আমার নাকে কাঁঠালিচাঁপার একটা গন্ধ এসে জোরে ধাক্কা দিল। বুঝতে বাকি নেই, রুসাফী কল দিচ্ছে। এই বখাটে ছেলেটা কল দেবার সাথে সাথেই কোনো এক অদ্ভুত কারণে এ কাঁঠালিচাঁপার ঘ্রাণটা আমার নাকে এসে লাগে। কেন এমনটা হয় তার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ কিংবা ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি। এ বিষয়টি নিয়ে দু’একজন সাইকোলজিস্টের সাথে কথাও বলেছি। তাঁরা বলেছেন, এটা নাকি একান্তই আমার মনের ভুল!
রুসাফী কল দিয়েই যাচ্ছে। কল রিসিভ করব না। কল রিসিভ করলেই বিপদ। আমি নিঃশব্দে সিড়ি মাড়িয়ে ছাদে ওঠে দেখলাম, রুসাফী অস্থির হয়ে আমাদের বাড়ির গেইটের সামনের রাস্তায় পায়চারি করছে। সকালে কল দিয়ে সে আমাকে বলেছিল, আমি সন্ধ্যার পরপরই আসব। তুমি রেডি থাকিও। কক্সবাজার কোর্টে গিয়ে আমরা কোর্ট ম্যারেজ করে ফেলব। এটা আমার শেষ কথা।
জবাবে কিছু না বলে আমি চুপ ছিলাম।
আমার খুব ইচ্ছে, উকিল পাত্র ছাড়া বিয়েই করব না। আর রুসাফী ছেলেটাকে তো বিয়ের প্রশ্নই ওঠে না। বখাটে ছেলে একটা! সারাদিন টই টই করে মাস্তানি করে বেড়ায়।
রাত বারোটার দিকে আমার নাকে আবারো কাঁঠালিচাঁপার গন্ধটা এসে লাগে। মোবাইল ডিসপ্লেতে বখাটে ছেলেটার কল ভেসে ওঠে। কল রিসিভ করতেই হুমকি দেয়, আমি তোকে পেলে পা দুইটা কেটে বাঁশি বাজাবো।
তার কাছ থেকে আমি এটা কখনোই আশা করিনি। আমি সারারাত ঘুমাতে পারিনি। খুব কেঁদেছি। সকালে ঘুম থেকে ওঠে আম্মার সামনে পড়তেই তিনি আমার চেহারা দেখে কিছু একটা আঁচ করে ফেলেছিলেন।
কিরে জাইমা, তোর কী হয়েছে?
আমি আম্মাকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছি।
কাঁদিস না। কী হয়েছে বল! সান্ত্বনার সুরে আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন আম্মা।
আম্মা, রুসাফী আমার পা দুটি কেটে ফেলবে বলে হুমকি দিয়েছে।
কেন? তার সাথে কি তোর কোনো ঝগড়াঝাটি হয়েছে?
না, তেমন কিছু হয়নি।
কিছু একটা তো হয়েছে। নইলে শুধু শুধু কেন তোকে হুমকি দিবে! কি হয়েছে সত্যি করে বল।
আমি ঢোঁক গিলে বললাম, তার সাথে কক্সবাজার পালিয়ে গিয়ে কোর্ট ম্যারেজ করে ফেলতে বলেছিলে। কিন্তু আমি রাজি হইনি তাই।
আম্মা হা হা করে হেসে উঠলেন। আম্মার মুখে হাসি দেখে আমি থ বনে গেলাম। তাঁর মেয়ে কত দুঃখ নিয়ে তাঁকে একটা নালিশ করল, কোথায় তিনি নালিশটা একটু আমলে নিবেন তা না, উল্টো হাসছেন! আম্মার সামনে নিজেকে এখন বোকা বোকা লাগছে।
আম্মা মুখের হাসিটা ধরে রেখেই বললেন, রুসাফীকে বলিস পালিয়ে বিয়ে করতে হবে না। পড়াশোনা করে শেষ করে একটা ভালো চাকরি করলেই আম্মা তোমার সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দিবে।
ধুর! বলে বিরক্তি প্রকাশ করে আমি কথার প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করলাম।
