ করতে চেয়েছিলেন।’

‘আপনি কি পুনরায় তাকে কল করেছিলেন?’ কোর্টিস তার মাথা ঝাঁকিয়ে গ্রিফিথকে জিজ্ঞেস করলেন।

গ্রিফিথ আমতা আমতা করলে ডোল্লার্ড মুখে যা এলো তাই বলে এসময় থামলেন।

‘একটা ভেজিটেবল স্টিক খান।’ আমি ডোল্লার্ডের কথা শুনে তাকে পরামর্শ দিলাম।

ডোল্লার্ড অস্ফুটস্বরে বললেন,‘ভেজিটেবল স্টিক আমি খেতে চাই না।’

‘ঠিক আছে আমি আপনাকে ভেজিটেবল স্টিক খেতে বলছি না।’ আমি তাকে বললাম।

ডোল্লার্ডের জন্য এটা ছিল বেশি বলা। তিনি দাঁড়িয়ে পড়ে তার চেয়ারটাতে ধাক্কা মারলেন।

‘এখন আমাকে নিয়ে মজা করার কী আছি!’ ডেল্লার্ড বললেন।

তিনি চারদিকে তাকিয়ে কাউকে যেন খুঁজছিলেন।

‘সবচেয়ে সহনুভূতিশীল মানুষ ছিলেন সাইকস, আর তিনিই মারা গেলেন।’ কোর্টিস বললেন।

‘রুমের মধ্যে একজন সালাদ মুখে দেয়া অবস্থায় তাকে খুন করা হয়েছে।’ আমি তাদেরকে মনে করিয়ে দিলাম।

আর ঠিক সেই সময় পেছনের দরজা শব্দ করে খুলে গেল। আমি সেদিকে তাকিয়ে কালো পোশাক পরা একজন মহিলাকে দেখতে পেলাম।

কালো পোশাক পরা মিসেস উন্ডলেস প্রথমবারের মতো সাইকসের মৃতদেহ দেখে বলে উঠলেন, ‘ওহ মাই গড!’ তিনি চিৎকার করে উঠে বললেন। ‘লোকটা মৃত।’

‘সত্যি?’ ডোল্লার্ড লাফ দিয়ে বলে উঠলেন। ‘কে তাকে খুন করেছে?’

কোর্টিস চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘এটা একটা মারাত্মক খুন!’

‘আমরা জানি সাইকস এখন মৃত, মিসেস উন্ডলেস।’ কোর্টিস বললেন। ‘পুলিশ এখন পথিমধ্যে আছে। আপনাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে।’

‘কী ঘটেছিল?’ মিসেস উন্ডলেস তার সাইকসের লাশের দিকে চোখ নিবদ্ধ করে উচ্চকন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন। ‘তাকে কে খুন করেছে? আমি খুনির সঙ্গে থাকতে চাই না।’

‘আপনি খুনির সঙ্গে থাকতে চান না?’ ডোল্লার্ড জিজ্ঞেস করল। ‘আপনি কি মনে করেন আমরা তাকে খুন করেছি!’

ডোল্লার্ড তার চোখ বন্ধ করতে যাবার আগেই মিসেস উন্ডলেস তার মুখে মদ ছুঁড়ে মারলেন। চকিতে ডোল্লার্ড দাঁড়িয়ে পড়ে একটা ন্যাপকিন টেনে নিয়ে মুখটা মুছলেন। গোলাপী রঙের অশ্রুবিন্দু তার চিবুকদ্বয় গড়িয়ে পড়ল।

তিনি তার হাতের ন্যাপকিন দিয়ে তার চোখ দুটো মুছলেন।

ডি. ডবলু. গ্রিফিথ উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে নির্দেশ করে বললেন, ‘মিসেস উন্ডলেস, আপনি যাবার আগে আমার ড্রাইভার মি. রেনোল্ডসকে বলে যাবেন যে মি. পিটার ও আমার যেতে দেরি হবে। মি. ডোল্লার্ড আপনি বসে আপনার মুখটা পরিষ্কার করুন। পিটারস খুনের তদন্ত চালিয়ে যাবেন।’

