খটখট করে টিনের দরজাতে অস্বাভাবিক বড় আর খ্যাংরাকাঠির ন্যায় নোংরা নখ দিয়ে নক করতেই একটা ধবধবে সাদা বেড়াল বেরুলো। বেড়াল বেরিয়ে, বেড়াল ডাস্টবিনের ওপরে দাঁড়িয়ে, বেড়াল গোল দুটো চোখ পাকিয়ে তাকাল। শহুরে সবাই চোখ পাকায়। কুকুরগুলো আরও বেশিই। এ কারণেই সে আগেই নক করে কোনো কুকুর মুরুব্বী আছে কিনা বুঝে নেবার জন্য। যদি থাকে, ঘুঁককুউ… ঘক… করে ওঠে। কুকুরের রাগি গলার শব্দ বের হয়ে আসে, কুকুর বের হয় না। কুকুর আছে বোঝা হয়ে গেলে, হিরণ সেখানে আর থাকে না। কুকুরগুলো বড় বেয়াড়া, কিচ্ছু বোঝে না সোজে না, আঁচড়ে দেয়, কামড়ে দেয়। চামড়া ছিঁড়ে দেয়।
এই যে এত মানুষ হেঁটে যাচ্ছে পথ দিয়ে, এদেরকে তার প্রতিপক্ষ মনে হয় না। প্রতিপক্ষ মনে হয় এসব কুকুর, বিড়াল, পিঁপড়া, কাককে। তার প্রতিপক্ষ মনে হয় শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষাকে। প্রতিপক্ষ মনে হয়, রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, ঠাণ্ডা, বন্যাকে। প্রতিপক্ষ মনে হয়, ঐ যে সরকারি গাছের মগডালে থাকে আম, জাম, কাঁঠাল– যেগুলো সে ধরতে পারে না। ফল আর তার মাঝের দূরত্বকে প্রতিপক্ষ মনে হয়। প্রতিপক্ষ মনে হয় ফল ধরা গাছের উচ্চতাকে, জঙ্গলের দুর্গমতাকে। প্রতিপক্ষ মনে হয়, নিজের শক্তিহীনতাকে, বামনত্বকে, কুৎসিততাকে। পথে ঘাটে পড়ে থাকা কাঁটা, ব্লেড, ছুরি, তীক্ষ্ণ যে কোনো লোহা, শক্ত ইট-পাথরকে। প্রতিপক্ষ মনে হয়, দিনের আলোকে কারণ, আলো রাতের সুবিধাকে সরিয়ে ফেলে। প্রতিপক্ষ মনে হয় রাতের অন্ধকারকে, অন্ধকার দিনের সকল সুবিধাকে ঢেকে ফেলে। এদের সাথে যুদ্ধ করতে করতেই তার জীবন চলে যাচ্ছে, এদের সাথে যুদ্ধ করতে করতেই তার জীবন চলে যাবে। আরও প্রতিপক্ষের কথা ভাবতে গিয়ে তার মনে হলো, রোজাম আর খালুপের কথা। তাদেরকে তার প্রতিপক্ষ মনে হয় কখনো কখনো কিন্তু মানুষ মনে হয় না কখনোই। তারা তার সমগোত্রীয় জীব। অন্য মাত্রার অপরিচিত জীব।
এ ডাস্টবিনে কোনো কুকুর নেই সে নিশ্চিত হয়েছে। বিড়ালটা বের হবার পর থেকে তেমনভাবেই মূর্তির মত দাঁড়িয়েই আছে। সে হুস শব্দ করে। হুস করতেই বিড়ালটা ধপ করে লাফিয়ে পড়ে, দৌড়ে রাস্তার ওপাশে গিয়ে আবার চোখ গোল করে তাকায়। ‘এই শালা তোকে দেখে ভয় পায় না কী রে! যা ভাগ! আবার চোখ দেখায় শালা! চোখ গেলে দেব একেবারে!’ – যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধরত এক বীর আর এক বীরের দিকে তাকিয়ে যেমনভাবে বীরবাক্য বলে তেমনই একজন বীরের মত এসব কথা বলে হিরণ বিড়ালবীরের দিকে তাকিয়ে। সাদা ধবধবে শরীরে এমন নোংরার মধ্যে থেকেও একটুও ময়লা লাগেনি বিড়ালটার গায়ে। বেড়ালের দিক হতে চোখ ফিরিয়ে নেয় সে। মনে মনে একটা ইট বা এমন কিছু খুঁজে। ইট-চাবি।
পাশে পড়ে থাকা একটা আধলা ইট দিয়ে ছিটকিনির উপর কয়েকটা বাড়ি দিতেই ভেতরের চাপে ফস্ করে খুলে যায় দরজাটা। ছিটকিনি, তালা ইত্যাদি খোলার জন্য ইট, হাতুড়, শাবল খুব ভালো চাবি। বেড়ালটা যা চাটছিল এতক্ষণ, এখন তা উছলে এসে পাশের জমাট বাঁধা ড্রেনের ওপর পড়ল। হিরণ পলিথিনের প্যাকেটটা তড়িঘড়ি তুলে নেয়। বেড়ালটা বেশি খেতে পায়নি, পলিথিনের মুখ গড়িয়ে কিছুটা ড্রেনের কাদালু পানিতে পড়েছে। প্যাকেটটা ঠিকমত বেঁধে সোজা হয়ে দাঁড়ায় হিরণ। খালুপ আর রোজাম হাজির। তাদের চোখে শূন্য আকাশ। ঐ শূন্য আকাশে হিরণের পাওয়া প্যাকেট চাঁদের মতো, সূর্যের মতো ঝুলছে, জ্বলছে। ওদের দিকে হিরণ কঠিন চোখে তাকায়– ‘না, দিমু না।’ খালুপ হিরণের দিকে এগোয়। প্যাকেটটা বগলে চেপে হিরণ হরিণের মতো দৌড় মারে।