দীর্ঘ একমাস আম্মা হাসপাতালের বেড়ে পড়েছিলেন। শেষমেশ কোভিটের কাছে পরাজিত হলেন আম্মা। কোভিট আম্মাকে টুপ করে গিলে ফেলেছে। আজ দুপুরের শেষ নিঃশ্বাসটুকু ত্যাগ করেছেন তিনি। ডাক্তার বলেছেন, আম্মার ফুসফুসে নাকি পানি জমে গিয়েছিল।
আম্মার লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসা হল। আম্মার মৃত্যুর সংবাদ আমি কাউকে ফোনে কিংবা ম্যাসেজে জানাতে পারিনি। কারণ আমি অজ্ঞান হয়ে বাড়ির এককোণায় পড়েছিলাম। মায়ের মৃত্যুর সংবাদ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ল। আম্মার জানাজা পড়ার জন্য অনেকের মতো রুসাফীও ছুটে এল। লাশ কবরে শুয়ে দেয়ার যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা চলছে। রুসাফী নাকি আমাদের ড্রয়িংরুমে বেশ কয়েকবার আসে। মনে মনে আমাকে খুঁজে। কিন্তু খুঁজে পায় না। আমার খোঁজ-খবর কারো কাছ থেকে নেবার সাহস হয় না তার। আমাকে অনেকবার কলও দিয়েছিল সে। আমি তো অজ্ঞান ছিলাম। তখন মোবাইল কোথায় ছিল তা আমার জানার কথাও না। আম্মাকে কবরে শুয়ে দেবার পরপরই আমার খোঁজে আরেকবার নাকি এসেছিল সে। তখনও আমার জ্ঞান ফিরেনি। আমি আম্মাকে শেষ দেখাটাও দেখতে পারিনি।
আম্মার মৃত্যুতে আমি আর আমার ছোট ভাইটা একদম ভেঙে পড়েছিলাম। বড় আপু তাঁর বাচ্চাকে নিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আম্মার শোক কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন।
রুসাফী প্রতিনিয়তই আমাকে সান্ত্বনা দেয়। পৃথিবীর কোনো সান্ত্বনাই আমার অশান্ত মনকে শান্ত করতে পারে না। আমি দিনে দিনে হতাশার অতলে তলিয়ে যাচ্ছিলাম।
বেশ কয়েকমাস পর একটা সুখবর পেলাম। আমার চাকরি হয়েছে আমাদের ইউনিয়ন হাসপাতালে। শেড এনজিওর আন্ডারে নিউট্রিশন কাউন্সিলর হিসেবে। বেতনও ভালো। সিদ্ধান্ত নিলাম বাড়িতে আর থাকব না। মামা বাড়িতে গিয়ে থাকব। কারণ ওখান থেকে আমার কর্মস্থল একদম কাছে।
মামার বাড়িতে উঠার পর থেকে রুসাফীর সাথে যোগাযোগটা কমিয়ে দিই। যোগাযোগ কমিয়ে দেয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হল, আমাদের বাড়ির মতো মামা বাড়িতে ফোনে কথা বলার তেমন খোলামেলা পরিবেশ ছিল না। সাথে আরও যোগ হলো, মামা-মামির কড়া নজরদারি! এসব নিয়ে রুসাফীর সাথে আমার বেশ কয়েক দফা বাক-বিতণ্ডারও হয়েছে।
ইদের ছুটিতে বাড়িতে এসেছি। আম্মা ছাড়া প্রথম ইদ। ভাবতেই ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। কী রকম খারাপ লাগা কাজ করছে বলে বুঝাতে পারব না। আমরা ভাই-বোনরা একজন আরেকজনের চেহারার দিকে তাকাতেই পারছি না। বিকেলে রুসাফী বাড়িতে এসেছে। তাকে দেখে কেন জানি আমার মেজাজটাই দপ করে জ্বলে উঠল। আমি রেগেমেগে বড় আপুকে গিয়ে বললাম, এ বখাটে ছেলেটা কেন আমাদের বাড়িতে এসেছে?
আমি ডেকেছি। বলে বড় আপু আমার দিকে বারকয়েক চোখ পাকিয়ে তাকালেন।
কেন ডেকেছেন?
তাকে দেখি না বহুদিন। তাই ডেকেছি।
আমি আর তর্কে গেলাম না। বড় আপুর সাথে আমি কখনোই তর্কে পেরে উঠি না। চা-নাস্তার পর্ব শেষে বড় আপু আমাকে গিয়ে রুসাফীর সাথে একবার দেখা করে আসতে বললেন। আমি বড় আপুকে সাফ জানিয়ে দিয়েছি, আমি ওই বখাটের সাথে দেখা করব না।
তুই দেখা না করলে ছেলেটা কষ্ট পাবে না?
কষ্ট পেলে আমার কি!
ধুর। বলে বড় আপু আমার হাত ধরে টেনে রুসাফীর সামনে নিয়ে গেলেন।
আমাকে দেখে শশব্যস্ত হয়ে সে জিজ্ঞেস করল, জাইমা, কেমন আছ তুমি?
আমি কোনো জবাব দিইনি। চুপচাপ ভেজা মুরগির মতো তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম শুধু।
তিনমাস পরের ঘটনা। বন্ধুরা তাদের ফেসবুক আইডিতে রুসাফীর এনগেজমেন্টের ছবি পোস্ট করেছে। ছবিগুলো দেখে তো আমি নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমাকে কিছু না জানিয়ে এনগেজমেন্ট করে ফেলল ছেলেটা! আমি মানছি, আমি তাকে অপছন্দ করি। তাই বলে জীবনের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবার আগে আমাকে একটু জানানোর প্রয়োজন মনে করল না সে! এনগেজমেন্টর কয়েকদিন পর আমি তাকে ফেসবুকে নক দিই। নানা অজুহাত দেখিয়ে খুবই কান্নাকাটি করছে সে। ফ্যামিলির প্রেশারে পড়ে নাকি এনগেজমেন্ট করতে বাধ্য হয়েছে। হেনতেন আরো অনেক কিছু। আমি এ বখাটে ছেলেটাকে হাড়ে হাড়ে চিনি! তার এসব কান্নাকাটি আমার কাছে অভিনয় ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি। তারপর থেকে সে আমাকে প্রতিদিনই ফেসবুকে নক দিয়ে আমার কান ঝালাপালা করে, এই বিয়েতে নাকি তার মত নেই। তাকে নাকি পরিবার থেকে জোর করে ওই মেয়ের সাথে বিয়ে দিচ্ছে। এখন সে কাবিননামা ভেঙে ফেলতে চায়!
আমি তাকে বারবার বুঝানোর চেষ্টা করি, এটা কখনোই সম্ভব না। কাবিন যেহেতু করে ফেলেছো, আল্লাহর নাম মুখে নিয়ে নতুন ভাবিকে বাড়িতে নিয়ে এসো।
বেচারা এক প্রকার বাধ্য হয়েই স্ত্রীকে ঘরে তুললো। নতুন বৌ ঘরে তোলার তিনমাসের মধ্যে শুরু হলো গেঞ্জাম। স্ত্রী বাপের বাড়িতে চলে গেল। আর ফিরে আসেনি। বিষয়টি একদম ডিভোর্স পর্যায়ে চলে গেল। এবার কনেপক্ষ দেনমোহরের টাকার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। বিচার-সালিশে নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম রুসাফীর। ডিভোর্স হবার পরপরই জানতে পারি, তার শ্বশুরবাড়ি আমার কর্মস্থলের পাশেই! আমি এতোদিন তা জানতামই না। কোনো এক অজানা কারণে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমাকে দোষারোপ করছে। তাদের বাচ্য হল, ডিভোর্সটা হবার পেছনে মূলহোতা নাকি আমি!
ইতোমধ্যে বন্ধু রাগিবের সাথে আমার বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে গেছে। উকিল ছেলে বিয়ে করার ভূতটা মাথা থেকে নেমে গেল। নাগিবের পেশা উকিলাতি না। তবু আমি রাজি হয়ে গেলাম। কারণ ছেলেটা খুবই সাদাসিধে। রুসাফীর মতো বদমেজাজি না!
চুপিসারে আমাদের এনগেজমেন্টটা হয়ে গেল। খুব বেশি মানুষজনকে জানাইনি। এনগেজমেন্ট চুপিচুপি হলেও বিয়ে তো আর এভাবে করা যায় না। আত্মীয়-স্বজনরা চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছেন। নাগিবদের বাড়িতে নির্মাণের কাজ চলছে। তাই আমাদের বাড়িতে ধুমধাম করে বিয়ে আয়োজন করা হলো। নির্মাণ কাজ শেষ হতে আরো বছরখানেক লাগতে পারে। কাজ শেষ হলেই শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে উঠব।
গায়ে হলুদের দিন সকালে রুসাফীকে কল দিয়ে বিয়েতে ইনভাইট করি। ভেবেছিলাম আমার কল পেয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করবে সে। কিন্তু তা করল না। তার কণ্ঠে আগের সেই তেজটুকু নেই। গলায় কেমন যেন একটা অসহায়ত্ব ফুটে উঠল।
জাইমা,তুমি আমাকে ফেসবুকে ব্লক দিছো কেন?
কি বল! আমি কেন তোমাকে ব্লক দিব?
ফেসবুকে ঢুকে চেক করে দেখ।
তার কল কেটে আমি ফেসবুকের ব্লকলিস্টে ঢুকে দেখি, তার আইডি!
আমার বুঝতে বাকি নেই, নাগিব আমার ফেসবুক আইডিতে ঢুকে রুসাফীকে ব্লক করে দিছে। আমি তৎক্ষনাৎ রুসাফীর আইডি আনব্লক করে দিয়ে তাকে ফোন করে সরি-টরি বললাম।
আমাদের বিয়েতে আসেনি সে। আমি জানতাম আসবে না সে। বাসরঘরে সারারাত আমি কাঁঠালিচাঁপার গন্ধটা মিস করছিলাম আর কাঁদছিলাম। বুদ্ধি হবার পর আমি এতো বেশি কখনোই কাঁদিনি। কেন জানি আমার মনে হচ্ছিল, বাসরঘরে নাগিবের জায়গায় রুসাফীর থাকার কথা ছিল! পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে তা হয়ে ওঠেনি। তাছাড়া রুসাফীর সাথে এতো এতো কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করার পরও আমি আজও নিশ্চিত না, আমি তাকে ভালোবাসি কিনা। যদি আমি একবার নিশ্চিত হতে পারতাম, আমি তাকে ভালোবাসি। তাহলে পৃথিবীর কোনো শক্তি আমার কাছ থেকে তাকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারতো না। আমার কান্না দেখে নাগিবও কেমন যেন মনমরা হয়ে বলল, যদি তুমি রুসাফীকে চাও,আমি তোমাকে তার হাতে তুলে দিব। প্লিজ, তুমি আর কেঁদো না।
আমি তোমাকে বলছি নাকি রুসাফীর জন্য কাঁদছি?
তাহলে কার জন্য কাঁদছো?
আম্মাকে খুব মিস করছি। আম্মার জন্য বুকটা ফেটে যাচ্ছে।
এ কথা শুনার পর নাগিবের মলিন চেহারাটা মুহুর্তেই ঝলমল করে উঠল। সে আমাকে কাছে টেনে নিয়ে সান্ত্বনা দিল, কেঁদো না। ধৈর্য ধরো। আন্টির জন্য আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দোয়া করো।
প্রতি শুক্রবার বিকেলে আমি আর নাগিব বীচে যাই। শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের বাকি ছয়দিনই আমার ডিউটি থাকে। তাই শুক্রবার দিনটা আমরা টেকনাফ বীচ চষে বেড়াই। কোনো এক শুক্রবার বীচে আসা মিস করলে আমার পুরো সপ্তাহটা খুব বাজেভাবে কাটে। তাই আমি পারতপক্ষে শুক্রবারে বীচে আসা মিস দিই না।
আজ বিকেলে আমরা দুপুরের পরপরই বীচে চলে আসি। কখনোই এতো তাড়াতাড়ি আমাদের বীচে আসা হয় না। অন্য দিনগুলোতে আমরা আসরের নামাজের পরেই আসি।
বীচে দাঁড়িয়ে আমি আর নাগিব বাদাম খেতে খেতে গল্প করছি। নাগিব কোনো বিষয়ে কথা বলা শুরু করলে সহজে থামে না। তাতে আমি মাঝেমধ্যে বিরক্ত হই। এমনিতেই তার কথা শুনতে আমার ভালোই লাগে। হঠাৎ দেখলাম রুসাফী আমাদের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। তার সাথে কেউ নেই! একা একা আকাশের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে হাঁটছে। তাকে দেখে আমার ভেতরটা কেমন যেন হু হু করে উঠল। পেছন থেকে ডাক দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ডাকিনি। তাকে ডেকে কথাবার্তা বললে হয়তো আমার পতি সাহেব মাইন্ড-টাইন্ড করতে পারে।
গভীর রাতে দরজায় টোকার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। সিথান হাতড়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি, তিনটা বাজে। আমার বুকের ওপর থেকে নাগিবের হাতটা সরিয়ে বিছানায় ওঠে বসলাম। জানালা দিয়ে জোছনা আলো এসে নাগিবের চেহারায় পড়েছে। সে আরামেই ঘুমাচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে দেখি, আম্মা দাঁড়িয়ে আছেন।
আম্মা, এতোরাতে আপনি?
হু, আমি। ঘুম আসছে না। এক কাপ চা করে দিবি?
আচ্ছা, বানিয়ে দিচ্ছি। বলে আমি রান্নাঘরের দিকে হাঁটা দিলাম। মিনিট দশেকের মধ্যে এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আম্মার রুমে গেলাম। চায়ের কাপটা আমার হাত থেকে নিতে নিতে আম্মা বললেন, আয়, আমার পাশে বস্।
আমি আম্মার পাশে বসি। আম্মা আজ নতুন শাড়ি পরেছেন। শাড়িটা আব্বা গতবছর ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা থেকে কিনে এনেছিলেন।
আম্মা, এই শাড়িতে আপনাকে খুব মানিয়েছে।
তাই?
হু।
তাহলে একটা ছবি তোল্।
আমি মোবাইলে কয়েকটি ছবি তুলে আম্মাকে দেখালাম। সাথে একটা সেলফিও তুললাম। ছবিগুলো আম্মার খুব পছন্দ হয়েছে।
আমি খুবই খুশি হয়েছি। কেন জানিস?
না, কেন?
তোর সাথে যে নাগিবের বিয়ে হয়েছে তাই। ছেলেটা খুব ভালো। তোকে সুখে রাখবে। রুসাফী সাথে বিয়ে হলে তোর কপালটা পুড়তো। রুসাফী তো একটা মিচকা শয়তান!
আমি কিছু না বলে আম্মার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে আম্মা বললেন, তুই বস্। আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসি।
দু’তিনটা মসজিদ থেকে ফজরের আজান ভেসে আসছে। আমি আম্মার জন্য একঘণ্টা ধরে বসে আছি। ওয়াশরুম থেকে আম্মার বেরুবার কোনো নামগন্ধ নেই। ভাবলাম একবার ওঠে গিয়ে দেখে আসি। গিয়ে দেখি, ওয়াশরুমের দরজা খোলা। ভেতরে আম্মা নেই! এতোক্ষণ পর আমার সংবিৎ ফিরে। মুহূর্তেই আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। আমি দৌড়ে ছুটে গিয়ে নাগিবকে ঘুম থেকে ডেকে তুলি। সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে রুমের লাইট জ্বালায়। আমার সারাশরীর কাঁপছে। কপাল দিয়ে টুপটুপ করে ঘাম ঝরছে।
জাইমা, তোমার কী হয়েছে?
একটু আগে আম্মা এসেছিলেন।
কী বল তুমি! স্বপ্ন দেখেছিলে মনে হয়?
আরে স্বপ্ন না। সত্যি সত্যি আম্মা এসেছিলেন!
পাগলের মতো কথা বল না। মৃত্যুর পর মানুষ আসতে পারে নাকি?
জানি, তুমি আমার কথা বিলিভ করবা না। দাঁড়াও, তোমাকে এভিডেন্স দেখাচ্ছি। বলে আমি মোবাইল ঘেটে কিছুক্ষণ আগে তোলা সেলফি আর ছবিগুলো নাগিবকে দেখালাম।
আম্মার ছবিগুলো দেখামাত্রই নাগিবের চোখ দুটি আতঙ্কে ঘোলাটে গেল। থরথর কাঁপতে কাঁপতে আমাকে ঝাপটে ধরল সে।