এবার ভ্যান উঠে দাঁড়িয়ে তার চেয়ারটা লাথি মেরে ফেলে দিলে গ্রিফিথ তাকে মোকাবিলা করার জন্যে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারা সামনাসামনি দাঁড়িয়ে আছেন। ভ্যান প্রায় তিরিশ বছর বয়সী তরুণ হলেও কিন্তু গ্রিফিথ পিছিয়ে গেলেন না।

‘আপনি আমাদেরকে বলেননি কী করার আছে। আপনি কাউকেই বলেননি কী করার আছে।’ ভ্যান রাগান্বিত কন্ঠে বারবার বললেন।

গ্রিফিথ ফিসফিস করে বললেন, ‘আমি এসবের মধ্যে অল্পস্বল্প সম্পৃক্ত।’

‘দেখুন, দেখুন…’ ডোল্লার্ড তার হাতের ফর্ক দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে তাক করে বললেন। ‘প্রত্যেকেই ভাঁড়।’

আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আবার উঠে দাঁড়িয়ে ভ্যান ও গ্রিফিথএর উদ্দেশ্যে বললাম, ‘বসে পড়ুন, বসে পড়ুন।’

রুমটা নীরব হয়ে গেল। আমার ধাতানি খেয়ে তাদের উত্তেজিত চেহারা শান্ত হলো। তারা বসে পড়ল আর মিসেস উন্ডলেস রুম ছেড়ে চলে গেল।

‘কে পুলিশকে তলব করেছেন?’ আমি জানতে চাইলাম।

‘আমি করেছি।’ কোর্টিস বললেন।

‘গ্রিফিথ ছাড়া অন্য কাউকেই রুম ত্যাগ করা কি উচিত হবে?’ আমি বললাম।

‘দরজার বাইরে থেকে আমাকে ফোন করতে সবাই দেখেছে। আমি দরজা খোলা রেখেই গিয়েছিলাম।’ কোর্টিস বললেন।

‘কেন আপনারা একে অপরকে অভিযুক্ত করে আতঙ্ক ছড়াতে শুরু করছেন?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘আমরা ভাবলাম এটা জ্যাসন সাইকসের প্রাক্টিক্যাল জোকস।’ ডেনিস গিলস বললেন। ‘তিনি প্রাক্টিক্যাল জোকস করতে ভালবাসতেন।’

‘রবারের দাঁত, স্যুপে দোয়াতের কালি আনন্দের ইঙ্গিতবাহী।’ ডোল্লার্ড দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন। ‘একজন সৌখিন কৌতুক অভিনেতা একদা লাঞ্চ করার সময় বিষ খেয়ে ফেলেছিল।’

‘ডোল্লার্ড লিউ’, কোর্টিস চিৎকার করে বলে উঠলেন। ‘আপনি একটু থামুন।’

‘আপনারা সবাই সঠিক,’ আমি বললাম। ‘তবে আপনাদের কেউই সাইকসকে পছন্দ করতেন না, তাই তো?’

‘ঠিক তাই।’ কোর্টিস বললেন, ‘আমাদের মাঝ থেকে কেউই তাকে খুন করেনি। আমরা কখনোই কি তাকে খুন করতে পারি?’

তবুও গ্রিফিথ বললেন, ‘আপনাদের ভেতর থেকে একজন সাইকসকে খুন করেছে।’

ডোল্লার্ড উঠে দাঁড়িয়ে কোণার দিকে থাকা রেডিওটাকে অন করলেন। আমরা রেডিও শুনতে লাগলাম আর সাইকসের মৃতদেহটা দেখতে থাকলাম।