মিউনিসিপ্যালিটির লোক এসে খালুপ আর রোজামের সাথে আসা আরও যে কয়জন ছিল তাদেরকে পেটাতে শুরু করে। ‘মোগো মারছ ক্যান খোলছেতো হিরইণ্যা’– খালুপ আর রোজাম আত্মপক্ষ সমর্থন করে। সুইপার ডাস্টবিনের দরজাটা লাগিয়ে দেয় শক্ত করে। ইটটা ডাস্টবিনের ওপরের ছিদ্র দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়। ইটটা কোঁৎ করে গিলে ফেলে ডাস্টবিন। ডাস্টবিন যা পায় তাই সমান গুরুত্বে গিলে ফেলে। তা কুকুরের গু হোক, শিশুর ডেডবডি হোক আর পচা শসা হোক। আদিম বৃদ্ধ ডাস্টবিন সবকিছু হজম করতে পারে কিন্তু গন্ধ হজম করতে পারে না। দরজা বন্ধ অন্ধ ডাস্টবিনটা গন্ধ ছড়াতে লাগল ঠাঁই বসে বসে।
লঞ্চঘাটের কাছে এসে মানুষের ভিড় হতে একটু দূরে গিয়ে বসল হিরণ। পিছন ফিরে দেখার চেষ্টা করে, খালুপ আর রোজাম আসছে কিনা। হিরণ আজ সারাদিন কিছু খায়নি। কিছুতেই এই খাবারের এক কণাও কাউকে দেয়া যাবে না।
সময় বুঝে সূর্যটা এখন আর আলো ছড়াচ্ছে না, ছবিতে আঁকা সকাল বা সন্ধ্যের সূর্যের মতো কীর্তনখোলার জলে অর্ধেক ডুবে আছে। মোটা মোটা মাংসের চাঁইয়ের মত আলোযোগী ঢেউয়ের ওপর দিয়ে এসে বড় বড় জাহাজের কালো তলাতে এসে মিশে যাচ্ছে। পারাবত নামের লঞ্চ এখন ছেড়ে যাবে ঢাকার দিকে। ভেঁপু বাজছে পোঁ… পোঁ… পোং আ…। কিছুক্ষণ পরপরই মানুষজনের জলমেশা গুঞ্জনের শব্দ ছাপিয়ে বাজছে বাঁশিটা।
সারাদিন জাহাজের খেলা এ জাহাজঘাটায়। সারাদিন অজস্র মানুষ ভেসে যাচ্ছে কোথায়, ভেসে ভেসে আসছে কোথা থেকে। কোনো জাহাজ এসে ভিড়ছে কোনোটা ছাড়ছে। পারাবত ছেড়ে দিল। রাজহংস ভিড়ে আছে ছাড়ার স্থানে। জলপঙ্খি এসে ভিড়ল। তার পেট থেকে বের হয়ে আসছে মানুষের পা, মাথা।
খাবারের প্যাকেটটা সামনে নিয়ে বসে হিরণ। কিছুক্ষণের মধ্যেই খেলনা জাহাজের আকার নিল পারাবত। একই জিনিস একবার খেলনা হয় একবার আসল হয়, সবই চোখের সীমার পরিসীমার সমীকরণ।
রাজহংস নামের লঞ্চের প্রস্তুতি বাঁশি বাজল এখন। প্যাকেটটার দিকে লোভী চোখে তাকিয়ে আছে একটা কুকুর, টলটলে মুক্তার মতো জল খসছে জিহ্বা দিয়ে। কুত্তার মুখে মুক্তা। অস্তায়মান সূর্যের আলোয় লোভের আগুনের মতো জ্বলছে কুকুরের চোখ।
দূরে যাত্রী ছাউনির রাস্তা ধরে খালুপকে দেখা গেল, এদিক ওদিক তাকাচ্ছে আর হাঁটছে। রোজামকে দেখা যাচ্ছে না। পাশে থেকে মাঝারি সাইজের একটা পাথর তুলে কুকুরটার দিকে কষে চালাল হিরণ। কুকুরটা হঠাৎ এমন মার খেয়ে– ঘাঁই কি কিঁ কুক… শব্দ করে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল। সেখান হতে মুখ খিঁচিয়ে হিরণকে উদ্দেশ্য করে চেঁচাতে লাগল – ঘাঁ – আঁ – আঁ ভাউয়াঁ। হিরণ কুকুরটার দিকে তাকিয়ে সমগ্র কুকুর জাতিকে গাল দিতে লাগল – ‘হালা হুয়ারের ছাওগুলো সব ডাস্টবিনগুলা দহল কইরা ফলাইছে, না হইলে এই ছোট্ট একটা প্যাকেটের জন্য খালুপ আর রোজাম কুত্তার মতন খুঁইজ্যা বেড়াইতো না।’ কুকুরদের ওপর হিরণের যত বেশি রাগ হয় তত বেশি মায়া বাড়ে খালুপ ও রোজামের ওপর – ‘অবশ্যই কোনো জায়গায় খাওন খুঁইজ্যা পায়নি।’ আরও ভাবে – ‘এইটা দিয়া তাগো অল্প পরিমাণ দেই।’ হিরণের পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে। নিজের ভাগ থেকে কাউকে ভাগ দেবার ভাবনাটা পেটের এক মোচড়েই ছিঁড়ে যায় এক মুহূর্তে।
আজ সারাদিন খায়নি সে, যে পরিমান খাবার প্যাকেটটাতে আছে তাতে নিজেরই হবে না। খালুপ যাত্রী ছাউনি ধরে সোজা চলে গেল, কিন্তু উত্তর দিক হতে রোজামকে এবার আসতে দেখল হিরণ, মনে হচ্ছে এদিকেই আসছে। খাবার জন্য পলিথিনের প্যাকেটটা খুলে বসেছিল হিরণ। রোজামকে দেখে তাড়াতাড়ি গুটিয়ে নেয়। এপাশে মোটা পিলারের আড়ালে ক্ষীণ দেহটা লুকিয়ে রাখে। একবার রোজামকে উঁকি মেরে দেখতে চেষ্টা করে– এখন কোথায় সে। কোথাও দেখা যাচ্ছে না। প্যাকেটটা খুলে খুব সাবধানে। চোখ আবার চকচক করে ওঠে।
সূর্যটা ডুবতে ডুবতে ডুবছে না যেন। আরো সিকি ভাগের অর্ধেক বেরিয়ে আছে। মানুষের নাজেহাল হওয়া দেখতে তার মনে হয় খুবই ভালো লাগে। মানুষের যে এত নাজেহাল হওয়া দেখছে তাতেও মনে হয় সূর্যটার মন ভরে না। আরও কত মানুষের অপমান হওয়া, পতন হওয়া, আরও কত যুগ ধরে যে দেখবে, কে জানে। খাবার প্যাকেটটাতে কি কি আছে দেখতে দেখতে এসব ভাবছিল হিরণ।
হঠাৎ কিছুদূরে চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেল। কোনো এক মানুষকে মারছে অনেক মানুষ। তৃতীয়বারের মত প্যাকেটটা বন্ধ করে হিরণ উঠে দাঁড়ায়। গোলমাল হৈ চৈ হিরণের নেশার মতো লাগে। সাথে সাথে ছুটে যেতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু ভাবল– ‘না, খাইয়াই যাই।’ আবার প্যাকেটটা খুলে বসল হিরণ। খেতে যাবে, এমন সময় মনে হলো, গোলমালের ভোঁতা শব্দের মধ্যে সরু একটা চিড় ধরিয়ে যে গোঙানিটা আসছে সেটা রোজামের। তাড়াতাড়ি প্যাকেটটা বন্ধ করে পূবদিকের যাত্রী ছাউনির ভাঙা ইটের যে স্তূপটা ছিল তাতে গুঁজে রেখে গোলমালের দিকে হাঁটতে লাগল। পেট চোঁ চোঁ করছে, ক্ষিধের জ্বালায় পদক্ষেপ নিতে ভাল লাগছে না। তারপরেও সে গুটি গুটি পায়ে সেখানে গেল।
গিয়ে দেখল, ঠিকই, রোজাম। ভিড়ের মধ্যে সব শরীরই বলিষ্ঠ। পোশাক আর সততা, কথা আর টাইয়ের উজ্জ্বলতা। হিরণ মার থামাতে বলতে পারছে না, উল্টো তাকেও মারির মধ্যে পড়তে হতে পারে। এসকল ক্ষেত্রে মানুষ মানুষকে মারতে মারতে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সংক্রমণের মতো, সংক্রামকের মতো সুযোগ পেলে অন্যকেও ছাড়ে না। সুতরাং এখন কিছু করতে গেলে তারা মারতে শুরু করতে পারে। রাজহংসের ছেড়ে যাবার বাঁশি বাজল। জাহাজটা এক্ষণি ছেড়ে দেবে। ভিড়টা পাতলা হচ্ছে। হিরণ দাঁড়িয়ে থাকে। যতক্ষণ না সব মানুষ যাচ্ছে ততক্ষণ কিছু করা যাবে না।
ভিড় কমে গেছে। ভিড়টা যেন একটা বিশাল বরফের চাঁই ছিল এখন গলে গেল জাহাজের বাঁশির তাপে। জাহাজের নোঙর তোলা হচ্ছে। একটা লোক শেষ গাট্টা মেরে রাজহংসের দিকে দৌড়াতে লাগল। শেষ গাট্টাটা খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে রোজাম। জাহাজ ছেড়ে দেবার সময় বিধায় রোজাম এ যাত্রা বেঁচে গেল। সে তীর ছেড়ে যাওয়া জাহাজের দিকে তাকাল। হিংস্র অজস্র মানুষজীব নিয়ে একটা যন্ত্রজীব ভেসে চলে যাচ্ছে। সেখানে এসে কোথা থেকে ভেসে আরো একটা জাহাজ ভেড়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে দূর থেকেই গতি কমিয়ে। জলপঙ্খি যাত্রী আকর্ষণের বাঁশি বাজাল। হিরণ গিয়ে রোজামের কাছে বসল। মুখ থোবড়ানো অবস্থা থেকে তাকে তোলার চেষ্টা করে। দুজনের শক্তিতে রোজাম কষ্ট করে উঠে বসে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। তারা কথাহীন কিছুক্ষণ বসে থাকে।
রোজাম কিছুটা ধাতস্ত হলে, হিরণ দয়াদ্র গলায় জিজ্ঞাসা করল– কি করছিলি?
– কিছু করি নাই।
– মারছে যে!
কান্নার দাগ শুকিয়ে গেছিল। হিরণের দয়ালু কণ্ঠের পরশে সেই দাগ বেয়ে আবার ফোটা ফোটা জল গোল গোল হয়ে গাল দুটো প্রায় না ছুয়েই গড়িয়ে পড়ল। রোজাম যা বলল তা হচ্ছে– ২নং যাত্রী ছাউনিতে বসে ছিল স্বামী-স্ত্রী, সাথে একটা বাচ্চা। বাচ্চাটি পাউরুটি খাচ্ছিল। যতটুকু খাচ্ছিল তার চেয়ে বেশি ভেঙে ভেঙে নিচেই পড়ছিল আর সেগুলো কুড়িয়ে খাচ্ছিল রোজাম। বাচ্চাটা এক সময় গোটা রুটিটায় রোজামের দিকে এগিয়ে দেয়– ‘নাও খাও, সিবু কাকা খাও।’ সিবু কাকা যে কে রোজাম জানে না। পুরো রুটিটা নিতেও ভয় করছিল, স্বামী-স্ত্রী যদি সন্দেহ করে। কিন্তু স্বামী-স্ত্রী একমনে বসে নদীর দিকে তাকিয়ে কি কি সব গল্প করছে আর হাসছে। হাত বাড়িয়ে রোজাম রুটিটা নিয়ে নেয়। শিশুটি সাথে সাথে চিৎকার দিয়ে ওঠে– ‘সিবু কাকা আমার রুটি নিয়ে নিল।’ রোজাম ভয় পেয়ে যায় শিশুর চিৎকারে। শিশুর বাবা-মা ফিরে তাকায়। ভয় পেয়ে চাপা গলায় সে বলে ওঠে– ‘শালা শুয়োরের বাচ্চা শিশু, আমি নিলাম না তুই দিলি।’ স্বামী স্ত্রীর চোখ পড়ে রোজামের হাতের পাউরুটির ওপর আর স্বামীটি এসে বকাঝকা শুরু করে। এসময় আশপাশ থেকে আরো কয়েকটা লোক এসে জোটে। স্বামীর ‘বকাঝকাকে’ জুটে যাওয়া লোকগুলো প্রহারে রূপান্তর করে। সে কোনো কথা বলার সুযোগই পায় না। জাহাজের বাঁশি বাজলে প্রহার প্রহর শেষ হয়। তারপরতো এই অবস্থা।
রোজামকে উঠিয়ে ধরে হিরণ তার সেই ডেরায় ফিরে যায়। এটি একটি পরিত্যক্ত বিরাট কন্টেইনার। ডাস্টবিন থেকে পাওয়া সেই খাবার যেখানে লুকিয়ে রেখেছিল সেখান থেকে বের করে আনে। এর মধ্যেই পিঁপড়া ধরে গেছে। সারি ধরে পিঁপড়া যাওয়া আসা করছে। শুঁড় নাড়াতে নাড়াতে মিছিল নিয়ে তেলাপোকা আসছিল কয়েকটা। মনে মনে পিঁপড়াদের মা বাপকে তুলে গাল দেয় হিরণ। যতদূর সম্ভব পিঁপড়া দূর করে খাবারটা ভাগ করে কিছুটা নিজে খায়, কিছুটা রোজামকে দেয়। রোজাম ছল ছল চোখে হিরণের দিকে তাকায়। এ খাবারের ভাগ কাউকেই দেবার কথা ছিল না। পিঁপড়া মিশ্রিত ভাত দুজনে খায়। কিছুক্ষণ পর রোজাম বমি শুরু করে। হিরণ বলে শুয়ে পড়, ঘুমিয়ে পড়, সকালে দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। রোজাম কাতরাতে কাতরাতে ঘুমিয়ে পড়ল।
কন্টেইনারের ভেতর বমির গন্ধে ভরে গেছে। হিরণও একটু দূরে ঘুমানোর জন্য শুয়ে পড়ল। শুয়ে পড়ার পর মনে পড়ল, যে কুত্তিটা প্রায় প্রতিদিন এখানে আসে সে আজ আসেনি। সমগ্র কুকুর জাতির কোনো কুকুরকেই সে পছন্দ করে না। শুধু এই কুকুরিটার সাথেই কেমন করে যেন তার প্রেম হয়ে গেছে। তার সংগ্রহ করা খাবার থেকে কুকুরিটাকে একদিন সে ভাগ দিয়েছিল। সেদিনও সে মনে করেছিল, এ খাবারের ভাগ কাউকে দেব না। কিন্তু কুকুরিটা এমন কাতরভাবে তার দিকে তাকিয়ে ছিল যে, সে তার প্রতীজ্ঞা ধরে রাখতে পারেনি। কুকুরির চোখে লোভ ছিল না, প্রার্থনা ছিল। খাবার পেয়ে কুকুরিটা সেদিন খুব কৃতজ্ঞ হয়েছিল বোধহয়। তারপরতো মাঝে মাঝে কুকুরিও কোনো খাবার পেলে এখানে নিয়ে চলে আসে। হিরণও খেয়েছে কুত্তির নিয়ে আসা খাবার। সে রাতে সে শুতে গেলে কুকুরিটাও তার গা ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। দিন দিন তাদের ভেতর মমত্ব, বন্ধুত্ব, প্রেমত্ব বেড়ে যায়।
এরপর থেকে কুকুরির সাথে দিনের মধ্যে একবার হলেও দেখা হয়। কোথা কোথা থেকে হঠাৎ করে কুকুরিটা এসে হাজির হয়। এক টুকরো আনন্দের মত মনে হয় তার কাছে। এর আগে আনন্দ, বন্ধুত্ব, প্রেম, ভালোবাসা, দয়া ব্যাপারটা সে একটুও বুঝত না। এই কুকুরির সাথে পরিচয় তাকে বিরাট এক আবিষ্কারের মুখোমুখি নিয়ে আসে। মনের ভেতর অন্য এক আলোর সন্ধান সে পায়। কখনো কখনো এমনদিনও এসেছে যেদিন সে কোথাও কোনো খাবার পায়নি, এমন সময়ের দিনে দেখা গেল কুকুরি মুখে করে কাগজের ঠোঙা বা পলিথিনের ব্যাগ মুখে করে নিয়ে আসছে। তাকে খাবার জন্য প্ররোচিত করছে। হিরণের চোখ ভরে জল বেরিয়ে আসে কুকুরির আচরণ দেখে। কুকুরির প্রতি তার কৃতজ্ঞতা জল হয়ে বের হয়ে আসে তার গভীর ভেতর থেকে। কুকুরির এভাবে খাবার নিয়ে এসে তার কাছে রাখার ব্যাপারটা বহুবার ঘটেছে। তারপর থেকে তার একমাত্র আনন্দ এই কুকুরির সাথে সময় কাটানো। হিন্দু মেয়েদের সে দেখেছে মন্দিরে শীবের নুনুর পুজা করতে। কৃষ্ণের পূজা করতে দেখেছে। মাঝে মাঝে তার নিজেকে দেবতা মনে হয়। মনে হয়, ঐ কুমারী নারীদের মতো, এই কুমারী কুকুরি তাকে পূজা দিচ্ছে।
রাত বেড়ে গেছে। হিরণের ঘুম আসছে না। মাঝে মাঝেই রোজাম কোকাচ্ছে, কাঁদছে ছোট বাচ্চাদের মত। প্রথমবার সে উঠে গিয়ে দেখেছে, ডেকেছে। রোজাম ঘুমের ভেতর কাঁদছে, কঁকিয়ে উঠছে। সে ঘুমিয়েছে তার ব্যথা জেগে আছে। মানুষ ঘুমায় তার ব্যথা ঘুমায় না।
রাত ফুলতেই আছে। রাত ফুলতে ফুলতে বিশাল ঢোল। রাত-ঢোল গম্ভীর হয়ে বাজছে। তার ঘুম ঝুলে গেল তার ভাবনার তারে, স্মৃতির তারে। তার কুকুরির কথা মনে পড়ছে। কন্টেইনারের ফুটো একটা জায়গা দিয়ে আকাশের সামান্য একটা টুকরো দেখতে পায়। এ এক টুকরো আকাশে একটা মাত্র তারা দেখতে পাচ্ছে সে। ব্যাপারটা তার ভালো লাগে। একটা মাত্র তারা তার দেখার জন্য। গগনের এ তারা কি তাকে দেখতে পাচ্ছে? সে তারাকে দেখতে পাচ্ছে। একটা মাত্র তারা। তার তারা। এটা তারই তারা।
সে আকাশ-পাতাল-মর্ত্য ভাবে এই ছোট কন্টেইনারের ভেতর শুয়ে শুয়ে। কন্টেইনারকে তার অন্ধকার কবরের মতো মনে হয়। কবরে থাকার স্বাদ কেমন হতে পারে অনুভব করার চেষ্টা করে। মৃত্যু কেমন তা ভাবতে চেষ্টা করে। তার শরীর হীম হয়ে আসে। একবার সেও রোজামের মতো মার খেয়েছিল খুব। তিনদিন সে উঠতে পারেনি। ঘুমিয়েছে জেগেছে। জেগেছে ঘুমিয়েছে। তিনদিন পর একবার জেগে তার নখের দিকে তাকিয়ে দেখে নখের ময়লা-মাটির ভেতর ধানগাছ জন্মেছে। বা ঘাস। সে চমকে ওঠে, সেকি মাটি হয়ে গেছে। সে তাড়াহুড়ো করে উঠতে যাচ্ছিল কিন্তু পারছিল না, মাটির মতোই অনড় হয়েছিল তার শরীর। সে ভেবেই নিয়েছিল সে বুঝি মাটি হয়ে গেছে, তার শরীরে বেরিয়েছে সবুজ শিশুধান গাছ।
স্মৃতিব্যথার ভেতর থেকে বেরিয়ে সে রোজামের দিকে খেয়াল করে। রোজামের ব্যথা মনে হয় কমেছে, সে আর কাতরাচ্ছে না, ঘুমের ভেতর কাঁদছে না। আহা ঘুমাক। ঘুম ছাড়া মানুষের দ্বিতীয় কোনো সুখ নেই।
হিরণের ঘুম আসছে না। তার মনে পড়ে– একদিন ঘুমের ভেতর তুমুল সঙ্গমের স্বপ্নে মেতে উঠেছিল হিরণ। স্বপ্নে যাকে দেখছিল সে মুখ তার পরিচিত কোনো নারীর মুখ নয়। সে কোনো নারীকে চিনেও না আলাদাভাবে। হাজার নারী, হাজার নারী যাত্রি এ জাহাজঘাটা দিয়ে যায়, আসে। তাদের দিকে সে ভালো মতো চেয়েও দেখে না, প্রকৃতপক্ষে কোনো মানুষের দিকেই সে ভালো করে চেয়ে দেখে না। তারপরেও স্বপ্নে মনে হচ্ছিল, যাত্রী নারীদেরই কেউ যেন তার কাছে এসে নিজে থেকে সঙ্গমে যুক্ত হয়েছে তার সাথে। স্বপ্নের নারীর সাথে যখন তার সঙ্গমের চূড়ান্ত আনন্দ তখন তার ঘুম ভাঙ্গে বা খেয়াল হয় যে, তার শিশ্ন প্রবিষ্ট হয়ে আছে আসলে পাশে শুয়ে থাকা কুকুরির সাথে। সে এক মুহূর্ত থমকে গেছিল। কিন্তু ঐ এক মুহূর্তই। তারপর আবার শুরু করেছিল। কুকুরি কোনো আপত্তি করেনি। তারপর থেকে এটা মাঝে মাঝেই করে কুকুরি প্রেমিকার সাথে। কুকুরি আপত্তি করে না। এখন খুব মনে প্রাণে চাইছে কুকুরিটা আসুক। আসুক। তার খুব প্রয়োজন কুকুরিকে।
কখন তার ঘুম এসে গেছিল। একটা শব্দে ভোর রাতের দিকেই তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। কুকুরি এসেছে। সে উঠে বসে। কুকুরি রোজামের দিকে একবার জ্বলজ্বলে চোখে তাকায়। আবার হিরণের দিকে তাকিয়ে ক্ষিধে পেয়েছে এমন শব্দ করে। কোনো খাবার নেই। কুকুরি তার দিকে তাকিয়ে আছে। পলিথিনে যে দুএকটা দানা ছিল সেগুলো চেটে খেতে ইশারা করে কুকুরিকে। কুকুরি পলিথিন চেটে খায়। দুচারটে ভাত ছাড়া আর কিছুই নাই। হিরণের হঠাৎ মনে পড়ে বমির কথা। কুকুরিকে রোজামের করা বমির দিকে নির্দেশ করে। কুকুরি রোজামের বমি খায়। কুকুরি কিছুটা শান্ত। কুকুরি বমি খেয়ে ফেলেছে কিন্তু বমির গন্ধ খেতে পারেনি। এখনো ভেতরটা বমির গন্ধে তুমুল ভরপুর। হিরণ কুকুরিকে কাছে ডেকে নেয়। কুকুরি হিরণের কাছে টানার স্পর্শেই বুঝে নেয় টানের মানে। কুকুরি হিরণের সুবিধামত আসন গ্রহণ করে প্রস্তুত হয়। মাঝে মাঝে সে রোজামের দিকে তাকায়। রোজামের কোনো সাড়া শব্দ নাই। স্খলিত হবার সময় হিরণ কুকুরের মত জিভ বের করে সুখে হাঁপায়।
২
রাতের পেট চিরে একটা ভোর জন্মিছে। সারারাত জ্বলে জ্বলে একটা ভোর জন্মাতে জন্মাতে ক্লান্ত শুকতারা মলিন মুখে পুবাকাশের কোল হতেই লুকিয়ে যাচ্ছে। তার মুখে প্রসব বেদনার ছাপ স্পষ্ট। চলে যাওয়া সময় চলে যাওয়া রাতের পাতলা আঁধার ফুঁড়ে ফুটফুটে একটা ভোর হাঁচড় পাঁচড় করে ছোট জরায়ূ ছিঁড়ে বের হয়ে আসছে। রাতের নাড়ির শেষ বাঁধনটি ছিড়ে বের হয়ে এলো ভোর। পৃথিবী কোঁকাচ্ছে যেন, রক্তরশ্মিতে ভেসে যাচ্ছে সবকিছুই। কিন্তু সূর্যটা উঠতেই পৃথিবীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল। সফল জন্মদাত্রী পৃথিবী এখন মা, মায়ের হাসি মুখ।
সূর্য উঠলে যে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে ওঠে এমন নয়, সবকিছুই যে চোখের সামনে নিয়ে আসে এমন নয়। কত কিছুতো ঢেকেও ফেলে। যেমন রাতকে, শুকতারাকে, অন্যসব তারাগুলোকে, চাঁদকে, ঢেকে ফেলে সূর্যের আলো।
ভোরের আলো ভেতরে আসাতে হিরণ দেখল, রোজামের মুখটা শোল মাছের মত ঢোল হয়ে ফুলে আছে। অথচ শান্ত, খুবই শান্ত মুখখানা। রোজামের দেহ দেখে তার সন্দেহ হয়। বাম হাতটা রোজামের নাকের কাছে ধরে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ভাবে, এ মৃত্যুটা কেমন? বুকটা চড়চড় করে ওঠে হিরণের– সুন্দর একটা মৃত্যুর আকাঙ্খা জাগে মনে, সীমাহীন আশা। আরো একটা দীর্ঘশ্বাস বাতাসের প্রতিটি কোনায় কোনায় কণায় কণায় মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল। রোজামের মৃত্যুতে বিষাদে ভরে গেল তার মন। সে অসহায় হয়ে কন্টেইনারের গোটা ভেতরে চোখ চালিয়ে দেখতে লাগল, যেন সে রোজামের প্রাণকে খুঁজছে। রোজামের শরীর থেকে প্রাণ বেরিয়ে গিয়ে এই কন্টেইনারের ভেতরেই আছে এখনো বাইরে যেতে পারেনি। রোজামের প্রাণটাকে দেখতে পেলে, ধরতে পেলে নাক দিয়ে রোজামের দেহে ঢুকিয়ে দেবে। রোজামের প্রাণকে দেখা যাচ্ছে না।
কুকুরিটাকে দেখা যাচ্ছে না, এর মধ্যে নিঃশব্দে কখন চলে গেছে সে বুঝতে পারেনি। হয়তো বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। মেঝে থেকে উঠে বাইরে এসে সবুজ ঘাসের ওপর দাঁড়াল। বাইরে কুকুরি নাই। কুকুরি তার গরম বীর্য বের করে নিয়ে, তাকে ঠাণ্ডা করে দিয়ে চলে গেছে কোনদিকে কে জানে। সবুজ ঘাসের ওপর হেমন্তের শিশির দেখতে পেল। শিশিরের শুদ্ধতার দিক হতে চোখ গেল মিউনিসিপ্যালিটির গাড়িটির দিকে।
মিউনিসিপ্যালিটির এ গাড়ি দেখে রোজাম সম্পর্কিত মনের সব বিষাদ দূর হয়ে গেল। নতুন বিষাদ দেখা দিল তার মনে। পৌরসভার সুইপাররা ডাস্টবিনগুলো পরিষ্কার করতে শুরু করেছে। আরো একটু আগে বের হতে পারলে ভালো হতো। রাতে যে সকল উচ্ছিষ্ট ডাস্টবিনে জমা হয়েছিল গাড়িটা সব নিয়ে চলে যাবে এখন। কি খাবে তাই নিয়ে চিন্তা করতে লাগল। তৎক্ষণাৎ তার রোজামের কথা মনে পড়ল। ওর কোমরে দু’চার আনা পয়সা আছে কিনা দেখা যেতে পারে। রোজামের কোমরে কোনো পয়সা নেই, তবে কালকের পাউরুটির খণ্ডটুকু গোঁজা আছে এখনো। রোজামের মৃত্যুমাখা শরীরের মরণগন্ধমাখা রুটির খণ্ডটুকু নিয়ে কামড়াতে কামড়াতে বের হয়ে গেল হিরণ, এখনো পরিস্কার করা হয়নি এমন কোনো ডাস্টবিনের খোঁজে।
তাকে সবসময় তেষ্টার ভেতর থাকতে হয়। কথায় আছে চেষ্টায় তেষ্টা মেটে। কিন্তু তাকে সবসময় চেষ্টার ভেতর থাকতে হয়, তেষ্টার ভেতর থাকতে হয়। চেষ্টাও মেটে না, তেষ্টাও মেটে না। কোনটা চেষ্টা আর কোনটা তেষ্টা তার ফারাক সে বোঝে না। চেষ্টা আর তেষ্টা তার কাছে সমার্থক।
৩
এখনো পরিষ্কার করা হয়নি এমন ডাস্টবিন দরকার হিরণের। যে ডাস্টবিনটা পরিস্কার করা হয়েছে সে ডাস্টবিন ছেড়ে অন্য এক ডাস্টবিনের কাছে যেতেই মিউনিসিপ্যালিটির গাড়ি সেখানে এসে হাজির হয়। এরপর আরো একটা ডাস্টবিনের কাছে পৌঁছানোর ঠিক আগেই হাজির হয় গাড়ি। পৌরসভার গাড়ি তার সাথে যেন মজার খেলা শুরু করেছে। পৌরসভার ময়লা টানা গাড়ি আর ময়লাখেকো রোজামের ভেতর কাঠিদৌড় খেলা শেষই হতে চাইছে না। বেলা বেশ বেড়ে গেছে। এখনো সে কিছু পায়নি। সে ক্লান্তি অনুভব করে। এ খেলা তার আর ভালো লাগে না।
খেলা ছেড়ে, পরিষ্কার হয়ে গেছে এমন একটা ডাস্টবিন থেকে একটু দূরে গিয়ে বসে, যেমন করে কাবাঘরের দিকে বা কোনো দেবতার মূর্তির দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করে মানুষ। ডাস্টবিনটাই তার কাবা, তার দেবতা, সমগ্র আগ্রহ বিগ্রহ, তার প্রার্থনা। এর মধ্যে কেউ না কেউ, খাদ্যকাবা এই ডাস্টবিনের দিকে আসবে উচ্ছিষ্ট খাবার ফেলতে। সে খেয়াল করে একটা কুকুর বসে আছে ডাস্টবিনের অপর পাশে ডাস্টবিনটাকে কেবলা করে। তার আর কুকুর দুজনেরই দূরবিন, নিকটবিন, মনবিন ডাস্টবিনকে কেন্দ্র করে সমস্ত শক্তি দিয়ে কাজ করছে।
এসময়ে একটা মেয়ে কোনদিক থেকে এসে একটা পলিথিন প্যাকেট ফেলে দিয়ে দ্রুত চলে গেল। দ্রুত এবং দূর থেকে চালিয়ে ফেলার জন্য পলিথিন প্যাক ভেতরে না পড়ে ডাস্টবিনের গায়ে ধাক্কা খেয়ে বাইরেই পড়ল। সাথে সাথে হিরণ আর কুকুরটা একই সাথে উড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্যাকেটের উপর। কুকুরটা ঘেউ করে কামড়ে দেয় হিরণকে। হিরণও পৃথিবীর সমস্ত কবি, নবি, দেবতা, দার্শনিকের– কুকুর কামড়ালে কুকুরকে কামড়াতে হয় না– মতবাদকে নির্বিকার অস্বীকার করে কুকুরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কামড়ে ধরে। উভয়েরই জেদ চেপে গেছে। কুকুর সুযোগ পেলে কামড়ে দিচ্ছে হিরণকে, হিরণ সুযোগ পেলে কামড়ে দিচ্ছে কুকুরকে। ধুন্ধুমার কাণ্ড বেধে যায়। দুজনেই রক্তাক্ত। কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। কেউ কাউকে ছাড় দিয়ে কথা বলছে না। দুজনের ভাষায় এক– গোঁ-গোঁ, ঘোঁ-ঘোঁ, গাঁউ-গাঁউ, ঘাঁউ-ঘাঁউ।
এক সময় হিরণ কিছুটা সুবিধা পায়। কুকুরের বুকের উপর চড়ে তার গলা চিপে ধরে। তার গায়ে কোথা থেকে সহস্র কুকুরের বল এসে হাজির হয়েছে। কুকুরটা নিথর হয়ে গেলে পাশে গড়িয়ে পড়ে হিরণও। বলহীনভাবে পড়ে থাকে তার দেহ, সহস্র কুকুরের দেহশক্তি তার শরীর থেকে উধাও। এক কুকুরের শক্তি নিয়ে সে পড়ে আছে।
তার শরীরের প্রায় সর্বস্থান থেকে রক্ত বের হচ্ছে। কুকুরের কামড়ে আর আঁচড়ে তার শরীরের অনেক জায়গা ফালা ফালা হয়ে গেছে। একটা কানের লতি ছিঁড়ে ঝুলছে। কুকুরের তীক্ষ্ণ নখের আঁচড়ে একচোখের পাতা ছিঁড়ে পড়ে গেছে। তার জিভ ফেড়ে দুভাগ হয়ে গেছে সাপের জিভের মত, গলগলিয়ে রক্ত পড়ছে সেখান দিয়ে। তার শিশ্নের মাথা দিয়ে মুত্রের বদলে, বীর্যের বদলে রক্ত বের হচ্ছে বেগে। অসহ্য ব্যথায় কাতরাচ্ছে সে। সমস্ত ব্যথা আগ্রাহ্য করে কিছুক্ষণ পর সে উঠে দাঁড়ায়। সে অদ্ভূত এক জীবন। এ অদ্ভূত জীব পৃথিবী আগে দেখেনি কোনোদিন। দারুণ ক্লান্তি। দারুণ ক্ষুধা। কুকুরের কামড়ের দারুণ বিষ বেদনা সারা শরীরে। সে উঠে দাঁড়ায়। ধিরে ধিরে টলমলে পায়ে পলিথিন প্যাকেটের দিকে যায়। তার খাওয়া দরকার আছে না নাই বুঝতে পারছে না। তবু হাতে তুলে প্যাকেট। কালো রাতের অন্ধকারের মতো – কালো পলিথিনটা বেশ ভারি। সে অন্ধকার পলিথিন প্যাকেট ছিঁড়ে অবাক হয়ে যায়। অপূর্ণ মানুষের বাচ্চা, মানুষের অপূর্ণ বাচ্চা। বেশ নরম, খাওয়া যাবে! সে প্যাকেট নিয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে গেল তারপর ধপ করে পড়ে গেল থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে।
তার চোখ বুঁজে আসছে। সে চোখ খুলে রাখার চেষ্টা করে। সে জানে সুযোগ পেলেই সূর্য ডুবে যাবে। সে প্রাণপণে চোখ মেলে থাকে, সে সূর্যকে ডুবতে দেবে না। জোর করে চোখ খুলে দেখে সূর্য মধ্যগগনে গনগন করছে। আসলে সূর্য ওঠা বা ডোবা বলে কোনো কথা নেই, আছে মানুষের চোখ খোলা বা বন্ধ করা। চোখ বন্ধ করলেই সূর্য ডোবা, চোখ খোলা থাকলে সূর্য থাকা। সে খুব জোর চেষ্টা করে চোখ খুলে রাখতে। সে জোর করে চোখ খুলেই রাখে। খুলেই রাখে। খুলেই রাখে…
সুযোগ পেয়ে সূর্যটা কিন্তু ঠিকই ডুবে গেল। রোজাম বুঝতেই পারল না সূর্য ডুবে গেছে। সে বুঝতেই পারল না সে মরে গেছে। সে চোখ খুলেই আছে।
এতক্ষণে প্রচুর লোক জুটে গেছে। পুলিশের গাড়ি এসে দুটো লাশ নিয়ে বাঁশি বাজাতে বাজাতে চলে গেল। কুকুরের লাশ পড়ে থাকল সেখানেই।
৪
তারিখ: সেদিনই। স্থান: জাহাজ ঘাটা। মানুষজন জাহাজঘাটার পরিত্যক্ত একটা যাত্রী ছাউনির কাছে এসে দেখল– একটা কুকুরি একটা বাচ্চা বিয়োলছে। বাচ্চাটা কুকুরের বাচ্চা নয়, বাচ্চাটা মানুষের।
গল্পটা জাহাজে করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বহন করে নিয়ে গেল মানুষজন এবং যারা শুনেনি তাদের শোনাতে গিয়ে তারা খেয়াল করে তারা গল্পটি ভুলে গেছে। কিন্তু যেহেতু গল্প বলা শুরু করেছে সেহেতু গল্প বলে শেষ করতেই হবে। গল্প বলতে শুরু করার এই এক দায় যেভাবেই হোক গল্প শেষ করতেই হবে। সুতরাং গল্প শেষ করার দায় থেকে, তারা অন্য মানুষের কাছে গল্পটা করছে এভাবে–‘কীর্তনখোলার জাহাজঘাটায় একটা পাগলি একটা বাচ্চা জন্ম দিয়েছে। কিন্তু বাচ্চাটি মানুষের বাচ্চা নয়, কুকুরের বাচ্চা।’ এভাবে উলোট-পালোট হয়ে জাহাজে চড়ে গল্পটি পৃথিবী ভ্রমণ করতে লাগল।
অবশ্য, একদিন এ গল্প মাটি হবে, এ মাটিতে ধান জন্মিবে। ধানে চালে লবণে ঝোলে মানুষের ভেতরে ঢুকে যাবে আরও…