ডোল্লার্ডও খবর শুনছিলেন, আমরা রেডিও এর খবর থেকে জানতে পারলাম যে হিরোহিতো ঠান্ডায় আক্রান্ত হয়েছেন তবে এখন অপেক্ষাকৃত ভাল। মিশরের কিং ফারুক সবেমাত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন, লিওপোল্ড স্টোকোস্কি ইতালির পথে রয়েছেন কারো সাথে মিলিত হবার জন্যে, সম্ভবত সফর করতে গিয়ে গ্রেটা গার্বো ও আলবার্ট বারোজসকে ইলিনয়ের ব্লুমিংটনের একটা হোটেল রুমে আঁধা অচেতন অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়। মটরসুটির খোলা ক্যানে রুমটা ভর্তি ছিল। আলবার্ট বারোজ এ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভারকে বলেছিলেন হোটেলের রুমের ভাড়া নগদে ৭৭,০০০ ডলার দিলেও তিনি নয় দিন মটরসুটি খেয়েই কাটিয়েছিলেন।

আমার মনে হলো পার্টি শুরুতেই পণ্ড হয়ে যেতে পারে সম্ভবত তাই ডিনারের সময় সাইকসের মৃতদেহের কথা উল্লেখ করা হয়নি।

‘আমি রুম ত্যাগ করে বাইরে যাবার সময় মি. সাইকসের গলায় একটা ছুরি দেখেছিলাম, সেটা তার পিঠে বিদ্ধ ছিল না। সাইকসের গলায় বিদ্ধ ছুরিটা ছিল অন্য ধরনের ছুরি।’ গ্রিফিথ বললেন, ‘আপনার কাছে হয়তো তিনটা কিংবা তারো বেশি ছুরি ছিল, ডি.ডবলু. গ্রিফিথ।’ ডোল্লার্ড হেসে বললেন। আমার চোখ দুটো গ্রিফিথের দিকে নিবদ্ধ হলো। আমার মনে হলো ওই মুহূর্তে গ্রিফিথের মনে ভাবনা দেখা গেল।

সাইকস কৌতুক করার জন্য নিজের গলায় ছুরিটা বসিয়ে হাসছিলেন। আপনারাও তা দেখে সবাই হাসছিলেন, সম্ভবত কোর্টিস তার পেছনে ছিলেন, আর সে সময় প্রকৃত ছুরি ঠাট্টাচ্ছলে তার পিঠে বসিয়ে দিলেন, যার পরিণতিতে তার মৃত্যু ঘটল। আপনারা সবাই ছিলেন। আপনাদের মধ্যে একজনই এটা করেছিলেন। আপনারা সবাই সন্দেহের তালিকায় আছেন। সম্ভবত আপনাদের অর্থের যোগানদার সেলিব্রেটিকে নিঃশেষ করার জন্য অন্য কোনো সুবিধাভোগী আপনাদেরকে নগদ অর্থ দিয়েছে।’

‘হাস্যস্পদ কথা।’ কোর্টিস হেসে উঠে বললেন।

‘এটা হাস্যস্পদ বিষয়।’ ভ্যান উঠে দাঁড়িয়ে বললেন। ‘আমি আর এখানে কোনো ক্রমেই এই অবস্থায় থাকতে চাই না।’ তিনি কথাটা বলে ওখান থেকে প্রস্থান করার জন্য গ্রিফিথের পেছনের দরজার দিকে এক পা বাড়ালে ডিরেক্টর গ্রিফিথ তার চেয়ার থেকে উঠে তার পথ আগলে তাকে আসল ছুরির হদিস দিতে বললেন।

‘সরে যান।’ ভ্যান চিৎকার করে উঠলেন।

‘কখনোই চলে যেতে পারবেন না।’ গ্রিফিথ চিৎকার করে বললেন।

ভ্যান একটা ঘুষি মেরে দিলে গ্রিফিথ তার বাহাত দিয়ে তা ঠেকিয়ে ডান হাত দিয়ে তাকে একটা ঘুষি মেরে দিলে ভ্যান ছিটকে পড়লেন। কোর্টিস দাঁড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বসে পড়লেন।

‘আমাদের বাইরে কিছু কাজ আছে।’ তিনি ফ্যাকাশে মুখে বললেন।

বাইরে কোথায়ও যেন একটা ঘন্টা বেজে উঠল।

আমরা কেউই ওখান থেকে নড়লাম না। পুলিশ আসার অপেক্ষায় আমরা সবাই বসে থাকলেও আমি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ আমি অবশ্য জ্যাসন সাইকসের খুনের রহস্য উদঘাটন করবোই।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu